#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৩|
পরদিন সকাল হতেই জুভান বেশ ব্যস্ত হয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। নাস্তাটাও করে যায়নি। সে যাওয়ার ঘন্টা খানিক বাদে বাড়িতে ফোন দিয়ে জানাল, নিধির সাথে তার ডিভোর্স টা হয়ে গিয়েছে। স্মৃতি কোনো পতিক্রিয়া দেখাল না। জুভানের যা খুশি সে তাই করছে। তার কোনো ব্যাপারে স্মৃতির নাক গলানোর কোনো অধিকার নেই। কিন্তু স্মৃতির শাশুড়ি, মারিয়াম আহমেদ কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করলেন। কেন করলেন হয়তো নিজেও জানেন না। উনি ঠিক কেমন ধাঁচের মানুষ সেটা বোঝা মুশকিল। এই একজনকে ভালোবেসে তার জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছেন তো কিছুক্ষণ পর আবার তার উপরেই রাগ দেখিয়ে দুনিয়া উল্টাচ্ছেন। শাশুড়ির এসব কর্মকান্ড দেখে দেখে স্মৃতি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তাই এখন আর এসব খুব একটা মাথায় নেয় না সে।
শুক্রবার বলে সকাল সকাল রান্নার সব কাজ সারল স্মৃতি। গোসলও করে ফেলল তাড়াতাড়ি। রুমে একা ভালো লাগছিল না বলে সে জারার রুমে গেল। জারাও এই কেবল তখন গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। স্মৃতি তার রুমে গিয়ে বসল। জারা চুল মুছতে মুছতে বলল,
‘ভাবি, আজ তো তোমার খুশির দিন।’
স্মৃতি ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কেন?’
‘ওমা, আজ না ভাইয়া আর নিধির ডিভোর্স হলো। এখন থেকে তো ভাইয়া পুরো তোমার। কেউ আর তোমাদের মাঝে ভাগ বসাতে পারবে না।’
স্মৃতি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। জারা তার কাছে এসে বলল,
‘কী হলো ভাবি, তুমি খুশি হও নি?’
স্মৃতি তার দিকে চাইল। হতাশ গলায় বলল,
‘তোমার ভাইয়া খুব লোভী, জারা।’
জারা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘সেটা তো আমি আগেই বলেছি। আমার বাবা আর ভাই দুজনেই একই প্রকৃতির।’
‘তাই বলে এত লোভী?’
স্মৃতির গলা ধরে আসে এইটুকুতেই। জারা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল,
‘হঠাৎ ভাইয়াকে তোমার কাছে এত লোভী কেন মনে হচ্ছে?’
স্মৃতি জবাব দিল না। জারা তখন মজার ছলে বলল,
‘তোমাদের জমিও কি ভাইয়া নিয়ে নিয়েছে নাকি?’
স্মৃতি করুন চোখে চাইল তার দিকে। কিন্তু তার সেই চোখের ভাষ্য জারার বোধগম্য হলো না। সে তার নিজের বলা কথাতেই কিছুক্ষণ দাঁত কেলিয়ে হাসল। স্মৃতি নিরুত্তর বসে রইল সেখানে। জারা বলল,
‘আর যাই হোক, ভাইয়া কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসে; এটা কিন্তু তোমাকে মানতেই হবে ভাবি।’
স্মৃতি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
‘হ্যাঁ, তা ঠিক। খুব ভালোবাসেন উনি আমায়’
জারা পুনরায় কিছু বলার আগেই স্মৃতি তাকে বলে নিজের রুমে ফিরে যায়। আর এইসব সহ্য করা যাচ্ছে না। ধৈর্যের বাধ যেন এবার ভেঙে যাচ্ছে। সত্যটা সামনে আসলেই সে তার স্বরূপে আসবে। এক এক করে প্রত্যেক কে শাস্তি দেবে সে। কাউকে ছাড়বে না, কাউকে না।
দুপুরের দিকে জুভান বাড়ি ফিরল। রুমে গিয়ে দেখল স্মৃতি কেউ একজনের সাথে ফোনে কথা বলছে। জুভান হাত থেকে তার ঘড়িটা খুলতে খুলতে স্মৃতির কাছে গিয়ে দণ্ডায়মান হলো। জুভান এতটা কাছে উপস্থিত হওয়ায় স্মৃতি ফোনে বলল,
‘আচ্ছা ভাই রাখি, বাবার খেয়াল রাখিস।’
কল কেটে দিয়ে সে পেছাতে নিলেই জুভান তার হাত টেনে ধরে। স্মৃতি তার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কিছু বলবেন?’
‘কার সাথে কথা বলছিলে?’
‘ভাইয়ের সাথে।’
‘আচ্ছা। তা বাবা ভালো আছেন?’
‘জ্বি, ভালো।’
‘আজকে তো জিহাদের সাথে আমাদের দেখা করার কথা ছিল, তাই না?’
স্মৃতি নিজেকে শক্ত করে বলল,
‘হ্যাঁ।’
জুভান হালকা হেসে বলল,
‘ওকে আমি আমাদের বাসায় ডেকেছি। সন্ধ্যার দিকে আসবে।’
স্মৃতি কপাল কুঁচকে বলল,
‘বাসায় কেন?’
‘কারণ আমি চাই, বাড়ির সকলের উপস্থিতিতে যেন তুমি তোমার মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করতে পারো।’
স্মৃতির ঠিক ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। জুভানের মাথায় কী চলছে সেটা সে মোটেও আন্দাজ করতে পারছে না। এই লোকটাকে বোঝা বড্ড দায়। এত ধোঁয়াশার মাঝে সঠিক ঠাঁই সে কীভাবে পাবে। আর এই লোকটা এখন ব্যাপারটাকে আরো বেশি ঘোলা করে দিচ্ছে।
জুভান ওয়াশরুমে চলে গেলে স্মৃতি আস্তে করে গিয়ে তার ফোনটা আবার হাতে নেয়। পাসওয়ার্ড হিসেবে তার নামটা লিখেও সে ফোনটা এবার আর আনলক করতে পারে না। অবাক হয় স্মৃতি। এর মাঝেই জুভান পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দিয়েছে? কিন্তু কেন? জুভান কি তবে বুঝে গিয়েছে, স্মৃতি যে তার ফোনে হাত দেয়?
বিরক্ত হয়ে স্মৃতি তখন রান্নাঘরে গিয়ে খাবার বাড়তে লাগে।
.
ডাইনিং এ খেতে বসে মারিয়াম আহমেদ ভজভজ গলায় বললেন,
‘মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স দিয়েই ছাড়লি?’
‘হ্যাঁ মা। যেটা ঠিক আমি সেটাই করেছি। এই নিয়ে আর কথা বাড়িও না।’
মারিয়াম আহমেদ মুখ কালো করে বললেন,
‘না, আমি কেন আর কথা বাড়াব? আমার কথা কি এখন আর কেউ পাত্তা দেয়? এখন তো আমার ছেলের অন্য সুপারিশ দাতা আছে, সে তো এখন কেবল তার কথা’ই শুনে চলে।’
জুভান বিরক্ত হলো খুব। বলল,
‘মা প্লিজ, শান্তিতে একটু খেতে দাও। এসব ব্যাপারে আর কথা বলো না, আমার ভালো লাগছে না।’
মারিয়াম আহমেদ কথা বাড়ালেন না। খাবারটা মুখে তুলে তিনি স্মৃতির দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে চিবুচ্ছেন যেন তিনি খাবার না স্মৃতিকেই চিবিয়ে খাচ্ছেন।
সব কাজ সেরে স্মৃতি রুমে গিয়ে দেখল জুভান মাথার উপর হাত রেখে চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে আছে। স্মৃতিও তখন কোনোরূপ সাড়া শব্দ না করে এক পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
সন্ধ্যার দিকে সত্যি সত্যিই জুভান জিহাদকে নিয়ে বাসায় ঢুকল। জিহাদকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলেই সে বাড়ির সবাইকে ডেকে আনল। বাড়িতে জিহাদকে দেখে আকবর সাহেব ভীষণভাবে চমকালেন। মারিয়াম আহমেদও ঠিক বুঝলেন না, জিহাদ কেন এসময় উনাদের বাড়িতে এসেছে। সবাই ড্রয়িং রুমে এলেও স্মৃতি তখনও আসেনি। জুভান জারাকে পাঠায় স্মৃতিকে ডেকে আনার জন্য। স্মৃতি ড্রয়িং রুমে এসে জিহাদ কে দেখে থমকে যায়। লোকটাকে সে চেনে। পাঁচ বছরে শারীরিক গঠনে খুব একটা পরিবর্তন না আসায় সে খুব সহজেই লোকটাকে চিনে ফেলল। স্মৃতি আসার পর জুভান জিহাদকে বলল,
‘জিহাদ, ও হলো তোর ভাবি। আর তোকে নাকি ও চেনে, তোর সাথে কথা বলতে চায়। আর সেই জন্যই আমি তোকে আজ বাড়িতে ডেকেছি।’
জিহাদ স্মিত হেসে বলল,
‘ভালো আছেন, ভাবি?’
স্মৃতি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাড়ির বাকি লোকগুলোও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। শাশুড়ি মা মাঝখান থেকে বললেন,
‘ওর সাথে আবার জিহাদের কী সম্পর্ক?’
জুভান স্মৃতি কে জিজ্ঞেস করল,
‘ওর কথাই তো তুমি বলছিলে, স্মৃতি?’
স্মৃতি মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘হ্যাঁ।’
জুভান জিহাদ কে বলল,
‘আমার স্ত্রীর ভাষ্যমতে তুই নাকি তাদের একটা জমি জোর করে কেড়ে নিয়েছিস, কথাটা কি সত্যি, জিহাদ?’
জিহাদ অবাক হলো যেন। বলল,
‘আমি তো যত জমি নিয়েছি তা মালিকের কাছ থেকে কিনে নিয়েছি আর সবগুলোই নিয়েছি আপনাদের কম্পানির জন্য। এছাড়া আর কোনো জমিই আমি নেইনি।’
জুভান এক পলক স্মৃতির দিকে তাকাল। আবার সে জিহাদ কে বলল,
‘ওদের জমিটা রানীরবাজারের ঐদিকে ছিল।’
জিহাদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কিন্ত ঐদিকের কোনো জমি নিয়ে আমি এখনও অবধি কাজ করিনি, স্যার।’
‘আলীনগরের কোনো জমি নিয়ে কাজ করেছেন?’
স্মৃতি এবার প্রশ্ন করল। আলীনগরের জমির কথা শুনে সকলের মুখ যেন থমথমে হয়ে গেল। জিহাদ একবার জুভানের দিকে তাকাল। জুভান যেন তাকে কিছু ইশারা করল। জিহাদ তখন বলল,
‘হ্যাঁ, আলীনগরের একটা জমি ছিল। মালিক আশরাফুল ইসলাম। উনার কাছ থেকে আমরা নগদ টাকা দিয়ে জমিটা কিনে নিয়েছিলাম।’
স্মৃতি তৎক্ষণাৎ গর্জে উঠে বলে,
‘মিথ্যে বলছেন কেন? আমার বাবাকে আপনারা এক টাকাও দেননি বরং ঐ জমিটা আপনারা আমার বাবার কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়েছেন।’
চলবে…