#অখণ্ড_তুমি
শারমিন আক্তার সেজৌতি
গত তিন মাসে ঈশিতার জীবনের উপর দিয়ে প্রতিনিয়ত নানা ঝড় বয়ে গেছে। রুম্মনের সাথে বিয়ের দিনটা এগোতে এগোতে একেবারে কাছে এসে ঠেকেছে। সামনের সপ্তাহে বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে আছে। ঈশিতা নিজের ঘরে রীতিমতো বন্দি জীবনযাপন করছে । সেদিন হসপিটাল থেকে ফিরে সেই যে ঈশিতা ঘরের দোর বন্ধ করেছিল, খুলেছিল পুরো দুদিন পরে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এ দু’দিনে বাবা কিংবা মা কেউ-ই একবারের জন্যও দোর খুলতে বলেনি তাকে, খাবার খেতেও ডেকেনি । বাবার করা আদেশের বলি হয়ে মা ও বাধ্য হয়ে চুপ হয়ে ছিলেন। বাবার ধারণা ছিল ঈশিতা দু’চার দিন চুপচাপ থেকে নিজ থেকেই দরজা খুলে দিবে, আর দু’চার দিন না খেয়ে থাকলে কেউ মরে না। উপরন্তু মেয়েকে তখন বেশিবেশি সাধাসাধি করলে সে-ই বরং উলটে বিপত্তি হতে পারে। ঈশিতার জেদের ভয়াবহতা সম্পর্কে বাবা খুবই সচেতন আচরণ করেন সবসময়। অযৌক্তিক কোন আবদার নিয়ে মেয়ের করা জেদকে তিনি কখনোই গায়ে মাখেননি, এ তার পুরনো অভ্যাস। একমাত্র মেয়ে হলেও ঈশিতাকে অন্তত এ ব্যাপারে তিনি কোন প্রশ্রয় দিতে একেবারেই নারাজ। হতে পারে প্রশ্রয় পেলে ঈশিতা খাওয়ার বায়না ধরে জুয়েলের দাবি করে বসবে কিংবা রুম্মনের সাথে বিয়ের প্রস্তাবটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অনড় থাকবে কিন্তু সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। ঠিক সে কারনেই বাবা সাময়িক একটা নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলেন ঈশিতার উপর। বাবার চালটা কাজেও এসেছিল খুব। এই দু’দিনে ঈশিতার ভিতরে কিছু ধারণা জন্মেছিল যে বাবা-মা’র কাছে তার জীবনের মূল্যই হয়ত খুব একটা নেই সেখানে তার ইচ্ছের মূল্য তো আরও নগন্য। বাবা-মা যা চাইবেন ওকে হয়ত সেটাই মেনে নিতে হবে, ছোটবেলা থেকে যদিও বহুবার তার মনে বাবা-মা নিয়ে এমন ছোট বড় প্রশ্ন এসেছে কিন্তু কখনোই সেই প্রশ্নগুলো অতটা গুরুত্ব পায়নি ওর কাছে। আজ যেন সব বদলে গেছে, আজ ছোট ছোট সবকিছুকেও অনেক বড় বলে মনে হচ্ছে ওর।
এ তিন মাসে ঘরবন্দী থেকেও ঈশিতা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে গেছে জুয়েলের খোঁজ নিতে, বহু কষ্টে কায়দা করে দু’বার বাসা থেকে বেরোতে ও সক্ষম হয়েছিল সে। প্রথমবার এক ছুটে হুরমুর করে দৌড়ে গিয়েছিল হসপিটালে জুয়েলের কেবিনে কিন্তু জুয়েলকে সেখানে পাওয়া যায়নি। পরিচিত সেই নার্স ঈশিতাকে দেখে এগিয়ে এসে বলেছিলেন,
–“তাকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে গতদিনই। ছেলেটার শরীরের বাকিসব ক্ষতগুলো সামলে গেলেও পা’টা তার আর কখনোই ফিরে পাওয়া হবে না। বিধাতা এই পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলেকে এত সহজেই পঙ্গু করে দিল! ভাগ্য বড় নিষ্ঠুর! ”
নার্সের প্রতিটা কথায় ইশিতার চোখ গড়িয়ে নোনা পানির ফোয়ারা নেমেছে, কণ্ঠটা ক্রমশ কাতর হয়ে উঠেছে কিন্তু তার মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হয়নি। ঈশিতার ভাবলেশহীন চেহারা দেখে নার্স তার কাজে ফিরে গেছেন। এরপরে ঘণ্টাখানেক হাসপিটালের করিডোরে বসে ডুকরে কেঁদেছে ঈশিতা, কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা সেখানে এসে পৌঁছয়। কোনরকম বাকবিতন্ডা ছাড়াই ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে, সেদিনই প্রথম বাড়িতে পাত্রপক্ষের সাথে পাত্র ও এসে হাজির হয়। ঈশিতা বাড়ি ঢুকতেই তাকে রুম্মনের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়। পাথরের মূর্তির মত কনে দেখার পর্বটাও চুকে যায়। সেদিন ঈশিতার নিজের বাবার উপরে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ হয়নি, আক্ষেপ ও টের পায়নি। নিজের উপরেই কি এক চাপা অভিমানে জগতের সবাইকে সে ক্ষমা করে দিয়েছিল আনমনে। মনে হয়েছিল সে নিজেই বুঝি হতভাগী, তার সাথে এমনই হবার ছিল সবকিছু। জুয়েল ও হয়ত তাকে ভুলে বসবে সময়ের সাথেসাথে, মিছেই ও সেই মানুষটার জন্য নিজের সাথে, নিজের পরিবারের সাথে এক অঘোষিত যুদ্ধে মেতে আছে।
মনটা একবার বলেছে, বাবা-মায়ের ইচ্ছেকেই দাম দি, বিয়ে করে নেই তাদের পছন্দের ছেলেকে তো অন্যবার কোথথেকে একরাশ দুঃখ এসে ভর করেছে বুকের উপরে। ভালোবাসার মানুষটিকে ছাড়াই, তাকে অসহায় অবস্থায় একলা রেখে জীবনটা কাটিয়ে দেবে সে! না এ হতে পারে না, ঈশিতা তো জুয়েলের কেবল সুসময়ের ভালোবাসা ছিল না, জন্মজন্মান্তরের পথচলার শপথ নিয়েছিল তারা। তবে আজ একটা ঠুনকো অঙ্গহানি কিভাবে তাদের সব স্বপ্ন, শপথের উপরে জিতে যায়! তাহলে ভালোবাসাটা তো কেবল নামমাত্রই রেয়ে গেল! এতই কি দুর্বল ছিল তাদের বন্ধন, তাদের এই দীর্ঘ পাঁচ বছরের পথচলা! এতটা দুর্বল ভালোবাসা তো তাদের ছিল না, কালেকালে ভালোবাসার জন্য কত কী বিসর্জনের কথা শোনা যায় কিন্তু আদতে তা দেখা যায় না। তবে কী ভালোবাসা শুধু কাব্য, উপন্যাসেই মহান,ত্যাগী, আত্মার বন্ধন! বাস্তবে যা হিসেবের ছকে কেটেছিঁড়ে একাকার হয়ে বিশ্রী অবস্থা করে ফেলে! ভালোবাসা কী তাই!
পুরো রাত জুড়ে নানারকমের ভাবনাচিন্তা খেলে যায় ঈশিতার মাথায়। নির্ঘুম, অন্ধকারচ্ছন্ন রাতটা ঈশিতাকে ঘুরিয়ে আনে তার জীবনের বিগত পাঁচ বছরের সমস্ত ঘটনাচক্র থেকে। বিগত পাঁচটি বছরের স্মৃতি আওড়ে কখনো সে অজান্তেই হেসেছে তো কখনো কেঁদে ভাসিয়েছে। ভোর হতেই নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল তার। কাজের মেয়ে নার্গিস সকালের নাস্তা নিয়ে ঘরে এলে ঈশিতা তার পায়ে ধরে অনুনয় করেছে কয়েকমুহূর্তের জন্য হলেও তার সেলফোনটা দেওয়ার জন্য। নার্গিস ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলেছে,
–“আপা, আপনার বাবা জানতে পারলে আমার সব ধ্বংস হয়ে যাবে আপা। আমার ঘরে একবছরের একটা মেয়ে আছে, অসুস্থ শাশুড়ি আছে, জামাইটা নেশাঘোর। আমার কাজ চলে গেলে সবাই না খেয়ে মরব আপা। দয়া করেন, আমার কাছে এই অনুরোধ কইরেন না”
নার্গিসের অনুনয় ঈশিতার কান ঘেঁষে চলে গেছে, পরিনামে সে আরও বেশি কাতর হয়ে একটা ফোন করতে চেয়েছে। একপর্যায়ে নার্গিস নিজের সংসার, সন্তানের উপর আসা দুর্ভোগকে ভুলে ঈশিতার হাতে তুলে দেয় তার ফোনটা আর নিজে দাঁড়ায় দরজার কাছে পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু জুয়েলের ফোনটা বন্ধ আসে, উন্মাদের মত ঈশিতা নিজের পুরনো ডাইরি ঘেটে জুয়েলের পরিবারের সদস্যদের নাম্বার খুঁজে। একপর্যায়ে জুয়েলের বড় ভাবির নাম্বার পাওয়া যায়। রিং হতেই ভাবি উদ্ধিগ্ন হয়ে ওপাশ থেকে বলে ওঠে,
—ঈশিতা তুমি? তোমার সাথে যোগাযোগের কতরকম চেষ্টা করেছি আমি কিন্তু পেরে উঠি নি।
ভাবির সাথে কথা বলে যা জানা গেল তাতে ঈশিতার নিজেকে ঘরে বেঁধে রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়লো। জানা গেল জুয়েল একপ্রকার মৃত মানুষের মত বেঁচে আছে, দেড় মাসের মধ্যে সে কারও সাথেই তেমন কথা বলেনি৷ হসপিটালের বেডে অসার হয়ে পড়ে থাকত সে, কারোর কোনপ্রকার আচরণই তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করত না। বড় ভাবি জুয়েলের একান্ত কাছের মানুষ, বন্ধুর মত সম্পর্ক ভাবির সাথে জুয়েলের কিন্তু সেই ভাবির থেকেও যেন যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয়েছে তার। জুয়েল ইচ্ছাকৃতই নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে নিয়েছে, ফোনের সিমটা খুলে রেখে গ্যালারিতে থাকা ঈশিতার ছবিগুলোর দিকে চেয়েই যেন তার দিন কেটে যায়। ভাবি বহুবার বলেছেন,
–ফোনে এত কী দেখো জুয়েল?
— কিছু না ভাবি।
–ঈশিতাকে খুব মিস করছ তাই না? মেয়েটাকে ওভাবে তাড়িয়ে না দিলেও পারতে, কতটা কষ্ট পেয়েছে ও ভাবো!
–(নিশ্চুপ)
এভাবেই জুয়েল কথাগুলোকে এড়িয়ে যেত, এইতো হসপিটাল থেকে রিজিলের কয়েকদিন আগেই হঠাৎ একদিন জুয়েল অবুঝ শিশুর মত কান্নাকাটি শুরু করে ভাবিকে ধরে। এরপরে নিজে নিজেই বলে গেছে,
–ঈশিতাকে ছাড়া জীবনটা একদম ফাঁকা ভাবি। আল্লাহ আমার সাথে এমন কেন করল বলেন তো? গত পাঁচটা বছরের প্রতিটা দিন ওকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নটা তিলেতিলে গেঁথেছি মনের মধ্যে। হন্যে হয়ে ছুটেছি একটা চাকরির জন্য। জীবনে এই একটা কিছুই আমি এতটা মন থেকে চেয়েছিলাম, ঈশিতাকে! ওকে ছাড়া আর কিছুই চাইনি ভাবি। তবে কেন এমন হল বলেন তো? সব যখন ঠিক হয়ে এলো, জীবনটা যখন শুধু আমাদের দুজনের হওয়ার কথা ছিল তখন উপরওয়ালা আমাদের টেনে আলাদা করে দিলেন ভাবি।
ভাবি চোখের জল চেপে প্রশ্ন করেছেন,
–ও তো তোমাকে ছেড়ে যায়নি জুয়েল। তোমার সাথেই থাকতে চায় আজীবন। তুমিই না মেয়েটাকে ছুঁড়ে ফেলছো নিজের জীবন থেকে।
উত্তরে জুয়েল কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকে এরপর কাঠকাঠ কণ্ঠ করে বলে,
–চাইলেও এই পঙ্গু জীবনের সাথে ওকে জড়াতে পারব না ভাবি। ঈশিতা যে জুয়েলকে ভালোবেসেছিল সে দরিদ্র হলেও অন্তত শারীরিক ভাবে অসম্পূর্ণ ছিল না, আমি নিজে ঈশিতার জন্য সম্পূর্ণ ছিলাম। আমি জানতাম আমার চারটে হাত পা অন্তত ঠিক থাকতে ঈশিতা আমার সাথে কষ্টে থাকবে না। সারাজীবন নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখতাম ওকে। আর এই আত্নবিশ্বাসটা থেকেই ওকে বলেছিলাম ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে, বাবার একমাত্র মেয়েকে বলেছিলাম সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসতে। কিন্তু এখন সব বদলে গেছে ভাবি, সব বদলে গেছে। জুয়েল এখন চাইলেও ঈশিতাকে সুখি রাখতে পারবে না। ওর হাত ধরে হাঁটতে পারবে না, ওর খুশির জন্য এখানে সেখানে ছুটে বেড়াতে পারবে না। দাঁড়িয়ে ওর গলায় মালা পর্যন্ত দিতে পারবে না জুয়েল। আমি ওর যোগ্য নই ভাবি, আমি অক্ষম হয়ে গেছি। আমার সাথে থাকলে ও শুধু কষ্টই পাবে। বাবা-মায়ের ভালোবাসা হারাবে, সব হারাবে। সারাটা জীবন আমার অঙ্গহানির বোঝা ওকে বয়ে বেড়াতে হবে। কষ্ট করে হাসতে হবে ওর, সুখী হবার অভিনয় করতে হবে ওকে।একসময় ও ক্লান্ত হয়ে যাবে। ওর সুন্দর ফুলের মত সহজ জীবনটাকে কাঁটা দিয়ে ভরে দেওয়ার জন্য জুয়েলের উপরে তখন ওর ঘৃণা হবে। জুয়েলের উপর ভালোবাসাটা করুণা হয়ে যাবে। এ আমি নিতে পারব না ভাবি। এর থেকে আমার মরে যাওয়া ঢের ভালো। আমরা দূরে থাকি সেই ভালো, তবুও ঈশিতা ভালো থাক। আমার উপরে করুণার দরে ওকে আমার সাথে বেঁধে রাখতে চাই না ভাবি।
কেবিন থেকে বেড়িয়ে ভাবি সেদিন অঝোরে কেঁদেছে এই ছেলেটার জন্য, সম্পর্কে দেবর হলেও জুয়েলকে সে নিজের ভাইয়ের মতই দেখে। ছেলেটার বুকের ভেতরে এত ক্ষত জমা হয়ে আছে জেনে ভাবির জীবনটাও সেদিন থেকে একটা কষ্টের মেঘে ছেয়ে আছে। বহুবার সে চেষ্টা করেছে কথাগুলো ঈশিতাকে জানানোর কিন্তু হয়ে ওঠেনি। তার উপরে ঈশিতার বিয়ের খবর কানে আসতেই জুয়েলের মনটা যেন এ দুনিয়ায় আর নেই এখন। ছেলেটার জীবনটা একটা শুণ্যতার খোলসে ঘিরে গেছে।
আজ হুট করে ঈশিতার ফোন পেয়ে ভাবি যেন হাতে চাঁদ পেলেন। গরগর করে সব বলে গেলেন, বুকটা হালকা লাগছিল তার। ঠিক হল সন্ধ্যায় ঈশিতার সাথে ভাবির দেখা হবে, ভাবি ঈশিতাকে জুয়েলের সাথে দেখা করিয়ে দিবেন।
নার্গিসের সহায়তায় সেদিন ঈশিতা বাড়ি থেকে বেরোতে পেরেছিল ঠিকই কিন্তু ভাবির সাথে দেখাটা তার হয়নি। বাড়ি থেকে বেরোবার মিনিট দশেকের মধ্যেই বাবা পুরোটা জেনে যান, নার্গিসের কাজটাও চলে যায়। তার দু-মাসের বেতন কেটে রেখে বাড়ি থেকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় মেয়েটাকে। জোরজবরদস্তি করে ঈশিতাকে মাঝপথ থেকে ধরে আনা হয়, এরপর থেকেই ঈশিতার জীবনটা একেবারে কয়েদি জীবন হয়ে গেছে।
দিনেদিনে ঈশিতা মানসিকভাবে ভেঙে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে আয়োজন করে চলছে তার বিয়ের প্রস্তুতি….
অখণ্ড তুমি
৩য় পর্ব
শারমিন আক্তার সেজ্যোতি
আগামী পর্ব অন্তিম পর্ব হবে…