ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব ৩২

#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন

পর্ব— ৩২

সকালে অতিরিক্ত চিৎকার আর অট্টহাসিতে ঘুৃম ভেঙ্গে গেল রোদেলার.. কিছুখন বুঝতে সময় লাগলো আসলে সে কোথায় আছে.. নিজের বাড়িতে নাকি মাছের বাজারে.. চোখ খুলে চমকে ওঠলো সে.. এতো রকমের ব্যাগ তার রুমে কি করে.. সে চমকে ওঠে বসলো.. বিছানার পাশে ইফ্ফাত, সানিয়া, মুনিরা বসে বসে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে.. রোদেলা হতাশাজনক লুক দিয়ে বলল– আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহ তোদের চোখে ঘুম দেয় নাই??
মুনিয়া রোদেলার দিকে না তাকিয়েই বলল– দিচ্ছে কিন্তু দশটা পর্যন্ত ঘুমাবো এমন ঘুম দেয় নাই…
রোদেলা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল– কি!! এতোক্ষন ঘোমাইলাম!!!
ইফ্ফাত চোখ তোলে তাকিয়ে বলল– হাসনাত ভাই কি নাইট ডিউটি করাবে বলেছে তোমারে শুধু ঘোমাচ্ছ কেন…
রোদেলা বালিশটা ইফ্ফাতের মুখের ওপর ছোড়ে মারলো.. তারপর বিছানা থেকে নেমে ওয়াসরুমে ডুকে গেল…

ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে দেখলো চারপাশটা থমথমে… সে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল– কি হলো??
সানিয়া– খালামনিরা, মামিরা আর কাজিনরা সবাই এসেছে..
রোদেলা মুহুর্তেই থমকে দাড়ালো.. পুরোনো কিছু স্মৃতি মনের কোটরে উকিঁ দিচ্ছে তার.. তাদের সামনে যেতে অনেকটা জড়তা কাজ করছে এখন.. ইফ্ফাত রোদেলার কাধে হাত দিয়ে বলল– থাক না যাও…
রোদেলা মুচকি হেসে– আমি ঠিক আছি..

তারপর কয়েকটা ঢুক গিলে সামনে পা বাড়ালো …দরজা দিয়ে উকিঁ দিতেই সবাইকে দেখলো সে।। আন্টিদের চেহারাই হালকা বয়সের ছাপ পড়েছে.. কাজিনদের বাচ্চা কয়েকটা বেড়েছে.. কিন্তু এখনো মনে হচ্ছে সেই পাঁচবছর আগের সবাই.. রোদেলা নিজের মায়ের দিকে তাকালো.. কতোটা খুশি তিনি.. চোখে মুখে খুশির ঝিলিক!!! খুশিতে চেহারাটা ঝলমলে হয়ে ওঠেছে!! রোদেলা আনমনে হেসে দিল.. তার মায়ের খুশির জন্য সব ভূলে যেতে রাজি সে… তার মা তার কাছে অনেক ইম্পোর্টেন্ট.. প্রতিটা সন্তানের কাছে তাদের মা রা স্পেশাল হওয়া দরকার।। কারন তারা নিজেদের সুখ বিসর্জন দিয়ে একটা সন্তানকে লালন পালন করে বড় করে তুলেন. আর তাদের কাছে প্রিয় হয় তাদের বাবার বাড়ির মানুষজন.. প্রতিটি মেয়ের কাছেই এটি সার্বজনীন সত্যের মতো… আর খালামনিরা তো মা ই.. এইসব ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে…
তাদের সালাম দিতেই হঠাৎ খালামনিরা তাকে জোরে জড়িয়ে ধরলো.. এইবার যেন রোদেলার কান্না আসছে… মা মা স্মেল কেন আসে খালামনিদের থেকে!! তারা মা এর বোন বলে!! পুরোনো সব ভূলে আবার আগের মতো মিশে গেল সে সবার সাথে!! সত্যি রাগ মানুষ থেকে অনেক আপন মানুষকে কেড়ে নেয়.. এরা যে তার আত্নীয়.. আত্নার অংশ… আর যা করা কিন্তু আত্নীয় সম্পর্ক ছিন্নকরাটা বোকামী।। বড্ড বোকামী….

রোদেলা সবার সাথে গল্প করে নিজের রুমে ড্রেস চেন্জ করতে ডুকলো… যেই পিছনের চেইন খুলতে লাগলো দেখলো বিছানার ওপর হাসনাত বসা… নিজে নিজে হাসলো সে।। আজকাল বড্ড দিবাস্বপ্ন দেখছে সে.. যখন চেইন পুরাটা খুলা শেষ হঠাৎ হাসনাত কেশে ওঠলো…সাথে সাথে রোদেলা পাশের ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে চোখ বড় বড় করে হাসনাতের দিকে তাকালো….
হাসনাত চোখ টিপ দিল তাকে..রোদেলা তোতলে বলল– আ-প-নি– এখা–নে..
হাসনাত মুচকি হেসে বিছানা থেকে দাড়িয়ে সামনে আসতে আসতে বলল– হুম.. এসেছিলাম এককাজে.. কিন্তু দেখলাম অন্যকিছু!!
রোদেলা হাসনাতের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। হাসনাত সেই বড় চোখের নেশায় মজতে লাগলো!!! হাসনাতের কাছে রোদেলার নেশা যেন ফুল ওয়াইনের বোতলের মতো!!! বারবার সে রোদেলার নেশায় মজতে পারে.. এতোটা ভালোবাসে তাকে যে তাকেই কাছে পেতে তার মনটা বারবার হু হু করে…
হাসনাত নেশা লাগানো চোখে আস্তে আস্তে রোদেলার কাছে আসতে লাগলো.. আর রোদেলা পিছুতে পিছুতে একসময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল তার!!
হাসনাত রোদেলার অনেকটা কাছে.. তার গরম নিশ্বাসগুলো নাকেমুখে পড়ছে রোদেলার!! রোদেলা থরথরিয়ে কাঁপছে.. আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে.. হাসনাত রোদেলার কম্পিত পাপড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের হাতটা রোদেলার পিছনে দিতেই রোদেলা চোখ খিছে অফ করে ফেলে…,

হাসনাত মুচকি হেসে রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে পিছনে হাত দিয়ে চেইনটা লাগিয়ে দেয়।। রোদেলা হাসনাতের ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেপেঁ ওঠে… হাসনাত রোদেলার মুখের সামনের চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল.. রোদেলা চোখ বড় বড় করে তাকালো.. হাসনাত মুচকি হেসে বলল– আমাকে এতটাও দেওয়ানা করিও না যাতে তোমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়.. আর মাত্র তিন দিন তারপর তুমি সবসময়ের জন্য আমার সাথেই থাকবে… রোদেলা মুচকি হেসে মাথা নুইয়ে নিল..

সেদিকে তাকিয়ে হাসনাত হেসে– তোমাকে দেখতে এসেছিলাম সবাই এসেছে.. প্রবলেম হচ্ছে কিনা জানতে.. কিন্তু তুমি নিজেকে গুচিয়ে নিয়েছ.. দেখে ভালোই লাগছে… ওকে আমি যাচ্ছি.. এইবলে আস্তে করে দরজা খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বেরিয়ে গেল সে।। আর রোদেলা ঐখানেই দাড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো…
///

বিকেলে ছাদে পেন্ডেল টাঙ্গানো হলো।। হলুদ আর মেহেদী একটা অনুষ্টানেই হবে… এইটা রোদেলাদের ছাদে… সঙ্গীত হাসনাতদের ছাদে.. বেচলর পার্টি আর কিটি পার্ট যারযার ইচ্ছে এইটা বাচ্ছাদের ওপর.. বড়রা ডিসাইড করে নি…আর বিয়েটা এন মোহাম্মদ ক্লাবে…

সবাই যে যার মতো রেডি হচ্ছে যেন যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা.. সানিয়া আজকাল আগের মতো এতোটা সাজে না.. হয়তো বড় হয়ে ম্যাচুরিটি বেড়েছে তার..

ছেলেদের সাজুগুজু শেষ.. কিন্তু মেয়েদের কোন খবর ই নেয়.. হাসনাত সবার সাথে ছাদের একপাশে বসে আছে.. তার দৃষ্টিও সামনের দিকে.. তার মায়াপরী তো সিড়ি বেয়েই ওঠে আসবে…

ছেলেদের সবার পান্জাবী ব্রু আর হাসনাতের টা গোল্ডের ওপর লাল পাড়ের… ইফতি সবাইকে গোল করে বসিয়ে বলল– দেখিও.. আবার মেয়েদের দেখে নরম হয়ে যাইও না.. আমরা চিটাগাঙ্গায়া ফুয়া,,, মাঢিত পরলে লোয়া…. ইভান কিটকিটিয়ে হাসি বলল– হ.. দেখা যাবে.. চিটাগাঙ্গা ল্যাঙ্গুয়েজ তুৃমি বলিও না.. ফানি শোনায়… আরাফ ফোনে গেইমস খেলতে কেলতে বলল– সব কয়টা হারবা.. মেয়েদের দেখে একেকটা একেক দিকে কাত হয়ে থাকবা…সব জানা আমার…
ইশান জোর গলায় বলল– হু… কখনো না.. ইভান ও তার সাথে গলা মেলালো… মেহেদী ব্রু নাচিয়ে বলল– আজকের কম্পিটিশন তো আমরাই জিতবো.. স্টেজ সাজানো,, ডালা সাজানো, টিম ওয়ার্ক, আর টিম ডান্স.. তাও আবার একটা… বাকি ডান্সতো সঙ্গীত অনুষ্টানে…
আরাফ— তাও দেখবি তোরাই হারবি….

এইসব গলাবাজি করে সামনে তাকাতেই সবকয়টায় চোখ বড় হয়ে গেল.. তাদের সামনের মানুষগুলো কি আদো মানুষ নাকি পরী!!!
মেয়েরা সবাই নীল কালারের শাড়ি পড়েছে.. চুল খোপা করে কিছু চুল সামনে কুঁকড়ো করে ছেড়ে দিয়েছে.. আর খোপায় গাজড়া দিয়েছে তারা.. হাত ভর্তি কাচের চুড়ি..পায়ে আলতা আর সেই আলতারাঙ্গা পায়ে কুন্তলের পায়েল.. কোমড়ে পুতির বিছা..আর গলায় পুতির হার যাতে কাচ বসানো…ছেলেদের মনোবল কমতে কমতে এতোটাই কমে গেছে যে তাদের আবার সাহস ও দিতে হবে!!!

ছাদের দুপাশে দুইটা স্টেজ.. হাসনাতের টা ছেলেরা সাজিয়েছে. আর রোদেলার টা মেয়েরা… ডালাও সেইভাবেই.. স্টেজের সামনে পর্দা দেওয়া.. প্রথমে রোদেলার টা খোলা হল.. ফুলদিয়ে সাজানো সুন্দর একটা স্টেজ..সবাই মেয়েদের সাবাশী দিল.. এরপর হাসনাতের টা খোলা হল.. সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেল.. এতো সুন্দর স্টেজ এর আগে কেউ সাজায় নি. কাঠের দোলনা বসানো স্টেজে আর পুরোটা কাচের লহর টাঙ্গানো পিছনে…. ফুল আর পুতিকে একসাথে মিক্স করে সাজানো… সবাই ছেলেদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ…
ইফ্ফাত আর মুনিরা মুড ই খারাপ হয়ে গেল.. তারপর ডালাগুলোর ওপর থেকে কাপড় সরানো হলো… ছেলেরা ইউটিউব দেখে ভালোই সাজিয়েছে.. প্রচুর টাকাও খরচ করে ফেলেছে তারা.. কিন্তু মেয়েদের টা সত্যি অসাধারন..ইউনিক বু্দ্ধিগুলো সব তাদের মাথায় আসে… আর তাই এই রাউন্ডে মেয়েরা জিতে গেল।।।

ইফ্ফাত ইফতির দিকে তাকিয়ে বলল– আমরাই জিতলাম..
ইফতি মুচকি হেসে বলল– এখনো রেজাল্ট ড্র.. বাকিগুলো দেখা যাক…

হাসনাতের মন এইসব কোন কিছুতে নেই.. সে তার মায়াপরীকে খুজছে… তার মায়াবতীর মায়াবী মুখখানা দেখার জন্য আকুল সে..
ইফ্ফাত খুব ভালোই বোঝতে পারছে হাসনাতের মনের অবস্হা সে অন্যদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে সরে দাড়ালো…
ওদের সরতেই হাসনাত সামনের দিকে তাকিয়ে হা হয়ে রইলো.. রোদেলার এই রুপ আজ হাসনাতের কাছে ১ম.. বাসন্তি ঢালা শাড়ির সাথে ফুলের জুয়েলারি.. আর সাজে যেন এক ফুলকুমারী..তার মনে হচ্ছে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুল থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এই পরীটা!!!… হাসনাত রোদেলার দিকে তাকিয়ে ব্রু নাচিয়ে হেসে দিল… আর এর বদলে রোদেলা ও মুচকি লাজুক হাসি দিল…

অনুষ্টান শুরু হলো.. সবাই বারেবারে স্টেজে ওঠে কেক খাইয়ে আর পিক তুলে নেমে যাচ্ছে.. আর রোদেলার আর হাসনাত একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কথা বলছে…এর ভিতরে আবার মেয়েরা আর ছেলেরা তাদের গ্রুপ ওয়ার্কের প্লেনিং শুরু করে দিয়েছে.. তাদের যে জিততেই হবে…

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here