#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন
পর্ব— ২১
সানিয়া, মুনিরা, মাহিয়া, ইফ্ফাত, ইফতি সবাই আপাতত হাসনাতের বাসায় উপস্হিত.. তারা ড্রইংরুমে বসে বসে একেকজন একেক কাজে ব্যাস্ত.. ব্যাস্ততা মূলত ওয়াইফাই নিয়ে…আর হাসনাতের আম্মু কিচেনে… কিচেন থেকে এতোটা সুন্দর স্মেল আসছে পেটের ভিতর খিদে যেন দিগুন হয়ে যাচ্ছে।। হাসনাত নাকি গোসল করছে হাসনাতের আম্মু বলে গেল.. আর তা শুনে ইফতি কয়েকদফা হেসে ফেলেছে…সানিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল– কি সমস্যা.. এতো দাত দেখানোর কারন??
ইফতি — আরে কালকে ঘুরতে যাওয়ার জন্য ভাইয়া এতোক্ষন গোসল করছে.. এইটা আগেও করতো যখন রোদেলার নানুর বাড়ি যাওয়ার সময় হতো…
মুনিরা খিলখিলিয়ে হেসে সানিয়ার ওপর গিয়ে পড়লো.. আর সানিয়া হতাশাজনক লুক দিয়ে দরজা জোরে জোরে বাড়ি দিয়ে বলল– বের হবেন নাকি ভেঙ্গে ডুকবো??
হাসনাত ভিতর থেকে চিল্লাই উওর — আরে শান্তির জায়গায় অশান্তি কর কেন আসতেছি…
মুনিরা দরজায় দাঁড়িয়ে বলল– কিরে রোদেলা আপু তুমি যে ভাইয়াকে প্রপোজ করতে এসেছো তা আর আজ সম্ভব না আপু..তুৃমি চলে যাও.. ভাইয়া আরো কিছুখন গোসল করোক…
হাসনাত সেন্ডুগেন্জিটা তাড়াতাড়ি পড়ে তোয়ালেটা কোমড়ে পেচিয়ে বেরিয়ে এলো..
হাসনাতকে এইভাবে দেখে সবাই চোখ বড় বড় করে ফেলল.. আর ইফতি হাসতে হাসতে সোফা থেকে সোজা ফ্লোরে। মুনিরা বুকের ওপর হাত গুঁজে স্হির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল– ঠিক এইজন্য রোদেলা আপনাকে এখন নাচাচ্ছে.. আপনি এমন বৌ পাগলা সোনামিয়া হয়েছেন কখন থেকে??
তখন হাসনাতের মা রুমে ডুকতে ডুকতে বলল– ছিলনা কখন.. রোদেলা ওর যেইজিনিস গুলো ছোয়ে দিয়েছে সবগুলো জিনিস শোপিস বানিয়ে রেখে দিয়েছে সাহেবে…
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো হাসনাতের দিকে.. ইফ্ফাত কুনুই দিয়ে ইফতিকে গুতা দিয়ে বলল– শিখ কিছু…
ইফতি হেসে নিজের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল– একেক জনের ভালোবাসার স্টাইল একেকরকম হয় জানে মান..
ইফ্ফাত লাজুক হাসি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল– এইসব নামে ডাকার কি খুব দরকার??
ইফতি ইফ্ফাত কাছে দাড়িয়ে কাধ দিয়ে কাধে হালকা ধাক্কিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল– তো বিয়ে করা বৌ.. আকদ তো শেষ… কয়েকদিন পর তুলে নিয়ে যাব শুধু…ইফ্ফাত হেসে সেখান থেকে চলে গেল..
মাহিয়া হা হয়ে হাসনাতের দিকে তাকিয়ে আছে.. হঠাৎ সে গালে হাত দিয়ে বলল– ওয়াও ভাইয়া আপনার ফিটনেস কতোটা সুন্দর,, আই এম ইম্প্রেস..
হাসনাত হঠাৎ ওর কথা শুনে চোখ বড় বড় করে বলল– আস্তাগফিরুল্লাহ.. কি বল এইসব.. আমার দিকে তাকাইও না একদম.. আমি শুধু আমার বৌয়ের সম্পত্তি.. সবাই খিলখিলিয়ে হেসে দিল.. হাসনাত সবগুলোকে রুম থেকে বের করে দিয়ে ড্রেস চেন্জর করে নিল…
সানিয়া হঠাৎ মাহিয়ার দিকে তিঘ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল– আমার দুলাভাইয়ের দিকে ভাই ছাড়া অন্যদৃষ্টিতে তাকালে চোখ কাটাচামচ দিয়ে তুলে ফেলব তোর.. বান্ধবী বলে রেহাজ করব না…
ইফতি যেই হেসে ওঠবে হঠাৎ মুনিরা ওর দিকে তাকিয়ে বলল– বেশি হাসলে বোন দিবনা আপনাকে.. ইফ্ফাত আপুকে অন্যজায়গায় বিয়ে দিয়ে দিব.. ইফতি তাড়াতাড়ি হাসিটা গিলে চুপসে গেল।। আবার বৌ হাতছাড়া হয়ে গেলে তার বা কি হবে…
হাসনাত ড্রেস চেন্জ করে ওদের সাথে এসে বসলো.সানিয়া সিরিয়াস মুড নিয়ে বলল– কালকে রোদেলা আপনার পাশে বসবে.. আপনি ওকে ইগনোর করবেন.. হাসনাত ফ্যাকাসে মুখ করে বলল– এইটা কি খুব জরুরি..
ইফতি— কি ভাই,,, নিজের দাম বাড়াবেন আরকি.. হাজার হোক আমরা ছেলে না..
হাসনাত—- হুম,, তোর লাইনটা আমি ঠিক করে দিছিলাম.. আর আমার লাভ স্টোরীতে বাগড়া তুই দিচ্চোস..
ইফ্ফাত — তো তখন বলেন নাই কেন.. বলে দিলে তো সব ঠিক হয়ে যেত..
হাসনাত পকেটে হাত পুরে দাড়িয়ে গেল তারপর দেয়ালের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে বলল– আঙ্কেলের বিশ্বাসটা ভাঙতে চায় নি.. আর কে বলেছে কাউকে ভালোবাসলে তাকে ভালোবাসি বলতে হবে.. আজকাল ভালোবাসাটা একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে.. নিজেদের প্রয়োজনে একজন অন্যজনের প্রতি আকষর্ন ফিল করে আর তাকে ভালোবাসা ভেবে প্রপোজ করে ফেলে.. পরে সেই সম্পর্ক টিকে না ফাটল আসে আর আলাদা হয়ে যায় তারা।।। আর ভালোবাসাটা হলো একটা অনুভতির নাম..যা অন্তর অনুভব করে কোন একজন মানুষের জন্য. যার ভালো খারাপ সব ভালো লাগে.. যদি তার খারাপ অভ্যাস এক্সেপ্ট করতে না পার,, অথবা তাকে পাল্টাতে চাও.. তাহলে আমি বলবো তুৃমি তাকে কখনো ভালোবাসনি…
সবাই মুহিত হয়ে হাসনাতের কথা শুনছে.. এমন চিন্তা কখনো তাদের মাথায় আসলো না কেন..এইসব ভাবতে ভাবতে সানিয়া হেসে দিল আসলেই তার বোন অনেক লাকি…
////
সকালে রোদেলা খুব যত্নকরে নিজেকে তৈরি করলো.. আজ নিজের সব পুরোনো স্মৃতিকে একত্রিত করলো সে.. এর থেকে খুব সুন্দর আইডিয়া পেয়ে গেল সে. আসলেই তখন সে বোকা ছিল!!!. মুখে রহস্যময় হাসি দিয়ে সে তৈরি হতে চলে গেল…
হাসনাত এদিক ওদিক পাইচারী করছে.. মেয়েদের তৈরি হতে এতো সময় লাগে কেন সেইটাই হাসনাতের কাছে এক বিশাল গোলক ধাধা।। তার বারবার অস্হির লাগছে রোদেলাকে কেমন লাগছে সেইটা চিন্তা করে.. হঠাৎ সানিয়া বুকের ওপর হাত গুঁজে বলল– ভাই,, ওয়াসরুমে যাবেন? চাপ কি বেশি??
হাসনাত আনমনে বলল– আরে রোদেলা আসছেনা কেন টেনশন করছি.. হঠাৎ তার মনে হলো সে কি বলে ফেলেছে.. সে আড়চোখে সবার মুখের দিকে তাকালো..সবাই স্হির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে.. সে কনফিউসন মিক্সিত হাসি হেসে বলল– আরে,, বলছিলাম..
মুনিরা— তোমার দ্বারা কিছু হবে না.. নিজেকে আগের মতো হিটলার বানাও.. যে রোদেলাকে অপদস্থ করতো..
হাসনাত পরপর ঢুক গিলে ভাবলো— আমি কিভাবে অপদস্থ করতে পারি তাকে.. আজকাল যে হার্ডটা বড্ড দূর্বল হয়ে ওঠেছে.. তাকে দেখলেই হার্ড এট্যাকের আসঙ্কা হয় আমার!!.. তবুও নিজেকে পরপর কয়েকবার ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দিল এইটা সেই পিচ্ছি রোদেলা যাকে একসময় যা ইচ্ছা বলতো সে.. শুধু বয়সটা হালকা বেড়েছে এই যা.. এইসব ভাবতে ভাবতে সামনে তাকাতেই তার চোখ বড়বড় হয়ে গেল.. মনে হচ্ছে যেন চোখগুলো হাসনাতকে ত্যাগ করে সামনের জনের গায়ে গিয়ে আটকে যাবে.. কয়েকবার ঢুক গিলে হাসনাত আনমনে বলে ওঠলো— হাসনাত বেটা,, তো তো গায়া…
রোদেলা যত কাছে আসছে তত হাসনাতের হার্ডবিট মিস হচ্ছে.. লালকালারের গাউন পড়েছে.. সেইখানে তার সাদা গলা দৃষ্যমান.. সেই গলাই আবার কুন্তলের হার ঝুলিয়েছে.. দুহাতে ছয়টা ছয়টা করে ডজনখানেক ঝুমকোচুড়ি.. তার রিনিঝিনি শব্দে হাসনাতের কলিজার ভিতর মোচড় দিচ্ছে.. সে আনমনে বলল– এতো বেশি সুন্দর হওয়ার কি দরকার তোর.. তারপর হঠাৎ তার খেয়াল হল গাড়ির ছেলেগুলো হা হয়ে তাকিয়ে আছে.. মুহুর্তেই সব রাগ তার রোদেলার ওপর ওঠে গেল.. রোদেলা কাছে আসতেই তারদিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে… রোদেলা মুচকি হেসে পাস করতেই হাসনাত জোরে বলে ওঠলো— আমরা রাঙ্গামাটি বেড়াতে যাচ্ছি.. বাদরের সাথে বন্ধুত্ব করতে যাচ্ছি না..
রোদেলা ব্রু কুঁচকে বলল– কেন?? কি হয়েছে?
হাসনাত — হাতের মধ্যে গরুর ঘন্টা লাগিয়ে আবার গরুর প্রচন্দের কালার পরে কি রাজকার্য করতে যাওয়া হচ্ছে শুনি??
রোদেলা—-আপনি কি জানেন আপনি মানুষটা বড্ড ইতর.. মানুষের প্রশংসা করা শিখেননি কেন ছোট বেলায়??
হাসনাত পকেটে হাত গুঁজে — টিচার হিসেবে তোমার মতো বেকুবকে পাইনি তাই বলে..
রোদেলা হাত উঁচিয়ে বলল– খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে.. আপনাকে আমি দেখে নিব..
হাসননাত— তোমার সামনে দাড়িয়ে আছি.. শখ মতো দেখ…
রোদেলা কটমটিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো… তার পাশে যেই ইশান বসতে নিল রোদেলা দাত কটমটিয়ে বলে উঠলো— বাসে কি সিটের আকাল পড়েছে??
ইশান অবাক হয়ে— নাতো…
রোদেলা— তাহলে নিশ্চয়ই আমার পাশে বসলে তোকে ফ্রি টিপস দিবে বলেছে..
ইশান— নাহ.. কেন??
রোদেলা রেগে — তাহলে আমার পাশে কেন বসতে আসছিস.. অন্যজায়গায় গিয়ে বসে সিটকে ধন্য কর না….
ইশান দুঃখী মুখ করে— এইভাবে কথা বল কেন তুমি??
রোদেলা রেগে মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে.. কারন রোজ নিম পাতার মিষ্টি রস খাইতো তাই..
ইশান মন খারাপ করে সেখান থেকে গিয়ে তামান্নার পাশে গিয়ে বসে পড়লো.. আর মনে মনে এই অভিশাপ দিয়ে দিল– তোমার কপালে যেন এমন একটা বর জুটে যে তোমাকে রোজ হেল্থ কেয়ারের নাম করে নিম করলার জুস খাওয়ায়…
রোদেলা বাসের জানালা খোলে জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে চোখ রাখলো.. হঠাৎ হাসনাত ওপরে নিজের ব্যাগটা গুঁজে রোদেলার পাশে ধুপ করে বসে পড়লো.. রোদেলা ভেঙ্চি কেটে বলল– আমি নাকি গরু,, গরুর পাশে বসতে গেলেন কেন??
হাসনাত অন্যদিকে মুখ ঘোরিয়ে বলল– ইশ্.. কি বাজে গন্ধ.. গাড়িতে কেন যে আর কোন সিট নাই.. সত্যি মনে হচ্ছে গরুর খোয়ারে বসে আছি..
রোদেলা রেগে হাসনাতের হাটুতে জোরে খামচি দিয়ে মনে মনে বলল– আপনাকে আমি গরুর খোয়ারে সত্যি সত্যি বেধে দিয়ে আসবো হাসনাত ভাই.. যদি সম্ভব হয়.. পুরো গায়ে গোবর লেপ্টে রোদে শোকাব যাতে আপনি গোবরের লাটি হতে পারেন…
হাসনাত মুচকি হেসে রোদেলার দিকে তাকালো.. যে আপাতত তাকে গালি দিতে ব্যাস্ত.. কিন্তু হাসনাত ব্যাস্ত তার মায়াপরীকে দেখতে.. সূর্যের রশ্নিতে তাকে আরো মায়াবী লাগছে.আজ তার সূর্যের সেই রশ্নির সাথে বড্ড হিংসা হচ্ছে..
চলবে