My First Crush পর্ব -০৭

#My_First_Crush
#পর্ব-০৭
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

একপ্রকার হন্তদন্ত হয়েই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো রাইয়ান। সম্পূর্ণ কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা যা কখনো ভাবনাতেও আসেনি সেরকম কিছু যখন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটে যায় ঠিক তখন মানুষের যেরকম ব্লাঙ্ক বোধ হয় রাইয়ানের অবস্থাও ঠিক সেরকমই হলো। মাথা একদম বিভ্রান্ত হয়ে আছে তার। এরকম কিছু যে এখানে দেখতে পাবে তা রাইয়ান কখনো কল্পনাও করেনি। তার মানে কি হৃদি তাকে বিয়ের আগে থেকে পছন্দ করতো? কিন্তু কিভাবে সম্ভব? হিসেব গড়মিল ঠেকতে লাগলো রাইয়ানের কাছে। তার আগে সেখান থেকে দ্রুত সরে নিলো সে।
___________________________________________________

সন্ধ্যা নামার পরে কফিশপে মোটামুটি ভালোই কাস্টমারের আনাগোনা থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। ওয়েটার দুজন কাস্টমারদের ফাইফরমাশ খাটায় ব্যস্ত। একের পর এক টেবিলে সার্ভ করে যাচ্ছে তারা। এমন সময় হৃদি প্রবেশ করলো সেখানে। আলসে ভঙ্গিতে কাঁধ থেকে ছোট ব্যাগপ্যাকটা নামিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো টেবিলে। আজ সারাদিন খুব খাটাখাটুনি গেছে তার। রাইয়ান আর তার আজ সকালে একসাথেই দাদীমার বাসা থেকে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু হৃদির কাজ থাকায় সে রাইয়ানের আগেই বেরিয়ে পড়ে। সেখান থেকে বেরিয়ে কাজ সারতে সারতে সারাদিন লেগে গেছে। পেটে এই মুহুর্তে খিদেয় গুটগুট করছে হৃদির। টেবিলের উপর একটা চকলেটের বাক্স দেখতে পেয়ে অগত্যা সেটাই খুলে গোগ্রাসে খেতে লাগলো। এক এক করে চকলেটের স্থান ফাঁকা করতে লাগলো সে। জেরিন একটা কাগজে হিসেব কষতে কষতে তখন এগিয়ে এলো হৃদির দিকে। জেরিনকে জায়গা করে দেয়ার জন্য হৃদি ব্যাগটি উঠিয়ে তার সামনে রাখলো। কাগজের দিকে দৃষ্টি রেখেই জেরিন চেয়ারে বসে পড়লো। জেরিনকে ধরে টেনে টেনে হৃদি বলে উঠলো,
‘আজকে আমি পুরো শেষ হয়ে গেলাম জেরিন!’
জেরিন কাগজটা রেখে ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
‘দশদিনের কাজ একদিনের জন্য জমিয়ে রাখলে এমন অবস্থা তো হবেই। বিয়ের আগে সবকিছু কতো টাইমলি করতি। বিয়ের পর তুই অনেক ইরেগুলার হয়ে গেছিস হৃদি। এমনকি প্রতিদিন লেট করেও আসিস।’
হৃদি বলল, ‘আমার জায়গায় থাকলে না তাহলে বুঝতি! বাসার সব কাজ সামলে তারপর কফিশপে আসতে হয়, দেরি তো একটু হবেই।’
‘আগে কি বাসার কাজ ছিলো না?’
‘আগে আমি একা ছিলাম। একা মানুষের আর কিই কাজ থাকে। এখন আমরা দুজন। কাজ তো একটু বেশিই হবে।’
‘কাজের পরিমাণ যেমন বেড়েছে তেমন মানুষও তো বেড়েছে। কেন রাইয়ান তোকে কোন হেল্প করে না?’
হৃদি আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
‘সে কি হেল্প করবে? তার নিজেরই কাজ কম নাকি! সারাদিন অফিসের কাজ করতে করতেই তো ক্লান্ত হয়ে যায় বেচারা৷ বাসার কাজ আবার কখন করবে!’
‘তার নিজের কাজ আছে তোর কি নিজের কাজ নেই? কোন দেশে থাকিস তুই হৃদি? এখানে স্বামী স্ত্রীর জন্য সব দায়িত্ব ইকুয়াল ইকুয়াল। নিশ্চয়ই তুই ই কোন কাজে ডাকিস না! তার উপর আদিখ্যেতা করে নিশ্চয়ই সকালে রাইয়ানের পছন্দের একশো একটা আইটেম বানাতে যাস!’
‘আচ্ছা এবার চুপ থাক!’
জেরিন বলল, ‘এরকম চুপ থাকতে থাকতে না সবকিছু আজীবন চুপই হয়ে থাকবে। এখনও তো তোর সোফাতেই ঘুমাতে হয় নাকি!’
জেরিনকে থামাতে হৃদি মুখে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করলো। জেরিন তার তোয়াক্কা না করে বলতে লাগলো,
‘আমি বুঝি না, কোন মানুষটা বিয়ের পর এরকম করে? এটা কোন কথা! ‘অভ্যেস নেই বলে এক বিছানায় ঘুমাতে পারবো না’, গে নাকি?’
হৃদি মুখ হা করে শব্দ আওড়াতে আওড়াতে বলল,
‘এবার কিন্তু….. তুই বেশি বেশি বলছিস।’
জেরিন মাথা উঁচু করে রাখার ভাব ধরে হৃদির থেকে নজর লুকাতে লাগলো। হৃদি বলল,
‘আমাকে তো ভালোই বলছিস। নিজে যখন কোন ছেলের প্রেমে পড়বি না তখন বুঝবি!’
জেরিন হাত জোর করে বলল, ‘মাফ চাই বোন। এভাবে অন্তত আমি পড়তে চাই না। খুবই ডেঞ্জারাস।’
হৃদি হেসে বলল, ‘আচ্ছা! সারাজীবন সিঙ্গেলই থাকবি?’
হৃদি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
‘একটা ভালো দেখে খুঁজে তো দেস না।’
হৃদি মুখ করুণ করে সহানুভূতির শব্দে বলল,
‘হুম!’
জেরিনও অনুরূপ ভঙ্গিমা করায় এবার দুজনে একসাথেই হেসে ফেলল। তারপর হৃদি বলল,
‘কিন্তু জেরিন একটা কথা বলে দেই, তুই কিন্তু আমার হাজবেন্ডকে নিয়ে আর উল্টাপাল্টা কিছু বলতে পারবি না।’
জেরিন বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে।’
জেরিনের কথা শেষ হতেই হৃদি মাথা ঝাঁকিয়ে টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা সরালো। চকলেটের বাক্স থেকে আরেকটা চকলেট নিয়ে মুখে দিতেই যাবে, জেরিন দ্রুত থামিয়ে বলল, ‘কি করছিস! এটা অ্যালকোহল চকলেট।’
হৃদি বাক্সের গায়ে লেখা পড়ে চোখ বড়বড় করে বলল, ‘তোকে না একবার বলেছি কোন অ্যালকোহল জিনিস আমাদের কফিশপে না রাখতে!’
‘আরে এটা কি আমাদের নাকি! একজন কাস্টমার ফেলে রেখে গেছে। সে আবার নিতে আসবে ভেবে আমি এখানেই রেখে দিয়েছি। ভালো হয়েছে এখনো মুখে দেসনি।’
হৃদির মুখ ঝুলে গেলো। বলল, ‘আমি তো অলরেডি খেয়ে ফেলেছি।’
‘মানে? কখন খেলি?’
জেরিন বাক্সটা নিয়ে চেক করে দেখলো দশটার মধ্যে ছয়টা চকলেটের জায়গাই খালি। সে বলে উঠলো,
‘এতোগুলো চকলেট তুই একসাথে কিভাবে খেয়ে ফেললি?’
হৃদি কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, ‘এখন কি হবে? আমি কি মাতাল হয়ে যাবো?’
জেরিন আমতা আমতা করে বলল, ‘কি জানি! আমিও তো বলতে পারি না।’
হৃদি দু হাত মাথায় দিয়ে বলল,
‘কি হয়ে গেলো এটা! এখন কি করবো?’
অ্যালকোহলের জন্য আর হবে কি চিন্তায় চিন্তায়ই হৃদির মাথা ঘুরতে লাগলো। এই অবস্থায় হৃদিকে একা ছাড়তে জেরিনও ভরসা পেলো না৷ অগত্যা একটা ক্যাব নিয়ে হৃদিকে অ্যাপার্টমেন্ট পর্যন্ত ছেড়ে আসতে জেরিনও গেলো সাথে। গাড়িতে উঠার কিছুক্ষণ পরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো হৃদি। জেরিনও একটু স্বস্তি পেলো। ভাবলো, হয়তো অ্যালকোহলিক চকলেটে আর অন্য কিছু হয় না। শুধু গাঢ় ঘুমই হয়। হৃদির মাথার ঝুঁটি থেকে বের হয়ে যাওয়া সামনের ছোট ছোট চুলগুলোকে হাত দিয়ে ঠিক করে দিলো জেরিন। যাক! এবার একটু নিশ্চিন্ত হওয়াই যায়।

বাসায় কেমন যেন দম বন্ধ লাগছিলো রাইয়ানের। একটু মুক্ত হাওয়ায় খোলামেলা হাঁটার জন্য রাইয়ান অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে বিল্ডিংয়ের নিচে এসে দাঁড়ালো। ফোন টিপতে টিপতে একটু আনমনেই পায়চারি করছিলো সে। অনতিদূরেই একটি ক্যাব এসে থামলো সেখানে। জেরিন ক্যাব থেকে নেমে হৃদিকে টেনে বের করলো। হৃদি তখন ঘুমে জবুথবু অবস্থা। তাকে কোনমতে একহাত দিয়ে সামলে জেরিন ক্যাবের ভাড়া মেটাতে লাগলো। জেরিনের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ানো ঘুমু ঘুমু হৃদি চোখ পিটপিট করে পাশে তাকালো। খানিক দূরত্বেই তাদের সোজাসুজি বিল্ডিংয়ের সামনে একজনের অস্পষ্ট অবয়ব ক্রমে স্পষ্ট হতেই হৃদি হঠাৎ জোড়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘হাজবেন্ড!’

হৃদি এতো জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো যে, চমকে জেরিনের পড়ে যাবার মতো অবস্থা হলো। দারুণ চমকে উঠে সামনে হৃদিকে দেখেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রাইয়ানও। জেরিনকে ছেড়ে একগাল হেসে হৃদি আবারও বলল,
‘আমার হাজবেন্ড!’
জেরিন বুঝলো হৃদির চড়ে গেছে। হৃদি মাতাল ভঙ্গিতে হেসে হাত পা নেড়ে নেড়ে বলল, ‘সবাই দেখো, ঐ যে আমার হাজবেন্ড।’
রাইয়ান আশেপাশে একবার নজর বুলালো। এক দুজন লোক ইতিমধ্যেই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। জেরিন ধরতে গেলো হৃদিকে। কিন্তু হৃদি নিজেকে ছাড়িয়ে বিরক্তির সাথে টেনে টেনে বলল, ‘ছাড় আমাকে। আমি আমার হাজবেন্ডের কাছে যাবো।’
এরপর টলমল পায়েই রাইয়ানের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হেসে বলল, ‘হাজবেন্ড, তুমি কি আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিলে?’
রাইয়ান হতবাক দৃষ্টিতে একবার তাকালো জেরিনের দিকে। জেরিন হাত দিয়ে ইশারা করে বোঝালো, হৃদি ভুলে উল্টাপাল্টা কিছু খেয়ে ফেলেছে। রাইয়ান আবারো দৃষ্টি নিলো হৃদির দিকে। রাইয়ানের সামনে এসে হৃদির পায়ে পায়ে বেজে খানিক হোঁচটের মতো খেলে রাইয়ান দু হাত দিয়ে ধরে ফেললো হৃদিকে। বলল, ‘তুমি ঠিক আছো?’
হৃদি মুখের হাসি প্রশস্ত করে মাতাল ভঙ্গিতে বলল,
‘হুম। একদম। আমার কি হয়েছে!’
এরপর হঠাৎ গলার স্বর নামিয়ে রহস্যের মতো একপ্রকার ফিসফিস করে হৃদি বলল, ‘কানে কানে একটা কথা শুনবে?’
রাইয়ান আবারো একবার আাশেপাশে লোকের দিকে তাকালো। কি করবে বুঝতে পারলো না। আর এদিকে শুধু হাত নাড়িয়ে কথা শোনার ইশারা করতে লাগলো হৃদি। অগত্যা রাইয়ান বিভ্রান্ত মুখে আস্তে আস্তে মাথা নিচে নামানোর মধ্যেই একপ্রকার লাফিয়ে উঠে রাইয়ানের গালে চুমু দিয়ে বসলো হৃদি। পেছনে ঘুরে এভারেস্ট জয়ের মতো মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে চেঁচিয়ে বলল, ‘ইয়েস! আই কিস মাই হাজবেন্ড।’

হতভম্ব হয়ে গেলো রাইয়ান। দু হাত মুখে চলে গেলো জেরিনের। রাস্তায় হাঁটতে থাকা লোকজনও থমকে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। রাইয়ান
চারপাশে তাকিয়ে দেখলো বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়েও কয়েকজন তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তাড়াতাড়ি হৃদির হাত ধরে তাকে বিল্ডিংয়ের ভেতরে নিয়ে গেলো রাইয়ান। লিফটের সামনে বোতাম টিপে দেখলো লিফট নেই। তাই সিঁড়িপথের দিকেই নিয়ে এলো হৃদিকে। হৃদি তখন টলমলে পুরো মাতাল অবস্থা। ঠিকমতো পা ফেলতেও পারছে না৷ একপলক হৃদির দিকে তাকিয়ে রাইয়ান নিচে ঝুঁকে কাঁধে তুলে নিলো হৃদিকে। রাইয়ানের গলা পেঁচিয়ে ধরে হৃদি শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলো। একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে নিজেদের বাসায় প্রবেশ করলো তারা। সরাসরি রুমে ঢুকে রাইয়ান বিছানায় বসে হৃদিকে পেছন থেকে শুইয়ে দিলো। একটু বসে সেখানেই জিড়িয়ে নিতে লাগলো সে। এদিকে কোন ফাঁকে হৃদি বিছানার উপর উঠে দাঁড়িয়ে বেসুরো গলায় গান শুরু করলো। রাইয়ান চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলো হৃদির কান্ড। রাইয়ান মুখে ‘হুস’ শব্দ করে থামতে বললো হৃদিকে। কিন্তু হৃদি থামলো না। গান গাইতে গাইতেই সে বিছানা থেকে নিচে নেমে লিভিং এরিয়ায় চলে এলো। পেছন পেছন ছুটে এলো রাইয়ানও। ঘুরে ঘুরে গান গাইতে গাইতে এবার নাচও শুরু করলো হৃদি। একবার সোফায় উঠে গেলো তো আবার ডেস্কের উপর বসে পড়লো। রাইয়ানের তখন শুধু পাগল হওয়া বাকি। একপর্যায়ে কাঁচের সেন্টার টেবিলটায় উঠে দাঁড়ালো হৃদি। হাত পা নেড়ে নেড়ে গাইতে লাগলো সেই একই বেসুরো গান,

Fish want To fly
Bird’s want to swim,
Like a orange;
The world is round,
Which I want to
Eat eat eat…..

সদর দরজা পুরো খোলা। এই না সব নেইবার অভিযোগ নিয়ে এসে পরে! বারবার সদর দরজার দিকে চোখ রেখে রাইয়ান নিচ থেকে হাত নেড়ে হৃদিকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। এতক্ষণে তা নজরে পড়লো হৃদির। গান থামিয়ে রাইয়ানের কথা শোনার জন্য টেবিল থেকে নামতে এক লাফ দিলো সে। এসে পড়লো ঠিক রাইয়ানের পায়ের উপর। চোখ বড় বড় করে কঁকিয়ে উঠে পেছনের সোফায় বসে পড়লো রাইয়ান। হৃদি ঢুলতে ঢুলতে নিচে বসে বলল,
‘কি হয়েছে রাইয়ান?’
হৃদি রাইয়ানের পা ধরতে গেলো। রাইয়ান না করতে লাগলো। হৃদি শুনলো না। হৃদিকে আটকাতে দু হাত দিয়ে টেনে তাকে উপরে উঠালো রাইয়ান। ফলশ্রুতিতে দুজনেই সোফার গায়ে হেলান দিয়ে পড়লো। হৃদি ঘোলা ঘোলা দৃষ্টিতে রাইয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here