গল্প :- ক্রমশ
ব্যভিচারী..
পর্ব :- ০৫
Writer :- Kabbo Ahammad
.
.
.
-: রিচার সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে এলো। সেই অন্ধকার থেকে একটা পিশাচের হাসি কানে এলো! রিচা মানসচক্ষে দেখতে পেলো কাব্য চৌধুরী হাসছে।একটা বিকট শব্দে। তারপর রাগ-অভিমান-ষড়যন্ত্র বুকে রিচা চলে গেল এ পৃথিবী ছেড়ে।
হ্যাঁ রিচার ও মার্ডার হয়েছে…
খবর পেয়ে ছুটে আসে কাব্য চৌধুরীর বাড়িতে, এসে দেবোপম একদৃষ্টে রক্তশূন্য শরীরটার দিকে তাকিয়েছিলেন। মেয়েটার বয়স বেশি নয়। ব্যক্তিগত জায়গায় তিনিও একজন মেয়ের বাবা। তার মেয়ের সাথে রিচার বয়েসের পার্থক্য বিশেষ বেশি নয়।তখন পরিতোষ পাশে এসে দাঁড়ালো আর বললো।
–“স্যার আপনি যা ভেবেছিলেন। কেসটা এতটা প্যাঁচালো জানতাম না। কিন্তু আসিফ ই যে এর পিছনে আছে, কি করে বুঝলেন!
দেবোপম তখন রিচার উপর থেকে নজর না সরিয়েই বললেন।
–“বলছি পরিতোষ। যা ভেবেছিলাম, তাই হয়েছে। কিন্তু আপসোস কি বলোতো! একটু তাড়াতাড়ি করলে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারতাম ।আমার জন্যই মনে হচ্ছে মেয়েটা……….
পরিতোষ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
–” কি যে বলেন স্যার। আপনি কি আর জানতেন আজকেই এই ঘটনা ঘটে যাবে।
–“সেটাই (বলেই দেবোপম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন)
“আচ্ছা মার্ডার ওয়েপনটা পেয়েছো?
–“হ্যাঁ স্যার ওই তো পাশের ড্রেনে। মার্ডার ওয়েপন।গ্লাভস। কোট। সব। জুতোর আওয়াজ পেয়েই ওগুলো জানলা দিয়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে মনে হয়। কিন্তু এরকম বোকা বোকা কাজ করার কি মানে!
–“কি জানো পরিতোষ, মানুষ ক্রুশিয়াল সিচুয়েশনে এসেই বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। বোকার মতো ভুল করে। কি বলছে কি আসিফ!
–“আমাদের আসার পর থেকে সেই এক ক্যাসেট বার-বার বাজিয়ে যাচ্ছে…. “আমি কিছু জানিনা। আমার কাছে একটা ফোন এসেছিল। আমি সেই ফোনটা পেয়ে এই এখানে ছুটে এসেছি। আমি এসেই দেখি ভাবি এভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে। তখন আমি পুলিশকে ফোন করতে যাবার আগেই, পুলিশ এসে পড়ে…. “কি বলবেন বলুন স্যার।
–“কিছু বলার তো নেই পরিতোষ। ওকে থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আর এই বডিটাও পোস্টমর্টেম এর জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করো।
–“ঠিক আছে স্যার।
তারপর পরিতোষ এগিয়ে যেতে ক্যাপটা নামিয়ে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে নিলেন দেবোপম। গরম হয়ে আছে। ঘেমে আছেন। অনেক ঝড় গেল। পুরো সেট আপ টা সাজাতে হয়েছে। নাহলে আসিফকে ধরা যেতোনা। কখনও কখনও রাজাকে হাত করার জন্য ঘোড়াকে টার্গেট করতে হয় এমনকি রানীকেও বাজী রাখতে হয়। দেবোপম মনে মনে বললেন। “চেক…..
.
.
.
থানায়……
.
দেবোপম চেয়ারে বসেছিলেন। পরিতোষ এসে উত্তেজিত গলায় বললো।
–“স্যার আমাকে কিন্তু এখনও ভাবাচ্ছে আপনি কি করে ধরলেন আসিফ ই আছে এর পিছনে আর সে রিচাকে খুন করতে পারে।
কথাটা শুনে দেবোপম একটু হাসলেন, তারপর বললেন।
–“বসো। তোমাকে বলছি সব। জানো পরিতোষ আমার প্রথমে মনে হয়েছিল এই ঘটনাটা পুরোটা অরূপ আর রিচা চৌধুরীর সাজানো। সন্দেহের তির পুরোটাই ওর দিকে যাচ্ছিল। তারপর দুটো অদ্ভুত তথ্য পেলাম, যেটা আমার চিন্তাভাবনা পুরোপুরি পাল্টে দিলো।
–“কি স্যার….
(পরিতোষ আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে তার রোলমডেলের দিকে)
–“প্রথমত একটা অদ্ভুত খবর জানতে পারি।
এই আসিফের চোখ রিচার উপর বহুদিন ধরেই পড়েছিল। কাব্য চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে ও বহুবার রিচার কাছে যায়। নানারকম প্রস্তাব নিয়ে। যেহেতু
কাব্য চৌধুরী মাঝেমাঝেই ট্যুরে যেতো, আসিফ চেয়েছিল রিচাকে ভুলিয়ে ওর সাথে ইন্টিমেট হতে। বলাবাহুল্য রিচা প্রতিবার ই ফিরিয়ে দিয়েছে। শেষবার সেটা রীতিমত ঝগড়ার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তখন ওদের কনভারসেশনটা একজন শুনে ফেলে, যে সেই মুহূর্তে কাব্য চৌধুরীর খোঁজ নিতে সে বাড়িতে ঢুকছিল। গেস করো সেই ব্যক্তিটি কে!
–“নাইম শেখ কি! (পরিতোষ দ্বিধাপূর্ণ গলায় উত্তর দিল)
–“নট ব্যাড পরিতোষ। এগজ্যাক্টলি। আমি ওই লোকটির সাথে প্রথমবার কথা বলার পরই বুঝতে পেরেছিলাম এ অনেক কিছু জানে। কিছু একটা ভেবে বা কোনোকিছুর ভয়ে বলছেনা। আমি গিয়ে ভদ্রলোককে একদিন চেপে ধরলাম। একটু আইনী ভয় দেখাতেই সুড়সুড় করে সব বলে দিলেন। এর মধ্যে রিচা একদিন আমার সাথে দেখা করে জানায় ওকে কেউ একটা মাঝে-মাঝেই ফোন করে বলছে এখন তো কাব্য চৌধুরী নেই। একা হয়ে গেছো। কত করে লাগবে! এসব উল্টোপাল্টা কিছু। আমি তখন আসিফের কথা জিজ্ঞেস করতে ও বলল আসিফ নাকি কাব্য চৌধুরীর মৃত্যুর পরে মাঝে মাঝেই রিচাকে গিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে আসতো। কোনো দরকার পড়বে কিনা খোঁজ নিতো। মানে চিন্তা করো একবার। কত সাহস। লোকটা ধুরন্ধর। আমার তখনই ওকে সন্দেহ হয়। আমি রিচাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিই। আর পরামর্শ দিই এখন কদিন কারোর সাথে দেখা করবেন না।
এটুক বলে দেবোপম একটু দম নিলেন।
–“তারপর স্যার! (পরিতোষ আরো আগ্রহী হয়ে ওঠে)
–“তারপর আমি একটা টোপ ফেলি। আমি একটা চিঠি পাঠাই আসিফকে। বিশেষ কিছু লিখিনা। শুধু লিখি…
“আপনি যে আমায় বহুবার কু প্রস্তাব দিয়েছেন, আপনার সাথে রাত্রি যাপন করার জন্য বলেছেন, আমি বারণ করে দিয়েছি কাব্য চৌধুরীর জন্য। আর এ জন্য কাব্য চৌধুরীর উপর আপনার যে প্রচ্ছন্ন রাগ ছিল সেটা আমি পুলিশ কে বলবো ভেবেছি। আপনার এই পাশে থাকার নাটক। আমি আপনার অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হয় কাব্য চৌধুরীর মৃত্যুর পিছনে আপনার কোথাও হাত আছে।
~রিচা………
–“বাপরে স্যার! কি মারাত্মক স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। এরকম টোপ না গেলার ক্ষমতা আসিফের নেই। (পরিতোষ এর চোখেমুখে উত্তেজনা)
–“তারপর ছিল ফাইনাল টাচ। আমি তোমাদের সরিয়ে আনলাম না ওখান থেকে তার কারণ ছিল। আমি তারপর একদিন আসিফের কাছে গেলাম। খোশগল্প করার ভান করে। সে তো চা বিস্কুট মিষ্টি সব ব্যবস্থা করল। তখন আমি এটা-ওটা বলার পর বললাম। কাব্য চৌধুরীর কেস টা আর কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছেনা। রবার দের ধরা গেল না। এখানে তো আর কোনো ক্লু পেলাম না। দেখা যাক। অন্যকোথাও পাওয়া যায় কিনা। এত কেস তার উপরে। আপাতত বন্ধ করতেই হচ্ছে এটা…. তারপর আরও অনেক কথার মাঝে এটাও বললাম তোমাদেরকেও ডেকে নিতে বাধ্য হলাম।অন্য কেসের এত চাপ বলে। ব্যাস ওকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিলাম ওর উপর বা রিচার উপর বা কারোর উপর ই আর নজর রাখা হচ্ছেনা।
(বলেই দেবোপম টেবিলে একবার করাঘাত করলেন)
–“আপনি জিনিয়াস স্যার। (তখন পরিতোষ প্রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো)
দেবোপম তখন একটু হেসে আবার সিরিয়াস হয়ে গেলেন।
–“কিন্তু পরিতোষ আমাকে দুটো ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে।
–“কি ব্যাপার স্যার?
–“রিচার খুন টা সব ঘেঁটে দিল। প্রথমত ল্যাক অফ স্ট্রং মোটিভ। মানে আসিফের একটা মোটিভ আছে ঠিকই।কিন্তু সেটা একটা খুন করার মতো না। মানে অতটাও স্ট্রং নয়। আর সেকেন্ডলি এই আসিফ। এই লোকটা ধুরন্ধর হতে পারে। কিন্তু বড্ড ভীতু গোছের। ভেবেচিন্তে খুন করার যথেষ্ট সাহসের দরকার। এই লোকটার সেটা আছে বলে মনে হয়না।
–“মানে কি বলতে চাইছেন আপনি! আসিফ খুন করেনি। কিন্তু ওকে তো আমরা ক্রাইম সিন থেকেই….. (পরিতোষ অবাক)
–“হ্যাঁ জানি। কিন্তু ওকে তো আমরা অনস্পট ক্রাইম করতেও দেখিনি। মার্ডার ওয়েপন হাতেও দেখিনি।
যদি ওর কথাটা সত্যিই হয়, যদি সত্যিই কেউ ওকে ফোন করে আসতে বলে, কোনো কিছু বলে আর সেই ফাঁদে ও পা দেয়। মানে হাইপোথেটিক্যালি হতে পারেনা এমন নয়। ডি.এন.এ টেস্টের রেজাল্ট হাতে না পেলে বলা যাবেনা।
–“আপনার বলার পর আমারও মনে হচ্ছে আসিফের মোটিভ টা স্ট্রং নয় তবুও। ওরকম কিছু হওয়াটাও আনকমন কিছু। দেখা যাক রিপোর্টে কি আসে। (পরিতোষ সমর্থন করলেন)
.
.
.
তারপর দেবোপম কে অতিরিক্ত চিন্তিত দেখাচ্ছে দেখে পরিতোষ আর ঘাঁটাবে কিনা বুঝে উঠতে পারলোনা।
রিচার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কিছুটা চমকে যাওয়ার মতোই। রিচা মৃত্যুকালীন সময়ে অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সেটুকু অনেক আগেই জানতে পেরেছিলেন দেবোপম। কিন্তু যে রিপোর্ট টা তার হাতে এসেছে, সেটা তাকেও অবাক করে দিয়েছে। রিচার গর্ভের সন্তানের বাবা মৃত কাব্য চৌধুরী না। অন্য কেউ। আর সবথেকে আশ্চর্যর ব্যাপার হচ্ছে। মার্ডার ওয়েপনে রিচার ছাড়া আর কারোর ডিএনএ পাওয়া যায়নি, কিন্তু গ্লাভস আর কোট থেকে রিচাকে বাদ দিলে অন্য আর একজন যার ডি.এন.এ পাওয়া গেছে সেটা আসিফের নয়। আর সবথেকে আশ্চর্যের কেসটা হল যে অপরিচিত মানুষ বা সম্ভাব্য খুনীর ডি.এন.এ পাওয়া গেছে রিচার গর্ভস্থ সন্তানের বাবাও সে। রিপোর্ট গুলো পাওয়ার পর প্রথমে বেশকিছুক্ষন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়েছিলেন দেবোপম। চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে গেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উনি কয়েকজন কনস্টেবল কে পাঠালেন অরূপের খোঁজে। তখন থেকেই গজগজ করছেন। তারপর পরিতোষ দ্বিধাভরে প্রশ্ন করলো।
–“স্যার আপনার সন্দেহ টাই সত্যি হল। মানে আমি এখনও ভাবতে পারছিনা। অরূপ ই শেষমেশ।
দেবোপম তখন রাগে ফেটে পড়লেন। আর বললেন।
–“ওই স্কাউন্ড্রেলটা নিজের সন্তানকে পর্যন্ত হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করলনা। রিচা ওকে জানায়নি এমন তো হতে পারেনা। কিন্তু পরিতোষ ও কি পেল এসব করে! মানুষ সত্যিই বিচিত্র জীব বুঝলে। সত্যিই বিচিত্র জীব।
এ মুহুর্তে পরিতোষ কি বলবে ভেবে পেলোনা, শেষমেশ সেও বললো।
–“সত্যি স্যার নিজের সন্তান কে। আমার তো এক ছেলে। ওর জন্যই সবকিছু করি। আর এই এখানে খাটাখাটনি করার পর যখন বাড়ি ফিরি, ওর মুখ টা দেখেই শান্তি পাই। জানেন স্যার এরা না বাবা হওয়ার যোগ্য ই না।
–“সত্যি পরিতোষ। মানুষ নিজের সন্তানের জন্য অনেকদূর যেতে পারে। আর এতো নিজের সন্তান কেই………..
কথা শেষ হবার আগেই কয়েকজন কনস্টেবল একজন কে ধরে নিয়ে এলো। নীল টিশার্ট, কালো প্যান্ট, কোঁকড়ানো চুল, মোটের উপর মাঝারি মুখশ্রীর ছেলেটা কাঁদোকাঁদো মুখ। হাত জোর করে আসার পর থেকে একটাই কথা বলে যাচ্ছে, “আমি কিছু করিনি স্যার। কনস্টেবল দের মধ্যে একজন যার নাম সমরেশ সে এগিয়ে এলো দেবোপমের কাছে, তারপর স্যালুট ঠুকে বললো।
–“স্যার পালাতে যাচ্ছিল। আমাদের দেখেই। ঘরে গিয়ে দেখলাম ব্যাগপত্র গোছানো। পার্স থেকে একটা রাজধানীর ঢাকা বাসের টিকিট ও পাওয়া গেছে।
দেবোপম তখন অরূপের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন।
–“একি না বলেই পালিয়ে যাচ্ছো ভায়া।
–“আমি কিছু করিনি স্যার। বিশ্বাস করুন। (অরূপ বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো)
–“তাহলে পালাচ্ছিলে কেন বাবা! +দেবোপম রসিয়ে রসিয়ে বললেন)
–“আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম!
–“ভয় পেয়ে গেছিলে। এমা কেন?
–“আমাকে একজন ফোন করে বলল আমার কোট, গ্লাভস পরে একজন রিচাকে খুন করেছে। পুলিশ আমাকে ধরতে আসছে। আমি তাই……..
–“আরে বাপরে। তুমি তো ভয়ংকর স্ক্রিপ্ট লিখতে পারো। মানে সত্যি। এককাজ করো তুমি ভেবে নাও আর কে কি বলেছে……
ততক্ষণ দেবোপম সমরেশের দিকে মুখ করে বললেন।
–“ওর একটু খাতির করো। আপ্যায়নে যেন ত্রুটি না থাকে দেখো।
সমরেশ ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো।
–“আচ্ছা স্যার। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।
তারপর দুজন কনস্টেবল অরূপ কে ধরে নিয়ে গেল। অরূপ পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলো।
–“বিশ্বাস করুন স্যার। আমি সত্যি কিছু করিনি। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।
কিন্তু দেবোপম সেদিকে কান না দিয়ে সমরেশ কে বললো।
–“ওর ঘর এবং ঘরের চারপাশ ভালো করে সার্চ করো।
সমরেশ উত্তর দিলো।
–“স্যার রাজ,রোহান এবং নীলয় ওখানেই আছে। ওরা সার্চ করছে।
–“বেশ। তুমিও যাও। আর কিছু পেলে খবর দিও।
–“ইয়েস স্যার।
(বলে সমরেশ স্যালুট ঠুকে বেরিয়ে গেলে। আর তখন পরিতোষ দেবোপমের কাছে এসে দাঁড়ায়।
দেবোপম ওর দিকে ঘুরে সহাস্য দৃষ্টিতে বললেন।
–“কি বুঝলে পরিতোষ!
–“কি সাংঘাতিক লোক স্যার এই অরূপ। কিন্তু ওর আর বেরোনোর রাস্তা দেখছিনা। কেসটা আমার কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেছে।
–“কিরকম শুনি……
(দেবোপম একটা সিগারেট ধরালেন)
তারপর পরিতোষ গড়গড় করে বলতে লাগলো।
“কাব্য চৌধুরী কে সরানোর প্ল্যান টা রিচা আর অরূপ দুজনে মিলেই করেছিল। তারপর কাব্য চৌধুরীকে খুন করে কেসটাকে রবারির কেস বলে চালিয়ে দেওয়া।আর সত্যি বলতে সেরকমই মনে হয়েছিল। রিচা হয়ত প্ল্যান করেছিল সবকিছু মিটে গেলে দুজনে সরে যাবে। তারপর হয়ত রিচা আর অরূপের কোনো কারনে ঝামেলা হয়। হয়তো কোনোকিছু নিয়ে। রিচা হয়তো এমনি বলেছে আমি ফেঁসে গেলে তুমিও ফেঁসে যাবে এরকম কিছু। তখন হয়তো অরূপ ভয় পেয়ে যায়। তাই রিচাকেও সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করে। যেহেতু অরূপ জানেনা আমরা ওর উপরে নজর রাখছি, আর রিচাও ওর সম্বন্ধে কিছু বলবেনা তাই ওকে কেউ কোনোদিন ধরতে পারবেনা। এর মাঝে হয়ত আসিফের কথাটা ওর মাথায় আসে। রিচাকে ও যে বিরক্ত করতো বা কুপ্রস্তাব দিত এটা নিশ্চয় রিচা ওকে বলেছে। ও তাই আসিফকে ফাঁসানোর জন্যই হয়ত ফোন করে ওখানে ডেকেছিল।
(এটুক বলে পরিতোষ একটু থামলো)
–“মোস্ট প্রিসাইজলি….
দেবোপমের চোখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। হয়তো অধঃস্তনের স্বতঃস্ফূর্ততা তাকে প্রভাবিত করেছে।পরিতোষকে দেবোপম পছন্দ করেন। কারন তার মনটা খুব পরিষ্কার। পুলিশের চাকরিতে এসেও সে নিজেকে সরল রাখতে পেরেছে। আর তাছাড়া সে সবসময় দেবোপমের প্রশংসা করে। দেবোপম এটাও জানে যে পরিতোষ তাকে রোলমডেল মনে করে। তাই কোনো কেসের কোনো চিন্তাভাবনা কিছু বলার থাকলে তিনি পরিতোষ কে বলেন। এরকম একজন সাগরেদ কার ই না ভালো লাগে!
এদিকে একটু থেমে পরিতোষ আবার বললো।
–“কিন্তু একটা জিনিস আমাকে ভাবাচ্ছে স্যার। অরূপ যদি খুন টা করেই থাকে তাহলে ওর কোট, গ্লাভস গুলো পাশের ড্রেনে কেন ফেলে দিলো?
দেবোপম তখন তার গাল ছুলকে প্রশ্ন করলেন।
–“আচ্ছা তুমি বলো, আসিফকে যদি তোমার ফাঁসানোর হতো তুমি কি করতে! ওকে ধরো ফোন করে ওখানে ডাকলে। পুলিশও দেখতে পেলো। কিন্তু মার্ডার ওয়েপন, কোট, গ্লাভস মনে করো অন্যকোথাও পেলে। ওর হাতে মনে করো রক্তের ছিটেফোঁটাও লেগে নেই, ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁসাতে পারতে কি?
–“সেটাও ঠিক। অরূপ হয়ত ভেবেছে কোট, গ্লাভস এগুলো পেলে আর সিনে আসিফকে দেখলেই হয়ত কাজ টা মিটে যাবে। কিন্তু আর একটা ব্যাপার স্যার! অরূপ কি করে মেনেজ করলো কেসটা! না মানে এটা তো বুঝলাম কোট গ্লাভস কেন রেখে এসেছিল। আসিফ কে ফোন ও করেছিল। কিন্তু আমরা যে ওই সময়েই ঢুকবো! মানে আমরা গিয়েই যে আসিফকে ক্রাইম সিনে পাবো, ওর পালিয়ে যাওয়ার আগেই সেটা কি করে!
দেবোপম তখন মৃদু হেসে বললেন।
–“এতটা যখন তুমি বললে। বাকিটা তুমিই ভেবে বলো।
পরিতোষের হঠাৎ চোখদুটো জ্বলে উঠল।
–“দাঁড়ান। দাঁড়ান। বুঝেছি স্যার। আসিফের ঘর থেকে বেরোনোর কল টা যে করে যে জানিয়েছিল আপনাকে সেটা………
ওর কথা শেষ করার আগেই দেবোপম বলে উঠলো।
–“ওটা আসিফ ছিলনা। আমার প্রথমে তাই মনে হয়েছিল। কারণ আমি আসিফকে বলেছিলাম জানাতে। ফোনটা যখন পেয়েছিলাম তোমাদেরও তাই বলেছিলাম। কিন্তু দুটো জিনিস খটকা লাগে আমার। সেটা বলার আগে বলি। আসিফকে কিভাবে খবর দিতে বলেছিলাম…
আমি মাঝে একবার আসিফ সাহেবের সাথে গিয়ে তার স্ত্রীর সাথে দেখা করি। আসিফ তখন কাজে বেরিয়েছিল। আমি ওর স্ত্রীকে বোঝায় যে আমরা খবর পেয়েছি আসিফ সাহেবকে একজন ব্ল্যাকমেইল করছে। কি নিয়ে সেটা এখনো জানা যাচ্ছেনা। কিন্তু ভয়ংকর কিছুই। আপনার হাজবেন্ডের লাইফ রিস্ক থাকতে পারে। উনি পুলিশেও খবর দেননি, এমনকি আপনাকেও জানিয়েছেন বলে মনে হয়না। আমরা ওনার উপর নজর রাখছি অনেকদিন…
তখনই জানতে পারি…ভদ্রমহিলার তো হাত পা শুকিয়ে যাওয়া মতো অবস্থা। তো ওনাকে তারপর বললাম।
এর মধ্যে সন্ধ্যে রাতের দিকে আসিফ সাহেব যদি কোথাও আপনাকে না জানিয়ে বেরোন আপনি অবশ্যই খবর দেবেন। ভদ্রমহিলা একপায়ে রাজী হয়ে যান। সেখান থেকেই। কিন্তু..প্রথম যে ফোনটা আসে সেটা আসে একটা ল্যান্ডফোন থেকে। তখন তাড়াহুড়োর জন্য খেয়াল করিনি। আমি বেরিয়ে পড়েছি ততক্ষণে তোমাদের সাথে। তার কিছুক্ষণ পর আবার ফোন আসে। এবার আসিফের। ও ফোন করে একথা আমাকে জানায়। কিন্তু আমরা ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছিলাম।এটা আমাকে ভাবিয়েছিল। পরে আসিফকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর সেইজন্যই তোমাকে বলেছিলাম আমার মনে হয়না আসিফ খুন করতে পারে।”
পরিতোষের চোখ আবার জ্বলজ্বল করে উঠল। একরাশ মুগ্ধতা সেই দৃষ্টি তে। যেন একজন আইডল যে তার থেকে অনেক ক্রোশ এগিয়ে আছে, তাকে ছোঁওয়ার চেষ্টা করা। সেই চেষ্টার মধ্যেও একটা তৃপ্তি আছে।
.
.
.
এরপর দেবোপম আর অরূপ মুখোমুখি। দেবোপম একটা চেয়ারে বসে। অরূপ হাত পা বাঁধা অবস্থায় আর একটা চেয়ারে। তার সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ এভাবেই চলে। বিশেষত অপরাধী দের সঙ্গে। অরূপ প্রায় ক্লান্ত। ওর কথা বলার ও ক্ষমতা নেই। একজন কনস্টেবল তখন ওর থুতনি ধরে মুখটা তুলে ধরে আছে। দেবোপম কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুখ খুললেন।
–“তোমার বাড়ির বাগান থেকে রিচার বাড়ি থেকে চুরি যাওয়া দশভরি সোনা পাওয়া গেছে। তুমি কিছু বলতে চাও!
কথাটা শুনে অরূপ মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো।
–“আমি কিছু জানিনা স্যার। সোনার ব্যাপারে। সত্যি বলছি। অন্যকেউ হয়ত……..
দেবোপম তখন রেগে গেলেন।
–“চুপ একদম চুপ। অনেক নাটক হয়েছে। তোর পালানোর আর কোনো রাস্তা নেই। এই ন্যাকাপোনা বন্ধ কর।
কিন্তু অরূপ অনড়…
–“সত্যি বলছি স্যার?
–“তোর কোট গ্লাভস পাওয়া গেছে ক্রাইম সিনের পাশ থেকে। হয়ত জানিস না। যতই কাদাজলে ফেলে রেখে যা, ডি.এন.এ টেস্টের মাধ্যমে তোর ডি.এন.এ-র স্যাম্পলে পাওয়া যাবে!
(দেবোপম অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন।)
–“স্যার আমাকে একজন অচেনা লোক ফোন করে বলেছিল আমি যেন গ্লাভস আর কোট পরে একজায়গায় গিয়ে দুটো খুলে রেখে চলে আসি।
–“বা বা বা… দারুন তো। আর তুই রেখেও এলি বাধ্য ছেলের মতো।
–“আসলে স্যার। আমি রিচাকে ভালোবাসতাম। কে কখন কিভাবে জানিনা আমার আর রিচার ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি তুলে নিয়েছিল। যেদিন ফোন টা আসে।সেদিন সকালে একটা চিঠি আসে। সেখানে সেই ছবি গুলো ছিলো। তারপর সেই ফোন টা আসে। সেই লোক টা বলে আমি যদি ওগুলো না করি তাহলে ওই ছবিগুলো ও পুলিশের কাছে পৌঁছে দেবে। ওগুলো আপনাদের হাতে এলে স্যার আপনারা আমাকেই সন্দেহ করতেন। তাই স্যার ভয়ে…….
অরূপের কথা শেষ হবার আগেই দেবোপম কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারলেন।
–“অনেক হয়েছে। গাঁজাখুরি গল্প। তোর মতো জানোয়ারের হয়ত যাই আসেনা, কিন্তু ওই রিচা মেয়েটির গর্ভে তোর মতো কুলাঙ্গারের সন্তান ছিল। তোকে ভালোবেসে নিজের স্বামীকে পর্যন্ত……..
আর তুই……..
কথা বলেই দেবোপম উঠে বেরিয়ে এলেন।
.
.
চলবে……………..
.
বিঃদ্রঃ পাঠকদের কি মনে হয়? আসল খুনি কে?