#অজানা-পৃথিবী
#লাবণ্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_৩
কুহেলী ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় বের হলো। ওর মনে হলো বাইরে এসে বহুকাঙ্ক্ষিত মুক্তি লাভ করতে পারলো। আলোঝলমলে মেঘমুক্ত আকাশ, দক্ষিণা উন্মুক্ত বাতাশে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে যদিও এখন বর্ষাকাল। কুহেলী মেইন দরজা দিয়ে বাইরে বের হতেই নজর পড়লো বাগানের দিকে। ও ভাবতেই পারেনি এই বিশাল বাড়িতে ওর বিয়ে হয়েছে। ওর কেমন সন্দেহ হলো,বাবা মা লোভে পড়ে আবিরের পরিবর্তে এই লোকটার সম্পত্তি দেখে বিয়েতে রাজি হয়েছিল নাতো?হতেই পারে। বাবা মা চাই সন্তান যেনো ভালো থাকে, হয়তো এই জন্যই ওর সঙ্গে এই অচেনা লোকটার বিয়ে দিয়েছে কিন্তু ওর তো অর্থসম্পদের দরকার ছিল না। ভালোবাসা কাঙালকে অর্থ দিয়ে ভুলানোর চেষ্টা নেহায়েত বোকামি ছাড়া কিছুই না। ভাঙা হৃদয় নিয়ে অর্থ দিয়ে কি আর সংসার হয়। এসব ভাবতে ভাবতে ওরা গেটের কাছে আসতেই হঠাৎ কুহেলীর ইচ্ছা করলো পেছনে ঘুরতে ও ইচ্ছা অনুযায়ী চটপট পেছনে তাকালো। তিনতলা বাড়িটা কেমন দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ একটা জানালায় ওর দৃষ্টি আটকে গেলো। চেনা সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পাঞ্জাবিতে লোকটাকে অসাধারণ লাগলো। কুহেলী তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আবারও এক ঝলক দেখে চলতে শুরু করলো। ওর মনে শুধু আবিরের স্থান সেখানে আর কারো স্থান নেই। মেয়েরা পানির মতো যেই পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে এই বাক্যে ও বিশ্বাসী না। ওতোটা শান্ত ও হতে পারবে না। বহুদিনের জমিয়ে রাখা ভালোবাসার বন্ধন হঠাৎ বিয়ের বন্ধনের কাছে পরাজিত হবে মানতে পারবে না। তাড়াছা লোকটা ভয়ানক বদমেজাজি। কুহেলী কথাগুলো ভাবতে ভাবতে গাড়িতে গিয়ে বসলো। আলিম গাড়ি ড্রাইভ করছে একমনে। ভাইয়ের এমন নিরবতা দেখে কুহেলীর কেমন লাগলো। ভাইয়া এরকম মানুষ না। ও কঠিন মূহুর্ত্তেও মজা করতে ছাড়ে না। সেই ছেলেটা আজ হঠাৎ চুপচাপ কেনো জানার জন্য ও মুখ খুললো,
> ভাইয়া বিশেষ কিছু কি হয়েছে? আমাকে নিয়ে চিন্তা করছো?
কুহেলীর প্রশ্নের উত্তর আসলোনা। আলিম নিজের খেয়ালে আছে। কুহেলী এবার উত্তর না পেরে ভাইয়ের কাধে হাত রাখলো,
> ভাইয়া কি হয়েছে কথা বলছো না কেনো?
> কিছু বলছিস?
> কি এতো ভাবছো?
>কিছুনা। ও বাড়িতে কবে ফিরবি ঠিক করেছিস?
> না,ওখানে আর ফিরছি না। আমি আবিরের খোঁজ করবো আর আমাকে তুই সাহায্য করবি। আমি কিন্তু সুইসাইড করবো ওকে না পেলে।
> হুম।
কুহেলী অবাক হলো ভাইয়ের এরকম কথা শুনে। উন্যদিন হলে বকাবকি করতো। সান্ত্বনা তো আছেই কিন্তু আজ কি হলো?। ওর ভাবতে ভাবতেই গাড়ি থেমে গেলো। ওরা বাড়িতে পৌঁছে গেছে। বাড়ির সামনে নামতেই দেখলো পাশের বাড়ির পিচ্চিগুলো পাশের খোলা জায়গাই ক্রিকেট খেলছে। কুহেলীর বেশ মজা লাগে ওদের খেলা দেখতে কিন্তু বাচ্চা গুলোও কেমন উদাসীন। খেলছে অথচ কথা বলছে না, চেচামেচি করছে না নীরব হয়ে খেলছে। ও বেশিক্ষণ রাস্তায় দাঁড়াতে পারলো না আলিম ওকে ডাকলো ভেতরে যাবার জন্য। কুহেলী তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। বাড়িটা একদিনের মধ্যেই কেমন পরিবর্তন হয়ে গেছে। পাশে ছোট একটা বাগান করেছিল সেখানে নানারকম ফুল ফুটেছে। একটা কালো গোলাপের গাছ দেখে ও অবাক হলো এটা আগে কখনও দেখেনি তারপর ভাবলো হয়তো ভাইয়া লাগাতে পারে। বাগানের দিকে বিয়ের জন্য তেমন একটা নরজ দেওেয়া হয়নি। আলিম কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে গেলো। কুহেলী ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই ওর মা আবেদা বেগম হাসিমুখে ওকে ভেতরে আসতে বলল। কুহেলী আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলোনা তাড়াতাড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাই ভেঙে পড়লো। আবেদা বেগম মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,
> কি হয়েছে বলবি এরকম পাগলামী কেনো করছিস? বাবা কিন্তু রাগ করবেন। কতোভালো ঘরে তোর বিয়ের দিয়েছে বলতো?
> আমি ওখানে আর ফিরবো না বাবাকে বলে দিবা। আবির কোথায় জানো তুমি?
> আবেদা তুমি মাইয়ারে ভালো শিক্ষা দেবার পারোনাই। আমাগো মাইয়া পুলা আছিলো না?
হঠাৎ ভেতর থেকে এরকম উক্ত আসবে কূহেলী আশাকরেনি। ওদের বাড়িতে কোনো বৃদ্ধ লোক ছিল না উনি আবার কে? দেখার জন্য কুহেলী তাড়াতাড়ি মাকে ছেড়ে ভেতরে আসতেই ওর চোখ ছানাবড়া। সোফায় বসে আছে ওর মরহুম দাদিজান এবং দাদু। কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য ভয়ে ওর শরীর কেঁপে উঠলো। উনারা মারা গেছেন অনেক বছর আগেই যখন ও একেবারেই পিচ্চি ছিল। তেমন কিছু বুঝতেও না ঠিক তখন। তাহলে উনারা এখানে কি করছে? কুহেলীর মনে হলো এখানে না আসাই ভালো ছিল । ও ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকালো কিন্তু ওর মায়ের মুখ একদম স্বাভাবিক। কুহেলী তাড়াতাড়ি উপরে উঠতে শুরু করলো। পেছনে তাকানোর সাহস নেই। কি হচ্ছে এসব আল্লাহ্ জানেন। ও রুমের দরজা বন্ধ করে ভাবলো আর দরজা খুলবে না। বাইরে ভুমিকম্প হলেও না। ও তাড়াতাড়ি নিজের ফোনটা ড্রয়ার থেকে নিয়ে নিলো। রুমটা একদম গোছানো পরিপাটি করা আছে যেমনটা ও পছন্দ করে ঠিক তেমনি। ও ফোন হাতে পেয়েই আবিরের নাম্বারে ফোন করলো। দুবারের পর তিনবারের সময় রিং হতে শুরু করলো কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না। উত্তেজনাই কুহেলীর শরীর কাঁপছে। ও আবারও চেষ্টা করলো বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরে ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে আবির সালাম দিয়ে বলল,
> কে বলছেন?
> আবির আমি কুহু বলছি। কোথায় তুমি? তুমি সেদিন আসোনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছো তাইনা? বলতে পারতে আমাকে তোমার পছন্দ না আমি তোমার জীবন থেকে সরে যেতাম কেনো এমন করলে? কান্না করে
> আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না? আর কিসের প্রতারণা?
> সন্ধ্যায় দেখা করো। আমি আমাদের চেনা সুরমা কফি হাউজে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।
> অদ্ভুত আমি কেনো আপনার সঙ্গে দেখা করবো? শুনেন আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। আমি যেতে পারবো না।
> বললাম তো সন্ধ্যায় অপেক্ষা করবো যা বালার সামনে এসে বলবে। রাখছি।
কুহেলী মুখটা কঠিন করে ফেলেছে। আবিরের কিছুই হয়নি ছেলেটা ভালো আছে কিন্তু ওকে এমন অচেনার মতো ভান করছে কেনো? বাবা মায়ের চাপে নাকি ওই লোকটার হুমকিতে এমন করছে? আবির মোটেও ওরকম ছেলে না। ও কোনো কিছুর বিনিময়েই নিজের ভালোবাসাকে ছাড়বে না। কুহেলী বিছানায় বসে আবিরকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর মনে হলো বাইরে দাদুদের কথা। উনারা কিভাবে এক রাতের মধ্যেই ফিরে আসলেন? ওর মাথায় সমস্যা হচ্ছে নাতো? আসলেও কি উনার মারা গিয়েছিল নাকি কোথাও ছিল? কুহেলীর এসব ভাবতে ভাবতেই দরজায় কেউ নক করলো। ও চোখের পানি মুছে ভয়ে ভয়ে দরজার পাশে গিয়ে উঁকি দিলো। বাবা দাঁড়িয়ে আছে। কুহেলী তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
> দাদু কিভাবে আসলো? উনি তো মারা গিয়েছিলেন।
> মা শান্ত হয়ে আমার কথাগুলো শোন? তোর ভাইয়ার সঙ্গে আমার পরিচিত একজন সাইক্রেটিসের সঙ্গে আগামীকাল দেখা করে আসবি। দাদুকে নিয়ে এসব বললে উনি কি ভাববেন শুনি? তোকে কতটা ভালোবাসে আর উনার আদরের কুহু উনাকে মৃত বলছে,ভাবলেই কষ্ট পাবেন।
> কিন্তু বাবা আমার এমন কেনো মনে হচ্ছে?
> তুই রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর আমি দেখছি।
> আচ্ছা।
কুহেলী বাবাকে ছেড়ে দিয়ে রুমে গিয়ে বসলো। সব কিছু ঘোলাটে লাগছে। আবির পাশে থাকলে এক মূহুর্ত্তের মধ্যে সমাধান করে ফেলতো। মাথাটা কেমন দপদপ করে জ্বলতে শুরু করলো। কুহেলী বিছানায় গিয়ে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণ ঘুমানোর দরকার ছিল কিন্তু ঘুম আসবে না তবুও ও চেষ্টা করলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে ওর চোখটা ঝাপসা হয়ে গেলো আর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
বিশাল দীর্ঘ ব্রিজের উপর দিয়ে দৌড়ে চলেছে কুহু। ব্রিজটা নড়াচড়া করছে হয়তো ভেঙে যাচ্ছে নয়তো স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ভয়ে কুহুর শরীর কাঁপছে। ও চিৎকার করে ডাকছে কিন্তু কেউ ওকে সাহায্য করছে না। দৌড়াতে দৌড়াতে যখন ও প্রায় তীরে চলে আসলো ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ একজন ওর শাড়ির আচলটা টেনে ধরলো। কুহেলী হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। ও গড়িয়ে গিয়ে উঠতে গেলো তখনই দেখলো আবির একটা ধারালো তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুহেলীর চোখে বিস্ময় আবির ওকে মারতে চাইছে কিন্তু কেনো? কুহেলী হাতটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে জিঞ্জাসা করতে গেলো তখনই আবির ওর দিকে তরবারি চালিয়ে দিলো। কুহেলী ভয়ে চোখ বন্ধ করলো কিন্তু পরক্ষণেই তরবারিটা কেউ একজন ধরে আবিরকে ধাক্কা দিয়ে ওকে নিয়ে তীরে ঝাপ দিলো। চোখের পলকে সব ঘটে গেলো। ব্রিজটা আবিরকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। কুহেলীর শরীর কাপছে। ঘড়ির কাটা ঢং করে বেজে উঠলো। কুহেলী চোখ খুলে তাকালো এতক্ষণ ও স্বপ্ন দেখছিল। ওর চোখে পানি হাতপায়ের শক্তি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। এরকম অদ্ভুত স্বপ্নের মানে কি আল্লাহ্ জানেন। ও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো ছয়টার পরে আবির আসবে কফি হাউজে ওখানে গিয়ে ওর মুখোমুখি হতে হবে। ওর জানা নেই সেখানে ওর জন্য আবারও কি চমক অপেক্ষা করছে।
চলবে