মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১০
জীবনের আঠারোটা বসন্ত পেরিয়েছে এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়নি কখনো মোনা। শুধু একবার বাসে বসে হেনস্থার স্বীকার হয়েছিল। এক বয়স্ক লোক মোনার পিছনের সিটে বসেছিল, লোকটা বার বার ঘাড়ের কাছে হাত দিচ্ছিল। মোনা প্রথম ভেবেছিল অনিচ্ছাকৃত ভাবে হয়ত, কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছে এটা অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ না। মোনা চেঁচিয়ে উঠলো, লোকটাকে কড়া কিছু কথা বলল। লোকটা দমে গেল। মোনা অবাক হয়ে যাচ্ছিলো, লোকটার বয়স মোনার বাপের বয়সের থেকেও বেশি হবে। অথচ লোকটা কত নিকৃষ্ট, জঘন্য।
আমরা নারী,আমাদের অনেক কিছু বুজেঁ সহ্য করতে হয়। ধর্ষিতা হলেও সমাজের কাছে বলা যায় না! অথচ ধর্ষক বুক ফুলিয়ে থাকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এসবের জন্য দায়ী। মোনা সারারাত মুখে ওড়না গুঁজে কেঁদেছে, আবার কখনো তীব্র কষ্টে চাপা চিৎকার দিয়েছে, আর্তনাদ করেছে। মোনার কাছে প্রতিটি মূহুর্ত ঘন্টাসম মনে হয়েছে, আজ যেন সকাল হতে খুব বেশি সময় লাগছে। মোনার হাত-পা কাঁপুনি থামছে না যেন। বার বার আতংকে মোনার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠছে। এমন ভয়াবহ রাত মোনার জীবনে আজ নিয়ে তিনবার এসেছে! ওর মা’কে যেদিন মেরে ফেলেছিল, আর একবারের কথা মোনা মনে করতে চাচ্ছে না। মোনা আজকের রাতের কথা কারো কাছে বলতে পারবে না,এমন বিশ্রী কথা কিভাবে বলবে? কেউ জানবে না এ কথা। মোনার চোখ লাল হয়ে ফুলে গেছে, প্রচণ্ড ভাবে প্রদাহ হচ্ছে চোখে। কান্নার ফলে মাথা তীব্র ভাবে ব্যথা করছে। মোনার চোখ দু’টো একবারে ছোট হয়ে গেছে । মোনা চোখ মেলে তাকায়, দেখে সকাল হয়ে আসছে। মোনা উঠে দাঁড়ায়, তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। এ বাসার মানুষের ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি। মোনা নিশান কে জোর করে ঘুম থেকে টেনে তুলে। মোনার এমন আচরণের কারণ বুঝতে পারছে না নিশান।
মোনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। জ্যাক’কে কি বলবে?জ্যাক যদি কোন সাহায্য না করে? তাহলে কি হবে,কোথায় যাবে?
নানান শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে যায় মোনা।জ্যাকের ঘুম এত তাড়াতাড়ি ভাঙে না। মোনা জ্যাকের নম্বরে ডায়েল করে অনেকবার, ফোন রিসিভ করছে না। মোনা হতাশ হয়ে ফোন হাত থেকে রেখে, ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। নিশান মোনার দিকে তাকাচ্ছে বার বার। কিছু বলতে চাচ্ছে ও। কি হয়েছে মোনার জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে।
জ্যাকের নম্বরে আবার ফোন দিতে সংকোচ হচ্ছে। এত স্বল্প পরিচয়ের একজন মানুষের কাছে এভাবে হেল্প চাওয়া? রাতের কথা ভাবতেই সমস্ত সংকোচ কেটে যায়। আবার ফোন দেয় জ্যাকের নম্বরে। তিন বারের মাথায় ফোন রিসিভ হয়। মোনা কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে কথা বলছে না,হয়ত সদ্য ঘুম ভাঙার ফলে। মোনারও কথা বলতে ইতস্তত বোধ হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ঘুম জড়ানো গলায় জ্যাক বলে,
-“কে বলছেন?”
মোনা কণ্ঠ’টা দুর্বল শুনাচ্ছে।একটা অস্থির ভাব বিদ্যমান গলায়। উতলা হয়ে বলে,
-“জ্যাক আমি মোনালিসা বলছি। আমার একটু হেল্প লাগবে, ইমেডিয়েটলি! প্রীজ না করবেন না।”
মোনার গলা শুনে মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বর কিছু ঘটেছে। জ্যাক কিছু’টা বিগড়ে যায়। চমকানো গলায় বলল,
-“মোনালিসা কি হয়েছে আপনার?আর ইউ ওকে? কোন বিপদে পড়েছেন?”
-“আমি খুব বিপদে পড়েছি। প্লীজ আমায় হেল্প করুন।”
মোনার ঘাবড়ে যাওয়া গলা শুনে জ্যাক তড়াক করে বিছানা ছাড়ে। জিজ্ঞেস করে,
-“পথ হারিয়েছেন?”
-“না বাসা হারিয়েছি।”
-“আপনি কোথায় আছেন?বলুন আমায়। আমি আসছি। আপনি এত নার্ভাস হবেন না। এড্রেস দিন।”
এত’টা ক্লেশ, পীড়া কিংবা আতঙ্কের মাঝেও মোনা ভরসা পেল।
-“ওইদিন যে বাসায় আপনি পৌঁছে দিয়েছিলেন,ওই বাসার কাছাকাছি আসুন। বাসার সামনে আসতে হবেনা।”
জ্যাক তাড়াহুড়ো গলায় বলে,
-“আসছি,আসছি। ওয়েট।”
মোনা এক মুহূর্ত নষ্ট না করে নিশান কে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। গেট থেকে বেরুতেই দেখে একটু দূরে জ্যাক গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোনা ভরসা পেলো,আস্থা পেলো। দ্রুত পায়ে জ্যাকের কাছে গেলো। জ্যাক ভ্রু কুঁচকে তাকালো মোনার দিকে।মোনার হাল দেখে বলল,
-“একি অবস্থা। কি হয়েছে আপনার?কোন সমস্যা হয়েছে?”
মোনা এসবের জবাব না দিয়ে বলল,
-“একটা উপকার করতে পারবেন?থাকার জন্য আমায় একটা বাসার ব্যবস্থা করে দিন।আমি বিপদে পড়েছি খুব।”
-“বিপদের কথা পরে শুনবো। গাড়িতে উঠুন।আগে আমার বাসায় চলুন। আরে আমি তো আছি,এত অস্থির কেন হচ্ছেন?”
জ্যাক নিশানের দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। মোনা নিস্তেজ গলায় বলল,
-“আমার ভাই।”
জ্যাক ফের নিশানের দিকে তাকিয়ে এক চিলতে হাসি দিলো। মোনা ক্লান্ত শরীর নিয়ে গাড়িতে উঠলো। জ্যাক গাড়ি স্টার্ট করলো। মোনা ফ্যাকাশে মুখে বসে থাকে। আজ ভার্সিটি তে যাওয়ার কথা ছিলো। জীবনের ঘোড় ঘুরতে এক মুহূর্তও লাগেনা। মোনা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলছে। মোনা জ্যাকের দিকে তাকিয়ে নিরুপায় হয়ে বলল,
-“একটা বাসায় ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন না?আর একটা পার্টটাইম জব। আপনি তো এখানকার পরিচিত।”
প্রত্ত্যুতরে জ্যাক হাসলো। কিছুক্ষণ পর বলল,
-“একটা কথা বলুন তো সত্যি করে, আপনি সাথে আসলে কি হয়েছে? ওইদিন রাতে কি হয়েছিল?আর আজকেও বা কি হয়েছে? আমার উপর ভরসা রাখুন।সব সমস্যার সমাধান করে দিবো।”
মোনা জ্যাকের দিকে নিঃসাড় দৃষ্টিতে তাকালো। জ্যাক বলল,
-“আচ্ছা থাক, বাসায় গিয়ে শুনবো।”
মোনা কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকলো। মাথায় নানা রকমের চিন্তা ঘোরপাক খাচ্ছে। মোনা অসহ্য হয়ে যাচ্ছে।জ্যাকের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আবার বলল,
-“জ্যাক বললেন না তো? হেল্প করবেন?”
-“যদি না করি তাহলে কোথায় যাবেন বলুন তো?”
মোনার গলা ধরে আসছে। জ্যাক হেল্প না করলে কোথায় যাবে? মোনা আতংকিত হয়ে যায়। ত্রসন হয়ে মন্থর গলায় বলল,
-“বাংলাদেশ ফিরে দিতে হবে।”
জ্যাক বাসার কাছে এসে গাড়ি থামালো। মোনা আর নিশান কে গাড়ি থেকে নামতে বলল। নিশান বিরক্ত হয়ে মোনার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মোনা নিশান কে নিয়ে জ্যাকের পিছনে পিছনে গেলো।
-“রুম তো চিনেন নাকি?রুমে যান রেস্ট নিন। সব কথা পরে শুনছি।”
মোনা নিশান কে নিয়ে রুমে গেলো। মোনার ভয় যে পুরোপুরি কমে গেছে তাও না। মোনা অনিশ্চিয়তায় ভুগছে। শুধু ভাবছে এই গল্পে শেষ কথায়? জীবনটা দিন দিন জটিল হয়ে যাচ্ছে। জটিল ধাঁধায় পড়লো মোনা।
মোনা রুমে এসে খাটে বসলো। জ্যাক’কি আসলেই এত ভালো মানুষ? নাকি এই রূপের পিছনে,অন্য রূপ আছে? মোনা জীবনে এতসব বিপদে পড়েছে যে মানুষ কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় খুব। জ্যাক যদি জিজ্ঞেস করে কি বিপদে পড়েছে তাহলে কি বলবে?এসব কিছুতেই বলা যাবে না। বিচিত্র রকমের চিন্তা-ভাবনায় প্রিন্সেসের কথা জিজ্ঞাস করতে ভুলে গেছে মোনা।
___
লিলি বেগম দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠে। মোনা তো এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। লিলি বেগম মোনার রুমে গেলো। মোনা,নিশান কেউ নেই রুমে। লিলি বেগম ছাদে গেলো,পুরো বাড়িতে খুঁজলো। কোথায়ও দেখলো না। বাসার বাইরে তো কখনো যায়না ওঁরা। লিলি বেগম প্রিয়মের রুমে গেল দ্রুত। প্রিয়ম ঘুমাচ্ছে। প্রিয়ম কে ঘুম থেকে তুলে চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করল,
-“মোনা কোথায়?নিশান কোথায়? ওদের তো দেখছি না।”
হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারণে প্রিয়ম কিছুই বুঝতে পারলো না। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে রইলো লিলি বেগমের দিকে কিছুক্ষণ। বিরক্ত ভরা গলায় বলল,
-“আম্মু! কি শুরু করলে সকাল সকাল? আমি বলবো কিভাবে?”
প্রিয়ম আবার ঘুমানোর জন্য চোখ বুঁজে। লিলি বেগম চিৎকার করে উঠে,
-” নিশান আর মোনা কে কোথায়ও দেখছি না। আর তুই বলছিস জানিস না? কোথায় নিয়ে গেছিস ওদের বল?”
প্রিয়ম চোখ খুলে হতাশ ভঙ্গিতে তাকায় লিলি বেগমের দিকে।ঘুমে প্রিয়মের চোখ আবার লেগে আসছে।ঘুমে জড়াগ্রস্থ মস্তিষ্কে লিলি বেগমের কথা যেন বুঝতে পারলো না।
(চলবে)