#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন
পর্ব— ২৬
গাড়ির তিব্র ঝাঁকুনিতে আড়মোড় ভেঙ্গে উঠে বসলো রোদেলা. হঠাৎ তার মনে হলো চারিদিকে বন্ধ বন্ধ.. অবাক হয়ে সে ভাবলো কিছুখন– কোথায় সে!! হঠাৎ তামান্নার ঝাঁকুনিতে চোখ মেলে পিটপিটিয়ে তাকালো সে..
তামান্না— কিরে নামবি না? আমরা তো পৌঁছে গেছি…সবাই নেমে গেছে..
রোদেলা অবাক হয়ে দাড়িয়ে — কি বলিস?? সবাই!! হাসনাত ভাইও??
তামান্না মাথা ধোলাল.. আর রোদেলা অবিশাষ্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে তাকে সামনে থেকে সরিয়ে লাফিয়ে হাসনাতের সিটের কাছে পৌছালো… আর সেখানে যেতেই তার আশার আলো ধপ করে সেখানেই নিভে গেল.. অদ্রি পরম মায়া ভরা কন্ঠে পিছন থেকে তার কাধে হাত দিয়ে বলল– হয়তো নিচে আছে.. গাড়িতে আর কতক্ষণ বসে থাকবে..বল?? তার কথায় যেন রোদেলার মুখে হাসি ফুটলো!!!! মুহুর্তেই তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো. সে তাড়াতাড়ি দৌড়ে নিচে নেমে সব জায়গায় চেক করতে লাগলো.. হাসনাতকে কোথাও দেখা গেলনা!! তাকে এবার হতাশায় গ্রাস করতে শুরু করলো…সত্যিই কি হাসনাত যাওয়ার আগে একবার তাকে দেখার ও প্রয়োজনবোধ করলো না… হঠাৎ তার মাহিয়ার কথা মনে পড়ে গেল..সে দাড়িয়ে আবার মাহিয়াকে খুঁজতে লাগলো.. তামান্না রোদেলার হাত ধরে টেনে বলল– চল বাসায় যাব.. এখানে আর দৌড়াদৌড়ির কাজ নেই…
রোদেলা অস্হির কন্ঠে বলল– কিন্তু তামান্না ওনি আমাকে না বলে কিভাবে চলে গেল?? তাহলে কি এতোদিনের সব কিছুই মিথ্যা?
তামান্না — হুট করে না জেনে কোন বিষয় নিয়ে মনগড়া কাহিনি বানানোটা অযোক্তিক.. ঠিক এই কারনেই এতোদিন ভাইয়া থেকে দূরে থাকতে হয়েছে তোকে.. আবার সন্দেহ করছিস?
রোদেলা কিছুখন চুপটি করে বসে কিছু ভাবলো!! তারপর বলল— হয়তো তোর ধারনাই ঠিক.. বেশি ভাবছি আমি. চল বাসায় যায়।। এই বলে তামান্নার সাথে বাড়ির দিকে রওনা দিল সে.. তবুও কেন যেন মনের কোণে খচখচটা রয়েই গেল তার!!!
হাসনাত হঠাৎ চোখ মেলে তাকালো.. কেন যেন মনে হলো কিছুর সাথে বাধা রয়েছে সে!! আর এই কারনেই হয়তো কোমড়টা টনটনে ব্যাথা করছে তার!! কিন্তু কিসের সাথে বাধা রয়েছে সে!!নিজেকে হাল্কা ঝাঁকিয়ে নিল সে!! আর এতেই অবাক হয়ে গেল হাসনাত… তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে..কিন্তু কেন?
হাসনাতের নিশ্বাসটা গলায় যেন আটকে গেল.. তাকে কে বা এইভাবে কিডন্যাপ করতে পারে!!! কি দরকার.. টাকার জন্য?এইসব ভাবনায় হাসনাতের মাথা যেন হ্যাং হয়ে গেল… তার কোন পুরোনো শত্রু কি একাজটা করলো তার সাথে?? প্রশ্ন অনেক আছে কিন্তু সব উওর যেন তারকাছে জানাই নেই!!!
হাসনাতের চোখের সামনে হঠাৎ রোদেলার চেহারাটা ভেসে ওঠলো. মুহুর্তেই বুকটা কেপে ওঠলো তার… মেয়েটার সাথে দেখা ও হলো না!!! তাকে কি মেয়েটা ভূল বুঝবে?? ভাববে কি তাকে ভালোবাসিনা ভেবে চলে এসেছি?? এইসব প্রশ্ন নিজেকে নিজে করেই বিমর্ষ হয়ে পড়লো হাসনাত!!
হঠাৎ হাসনাতের মনে হলো যদি এরা হাসনাতকে মেরে দেয়.. আর এইটা মনে হতেই তার চোখে কোনে অশ্রু জমা হতে লাগলো.. একসময় সে মৃত্যু চায়তো তার নিজের জন্য কিন্তু এখন সে বাচতে চায়.. খুব করে বাচতে চায়!! রোদেলার সাথে যে তার অনেকগুলো স্বপ্ন পূরণ করার ইচ্ছে!!
তার নিজের চেয়ে বেশি চিন্তা রোদেলাকে নিয়ে হচ্ছে এখন।। সে যে বড্ড ভালোবাসে তার সেই রাগী পিচ্চিকে!!
রোদেলা মনমরা হয়ে তামান্নাকে বিদায় জানিয়ে ঘরের ভিতর চলে গেল..রোদেলা যেতেই তামান্না যেন হাফ ছেড়ে বাচলো!! তার রোদেলার জন্য অনেক খারাপ লাগছে.. সাথে ইফতির ওপর রাগ ও.. ইভানের বড় ভাই না হলে কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিত তাকে..
যতোসব উদ্ভট চিন্তাধারা.. হাসনাত ভাই ইচ্ছামতো ধোলাই লাগালে খুশিতে লুঙ্গি ডান্স দিবে সে তাও ইফতির ভাইয়ের লুঙ্গি পড়ে.. এইসব ভাবতে ভাবতে সে কাধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিজের বাড়ির দিকে প্রস্হান করলো..
রোদেলা নিজের বাড়িতে ডুকে অবাক হয়ে গেল.. তার নিজের বাড়ি কিনা চেক করার লক্ষ্যে সে আবার বাইরে গিয়ে ন্যামপ্লেটটা দেখে এলো.. সত্যিই এইটা তারই বাড়ি!! দুদিনে এমন হুলিয়া পাল্টালো কিভাবে !! চারিদিকে যেন সাজ সাজ রব..মনে হয় যেন বাড়ির বিয়ে!! তারপর নিজেকে ধমকাল সে.. বাড়ির আবার বিয়ে কিভাবে হয়!! তারমানে বাড়িতে বসবাস করা কারো বিয়ে… কিন্তু বিয়ে টা কার!!! এইসব ভাবতে ভাবতে সে ভেতরে প্রবেশ করলো।।।
হঠাৎ মুনিরা এসে নাচতে নাচতে বলল– আজকে সই তোমার মজার দিন.. কালকে তোমার বিয়া… নাচবো আমরা নাচবো সবাই ঘোমটা মাথায় দিয়া…
এইবলে সে রোদেলার আসে পাশে ঘুরে নাচতে লাগলো.. রোদেলা যেন অবাকের চরম সীমানায় পৌছালো.. সে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল– কিরে?? সস্তার নেশা করছিস নাকি?? এমন উড়নচণ্ডীর মতো করছিস কেন??
তখন সানিয়া রোদেলার সামনে এসে বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে হাত গুঁজে বলল– কালকে দুপুরে তোমার আকদ.. “রুপনগর ক্লাবে.””.
রোদেলার মাথার ওপর যেন আকাশটা ভেঙ্গে পড়লো.. সে চরম রেগে বলল– কি বলছিস আবোল তাবোল?? কার সাথে বিয়ে? উল্লুকটা কে??
মুনিরা— বাবার বন্ধুর ছেলে..
রোদেলার পুরো দুনিয়া ঘুরতে লাগলো.. তার বাবামা তার থেকে জিঙ্গেস না করে কিভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে..তাদের কি একবারও উচিত ছিলনা তার থেকে জিঙ্গেস করা!!
সে মুনিরার আর সানিয়ার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো.. মেয়েদুইটির নাচানি দেখলে উগান্ডায় পাঠাতে মন চায় দুইটাকে….এইসব ভাবতে ভাবতে সে হনহনিয়ে তার মায়ের রুমের দিকে প্রস্হান করলো.. আর তার যাওয়ার সাথে সাথে সানিয়া আর মুনিরা একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল…
রোদেলা তার মার রুমে ঢুকেই বড় সড় শক খেল.. তিনি লেহেঙ্গা, শাড়ি, আর জুয়েলারির মাঝখানে বসে আছেন.. মনে হচ্ছে এইসব নিয়ে এক্সিবিউশন করছেন তিনি…
আবার গুনগুনিয়ে গান ও গায়ছেন “” এই মন তোমাকে দিলাম””” এইটা কোন কথা!! এই বুড়োবয়সে আবার কাকে মন দেওয়ার কথা বলছে এই ভদ্রমহিলা !!
রোদেলাকে দেখতেই দৌড়ে রোদেলার কাছে এসে বলল– এই রোদেলা এখানের মধ্যে কোনটা ভাল লাগবে তোকে দেখতো..
রোদেলা হতাশাজনক লুক দিয়ে বলল– বরটা যখন নিজেরাই ঠিক করেছো?এইসবও নিজেই ঠিক করে ফেল.. পারলে বিয়েটাও নিজে করে বসে থাকিও..এইবলে গটমটিয়ে সেখান থেকে চলে গেল সে!!
এইটা কোন দেশী বিচার!! যার বিয়ে তার খবর নাই আর পাড়াপড়শি ঘুম নাই!! এমন হলে কি করে হবে..রোদেলার হঠাৎ মনে হলো তার বাবা হয়তো তার মন বোঝবে.. সে তার বাবার কাছে যেতেই তিনি হাসিমুখে বলল– রোদেলা,, রুপনগরে বিয়েটা দিচ্ছি তোর বুঝলি…. তোর না ক্লাবটা পছন্দ বেশি..
রোদেলা কাঁদোকাঁদো চোখে তার বাবার দিকে তাকালো.. সত্যি কি কালকে তাকে কুরবানির মাঠে নেওয়া হবে!!! সে দৃঢ় কন্ঠে বলল– ভাবছি ক্লাবের সাথে বিয়ে করে নিব.. কোন ছেলের সাথে করবো না.. কারন ক্লাবটা আমার প্রচন্দ.. ছেলেটা তো আর নয়..
শামীম সাহেব মুচকি হেসে বলল– সোনার টুকরো ছেলে! এই বলতেই রোদেলা তারদিকে রাগীদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল– তাহলে তোমরা সেই টুকরাটা গলাই ঝুলিয়ে নাও.. সোনার ভরিতো আবার ৫৫ হাজার টাকা।।। এই বলে হনহনিয়ে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে এলো সে..
রোদেলার আজ খুব অসহায় লাগছে নিজেকে।। তার না বলা ভালোবাসাটা কি এইভাবে না বলাই থেকে যাবে??
হাসনাতের মিষ্টি চেহারাটা বারবার তার সামনে দৃষ্যমান হতে লাগলো.. হাসনাতের জন্য মনের ভিতর যেই তোলপাড় টা শুরু হয়েছে তার সেইটা যে শুধু হাসনাতই শান্ত করতে পারে…
রোদেলা নিজের ফোনটা নিয়ে হাসনাতকে কল দিল.. বারবার রিং পড়ে কেটে গেল সেইটা.. কেউ রিসিভই করলো না!! রোদেলা ডুকরে কেঁদে দিল.. হঠাৎ কি মনে করে হাসনাতের বাড়ির নাম্বারে কল করলো সে.. আশা একটাই হাসনাতের সাথে একবার যোগাযোগ!!
কয়েকবার রিং পড়ার পর একটা অপরিচিত ভয়েস শুনা গেল অপর প্রান্তে.. রোদেলা হ্যালো মামি বলতেই ওপাশ থেকে কর্কশ স্বরে একটি মেয়ে বলে ওঠলো— মামি না.. আমি আসলে ওনার ভাইয়ের মেয়ে.. ওনি একটু বিজি.. হাসনাতের কালকে বিয়ে তো তাই..
মুহুর্তেই রোদেলার পুরো দুনিয়া ঘুরতে লাগলো.. তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে.. হাসনাত ভাই শেষ পর্যন্ত নিজের কথাটাই রাখলো!! সেইম দিনে বিয়ে করছেন তিনি!! রোদেলার দুচোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়লো।। তার ভিতরটা কষ্টে মুষড়ে যাচ্ছে.. সে বিরবিরিয়ে বলল– কনগ্রাচুলেশন হাসনাত ভাই,,, কাল থেকে তোমাকে জ্বালানোর কেউ থাকবে না।।
এইসব বলতে বলতে ধুপ করে বিছানার পাশে বসে পড়লো.সে. চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল!!!
হাসনাত বন্ধ ঘরে এখনো বন্ধি!! তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।। কিন্তু সে নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে.. তার যে মরার আগে একবার রোদেলাকে নিজের মনের কথাটা বলার ইচ্ছা.. সে তার জিবনের অন্তিম ইচ্ছা পূরন না করে কোন ভাবেই মরতে পারে না.এই ভাবনাই যেন তার মনোবল বাড়িয়ে দিচ্ছে..
চলবে….