#গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
#লেখাঃনুশরাত জেরিন
#পর্বঃ১৪
,
,
ভার্সিটিতে পৌছে অপু ক্লাসের সামনে ভিড় দেখতে পায়।
অপু কৌতুহল বশত সামনে এগোয়।
ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই অপুর চক্ষু চড়কগাছ হয়।
দেখে পিহু আর রাহুল একজন আরেকজনের চুল আর কান ধরে টানাটানি করছে।
মনে হচ্ছে ওয়ান টুতে পরা বাচ্চারা খেলনার জন্য মারামারি করছে।
অনেক ছাত্র ছাত্রী এই ফ্রিতে বিনোদন উপভোগ করছে।
অপু হাসবে না কাঁদবে বুঝে পায়না।
তাড়াতাড়ি দুজনকে দুজনার থেকে টেনে আলাদা করে।
টানতে টানতে ক্যান্টিনে নিয়ে আসে।
চেয়ার টেনে দুজনকে বসায়।নিজেও বসে।
পিহু রাহুলের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচে দেয়,রাহুলও পাল্টা ভেঙচায়।
অপু হু হা করে হেসে ওঠে।
হাসতে হাসতে একপ্রকার গড়াগড়ি খায়।পেট চেপে ধরে হাসে।
পিহু আর রাহুল প্রথমে অপুকে এইভাবে হাসতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে।পরে ওরাও হাসিতে যোগ দেয়।
অপু অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে দুজনার দিকে তাকিয়ে বলে,
—তোরা সত্যিই কি বাচ্চা?নাকি বুদ্ধিতে অপরিপক্ক?
পিহু বলে,
—আমি না রাহুল।
রাহুল বলে,
—কি আমি?
অপু আবার হাসে।এ দুটোর সাথে থাকলে অপুর মন খারাপ থাকার জো নেই।এমন এমন ঘটনা ঘটায় দুটোতে মিলে যে না হেসে পারা যায়না।
অপু হাসতে হাসতেই বলে,
—এবার বলতো ক্লাসের সামনে ওভাবে মারামারি করছিলি কেনো?
পিহু লাফিয়ে উঠে বলে,
—আমি বলবো।
রাহুল পিহুর ঘার ধরে বসিয়ে দিয়ে বলে,
—না আমি বলবো।
দুজনার আবার লেগে যায় কথা কাটাকাটি।
একজন বলে, আমি আগে বলবো,তো আরেকজন বলে আমি বলবো।
অপু মাথায়,হাত দিয়ে বসে থাকে।
মনে মনে ভাবে,
—এরা তো বাচ্চা বা বয়সে অপরিপক্ক না।
এরা তো পাগল,বদ্ধ উন্মাদ।
এমন সময় রায়হায় আসে ক্যান্টিনে।
অপুকে দেখে অপুদের টেবিলের কাছে এগোয়।
একটা চেয়ার টেনে বসে পিহু আর রাহুলের দিকে দেখে।
বলে,
—কি হচ্ছে এখানে?
পিহু আর রাহুল সেদিকে কর্নপাত করেনা।
তারা নিজেদের নিয়ে এতোটাই ব্যাস্ত যে পাশে কেউ বসেছে সে খবরও রাখেনা।
রায়হান পিহু আর রাহুলের থেকে কোন উত্তর না পেয়ে অপুর দিকে তাকায়।বলে,
—এরা তোমার বন্ধু? রিয়েলি?
কেমনে সম্ভব?
অপু হাসে।
রায়হান আবার বলে,
—এদের সাথে তোমার একটুও মিল নেই,এরা কতো শান্তশিষ্ঠ আর তুমি কতো দুষ্টু।
কথাটা যে রায়হান দুষ্টুমি করে বলেছে সেকথা অপু বুঝতে পারে।অপু হাসতে হাসতে বলে,
—আপনি ও তো ওদের মতো শান্তশিষ্ট।
রায়হান হু হা করে হেসে ওঠে।
—আমার কথা আমাকেই ফেরত দিচ্ছো?
অপু আর রায়হানের কথা বলার মাঝে পিহু আর রাহুল থামে।
দুজন দুদিকে তাকিয়ে থাকে মুখ ফুলিয়ে।
হুট করে দুজনে একসাথে চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে পরে।
পিহু অপুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—আমি বাড়ি গেলাম অপু।আজ ক্লাস করবোনা।
কথাটা বলেই পিহু হাঁটা শুরু করে।
রাহুল অপুকে চোখ দিয়ে ইশারায় বোঝায় যাওয়ার কথা।সেও পিহুর পিছু ধরে।
রায়হান অপুর দিকে তাকায়।বলে,
—আসো আমরা ক্লাসের দিকে এগোই।
—না,আমি আজ ক্লাস করবোনা।
—কেন?ওরা চলে গেছে তাই?
অপু হ্যা সূচক মাথা নাড়ে।
সত্যি পিহু আর রাহুলকে ছাড়া অপুর একা একা ক্লাস করতে ভালো লাগেনা।
অন্য কারো সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে পারেনা অপু।
রায়হানের বলতে ইচ্ছে করে,
—চলো তাহলে আজ একসাথে হেটে হেঁটে বাড়ি ফিরি।
কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না।পাছে অপু কিছু মনে করে বসে সেই ভয়ে।
অপু সৌজন্যমূলক হাসি হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়।বলে,
—আচ্ছা তাহলে আসি ভাইয়া।
রায়হানের হাসি হাসি মুখে বিষন্নতা ভর করে।
যাওয়ার সময় এমন কথা না বললে কি হতো না?
—–
আসেপাশে আজ প্রচুর গাড়ি,রিকশা আছে।
সবগুলো রিকশা অপুর পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে যায়।
অপু রিকশায় ওঠেনা।আজ তার হাঁটতে ইচ্ছা করছে।আগে তো মাইলের পর মাইল হেঁটেই যাওয়া আসা করতো অপু।
আজ না হয় শখের বশে একটু হাঁটা যাক।
হাঁটতে হাটতে প্রায় অর্ধেক পথ চলে আসে অপু।
সামনে দেখে ফুটপাতে এক বৃদ্ধ মহিলা পরে আছে।
অপু দৌড়ে গিয়ে তাকে তুলে দাড় করায়।
বৃদ্ধ মহিলার শরীর প্রচুর দুর্বল,হাত পা কাঁপছে তার।
অপু টেনে দাড় করানোর পরও মহিলাটি অপুর গায়ে হেলেদুলে পরছে।
অপু টেনে হিঁচড়ে যেমন তেমন করে পাশে একটি চায়ের দোকানে মহিলাকে নিয়ে আসে।
পাশে বাশের তৈরি বেন্ঞ্চটায় বসায়।
কপালে হাত দিয়ে দেখে শরীর গরম।
মহিলাটির বেশভূষা দেখলেই বোঝা যায় তিনি ভিক্ষুক। তাছাড়া ভার্সিটিতে যাতায়াতের পথে বেশ কয়েকবার তাকে ভিক্ষা করতেও দেখেছে অপু।
অপুর তাকে দেখে বেশ মায়া হয়।
কেমন মলিন জামা কাপড় গায়ে তার।কুঁচকানো, অসুস্থ শরীর নিয়েও এই বয়সে সে ভিক্ষা করে?
অপু তাকে জিজ্ঞেস করে,
—আপনি এতো অসুস্থ অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়েছেন কেনো?
মহিলাটি কান খাড়া করে সে কথা শোনে।
বয়সের ভারে হয়তো কানেও কম শুনতে শুরু করেছে।
খুব কষ্টে মুখ নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করে।
কিন্তু সে কথা অপুর কান পর্যন্ত পৌছায়না।
অপু বোঝে অসুস্থ শরীরে বৃদ্ধার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
তাছাড়া হাত পাও কাপছে ক্রমাগত।
অপু আরেকবার জিজ্ঞেস করে,
—সকালে কিছু খেয়েছেন?
বৃদ্ধা মাথা নাড়ে।সে খায়নি।
সকাল তো দুর তিনি কাল থেকে না খেয়ে আছেন।তবে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেননা।
অপু মাথা নাড়ানো দেখে দোকানের কাছে এগোয়।
ছোট্ট একটা চায়ের দোকান হওয়ায় ভাল কোন খাবার চোখে পরেনা।
এককাপ চা আর কিছু টোস্ট কিনে নেয় অপু।
এছাড়া আর কোন খাবার দেখতে পায়না সে।
খাবার কিনে আবার বৃদ্ধার পাশে বেন্ঞ্চটায় বসে সে।
বৃদ্ধার হাতে চায়ের কাপ দিতে চায়।
বৃদ্ধা ধরতে পারেনা।হাত অনবরত কাপে তার।
অপু নিজের হাতে কাপে টোস্ট ডুবিয়ে বৃদ্ধার গালে তুলে দেয়।
বৃদ্ধা অতিরিক্ত খুশিতে কেঁদে ফেলে।
টলমল চোখে হা করে।
রাস্তায় যাতায়াতরত অনেকে এসব খেয়াল করে আবার অনেকে করেনা।
রেড সিগনাল পরায় গাড়ি থামে নোমানের।
গাড়ির জানালার কাচ সচারাচর বন্ধই থাকে নোমানের।
বেশ কয়েকবার গাড়ির কাচে টোকা পরায় বিরক্ত হয়ে কাচ নামায় নোমান।
দেখে এক বাচ্চা মেয়ে ফুলের মালা বিক্রি করছে।
বেলি মুলের মালা।
নোমানের মায়ের বেলি ফুলের মালা খুব পছন্দ ছিলো।দামী দামী গহনা পেলে যে পরিমান খুশি হতো তার থেকে হাজার গুন বেশি খুশি হতো বেলি ফুলের মালা পেলে।
নোমানের রুমের দেয়ালে মায়ের যে ছবিটা টানানো আছে তাতেও তার মায়ের চুলে জড়ানো ছিলো বেলি ফুলের মালা।
নোমান কথাগুলো ভেবেই হাসে।
তার মায়ের মতো হয়তো অন্য কোন মেয়ে আর হয়না।
অল্পতেই সন্তুষ্ট হয় নাকি কেউ এখন?
নোমান মেয়েটাকে ইশারায় না বোঝায়।
সে নেবেনা।নিলেও কাকে দেবে?
দেওয়ার মতো কেউ আছে কি?
নোমান মনে মনে খোঁজে। পেয়েও যায়।
তার বউ আছে।
হঠাৎ নোমানের মনে হয়, ওহ হ্যা,তার একটা বউ আছে।
কিন্তু তার কি বেলি ফুলের মালা পছন্দ হবে?সে তো লোভী?
সবুজ সিগনাল দিতেই গাড়ি চলতে শুরু করে।
নোমান গাড়ির কাচ উঠাতে যায়।চোখ পরে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে।
ওই মেয়েটার মতো দেখতে কেউ।
মেয়েটার নাম কি ছিলো?
নোমানের নাম মনে পরেনা।
ভাল মতো দেখার জন্য চোখ তীক্ষ্ণ করে তাকায়।
দেখে একটা বৃদ্ধা ভিক্ষুককে নিজের হাতে খাওয়াচ্ছে সেই মেয়ে।
পরম যত্নে চোখের পানিও মুছে দিচ্ছে।
নোমান বড়সড় ধাক্কা খায়।
মেয়েটি তো লোভী? সার্থন্বেষী?
তাহলে এসব কেনো করছে?কেন একজন ভিক্ষুককে ঘৃনা না করে পাশে বসিয়ে নিজের হাতে যত্ন করছে?
এতে কি স্বার্থ আছে তার?
তাহলে কি নোমানের ধারনা ভুল?মেয়েটা তার মায়ের মতো?মিসেস রিচির মতো নয়?এতোদিন ভুল ভেবেছে নোমান?
,
,
চলবে……