‘অঙ্গারের নেশা ‘
পর্ব-২৩
বাহিরে বোধহয় হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। সুফিয়ান বুকে গুটিয়ে থাকা যুবতীর দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো৷ ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে গেছে প্রাণেশা, গাঁয়ের সঙ্গে নিবিড় হয়ে লেপ্টে আছে। উপরে একটা কম্ফর্টার দেয়া আছে গায়ে, কিন্তু তারপরও প্রাণেশার ঠান্ডা কমছে না। সুফিয়ান হাত বাড়িয়ে মোমের মতো সাদা নাকটা ছুয়ে দিতেই প্রানেশা হালকা কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে স্নিগ্ধ হাসলো। সুফিয়ান প্রানেশার হাতটা আলতো হাতে ধরে দীর্ঘক্ষণ অধরে লাগিয়ে রাখলো৷ প্রানেশা সরালো না , তার দৃষ্টিও নিবদ্ধ সুদর্শন যুবকের খাড়া কাটা চোয়ালের উপর, ছেলেদের চোখ ছোট থাকে কিন্তু সুফিয়ানের বড় চোখ তার ভেতরে গভীর ডার্ক চকলেট বলের মতোন চকচকে মণি। প্রাণেশার হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো গভীর চোখদ্বয়ে গভীর ছুঁয়ে দিতে, ঘোরের মাঝেই মুখটা উঁচু করে চোখের পাতায় চুমু খেয়ে কাঁধে মুখ গুজে রইলো৷ সুফিয়ানের নিশ্বাস ঘন হয়ে গেলো, প্রাণেশার মাথায় হাত রেখে বললো-
‘একটু আগে তো শুনবো শুনবো বলে জেদ করছিলে, এখন শুনবে না?’
‘হু, শুনবো বলুন ‘
‘এমন করে থাকলে বলবো কীভাবে?’
প্রানেশা দুষ্টু হেঁসে বললো –
‘কিছু জানিনা, এভাবেই বলুন ‘
সুফিয়ান বুঝতে পারলো এসব তাকে জ্বালানোর উসিলা মাত্র। সুফিয়ান প্রানেশাকে টেনে বালিশে শুয়ে দিলো। প্রাণেশা ভাবলো সুফিয়ান রেগে গেছে, এখন খুব বকবে। তাই সরি বলতে প্রস্তুতি নিতেই তাকে অবাক হয়ে দিয়ে প্রাণেশার আগের ভঙ্গিতে নিজেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশার থমকে যাওয়া মুখ দেখে মৃদু হেসে বললো –
‘এবার ঠিক আছে ‘
প্রানেশাও প্রতুত্তরে হেঁসে ফেললো। সুফিয়ান চোখ বন্ধ করে সেই অন্ধকারে ঢেকে থাকা দিনটার কথা মনে করলো। কী কুৎসিত একটা দিন ছিলো সেটা! ভাবতেই সুফিয়ানের গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে।
সেদিন যখন সুফিয়ানের দীর্ঘ আট দিন পর জ্ঞান ফিরলো সেদিন সে সবার প্রথমে সৃষ্টিকর্তাকে বিরাট ধন্যবাদ জানালো। এত বড় এক্সিডেন্টের পর সে যে বেঁচে আছে ভাবতেই শুকরিয়া আদায় করলো। তারপর হঠাৎ মনে পড়লো তার প্রানেশার সঙ্গে তো তার দেখা করার কথা ছিলো! লাফিয়ে উঠে বসলো সে। হাতের ক্যানালোতে টান লাগতেই কয়েক ফোটা রক্ত গড়িয়ে পড়লো। অতকিছু খেয়াল না করে জোরে চেচিয়ে মাকে ডেকে উঠলো, কিন্তু একি!তার গলা দিয়ে আওয়াজই বের হচ্ছে না। অতিরিক্ত মাত্রায় স্ট্রেসের কারণের গলা দিয়েও রক্ত পড়তে শুরু করলো। বাহির থেকে আওয়াজ পেয়ে নার্স ভেতরে ঢুকে পড়লো, মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেবও আসলেন৷ সুফিয়ানের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। গলা আওয়াজ বের করতে না পেরে গলায় চেপে ধরে আছে। ডক্টর এসে সুফিয়ানকে তার গলায় ইনজুরির কথা জানালেন। সুফিয়ান ইশারায় জিজ্ঞেস করতেই ডক্টর বললেন-
‘এই এক দেড় মাস লাগবে! কিন্তু গলায় প্রেশারাইজ করলে রিকোভার করতে টাইম লাগবে। মেডিসিন নিয়মিত নিলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন, ডোন্ট নিড টু ওয়ারি ‘
সুফিয়ান ততক্ষণে শান্ত, নিশ্চুপ। মিসেস অদিতি থাকতে চাইলেও সুফিয়ানের ভয়ে আর থাকতে পারেনি। সুফিয়ান বলেছে সে কিছুটা সময় একা থাকতে চায়।
কয়েক দিন পরই রিলিজ হয়ে বাড়ি ফিরলো সুফিয়ান৷
সবার আগে প্রাণেশার সঙ্গে দেখা করার জন্য মন ছুটে গেলো। প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো প্রাণেশা নিজেই ফোন দিবে, কিন্তু মোবাইল অন করতেই দেখলো প্রানেশার কল তো দূরের কথা, তার নাম্বারই পড়ে আছে ব্লক লিস্টে। প্রতিবার সুইচ অফ বলছে৷ সুফিয়ানের হার্টটা তখন মিনিটে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেগে ছুটতে লাগলো। আরেকটা নাম্বারে কল দিতেই সেটা বিজি শোনালো। সুফিয়ানের বুকে তখন তীব্র ব্যাথায় ভরে উঠেছে, একজনকে দিয়ে খোঁজ লাগাতেই শুনলো প্রানেশা অন্য কারো সাথে রিলেশনে আছে এটা খবর পেয়েছে। সুফিয়ান মাথা ঘুড়িয়ে নিচে বসে পড়লো। এসব তার কিছুতেই বিশ্বাস হলো না। সে নিজেই ক্ষত গলা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। অদিতি আর রাহাত সাহেব ঘরে ছিলো বলে জানতে পারেনি৷
কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে গেলো, প্রানেশা নাকি মায়ামতী
ঝিলে একটা ছেলের হাত ধরে বসে আছে। সুফিয়ান তখনও বিশ্বাস করেনি। কিন্তু নিজে যখন দেখলো ঠিকই প্রানেশা একটা ছেলের হাত ধরে কথা বলছে স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। রেয়ানই ছিলো সেটা, কিন্তু সাইড থেকে চেহারা খেয়াল করেনি সুফিয়ান।
বেড়িয়ে গেলো তখন সে, আর সহ্য করতে পারছিলো না অন্য কারো সাথে। কী অসহ্য তেঁতো যন্ত্রণা!
সেদিন রাতেই সুফিয়ান টিকিট বুক করে, সকালে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলো সে। সাথে ছিলো তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ইভানান। যে ইমোশনাল ব্লেইকমেইল করে রওনা হলো। সুফিয়ান কষ্টে জর্জরিত মনে আর কিছু ভাবতে পারেনি৷ বন্ধু সাথে থাকলে কষ্ট কমবে ভেবেই সে সাথে নিলো৷ কিন্তু তখনও সে জানতোনা, ইভানান কী ভয়ংকর খেলায় মেতেছে! সুফিয়ানের কানে যেনো কোনোভাবেই রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্কের কথা না জেনে সব ব্যবস্থা করে ফেললো। আর সুফিয়ানকে অনবরত ব্রেইন ওয়াশ করতে থাকতে থাকলো। প্রাণেশা যে তার সাথে বেইমানি করেছে তা একপ্রকার জোর করে বিশ্বাস করালো। সুফিয়ান মেতে থাকলো পার্ট ক্লাব, মেয়ে নিয়ে। ইভানানের গভীর ফাঁদে পুরোপুরি পা দিয়ে ফেললো৷ শুধু মিসেস অদিতির রিকুয়েষ্টে, নতুন করে একটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো৷ ব্রিলিয়ান্ট হওয়ায় অল্প দিনের মাঝেই পাকাপোক্ত ভাবে সকল কিছু আয়ত্ত্বে করে নিলো। আর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করলো এক মিথ্যা বন্ধুকে। ইভানানের কথাই তার কাছে একসময় সত্যি মনে হলো। কিন্তু সুফিয়ানের বোধ হয় মনেই ছিলো না
‘ Evil was once an angel ‘
চলবে…
‘অঙ্গারের নেশা ‘
পর্ব-২৪
‘রেয়ান, তুমি বলেছিলে তোমার বড় ভাই আছে। মা বাবার ছবি দেখালেও ভাইয়ের ছবি তো দেখালে না! ‘
তখন সম্পর্কের বয়স চার বছর। এর মধ্যে প্রানেশার মনে নানারকম সন্দেহের উৎপাত হয়েছে। প্রানেশার শুধু মনে হতো রেয়ান কিছু লুকাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেই রেয়ান নানা অযুহাত দিয়ে দিতো৷ আর পাঁচ দশটা স্বাভাবিক কাপলদের মতো প্রানেশা হতে পারে না। কেনো তার জানা নেই। আজ গাড়িতে বসে রেয়ানকে জিজ্ঞেস করে ফেললো সে৷ রেয়ান ড্রাইভিং করছিলো। প্রানেশার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো। আমতা
আমতা করে বললো –
‘ বলেছিলাম না, আমার ভাই এখানে থাকে না। হি ইজ আউট অফ কান্ট্রি ‘
‘কিন্তু, তাই বলে তার কোনো ছবিই নেই! ‘
রেয়ান রাগী মুখে বললো-
‘ তুমি কী সন্দেহ করো প্রানেশা! ‘
প্রানেশার উৎসুক মুখ মিইয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে উইন্ডোর দিকে তাকিয়ে রইলো। চাইলেও হিসাব যে মিলে না। রেয়ান মুখ অন্য দিকে করে মুখ হাসলো, যাক প্রানেশার প্রশ্নের জাল থেকে এবার বাঁচা যাবে। প্রানেশার মলিন মুখ দেখে প্রানেশার হাত এক হাত রাখলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো –
‘সরি, আমি রেগে গেছিলাম। তুমি বারবার এত প্রশ্ন করবে না ‘
প্রানেশা চমকে হাত সরিয়ে ফেললো৷ রেয়ানের ছোঁয়ায় প্রানেশা এখনো কম্ফোর্ট হতে পারেনি। রেয়ান আর কিছু বললো না।
রেয়ান চেহারা বদলানোর পর থেকে আগের ভার্সিটিতে পড়ে না। ওখানে থাকলে যে তাকে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই, অন্য ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। সবাই শুধু এতটুকু জানে যে সুফিয়ান বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে আর রেয়ান অন্য ভার্সিটিতে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। যেদিন মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেব এই ব্যাপারটা জানতে পারেন সেদিন তাকে খুব মেরেছে। প্রানেশাকে নিয়ে সংগঠিত ঘটনা জানেনা বলেই রহস্য ভেদ করতে পারেনি। কিন্তু রেয়ানের ভেতরের রাগ আরও বেড়েছে। চেহারার জন্য নতুন ভার্সিটিতে বেশ ভালো নাম হয়ে গেছে তার। মনে মনে সে এটা ভেবেই খুশি হয় যে তাকে কেউ আর অবজ্ঞা করতে পারে না। ব্যস এটুকুই তো চেয়েছে সে ৷
———
পাঁচ বছর পর,
ডান্স ক্লাবের ড্রিংক জোনে একটার পর একটা গ্লাস খালি করছে সুফিয়ান। আট পেগ শেষ করার পর পাশের সোফায় গিয়ে বসলো। ইভানান সামনে একটা শর্ট ড্রেস পড়া মেয়ের সঙ্গে ডান্স করছে। হাতে মদের একটা ডিজাইনিং গ্লাস। সুফিয়ানকে বসতে দেখে এগিয়ে এসে পাশে লাফিয়ে বসলো। পুরো সোফা দুলে উঠতেই সুফিয়ান একবার আড়চোখে তাকালো। ইভানান ঠোঁট বাকিয়ে হেঁসে বললো –
‘সুফি, প্রতিদিন কম মেয়েকে তো পাঠাচ্ছি না তোর কাছে। তবুও এমন দেবদাস! ‘
সুফিয়ান দুই হাতের তালু দিয়ে মুখমন্ডল ঘষলো। হাতের কব্জি উল্টিয়ে দেখলো রাত ১১.৩০। উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির চাবি বের করলো। তারপর হাঁটা ধরলো। ইভানান হাতের গ্লাসটা দ্রুত ভঙ্গিতে রেখে পেছনে পেছনে এলো। গাড়ির দরজা খুলে নির্লিপ্ততা নিয়ে বসলো সুফিয়ান, তার পাশের সিটে ইভানান বসলো। ইভানান চিন্তিত হওয়ার মতো করে বললো –
‘তুই আজ বেশি খেয়েছিস। আমি ড্রাইভ করি, তুই ওঠ’
সুফিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো-
‘আই এম কমপ্লিটলি ফাইন। ইউ ডোন্ট নিড টু ওয়ারি ‘
‘ইফ আই ডোন্ট থিঙ্ক, হু ইলস উইল? ‘
সুফিয়ান শক্ত কন্ঠে বললো-
‘ আই ডোন্ট নিড এনিওয়ান’
সুফিয়ানের দৃষ্টি আবদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার অন্ধকার জনমানবহীন রাস্তায়। কিন্তু মন একবিন্দুও এখানে নেই। পাঁচ পাঁচটে বছর হয়ে গেছে, অথচ এখনও সুফিয়ান ভুলতে পারেনি তার প্রাণের কথা। কী করে ভুলবে! নিজের সবটা দিয়ে যে ভালোবেসেছিলো।
অতিরিক্ত ভালোবাসায় একবার ডুবলে বাঁচার উপায় নেই। হয় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে হবে, না হয় কেউ টেনে তুলবে এই আশায় হাত পা ছুড়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।আদৌ যে কেউ বাঁচাবে, এই নিশ্চয়তা নেই।
কিন্তু ওই যে ভালোবাসা!
তাহার চেয়ে সু্ন্দর আর একইসাথে কুৎসিত অনুভূতি পৃথিবীতে একটিও নেই!
ইভানান মাথা হেলে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। গাছগুলো যেনো পেছনে চলে যাচ্ছে একের পর এক। মনে মনে সে নিজের ব্যাথিত অতীত মনে করছে।
তখন সে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে ৷ প্লে থেকে এই পর্যন্ত সুফিয়ানের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে জান দিয়ে ভালোবেসে বন্ধুত্বের সকল দায়িত্ব পালন করেছে। সব সময়ই সুফিয়ানকে নিজের ভাই মেনেছে।
নিজের সকল কিছু ভাগ করে নিতো সুফিয়ানের সঙ্গে।
কিন্তু সুফিয়ান কি করলো তার সাথে! তার আদরের ছোট বোনটাকে শেষ করে দিলো। মেরে ফেললো!
মনে হয় এই তো সেইদিন ছোট বোনের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করলো, কেক নিয়ে মুখে লাগিয়ে দিলো, বোনের বিনুনি ধরে টেনে দৌড়ে ভেগে গেলো। এখন সব স্মৃতি! অথচ এখনও জীবন্ত। হাতড়াতে শুরু করলে গোলকধাঁধার মতো সব চোখে মুখে বাড়ি খায়।
ছোট বোন ইনায়া, মা, বাবা। কত সুন্দর একটা পরিবার ছিলো তার৷ খুব বেশি একটা গ্যাপ ছিলো না ইনায়া আর ইভানানের মাঝে। তাই সম্পর্কটা ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ। ইনায়া তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। ইভানান বোনের রুমে ঢুকতেই দেখলো জানালার পাশে বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইভানান মাথায় হাত দিয়ে হালকা করে বাড়ি দিলো। ইনায়া একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভানান দেখলো ইনায়ার মুখটা লাল হয়ে আছে, চোখের কোণে জল। ইভানান জিজ্ঞেস করলো ‘ কী হয়েছে? ‘
ইনায়া ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করলো। ইভানান অবাক হয়ে গেলো। ইনায়া কখনো এভাবে তো কাঁদেনা! আজ কী হলো তাহলে?
মাথায় হাত রেখে অস্থির ভাবে বললো –
‘ ইনু, কী হয়েছে তোর? কেউ কিছু বলেছে তোকে!একবার নাম বল, কেটে রেখে দেবো ‘
ইনায়া ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো-
‘ সুফিয়ান ভাই আমাকে বোঝে না কেনো ইভ ভাইয়া? ‘
ইভানান বুঝতে পারলো না। তাই অবাক হয়ে বললো-
‘সুফি! ‘
‘হ্যা সুফিয়ান ভাই। আমি তাকে ভালোবাসি ইভ ভাইয়া’
ইভানান অবাক হয়ে তাকালো ৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত স্বরে বললো-
‘ কবে থেকে? ‘
ইনায়া নিজেকে সামলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। লজ্জিত হওয়ার মতো করে বললো –
‘ ক্লাস নাইন থেকেই ভালো লাগতো। বিশ্বাস করো ইভ ভাই, আমি সুফিয়ান ভাইকে সত্যিই খুব ভালোবাসি। ‘
একটু থেমে ইভানানকে অনুরোধ স্বরে বললো –
‘ ভাইয়া, সুফিয়ানকে ভাইকে আমি অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে কিছুতেই বোঝে না। তুমি একটু বোঝাও না তাকে’
ইভানান মৃদু হেসে বললো –
‘মনের কথা জানিয়েছিস ওকে?’
ইনায়া চকিত নজরে তাকিয়ে বললো –
‘সুফিয়ান ভাই কী আমাকে গ্রহণ করবে? ‘
ইভানান মজা করে বললো-
‘মনে মনে যাকে নিয়ে সংসার সাজিয়ে ফেললি, আর তাকেই বললি না! পাগলী ‘
ইনায়া ভয়ার্ত চেহারায় বললো-
‘ সুফিয়ান ভাই যদি না মানে, আমি মরে যাবো ভাইয়া’
ইভানান রাগী মুখে বললো-
‘ এক থাপ্পড় মারবো না! বেশী বুঝিস। অত বেশি ভয় না পেয়ে বলে দে ‘
‘আচ্ছা, তাহলে কালই বলি’
ইভানান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বাহিরে চলে গেলো। তার কোনো আপত্তি নেই, থাকবে কী করে! সুফিয়ানের শিরা উপশিরা চিনে সে। মেয়েলি দোষ নেই, চরিত্র ভালো, সৎ। ব্যস এটুকুই যথেষ্ট। তার বিশ্বাস তার বোন সুফিয়ানের সঙ্গে ভালো থাকবে।
পরের দিনই শাড়ি পড়ে, পিঠ পর্যন্ত চুল খুলে রেখে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে সুফিয়ানকে মনের কথা জানায় ইনায়া। সুফিয়ান প্রথমে অবাক হয়েছিলো। কারণ, ইনায়াকে সে নিজের বোন ব্যতিত কিছু ভাবেনি কখনো। তাই , ভালো করে বুঝিয়ে বলে দিলো৷ কিন্তু ইনায়া কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে বললো-
‘ সুফি ভাই, আমার মতো করে কেউ আপনাকে ভালোবাসবে না। একটা সুযোগ দিন আমাকে। ‘
সুফিয়ান ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। রাগী স্বরে বললো –
‘ ইউ হ্যাভ লস্ট ইওর মাইন্ড ইনায়া। ইউ নিড ট্রিটমেন্ট’
‘ তো দিন না, ট্রিটমেন্ট দিন আমাকে। আপনিই একমাত্র ঔষধ আমার ‘
‘জাস্ট স্টপ ইট। চলে যাও ইনায়া, আমাকে রাগীও না’
ইনায়া নিচে বসে পড়লো, সুফিয়ানকে আরও অবাক করে দিয়ে সুফিয়ানের পা ধরে আকুতিভরা টলটলে স্বরে বললো –
‘ সুফি ভাই, কৈশোরের প্রথম প্রেম আপনি। কী করে ভুলি আমি? ‘
সুফিয়ান টেনে উঠিয়ে ইনায়ার গালে পরপর দুটি থাপ্পড় মেরে দিলো। রাগে হতবুদ্ধ হয়ে গেছে সে। কী করে এত বেহায়া হয় ইনায়া ভাবতেই রাগের পারদ বাড়তে থাকলো। কিন্তু সে তখনও জানতোই না, ভালোবাসা মানুষকে দিয়ে সব করাতে পারে।
ইনায়া হৃদয়ভগ্ন হয়ে দৃষ্টি স্থির করে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে জায়গা ত্যাগ করলো। এতক্ষণ তারা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইভানান কল করে আসতে বললো তাই এসেছিলো। কিন্তু ইনায়া যে এমন করবে সে জানতো না। চুপচাপ নিচে নেমে গেলো। আর ছাদে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ইনায়া। অস্ফুটস্বরে বললো –
‘ আমার মতো আপনিও একদিন ভালোবাসার শিখায় পুড়বেন সুফি ভাই ‘
দীর্ঘক্ষণ পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোলাপ গুলো যত্নশীল হাতে উঠিয়ে নিলো। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো৷ একটা কাগজে লিখলো –
‘ইভ ভাইয়া, তোমার এই বোনটাকে ক্ষমা করে দিও।
ঐ নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন মানুষটাকে ছাড়া জীবনটা কী যে বিষন্নময়! তাকে বিহীন এক একটা রাত কী যে দুর্বিষহ! আফসোস, জমা কথাগুলো কিছুই তাকে বলা হলো না। তার আগেই আমি পাড়ি জমাবো, না ফেরার দেশে ‘
পরের দিন সকালে যখন ইনায়া দরজা খুলছিলো না তখন অজানা আশঙ্কায় শরীর কেঁপে উঠলো ইভানানের। দরজা ভেঙে ভেতর যেতেই দেখলো ইনায়ার লাশটা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে। বোনের লাশ জড়িয়ে পাগলের মতোন চিৎকার করে কেঁদেছিলো। বিশ্বাসই হয়নি তখনও যে বোনটা বেঁচে নেই। সুখ শান্তি সব যেনো চলে গিয়েছিলো পরিবারের। সুফিয়ানকে যখন বললো ইনায়ার কথা তখন সুফিয়ানেরও অপরাধবোধ হয়েছিলো কিন্তু সেই কষ্টটা ইভানানের সামনে খুলে প্রকাশ করতে পারেনি। ইভানান সুফিয়ানের নির্লিপ্ততা সহ্য করতে পারছিলোনা। যার জন্য নিজের জীবন শেষ করলো তার বোন, সে এতটা স্বাভাবিক এটা ভাবতেই সুফিয়ানের প্রতি ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছিলো তার। তারপর শুরু হলো তার প্রতিশোধ নেয়ার নেশা। সুফিয়ানকে তিলে তিলে শেষ করার জন্যই এসবকিছু৷
গাড়ির হর্ণ বাজতেই ধ্যান ভাঙলো ইভানানের। সুফিয়ান গাড়ি পার্ক করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। ইভানানকে নামতে বলেছে৷ ইভানান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নেমে পড়লো। সুফিয়ান এপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকে গেছে। ইভানান খেয়াল করলো বহুদিন পর চোখের কোণা ভিজে উঠেছে তার। রাতের তারায় ঢাকা ঝলমলে আকাশ দেখতে দেখতে অভিমানী সুরে বললো –
ভালো আছো তো না ফেরার দেশে?
মনে করো তো সেখানে আমাকে?
নাকি লেলিহান দাবানলে এখনো পুড়ো?
পৃথিবীর বুক ছেড়ে গেলে অজানায়,
ভালোবাসার কী এতোই শক্তি,
যে করে দিলো নিঃস্ব তোমায়!
চলবে….