মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৭
মোনা অকারণে নিশানের মাথা ভর্তি চুলে আঙুল বিলি করছে।নিশানের চুল গুলো একদম ইমরুল চৌধুরীর মত,সিংহের কেশর যেন। বাবার কথা মনে পড়তেই মোনার চোখের সামনে আরেকটা ঘৃন্যিত মুখ ভেসে উঠলো । মোনার চূর্ণ বিচূর্ণ বুকটা বার বার ভারী হয়ে উঠছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে, যায় মোনার শরীর ঈষৎ নড়ছে। হিমেল বাতাস লাগা দিঘির পানির মত মোনার ঠোঁট কাঁপছে। মোনা কষ্ট কে ঠাঁই দিতে চাচ্ছে না। কষ্টকে একবার ঠাঁই দিলেই ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পায়। মোনা নিজেকে আবেগশূন্য একজন মানুষ বানাতে চায়। যার কোন কষ্ট,আফসোস কিছু নেই। ম্লানি দৃষ্টি মেলে জানালার দিকে তাকায় মোনা। চোখ গুলো নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও বার বার ঝাঁপসা হয়ে আসে। মোনা চোখ মুছে!
__
লিলি বেগম রুমে বসে আছে হাবিবের সাহেবের অপেক্ষায়। হাবিব সাহেব কখন বাসায় ফিরবে?মোনার ঘাড়ে যে বদনাম দিয়েছে, তার পিছনের সত্যিটা জানাবে। সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেলো প্রিয়ম বাসায় ফিরেনি। লিলি বার বার প্রিয়মের নম্বরে ডায়েল করছে, ফোন সুইচ অফ! লিলি বেগম যথারীতি হতাশ হয়। ছোট ছেলেটা লিলির খানিক বাধ্য থাকলেও প্রিয়ম একদম কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে।এই সবটাই হাবিব সাহেবের আশকারায়। নিজের ইচ্ছে মত ছেলেদের মানুষ করতে পারলো না। লিলি ক্ষীণ নিঃশ্বাস ছাড়ে। এ সংসারে তার যেন কোন গুরুত্ব নেই, তার অনুপস্থিতিতেও যেন কেউ অভাব বোধ করবে না।
গেটের সামনে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেলো।লিলি বেগম জানালার ফাঁক দিয়ে তাকালো। কালো রঙা কারে চড়ে প্রিয়ম এসেছে। লিলি বেগম রুম থেকে বের হয়। প্রিয়ম গাড়ি পার্ক করে বাসায় ঢুকে। উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে প্রিয়ম কে, চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে গেছে। এলেমেলো পায়ে হাঁটছে। লিলি বেগম ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
-“প্রিয়ম আমার রুমে আয়।”
প্রিয়ম মায়ের দিকে তাকায়। লিলি বেগম ওদের সাথে শক্ত গলায় কথা বলা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। নিছক রাগ দেখিয়ে কি লাভ, যে রাগে ছেলেদের কোন ভাবান্তর, পরিবর্তন নেই।প্রিয়ম লিলি বেগমের পিছনে পিছনে যায়।ধপ করে খাটের উপর বসে পড়ে ক্লান্ত ভর করা শরীরে। দুর্বল গলায় বলল,
-“কি বলবে আম্মু?”
-“রাত থেকে কোথায় ছিলি?”
প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,
-“এমন ভাবে বলছো মনে হচ্ছে এটা খুব নতুন কিছু?”
লিলি বেগমের নাক মুখ শক্ত হয়ে আসে রাতে। সন্তান যদি এত বেপরোয়া হয়ে উঠে,তখন আফসোস করা ছাড়া উপায় থাকে না। লিলি বেগম চেঁচিয়ে উঠল।
-“তুই মোনা কে কেন নাইট ক্লাবে নিয়েছিস জোর করে?এতটা বেপরোয়া হয়েছিস ।কোনটা করা উচিত, কোনটা করা উচিত না তাও বুঝিস না? বিবেক, বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।”
প্রিয়ম সহজ, স্বাভাবিক গলায় বলে,
-“হ্যাঁ আমি ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সকালে তো পাইনি ওকে। মোনা কি বাসায় চলে এসেছে?”
লিলি বেগম নির্বাক হয়ে যায়। কত সাবলীল ভাষায় কথাগুলো বলছে প্রিয়ম! লিলি বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“মোনার সাথে কথা বলবি না তুই। ওরা তোদের মত এত স্মার্ট নয়! ওদের লাইফস্টাইল, মেন্টালিটি , চিন্তা-ভাবনা তোদের মত না। এইটুকু অন্তত তোর বুঝা উচিত।”
প্রিয়ম কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচু গলায় বলল,
-“স্যরি আম্মু।”
-“স্যরি না বলে নিজেই রিয়েলাইজ কর যে তুই ওর সাথে অন্যায় করিস নি?”
প্রিয়ম কোন উত্তর না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। লিলি বেগম গম্ভীর মুখে বসে থাকে। লিলি বেগমের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এখান থেকে চলে যেতে। এত টাকা,গাড়ি,বাড়ি কিন্তু সুখ কোথায়? সুখ যে বড্ড আপেক্ষিক জিনিস! প্রতিপত্তির মধ্যে তো সুখ বিদ্যমান না! বাহির থেকে লিলি বেগম কে সবাই দেখলে ভাবে কত হাসি খুশি মানুষ সে! অথয ভিতরটা ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষত। তৃষ্ণার্ত কাকের মত কম সুখের সন্ধান করেনি। কিন্তু পাইনি কখনো।
___
মোনা দরজা খুলেনি রুমের ভিতরই বসে ছিলো। সব কিছুতে অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছে, উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। নিশান সব জামাকাপড় এলোমেলো করে রেখেছে। মোনা অভ্যস্ত হাতে জামাকাপড় গুলো ভাঁজ করছে। সময় কাটছে না! জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে যেন। বেঁচে থাকার কোন কারণ খুঁজে পায়না আজকাল।
হাবিব সাহেব অফিস থেকে ফিরে আসে। হাতের কব্জি থেকে ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখে। ক্লান্ত হাতে টাই খুলে। লিলি বেগম বিধ্বস্ত মুখে খাটে বসে থাকে। হাবিব সাহেব একজনর সেদিকে তাকায়। তারপর চোখ ফিরিয়ে নেয়। ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিতে হাত মুখ মুছছে।
-“কি যেন বলেছিল তুমি? মোনা ছেলেদের সাথে রাত কাটিয়েছে?”
হাবিব সাহেব নির্লিপ্ত গলায় বলল,
-“আমি কি মিথ্যা বলেছি?”
-“সত্যি বলেছো?তোমার ছেলে জোর করে মোনা কে নাইট ক্লাবে নিয়ে গিয়েছে। আর গলা উঁচিয়ে মেয়েটা’কে যা ইচ্ছে তাই বলছো।”
হাবিব সাহেব বিদ্রুপ ভঙ্গিতে তাকায়। তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলল,
-“লাইক সিরিয়াসলি?প্রিয়ম জোর করে ওকে নাইট ক্লাবে নিয়ে গেছে? মানুষকে জোর করে কিভাবে নাইট ক্লাবে নেয়? আর আমার ছেলের সাথে নাইট ক্লাবে যাওয়া শুরু করেছে? ওই মেয়ে ফুঁসলিয়ে আমার ছেলের গলায় ঝুলে পড়ার পরিকল্পনা করছে। ওমন থার্ড ক্লাস মেয়েদের চিনা আমি।”
হাবিব সাহেবের দিকে বিধ্বস্ত মুখে তাকিয়ে রইলো লিলি বেগম। নির্বোধ এর মত যুক্তিহীন কথা বলছে! লিলি বেগম প্রত্যুত্তর করার মত কড়া জবাব খুঁজে পেলো না।একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ হাবিব সাহেব, অথচ কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় তা বুঝে না। লিলি বেগম কে তীব্র হতাশায় গ্রাস করল। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। হাবিব সাহেব রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
মোনা চেঁচামেচির শব্দ পেলো।বুঝতে পারলো হাবিব সাহেব বাসায় এসেছে। আর এই চেঁচামেচির বিষয়বস্তু যে মোনা নিজে তা মোনা ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছে। এ বাসায় আর এক দন্ড থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না মোনার। নিজেকে নর্দমার কীট মনে হচ্ছে। নয়ত এত অপমানের পর কিভাবে এখানে পড়ে রইল? দুপুরে ভাত খেতেও বের হয়নি মোনা। লিলি বেগম অনেকক্ষণ দরজা নক করেছে, মোনা কে ডেকেছে। মোনা কোন সাড়াশব্দ দেয়নি।
সন্ধ্যা নেমে এলো। সূর্যটা গোলাপী আভা ছড়িয়ে ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে। মোনা রুম থেকে বের হয় নিশান কে নিয়ে। নিঃশব্দে ছাদে যায়। আবছা অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো। দুইজন মানুষের ছায়ার মত দেখা গেল এক কোণে। মোনা ভালোভাবে লক্ষ্য করলো। মোনা দুই হাত দিয়ে চোখ ডেকে ফেলল। এরিক আর পাশের বিল্ডিং এর একটা মেয়ে, এই মেয়েটা মোনা প্রায়ই দেখতো। দুইজনের দুইজনের ঠোঁটে এমন ভাবে চুমু খাচ্ছে মনে হচ্ছে প্রতিযোগিতা চলছে। নিশান সাথে থাকায় মোনা দ্রুত চলে যেতে উদ্যত হলো। এরিক মোনা কে ডাক দিলো। মোনা পিছনে ফিরে তাকালো না! এরিক এসে মোনার সামনে দাঁড়ালো।
-“আরে চলে যাচ্ছো কেন?তুমি এত লজ্জা কেন পাচ্ছ? শুধু চুমোই তো খেয়েছি।”
মোনা এদের নির্লজ্জতা দেখে অবাক না হয়ে পারে না। এরিকের সাথে থাকা মেয়েটা মোনার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তারপর এরিকের দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে কি যেন বলল। মোনা হিন্দি বোঝে না। এরিক হাসতে হাসতে বলল,
-“চুমু খেলাম আমরা আর লজ্জা পেলে তুমি?”
মোনা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলে,
-“লজ্জা পাবো কেন?আমায় খালা ডাকে তাই চলে যাচ্ছি।”
এরিক মেয়েটাকে দেখিয়ে মোনার উদ্দেশ্যে বলল,
-“ও হচ্ছে এ্যালি, আমার গার্লফ্রেন্ড।”
এ্যালি হ্যান্ডশেক এর জন্য মোনার দিকে হাত বাড়ায়। মোনার এ্যালির দিকে তাকাতেই লজ্জা করছে, পোশাক-পরিচ্ছেদের কারণে। আর একটু বড়সড় কাপড় পড়লে কি হয় কি জানে।মোনাও হাতে বাড়িয়ে দেয়। এ্যালি নিশান কে বলে,
-“হাউ আর ইউ কিউটি বয়?”
নিশান ফ্যালফ্যাল করে তাকায় এ্যালির দিকে। যেন চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে আসা প্রাণী দেখছে।এরিক বলে,
-“ও কথা বলতে পারে না।”
এ্যালি দুঃখ প্রকাশ করলো।মোনা নিশান কে নিয়ে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে যায়।বাসায় যে লিলি বেগম আর হাবিব সাহেবের সাথে এত ঝগড়াঝাঁটি হয়, মোনার সাথে প্রিয়ম যে সব ব্যবহার করে এগুলো কিছু নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই এরিকের। ও এসবে নেই! এগুলো নিয়ে ওর ভাবান্তর ও নেই।
দুপুরে মোনা খায়নি বলে নিশানও খায়নি। নিশান পেটের ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছে। ওদিকে ডাইনিং রুম থেকে লিলি বেগম ডাকছে। মোনা বুঝতে পারছে না এত কিছুর পরও তাঁদের সবার সাথে বসে খাওয়ার জন্য কেন ডাকে?মোনার তাঁদের সামনে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই কিন্তু নিশান তো না খেয়ে থাকতে পারবে না। মোনা টেবিলে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে। আশেপাশে কোথায়ও তাকাচ্ছে না। টেবিলের সবাই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। মোনার গলা দিয়ে খাবার নামতে চাচ্ছে না। শুধু বসে বসে খাবারের প্লেট নাড়াচাড়া করছে। নিশানের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে মোনা নিজের প্লেটে পানি দিয়ে উঠে যায়। মোনা রুমের দরজায় আসতেই কেউ একজন পিছন থেকে মোনার হাত টেনে ধরে। খুব শক্ত ভাবে মোনার হাত চেপে ধরে। মোনা পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে প্রিয়ম।
(চলবে)