#My_First_Crush
#পর্ব-০৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
সকালের এক ফালি রোদ মুখের উপর গাঢ় হতেই ঘুম ভেঙে গেলো আমার। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আস্তে করে উঠে বসলাম। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে লাগলো। নিজেকে বিছানার উপর আবিষ্কার করতেই খানিক অবাক হলাম। তৎক্ষনাৎ কিছু মনে পড়লো না। পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। স্মৃতি কুঠুরিতে ধরা পড়লো গতকাল রাতের কথা। সেই যে অদ্ভুত চকলেট খেয়ে ক্যাবে উঠলাম তারপর আর শত চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারলাম না। দ্রুত বিছানা হাতড়ে ফোন খুঁজে বের করলাম। কল লাগালাম জেরিনকে। জেরিন ফোন রিসিভ করেই বলল,
‘ঘুম ভেঙেছে তবে ড্রামাকুইনের। বাপ রে, কাল রাতে যে কান্ডগুলো করলি!’
আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘কি করেছি আমি?’
‘মনে নেই তোর?’
‘তুই তাড়াতাড়ি বল।’
এরপর জেরিন আমাকে অদ্যপান্ত সব খুলে বলল। আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
‘কি! আমি রাইয়ানকে কিস করেছি!’
‘হুম।’
‘তুই আমাকে আটকালি না কেন?’
‘তুই তখন পুরো অন্য হৃদিই হয়ে গিয়েছিলি। তোর এই রূপ কখনো দেখিনি আমি। তোকে আটকানোর ক্ষমতা আমার সাত পুরুষের হাতেও তখন ছিল না।’
আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। করুণ গলায় বললাম,
‘তারপর?’
‘কি তারপর?’
‘তারপর ভেতরে যাবার পর কি হয়েছে?’
‘ভেতরে যাবার পর কি হয়েছে তা আমি কিভাবে বলবো? আমি কি তোদের সাথে বাসার ভেতরে গিয়েছিলাম নাকি!’
আমি ফোন রেখে দিলাম। গায়ের চাদর মুখে পুরে মনে করার চেষ্টা করলাম বাকিটা। হঠাৎ আমার নজর পড়লো আমার গায়ের উপর। যতদূর আমার মনে পড়ে গতরাতে আমার পরনে ছিল একটি চেকচেক ডিজাইনের টপস আর ব্লু জিন্স। কিন্তু এখন তার পরিবর্তে নাইট পাজামা। আমার মুখ হা হয়ে গেলো। আমার ড্রেস চেঞ্জ হলো কিভাবে? কি হয়েছিল কাল রাতে? বাইরে থাকতেই আমি এমন আচরণ করেছি তাহলে ভেতরে আসার পর ঠিক কি করেছি? চিন্তায় আমার মাথা গুলিয়ে উঠলো। তার মানে কি গতরাতে আমি রাইয়ানের সাথে…..
বিছানার সাথে ঠাস করে হেলান দিয়ে পড়লাম। আবারও আস্থাহারা চোখে গায়ের উপর থেকে কম্ফোর্টার সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে নিজের উপর নিজেই বিরক্ত ও অতীষ্ট হয়ে বললাম
‘ওহ হৃদি! সামান্য একটু হুঁশ হারাতেই তুই এতোটা বেপরোয়া কি করে হয়ে গেলি! এখন আমি সত্যিটা জানবো কিভাবে?’
গুটি গুটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। দেখতে পেলাম রাইয়ান অফিসে যাবার তোড়জোড় করছে। অ্যাশ কালারের ফরমাল শার্টের সাথে ম্যাচ করে পরা ঘড়ির ফিতা লাগাচ্ছে সে। অনতিদূরেই আমি গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার দিকে চেখ পড়তেই রাইয়ান জিজ্ঞেস করলো,
‘কিছু বলবে?’
আমি মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু গলায় কোনমতে বললাম, ‘গতরাতে আমি বাসায় ঢোকার পর কি হয়েছিল?’
এবার আমার দিকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িলো রাইয়ান। দু হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
‘তোমার কিছু মনে নেই?’
আমি আস্তের উপর মাথা নাড়ালাম। আড় চোখে একবার দেখে নিলাম রাইয়ানকে। রাইয়ান আমার দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগলো। আর টেনে বলতে লাগলো, ‘গতরাতে.……তুমি…..’
বুকের মধ্যে ধকধক করা শুরু হয়ে গেলো আমার। কাছাকাছি চলে এলে ইতস্ততার সাথে আমিও এবার এক পা এক পা করে পিছুতে লাগলাম। রাইয়ান আগাতে আগাতে বলল, ‘গতরাতে তুমি আমার…..’
পিছনে যেতে যেতে আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলো।
আমি আমার লজ্জিত মুখ যতই তার দৃষ্টি থেকে লুকাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। ততই আমার দিকে তার রহস্যময় গভীর দৃষ্টি তুলে ধরতে লাগলো রাইয়ান। আমার মুখের উপর ঈষৎ ঝুঁকে এসে থমকে গিয়ে অবশেষে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে নালিশের স্বরে রাইয়ান বলল,
‘গতরাতে তুমি আমার উপর বমি করে দিয়েছো?’
আমি বিস্ময়ের সাথে ঝট করে মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম। অবাক গলায় বললাম,
‘বমি করে দিয়েছি?’
‘হ্যাঁ, বমি করে দিয়েছো।’
এরপর রাইয়ান মনে করালো কিভাবে তখন সোফার উপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মুখের হঠাৎ পরিবর্তন বুঝতে পেরে আমাকে ধরে তাড়াতাড়ি উঠে বসাতে যায় রাইয়ান। কিন্তু তার আগেই আমি রাইয়ানের বুকের উপর বমি করে দেই। অগত্যা চোখ মুখ কুঁচকে সবটা সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না বেচারার।
আমি অপ্রস্তুতার সাথে একসেটে হয়ে পড়লাম। রাইয়ান শাসনের সুরে বলতে লাগলো, ‘হৃদি, আর কিন্তু এসব উল্টাপাল্টা কিছু খাওয়া চলবে না। তোমাকে সামলানো অনেক কঠিন। সারারাত আমাকে তোমার আর আমার জামাকাপড় ধুয়ে কাটাতে হয়েছে। ও হ্যাঁ! জামার কথায় মনে পড়লো, তোমার যেহেতু কিছু মনে নেই তাই আগেই বলে দেই, তোমার ড্রেস তুমিই পাল্টেছিলে। এখন হয়তো ভুলে যেতে পারো।’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে লজ্জিত গলায় বললাম,
‘সরি রাইয়ান।’
রাইয়ান প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টারের মতো গলায় বলল, ‘হুম।’
আমি তাড়াতাড়ি রাইয়ানের সামনে থেকে কেটে পড়তে লাগলাম। রাইয়ান ঠোঁট চেপে হেসে পেছন থেকে হঠাৎ বলে উঠলো, ‘কিন্তু…. ‘
আমি থমকে দাঁড়ালাম। রাইয়ান বলল,
‘একটা জিনিস খেয়াল করলাম, তুমি বেশ ভালোই নাচতে পারো। গানটা যেন কি ছিলো? Fish want…. to fly, Bird’s want to….swim.
আমি চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম। লজ্জায় একদমই মাথা কাটা গেলো আমার।
______________________
হৃদির যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই রাইয়ানের হঠাৎ গতকালের কথা মনে পড়ে গেলো, যখন হৃদির বাড়িতে নিজের ছবি দেখে রাইয়ান সোজা চলে গিয়েছিল জিশানের অফিসে। রাইয়ানকে সোফার উপর ওমন গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে জিশান কাজের ফাঁকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কিরে, কি ভাবছিস ওমন করে?’
রাইয়ান বলল, ‘হৃদি মনে হয় আমাকে বিয়ের আগে থেকেই পছন্দ করে।’
‘হুম, তো কি হয়েছে?’
জিশানের এমন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখে রাইয়ান বলল, ‘তুই কোন অবাক হলি না?’
‘অবাক হবার কি আছে? আমি তো সেই আগে থেকেই বুঝেছি।’
রাইয়ান অবাক হয়ে বলল, ‘আগে থেকেই বুঝেছিস!’
‘না বোঝার এখানে কি? পছন্দ না করলে কি কেউ কাউকে বিয়ে করে। আমরা সেই আগের যুগে তো নেই যে, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে ফ্যামিলি দেখে বিয়ে ঠিক করে ফেললো আর মেয়ে বিয়ে করে নিলো। দেখ, তোর উপর দাদীমার প্রেশার ছিল। হৃদির উপর তো আর কারো প্রেশার ছিল না। তবুও ও বিয়েতে রাজী হয়েছে কেন? অবশ্যই তোকে পছন্দ করে বলে।’
‘তার মানে কি তুই বলছিস এটা স্বাভাবিক?’
‘হুম।’
এতক্ষণ ভবিষ্যৎ ভাবনার বিপরীতমুখী ভাব দেখে রাইয়ান যে উদ্বিগ্ন ছিল জিশানের কথায় একটু স্বাভাবিক বোধ করলো সে।
বাস্তবতায় ফিরে এলো রাইয়ান। সোফা থেকে ল্যাপটপের ব্যাগটা তুলে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। লিফটে ঢুকে দেখলো সেখানে দাঁড়ানো একজন বৃদ্ধ লোক। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো রাইয়ান। লিফট চলতে শুরু করলো। বৃদ্ধ লোকটি রাইয়ানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলল,
‘তুমি গতরাতের ঐ ছেলেটা না যার স্ত্রী বিল্ডিংয়ের নিচে মাতাল হয়েছিল?’
রাইয়ান আস্তে করে মাথা নাড়িয়ে ‘হুম’ বলল। বৃদ্ধ লোকটি একগাল হেসে বললেন,
‘তুমি কিন্তু খুব ভাগ্যমান। অন্যদের স্ত্রী মাতাল হলে গালিগালাজ করে। স্বামীর নামে একশো একটা অভিযোগের বহর খুলে দেয়। আর তোমার স্ত্রী মাতাল হয়ে স্বামীকে চুমু দেয়। ভাগ্যবান, খুব ভাগ্যমান।’
রাইয়ান আস্তে করে বৃদ্ধ লোকটির সামনে মাথা নাড়িয়ে স্মিত সৌজন্যতার হাসি দিলো। তারপর সামনে দৃষ্টি নিয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগলো।
___________________________________________________
দু হাতে দু’টি সফট ড্রিংকসের ক্যান হাতে নিয়ে জিশান সাবধানে প্রশস্ত রাস্তাটি পার হয়ে এলো। রাস্তার এক পাশেই রাইয়ানের কালো মার্সিডিজ গাড়িটা দাঁড় করানো। জিশান গিয়ে গাড়ির জানালায় দুটো টোকা দিলো। জানালার কাঁচ নামিয়ে রাইয়ান বলল,
‘আমি আমার কাজ ফেলে রেখে এতক্ষণ ধরে তোর অফিসের কাজ করে দিচ্ছি আর তুই কোথায় উধাও হয়েছিলি?’
জিশান ঠোঁট প্রশস্ত করে বলল,
‘রাগ করিস না বন্ধু। আমি তো তোর খাতির করার জন্যই সফট ড্রিংকস আনতে গিয়েছিলাম।’
‘এই দুইটা আনতে এতক্ষণ লাগে! দুইদিন পরপরই তোর একেকটা সমস্যা বাঁধে আর আমাকে সলভ করতে হয়। এখন থেকে তোর স্যালারির অর্ধেক আমাকে দিবি।’
গাড়ির উপর এক হাত রেখে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে জিশান বলল, ‘করবি না তো কি করবি! মনে নেই স্কুলে থাকতে আমাদের ক্লাস টিচার শুধু কথায় কথায় ‘রাইয়ানকে দেখো, রাইয়ানকে দেখো, রাইয়ানকে দেখো’ বলতে বলতে কানটা কি ঝালাপালা করে দিতো। একারণেই তো এখন স্যারের কথা রাখতে কোন সমস্যায় পড়লেই তোকে দেখি। এখন একটা জিনিয়াস বন্ধু থাকার কিছু তো সুবিধা ভোগ করি!’
জিশানের কোন কথায় কর্ণপাত করলো না রাইয়ান। তার দৃষ্টি এখন পূর্ণ মনোযোগের সাথে ল্যাপটপের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। কি-বোর্ডের উপর দ্রুত গতিতে নড়ে চলেছে তার হাত। জিশান মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো। বাহ! এত স্পিড! রাইয়ানের ঘন কালো ভ্রু যুগল খুব সুক্ষ্ম ভাবে ভাঁজ হয়ে আছে। চোখের পলক যেন একবারের জন্যও পড়ছে না। পুরো মুখে তার বুদ্ধিদীপ্তের আভা। কফি কালারের শার্টের হাতা গুটানো হাতে কালো ব্রান্ডেড ঘড়ির কম্বিনেশনে তাকে দুর্দান্ত দেখাচ্ছে। যেমন স্মার্ট, তেমন ট্যালেন্টেড। খানিক পরেই ‘ইনটার’ বাটনে একটা ক্লিক করেই রাইয়ান রিল্যাক্স হয়ে বলল, ‘হুম, হয়ে গেছে।’
জিশান বিস্ময়ের সাথে একেবারে জানালা গলিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে উঁকি দিয়ে বলল, ‘হয়ে গেছে! এতো তাড়াতাড়ি সলভ করে ফেললি। আমি কাল সারারাত চেষ্টা করেও পারি নাই। তুই কি দিয়ে তৈরি ভাই?’
তারপর আবার দুষ্টমির হাসি হেসে বলল,
‘ব্রো, আমার তো মনে হয় বিয়ের পর তুই আরও বেশি স্মার্ট হয়ে গেছিস। ভাবি কি নাস্তার সাথে স্পেশাল কিছু দেয়?’
সরু চোখে তাকিয়ে রইলো রাইয়ান। জিশান হাসতে লাগলো। জানালা দিয়ে ল্যাপটপটা ওকে ধরিয়ে দিলো রাইয়ান। গাড়ি স্টার্ট দিলো। জিশান বলল,
‘আরে, চলে যাচ্ছিস নাকি!’
গাড়ি আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলো। জিশান বলল,
‘আরে, আমি ওখানেই যাবো। আমাকে একটা লিফট দে।’
গাড়ির স্পিড বাড়তে লাগলে জিশান পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘ভালোই, বউ পেয়ে এখন তো আর বন্ধুকে ভালো লাগবেই না। যা, তোর সাথে আমার তিনদিনের ব্রেকআপ।’
রাইয়ানের গাড়ি পুরোপুরি চলে গেলে জিশান কোমরে হাত রেখে নিঃশব্দে হাসতে লাগলো।
আর এদিকে রাস্তার ওপাশে গ্রোসারি শপের বাইরে দাঁড়ানো জেরিনের মুখ হা হয়ে গেলো। হাত থেকে সব ব্যাগ পড়ে গেলো। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। তার মানে কি তার কথায় কথায় বলে দেয়া কথাটাই সত্যি?
___________________________________________________
সরকারি ছুটির দিন। একটু বেলা করেই ঘুমাচ্ছিলো রাইয়ান। নরম তুলতুলে বিছানায় চারকোল কালারের চাদর গায়ে রাইয়ান যখন তার আয়েশি ঘুম উপভোগ করছিলো, ঠিক তখনই ছাদ ভেঙে পড়ার মতো জোরে একটা চিৎকার ভেসে এলো। ধড়ফড় করে উঠে বসলো রাইয়ান। সাদা টি শার্ট আর শর্টস পড়েই দ্রুত লিভিং এরিয়ায় এলো। এসে দেখলো হালকা গোলােপি রঙের টপস আর জিন্স গায়ে সোফায় বসে আছে হৃদি। মাথার চুলগুলো সব খোঁপার মতো করে একটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো। হাতে একটা কি যেন নিয়ে সে একটু পর পর নাক টেনে টেনে কাঁদছে। রাইয়ান এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘কি হয়েছে হৃদি?’
হৃদি হাতের বস্তুটা দেখিয়ে বলল, ‘আমার ব্রেসলেটটা ছিঁড়ে গেছে।’
হৃদির কথায় রাইয়ানের মুখের ভঙ্গি পাল্টে গেলো। বলল, ‘এর জন্য তুমি এমন চিৎকার দিয়েছো? আর আমি ভেবেছি ডাকাত এসেছে ঘরে।’
রাইয়ান একটা হাই তুলে মাথার এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলাতে লাগলো। হৃদি গলায় জোর দিয়ে বলল,
‘আমার ফেভারিট ব্রেসলেট ছিল এটা। ছিঁড়ে গেলো।’
হৃদির পেছনে গেলো রাইয়ান। সোফার উপর হাতে ভর দিয়ে উবু হয়ে দাঁড়ালো। একটা টিস্যু বাড়িয়ে দিলো হৃদির দিকে। হৃদি টিস্যু নিয়ে নাক টেনে মুছতে লাগলো। ঈষৎ মুখ কুঁচকে ঠোঁট চেপে খানিক হেসে হৃদির দিকে তাকিয়ে রইলো রাইয়ান। তারপর বলল,
‘আচ্ছা থাক! মন খারাপ করো না। নতুন বলে হয়তো খারাপ লাগছে। আরেকটা কিনে নিয়ো এমন দেখে।’
হৃদি একটু নাক টেনে বলল,
‘নতুন না। তিন বছর আগে কিনেছি।’
রাইয়ান বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘তিন বছর ধরে কিনেছো! এটা যে এতোদিন ব্যবহার করতে পেরেছো এই তো বেশি। আবার এর জন্য কাঁদছো!’
কথা বলতে বলতে রাইয়ান কিচেনে চলে গেলো। কিচেন কেবিনেট থেকে বের করলো ইন্সট্যান্ট কফি পাউডার, দুধ আর চিনি। একটা মগে গরম পানি ঢেলে নিয়ে একে একে সব উপকরণ মেশালো। একটা চামচ নিয়ে নাড়তে নাড়তে আবারো চলে এলো লিভিং এরিয়ায়। হৃদি তখনও বলে যাচ্ছে,
‘আরে, আমি কি বলেছি নাকি ব্রেসলেটটার আরো টেকসই হবার প্রয়োজন ছিল। আমার এতো ফেভারিট ব্রেসলেট, কতো পছন্দের, কতোদিন ব্যবহার করেছি আজ ছিঁড়ে গেলো। এখন একটু মন খারাপ তো হবেই তাই না! আমি তো আর হাউমাউ করে কাঁদছি না।’
রাইয়ান মুখ চেপে হেসে কফির মগে চুমুক দিতে গেলো। কিন্তু তার আগেই ভোতা মুখে উঠে তার হাত থেকে কফিমগ নিয়ে গেলো হৃদি। রাইয়ান হতভম্ব হয়ে গেলো। কফিতে একটা চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে হৃদি বলল,
‘এখন একটু ভালো লাগছে।’
কোমরে হাত রেখে হৃদির দিকে তাকিয়েই মাথা দুলালো একবার রাইয়ান। তারপর পাশে চোখ যেতেই দেখলো সোফার পাশে টেবিলের উপর থাকা তার পেনড্রাইভটা মুখে পুরে নিতে যাচ্ছে মিঁয়ো। রাইয়ান আঙ্গুল তুলে জোরে ডেকে উঠলো,
‘মিঁয়ো না।’
চমকে উঠে হৃদির হাত থেকে কফি পড়ে যাবার মতো অবস্থা হলো। দ্রুত সামলে নিয়ে কফিমগ টেবিলের উপর রেখে হৃদিও ডেকে উঠলো,
‘মিঁয়ো, মিঁয়ো।’
মিঁয়ো শুনলো না। দিব্যি পেনড্রাইভটা মুখে নিয়ে সে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে সরে গেলো। পেছন পেছন ছুটতে লাগলো রাইয়ান ও হৃদিও। মিঁয়ো কোন ফাঁক ফোঁকর না পেয়ে সোফার উপর উঠে বসে লেজ নাড়াতে লাগলো। রাইয়ান সোফার সামনে গিয়ে দু হাত প্রশস্ত করে বলল,
‘মিঁয়ো দিয়ে দাও ওটা নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।’
হৃদি পাশ থেকে বলল, ‘এভাবে না রাইয়ান। মিষ্টি করে বলতে হবে। মিঁয়ো, আমার সোনা। দিয়ে দাও ওটা আমাকে।’
রাইয়ান হাসিমুখে বলল, ‘দিয়ে দাও মিঁয়ো। আমি তোমাকে চকলেট খাওয়াবো।’
‘কিন্তু মিঁয়ো তো চকলেট খায় না।’
রাইয়ান হৃদির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমার মাথা কি খাবে?’
‘ওর মুখের তুলনায় অনেক বেশি বড় হয়ে যাবে না!’
চোখ কুঁচকে মাথা কাত করে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলার ভঙ্গিমায় একটা গভীর শ্বাস ছাড়লো রাইয়ান। আর এদিকে মিঁয়ো ওদের কথার মধ্যে আস্তে করে সোফা থেকে নেমে গেলো। খেয়াল হতেই ওরা দুজন আবারো মিঁয়োর পেছনে দৌঁড়াতে লাগলো। একসময় দুজন দুদিক দিয়ে এসে আটকে ফেললো মিঁয়োকে। হাত দু দিকে বাড়িয়ে রেখে মিঁয়োকে ধরার উদ্দেশ্যে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো তারা। কাছে চলে এসে মিঁয়োকে ধরতে দুজনে একসাথেই ঝাঁপ দিয়ে ফেললো। মিঁয়ো বেরিয়ে পড়লো ফাঁক দিয়ে। আর দুজনে দুজনের মাথায় বারি খেলো। মাথা ডলতে ডলতে বসে পড়ে দুজন দুজনের দিকে তাকালো একবার। পরক্ষণেই দেখলো মিঁয়ো দূরে চলে যাচ্ছে। হৃদি অস্থির হয়ে পড়ে ডাকলো, ‘মিঁয়ো।’
রাইয়ানও ডেকে উঠলো, ‘মিঁয়ো।’
আবারো শুরু হলো পুরো ঘরময় তাদের ছোটাছুটি। সামনে মিঁয়ো। পেছনে তারা দুজন। এরপর অবশেষে মিঁয়োকে ধরে মুখ থেকে পেনড্রাইভ নিতে সক্ষম হলো তারা। হাঁপিয়ে উঠে দুজনেই সোফার গায়ে হেলান দিয়ে পড়লো। কিন্তু ততক্ষণে পুরো বাড়ির বেহাল অবস্থা। জিনিস পত্র এদিক ওদিক পড়ে আছে। সোফার কুশনের কোন ঠিক নেই। সবকিছু হয়ে গেছে এলোমেলো। সেগুলো নজরে পড়তেই রাইয়ান আর হৃদি একে অপরের দিকে করুণ মুখে তাকালো। সাধের ছুটির দিনটা কি তবে আজ এর পেছনেই কাটবে!
চলবে,