অন্তরালের কথা পর্ব ১১

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১১
.
.
শ্বশুর বাড়িতে আজ প্রথম দিন তানহার। আর আজই তার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল? উফফ! কি বাজে ব্যাপারটাই না ঘটলো। অবশ্য দেরি হবে নাই বা না কেন,সারারাত তিহানের দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরের দিকেই চোখ লেগেছিল তার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে নিল তানহা।
পাশে তাকিয়ে দেখে অতল বিছানায় নেই।অতলকে খোঁজার পরিবর্তে তানহার বুক জুড়ে নেমে এলো এক স্বস্তির নিঃশ্বাস। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে হাইম তুলতে তুলতে হাত খোপা করছিল তানহা। এমন সময় তার চোখে পড়ল সাইড টেবিলের উপর একটি ছোট্ট চিরকুট। আর চিরকুটটির উপরে রয়েছে একগুচ্ছ কদমফুল। তানহা বেশ অবাক হয়ে গেল কদমফুল গুলো দেখে! আর মনে মনে ভাবল,” তার সাথে পরিচয় তো কেবল একরাতের। আর রাতে তো তার সাথে তানহার প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি কোনো কথাই হয়নি। তাহলে সে কী করে জানল তানহার কদমফুল পছন্দ!এমনও হতে পারে তার নিজের কদমফুল পছন্দ বলে তানহাকে দিয়েছে। কোনটা? সে যাই হোক! আগে সে কদমফুল গুলোর ঘ্রাণ নিবে। অনুভব করবে প্রতিটি পাপড়ির স্পর্শ। এতে যদি তার মনের কোনো এক কোণে আষাঢ়ের মাতাল হাওয়া বয়ে যায় দোষ কী তাতে? ক্ষনিকের জন্য হলেও তো সে সবকিছু ভুলে হারিয়ে যেতে পারবে অন্য এক ভুবনে। ”
কদমগুচ্ছটি তানহা তার হাতের মুষ্ঠির মাঝে নিয়ে তাতে নাক ডুবিয়ে পরম স্নিগ্ধতার আবেশে চোখ বুঝে ফেলল। এ সময়টিকে তানহা উপভোগ করবে নাকি না পাওয়ার তালিকায় আরও একটি অনুভূতি সংযোজন করবে সে জানে না। তানহা সত্যিই জানে না তার কি করা উচিৎ। চোখ দুটো মেলতেই কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তানহার গাল বেয়ে। ফুলের দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে করে বলল,
” এতগুলো বছর ধরে আষাঢ়ের প্রথম কদম গুচ্ছটি তিহানের হাত চেপে আমার জন্য খুশির জোয়ার বয়ে আনতো। আজও আষাঢ়ের প্রথম কদম গুচ্ছটি এলো তবে তিহানের পরিবর্তে অতলের হাত চেপে। এটাই কি লিখা ছিল আমার ভাগ্যে? অবিবাহিত জীবনে প্রথম কদম গুচ্ছ আসবে প্রেমিকের নাম হয়ে আর বিবাহিত জীবনে প্রথম কদম গুচ্ছ আসবে বরের নাম হয়! কেন, অন্য কারো হাতে চেপে কি আসা যায় না এই হতভাগীর কাছে? আমারও যে কষ্ট হয় কেউ কি বুঝে না, নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকে? ”
কথাগুলো বলেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল তানহা। হুট করেই কান্নার মাঝে নীরব হয়ে যাওয়াটা তার নিজের কাছেও কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। তানহার ইচ্ছে হচ্ছিল ভীষণ করে কাঁদতে কিন্তু পারছিল না। পারছিল না চিৎকার করে কেঁদে নিজের মনকে হালকা করতে। কেবলই নতুন কিছু সম্পর্কের কথা ভেবে।
কদমগুচ্ছটি টেবিলের উপর রেখে তার পাশে থাকা চিরকুটটি হাতে নিল। চিরকুটের ভাজ খুলে দেখতে পেল অতলের লিখা কয়েকটি লাইন। অবশ্য তানহার প্রথম দিকে বুঝতে একটু সমস্যা হয়েছিল চিরকুটের ভেতরকার লিখাটি কার তা নিয়ে কিন্তু পরবর্তীতে চিরকুটের নিচে ছোট্ট করে অতলের নাম দেখে আর সমস্যা হলো না। তাই চিরকুটটি পড়তে লাগলো তানহা,
” খুব ভোরে বাবার কল এসেছিল হসপিটাল যাবার জন্যে। তিহানের মাঝরাতে জ্ঞান ফিরেছে।এখন ও কিছুতেই হসপিটালে থাকতে চাচ্ছে না। ভীষণ রকম জোরাজোরি করছে। বাবা কোনোমতেই বুঝাতে পারছে না ওকে। তাই তোমাকে না বলেই চলে যেতে হলো। অবশ্য ঘুম না ভাঙানোর আরও একটি কারণ আছে। তোমার ঘুমন্ত মুখটা দেখে কেমন যেন শান্তি অনুভূত হচ্ছিল। মায়াবতীর বাঁধনে পড়লে যা হয় আর কি! তাই আমার মায়াবতীর ঘুম না ভাঙিয়ে চলে এলাম। এমনিতেই কাল যে ধকল গিয়েছে তোমার উপর দিয়ে আজ না’হয় একটু বেশিক্ষণই ঘুমোলে। আর হ্যাঁ, কদমগুচ্ছটি সযত্নে রেখো খুব ভালোবাসা নিয়ে ভোর বেলা ছাদে গিয়ে গাছ থেকে ছিঁড়ে একত্রিত করেছি। জানি না পছন্দ হবে কিনা তোমার তবে মন বলছিল তোমার হয়তো ভালো লাগতে পারে। আর কিছু বলছি না বাকি কথা ঘরে এসে হবে।
ইতি,
অতল। ”
মৃদু হাসল তানহা। তবে অতলের চিরকুটটি পড়ে না, তার ভাগ্যের পরিহাস দেখে। দু’ভাইয়ের মাঝে যে এতো মিল থাকতে পারে অতল আর তিহানকে না দেখলে তানহা জানতেই পারতো না। তানহা ও তিহানের সম্পর্ক শুরু হওয়ার প্রথম আষাঢ়ের প্রথম কদম গুচ্ছটি তিহান ঠিক এইভাবে একটি চিরকুটের সাথে দিয়েছিল। আজও সেই একই কান্ড ঘটলো। অতল তার প্রথম কদমগুচ্ছটি তো দিল সাথে চিরকুটও। প্রেমিক ও স্বামীর মাঝে এরকম মিল কয়জনের ভাগ্যেই বা জুটে! কথাগুলো ভেবেই তানহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চিরকুটটি টেবিলের উপর রেখে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে।
.
অতল হসপিটালে আসার পর থেকেই তিহানকে বুঝিয়ে চলছে যাতে অন্তত আর একটি দিন সে ডক্টরের অবসার্ভেশনে থাকে কিন্তু কে শোনে কার কথা। তিহান আজ যাবে মানে আজই যাবে। তাই অতল আর কথা না বাড়িয়ে তিহানকে হসপিটাল থেকে রিলিজ নিয়ে রওনা হলো বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। মিনিট বিশেকের মাঝে পৌঁছেও গেল তারা। অতল তিহানকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসছে। শরীরটা যে এখনো বেশ দূর্বল। তাদের পেছনে ধীর পায়ে আসছে অতলের বাবা ও মিরাজ কাকা। সারারাত না ঘুমনোর ফলে তাদের দু’জনকেও বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অতল তিহানকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বাবাকে বলল,
” সারাটা রাত তো জেগে ছিলে তারউপর কিছু খাওনি। মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে। এখন ঘরে গিয়ে গোসলটা সেরে কিছু মুখে দিয়ে একটা লম্বা ঘুম দাও। শরীরের ক্লান্তি কিছুটা হলেও কমে যাবে। ”
” না না, আমি ঠিক আছি। বিশ্রামের কোনো প্রয়োজন নেই। ছেলেটা আমার ভালো ভালো ঘরে ফিরে এসেছে এর থেকে শান্তির কী হতে পারে বল। কোনো প্রয়োজন নেই এখন বিশ্রামের।”
” প্রয়োজন আছে কি নেই সেটা নাহয় আমার উপরই ছেড়ে দাও। ”
” কিন্তু….. ”
” কোনো কিন্তু না বাবা, যেটা বলেছি সেটা করো। ”
“বুঝতে পারছিস না তুই। আমি হাজার চেষ্টা করলেও এই মুহুর্তে ঘুমের ঘ ও আমার চোখের বারান্দায় আসবে না। তারচেয়ে ভালো না আমি তিহানের কাছে বসে থাকি।”
” তুমি তিহানের কাছে বসতে চাইলেও তো এখন বসতে পারবে না। ডক্টর কি বলেছে ভুলে গিয়েছ? তিহানের কিছুদিন ফুল রেস্টে থাকতে হবে। তুমি ওর পাশে থাকলে কি ও রেস্ট নিতে পারবে।”
“এই কথা তো আমার মাথাতেই ছিল না। না না,আমি ওর ঘরে যাবো না। ছেলে আমার রেস্ট নিক, সুস্থ হোক তারপর না-হয় যাওয়া যাবে।”
আনিস খন্দকার চলে গেলে অতল মিরাজ কাকার দিকে তাকিয়ে বলল,
” তোমাকেও কি নতুন করে কিছু বলতে হবে নাকি কাকা? ”
” না না, অতল বাবা। আমি এমনি চলে যাচ্ছি। ”
” শুধু চলে গেলে হবে না, বাবাকে যেই যেই কথাগুলো বলেছি সেগুলো তোমাকেও পালন করতে হবে। বুঝেছ? ”
” আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। ”
মিরাজ কাকাও চলে গেল নিজ রুমে। এদিকে অতলও তিহানকে নিয়ে উপরে অর্থাৎ তিহানের রুমের দিকে যাচ্ছিল। এমন সময় নূপুরের ঝনঝন শব্দ অতল ও তিহানের কানে এলো। দু’জন একসাথে পেছনে ঘুরে তাকাতে দেখে তানহা ভেজা চুল মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের দিকে আসছে। দু’ভাইয়ের চোখ যেন আটকে গিয়েছে তানহার সৌন্দর্যের উপর। কারো বুক থেকে বের হচ্ছের দীর্ঘশ্বাস তো কারো বুকে ভরে আসছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। তবে কারোই যেন চোখ ফিরছে না, আর ফিরবেই বা কি করে! তানহাকে যে মারাত্মক সুন্দরী লাগছে। পরনে তার নীলের মধ্যে গোল্ডেন পারের জামদানী শাড়ি। দু’হাতে মুঠ ভর্তি নীল রেশমী চুরি। আর নাকে একটি ছোট্ট ডায়মন্ডের নাক ফুল। নাক ফুলটি ছোট হলেও এটি যেন তানহার সৌন্দর্যকে কয়েক হাজার গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনি তো তানহার রূপ তাকে আলোক বাতির মতো ঝলমলিয়ে রাখে। তারউপর নাক ফুলের ঝলকে যেন সেই ঝলমলানি আরও প্রাণ খুঁজে পেয়েছে।
তিহানের যে চোখ ফিরছে না তানহার দিক থেকে। এক অদ্ভুত মুগ্ধতা যেন বিরাজ করছে তানহার চারিপাশে। কমদিন তো হলো না তানহাকে চিনে সে। তবে এই সৌন্দর্য্য আগে কেন চোখে পড়েনি তার! ওহ্ পড়বেই বা কি করে, এর আগে যে তানহা নাক ফুল পড়ে বিবাহিত নারীর মতো ঘুরেনি তার চোখের সামনে।
কথাগুলো ভেবেই তিহানের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। পরক্ষনেই মনে মনে বলল ,
” তানহার চুল তো ভেজা! এতো সকালে গোসল করেছে কেন সে! এতো সকালে তো ওর গোসল করার কথা ছিল না। আচ্ছা, কাল রাতে তো ওদের বাসর রাত ছিল। এদিকে তার ভাইয়াও হসপিটাল ছিল না। তারমানে বাসাতেই ছিল। তাহলে কি কাল রাতে তার ভাইয়া আর তানহা….. না না এটা কিছুতেই হতে পারে না। তানহা কখনোই তার তিহানের ভালোবাসা অন্য কারো সাথে ভাগ করতে পারবে না।
তাহলে কি ভদ্রতা রক্ষা করতে তানহার এই গোসল ! হুম, তাই হবে। কিন্তু…যদি সেরকম কিছু হয়ে থাকে তখন! ”
যতই তিহান তার মনকে পজিটিভলি বুঝানোর চেষ্টা করছে তার মন যেন আরও অবুঝ হয়ে উঠছে। অস্থির অস্থির লাগছে তিহানের। কোনোমতেই শান্তি পাচ্ছে না। চোখ দুটো ভেঙে যেন জলরাশি ছুটবে এখুনি। যেটা সে সবার থেকে আড়াল করতে ছটফট করছে। তাই অতলকে রেখে তার শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি খাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে লাগল।
সেদিকে অতলের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সেতো তার নতুন বউকে দেখতে মহাব্যস্ত। অতল এগিয়ে এলো তানহার একদম কাছে। বলল,
” বউটা যে আমার সুন্দর তা কাল রাতেই বুঝেছিলাম। তবে এতটা যে মারাত্মক আগুন সুন্দরী তা জানা ছিল না। ”
তানহা মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলল। তবে সেটি লজ্জা লুকানোর জন্য নয়। বুক ভরা কষ্ট আর চোখের জল লুকাতে।
অতল তানহার হাসির মাঝে মাথা নিচু করার দৃশ্য দেখে বলল,
” এতো লজ্জা পেয়েও না গো। কিছু লজ্জা জমিয়ে ঘরের কোণে রেখে দাও। হঠাৎ কোনো এক সময়ে কাজে লাগবে। ”
কথাটি বলেই অতল হাসতে হাসতে চলে গেল তিহানের ঘরের দিকে। তানহাও আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না, সোজা নিজের ঘরে এসে বিছানার কোণে বসে বুক ফেঁটে কাঁদতে লাগল। আর মনে মনে ভাবল,
” তিহান যে তাকে ভেজা চুল অবস্থায় দেখে ফেলেছে। হয়তো বেশ কষ্টও পেয়েছে। তাই তো চোখের জল নিয়ে এভাবে দৌঁড়িয়ে চলে গেল। এখন কি ভাববে তিহান! যার জন্য হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিল, সেই কিনা বাসর রাতে নতুন ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উন্মাদ ছিল! কিন্তু এটি যে সম্পূর্ণই ভুল। এ ধারণার যে কোনো ভিত্তিই নেই। কে বুঝাবে তিহানকে? তানহা যে কেবল মানুষের প্রশ্নবোধক দৃষ্টির থেকে রক্ষা পেতেই এই সাত সকালে গোসল করেছে। এই কারণ ব্যতীত আর‍ যে অন্য কোনো কারণই নেই। ”
তানহার ভেতর ফেঁপে দম বন্ধ হয়ে আসছে। কোনোকিছু না করেও তানহার ভেতর এক অপরাধবোধ জন্ম নিয়েছে। সেই সাথে অনুশোচনাও।
.
বহুকষ্টে ঘরের ভেতর এসে পরনের শার্ট খুলে মেঝেতে ফেলে বিছানায় গা মেলে দিল তিহান। চোখ দুটো বুঝে নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। তবে মনের সাথে সাথে চোখ দুটোও যে আজ বড্ড তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। চোখ দুটো যেন উত্তপ্ত শিখার ন্যায় জ্বলছে। না পারছে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে আর না পারছে চোখ বুঝে নিজেকে শান্ত করতে। কিছুই পারছে না সে। তার চোখের সামনে যে বারংবার তানহার ভেজা চুলে তোয়ালে রোদ দেয়ার দৃশ্যটি আনাগোনা করছে। শুধু যে আনাগোনা করছে তাতো নয়। তিহানের ভেতরটাকে পুড়ে যে ছাই করে ফেলছে সেই দৃশ্যটি। তারপরও চোখের জলকে যেন সে সায় দিচ্ছে না উপচে পড়তে। কারণ একবার যদি সেই জল উপচে পড়ে তাহলে তাকে বাঁধা দেয়া তিহানের সাধ্যের বাহিরে চলে যাবে। তাই আগে থেকেই তিহান কন্ট্রোলে রাখার হরদম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here