অতৃপ্তির মাঝে তৃপ্তিময় সে পর্ব -১৭+১৮

#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -১৭
________________
৩৭.
–“আদ্রিন ছেলেটার চোখে তোর জন্যে ব্যাকুলতা স্পষ্ট।কি সুন্দর দেখতে উনি!ওরে তৃপ্তি আমি এখন না তোর উপর জেলাস।”
অর্পা হেসে বললো তৃপ্তিকে।
তৃপ্তি সংকচিত হলো মুহূর্তেই।কিন্তু,আঁখি তার এখনো আদ্রিনের পেছনের অবয়বে সীমাবদ্ধ।কানে ফোন চেপে ছেলেটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে তার কাজের দিকে উদ্যত।কিছু সময় বাদেই আদ্রিনের অবয়ব হাওয়ায় মিললো।পলক ফেলে তৃপ্তি।পরপরই তার কানে ভেসে আসে প্রিয়র কণ্ঠস্বর,
–“ভাইয়াটা অনেক ভালো।আমাকে টাকা দিয়েছে চকলেট খাওয়ার জন্যে।আপু ভাইয়াটাকে আমাদের বাসায় আটকে রাখবো সুযোগ পেলে।কেমন!”
অবুঝ প্রিয়র কথায় হাসিতে ফেটে পড়ে অর্পা।পেটে হাত বুলিয়ে নিজের হাসি দমনের চেষ্টায় সে জবাব দেয়,
–“বাসায় আটকে রাখতে পারবে কিনা জানা নেই,কিন্তু তোর বোনের মনের ঘরে তোর ভাইয়াটা আটকে গেছে। এটা জেনে রাখ,প্রিয়।”

তৃপ্তি মজার ছলে চড় দেখায় অর্পাকে।হাত নাড়িয়ে বলে,
–“বেয়াদপি বন্ধ করবে?ছোট মেয়ের সামনে কি-সব বলছো।”
তৃপ্তির হু’মকিতে নাক ফোলায় অর্পা।ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে প্রিয়র হাত চেপে ধরে,
–“চল রে প্রিয় আমরা যায়।এই শক্ত মেয়েটা গলবার মতো না।থাকুক সে তার শক্ত অভিমান নিয়ে।বেশি দেরী হলে কিন্তু এই সুদর্শন পুরুষকে আমার ভান্ডারেই বন্ধী করবো।”

অদ্ভুত জ্ব’লনে তৃপ্তির গা শিরশির।মনে হচ্ছে উত্তপ্ত লাভায় জ্ব’লছে সে।সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো,অর্পার এই মজার ছলে বলা কথাটাও সহ্য করছে না তার করুণ আঁখি।সেথায় ভিড় করলো অভিমানী জল।অর্পা থেমে নেই।সে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় সমেত।কম্পিত কণ্ঠে তৃপ্তি বেশ চিল্লিয়ে বলে,
–“ঐ মানুষটা শুধুই আমার,অর্পা।”
অর্পা হাসে।পেছনে বাঁক ফিরে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে উত্তর দেয়,
–“এইতো আমার বোন।এইভাবেই নিজের ভালোবাসার জন্যে গলার স্বর চওড়া করবি।”
অর্পা চলে যাচ্ছে।
তৃপ্তির পা থেমে।এই ক্ষণে তার কান্না পাচ্ছে বেশ।হলোও তা।অভিমানী জল গাল গড়িয়ে পড়ে। হাসফাঁস লাগছে তার।কাধেঁর উপর বসা শাড়ির আঁচল অল্প টেনে হাতে আবদ্ধ মোবাইল ফোনে আঙ্গুল চালিয়ে মুহূর্তেই ফোন লাগালো তার কাঙ্খিত পুরুষকে।

অল্প সময়ের ব্যবধানে তৃপ্তির নাম্বার থেকে ফোন আসতে দেখে বিচলিত আদ্রিন।তার মেহেবুবার কোনো বিপদ হয়নি তো!তীব্র কণ্ঠে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে কল রিসিভ করলো সে।আদ্রিন চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
–“ঠিক আছো, তৃপ?হঠাৎ কল দিলে?”
–“আপনি শুধুই আমার।”
ব্যস বিপ শব্দে ফোন কাটলো।কম্পিত স্বরে তৃপ্তির সেই বুলি আদ্রিনের কানে ছন্দ তুলছে।তার হাসিমুখ দেখে তন্ময় বুঝলো,নিশ্চয় কোনো খুশির সংবাদ দিয়েছে তার স্যারের মনের মানুষটা।উত্তজনা সহ্য না করে মুখ খুললো তন্ময়,
–“তৃপ্তি ম্যাডাম কি বলেছে, স্যার?আপনাকে অনেক হাস্যোজ্বল দেখাচ্ছে।”
চোখের আয়তন ছোট হয় আদ্রিনের। সিটে গা এলিয়ে কড়া সুরে সে আওড়ায়,
–“আমার আর আমার মেহেবুবার মাঝের সকল সুখ দুঃখের খবর শুধু আমি জানবো,তন্ময়।”
বড্ড অহংকারী মনে হচ্ছে এখন আদ্রিনকে।তন্ময় তাও এই অহংকারীকে কিছু বললো না।ইশারায় ড্রাইভারকে গাড়ি চালানোর নির্দেশ দিয়ে সেও চুপ।মন তার চুপ নয়।স্যারের এমন হাস্যোজ্বল রূপ তার পছন্দ হচ্ছে ইদানিং।আদ্রিন নামের শক্ত পুরুষটা কখনো একটা মেয়ের ফোন কলে এমন মিটিমিটি হাসবে,মজার ছলে কথা বলবে এমনটা ভাবেনি তন্ময়।পেছন ফিরে সে আদ্রিনের পানে তাকালো পুনরায়।আদ্রিন তার মোবাইলে মগ্ন।অধরে সেই তির্যক হাসি।নিশ্চয় সে এবং তার মেহেবুবার ছবি দেখে এই প্রেমিকের মন উতলা হচ্ছে!
.
তৃপ্তি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে নিঃশব্দে।আলেয়া কিছু কাপড়ের স্যাম্পল দিয়েছিল।সেই স্যাম্পলের ফটোশুট করে আবারও আলেয়ার বাসায় যাওয়ার জন্যে উদ্যত তৃপ্তি। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাতে বড় ব্যাগটা নিয়ে বেরুনোর পূর্বে নিজেকে পুনরায় পরখ করলো সে আয়নায়।কালো রঙের লং শার্ট তার বেশ ঢোলা। হাঁটুর নিচ হতে নীল জিন্স স্পষ্ট।মাথায় পেঁচানো স্কার্ফ আর আঁখি ঢাকা কালো রোদ চশমায়।বাহিরে তীব্র রোদ।বিনা বাক্যে সে বাড়ি হতে বেরুলো।বিকালে অর্কের আশীর্বাদ।তাই সব কাজ তার আগেই শেষ করা বাধ্যতামূলক।
আদ্রিনের সাথে ইয়াকুব বিল্ডার্সে শেষ দেখা হয়েছিল তার।এরপর থেকেই বাড়িতে ছিলো সে নানান কাজে।ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা।সেমেস্টার শেষ তার।এই কারণে ভার্সিটির চাপ নেই।কিছুদিনের জন্যে কেবল প্রশান্তি।কাজের ভারে নাস্তানাবুদ তৃপ্তি ভুলেই বসেছে সে আদ্রিনকে কতো নেশাক্ত কথা বলেছিলো সেদিন।বিয়ে বাড়ির কাজের ব্যস্ততা বা পেইজ সামলানো এইসবে আদ্রিনের সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে একেবারে কম।আজ সকালেও তৃপ্তি তার কাজের কথা জানিয়ে বিদায় জানিয়েছে আদ্রিনকে।এরপর হতে তার সাথে কথা নেই।কিন্তু,তৃপ্তির বিশ্বাস আদ্রিন তাকে আজ দেখতে আসবে।মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায় তৃপ্তির।

বাড়ির গাড়ি উপস্থিত থাকলেও সে রিকশাকে উপযুক্ত মনে করে। রোদের তেজ মুহূর্তেই তার চকচকে শরীরকে ঘামে নাইয়ে দিয়েছে।হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম পুছে মেয়েটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে।প্রিয়তমকে দেখার অপেক্ষা যেনো কিছুতেই কমছে না।
৩৮.
হাতের কাজ শেষ করে আলেয়ার বাসার নিচে নামে তৃপ্তি।দুপুর বেলায় রোদের তেজ কিছুটা কমে। অদূরে কিনারায় দেখা যাচ্ছে আইস্ক্রিমের ভ্যান।তৃষ্ণার্ত মন তার লোভে ভরপুর।ধীর পায়ে সে এগুচ্ছে সেথায়। মনে মনে সে পরিকল্পনা করলো আদ্রিনকে ফোন করার। ভ্যানের দিকে পৌঁছানোর পূর্বে তার কানে প্রবেশ করে পরিচিত সুর।তবে এই সুরে খুশি হয়নি তৃপ্তি।

–“আদ্রিনের মেহেবুবা?”
ঘুরে তাকায় তৃপ্তি।আরাফাত দাঁড়িয়ে।মুখে তার হিং’স্র’তা।
–“হ্যাঁ।কোনো সমস্যা?”
তৃপ্তির পাল্টা জবাব।
আরাফাত হাসে।বেশ সামনেই এগিয়ে আসে তৃপ্তির।যার দরুণ কিছুটা পিছিয়ে যায় মেয়েটা।
–“বয়ফ্রেন্ড দিয়ে মাইর খাইয়ে নিজেকে সাহসী ভাবা হচ্ছে?ভুলে যেও না আমাদের রিলেশনে আসার জন্যে তুমি আমাকে বাধ্য করেছিলে।”
তৃপ্তির মেজাজ বিগড়ানো।এই ছেলে সেই পুরানা গল্প কেনো আওড়ায় জানেনা তৃপ্তি।তবে আজ এর দফা রফা করেই দম নিবে।
–“শুনো আরাফাত,অতীত নিয়ে দফা রফা করার সময়টা আমি নির্ধারণ করছি আজ।তুমি আমার জন্যে একটা মোহ ছিলে,তাও অন্য কারো প্রতিচ্ছবি হিসেবে।উক্ত ব্যক্তিকে আমি পেয়েছি আর সে আমার জীবনেই আছে।এছাড়াও তুমি কখনো আমার প্রতি মনোযোগী ছিলেই না।ছোট ছিলাম বুঝিনি,তাই ভুল করেছি।সেই ভুল হওয়ার বছর গড়িয়েছে অনেক।এখন এইসব বলে কি লাভ?আমাদের সম্পর্কটা কোনো সম্পর্কের আওতায় পড়েই না।তাই আমাদের নর্দমা সমতুল্য অতীত নিয়ে আর ভেবো না তুমি।নাহলে এইবার আদ্রিন নয় আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করবো না।”

এতটুক কথা যথেষ্ট ছিল আরাফাতকে ক্ষেপিয়ে তোলার।হুট করেই সে তৃপ্তির মুখ চেপে ধরে।চেয়েও তৃপ্তি চেঁচাতে পারছে না।এই আবাসিক এলাকার গলি একটু নিস্তব্ধ।সেই আইস্ক্রিম বিক্রেতাও নেই এখন। ব্যাগে তৃপ্তির মোবাইলের ভাইব্রেটর আপন গতিতে বিপ বিপ শব্দ করছে।আরাফাত আরো জোরে বল প্রয়োগ করলে ব্যথায় তৃপ্তির আঁখিতে জমে জল।আরাফাত আর কিছু বলতে নিলে তৃপ্তি সেই হিংস্র মানবের গলায় নখ দাবিয়ে দেয়।তাও ক্ষান্ত হলো না আরাফাত।কাটকাট গলায় জবাব দেয়,
–“ইচ্ছে মতো আমার জীবনে এসেছিলে আবার চলেও গেলে।যদিও আমার অনুভূতি তোমার জন্যে শূন্য ছিলো।কিন্তু, প্রেমিক দিয়ে মাইর খাইয়ে ভুল করেছো।আবার এখন বলছো তুমি মা’রবে! আহ জান,
ভেবেছিলাম কেটে পড়বো তোমাদের মধ্য থেকে। তবে পারছি না।বিশেষ করে তোমার রূপে আমি আটকে।আদ্রিন আর তোমার সম্পর্ক ভাঙার দায়িত্ব আমি নিলাম।”

হঠাৎই গাড়ির হর্নের শব্দ।হয়তো কোনো গাড়ি বাঁক ফিরছে এই আঁকাবাঁকা রাস্তায়!তৃপ্তিকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে আরাফাত।ঠোঁটে হাতের তালু স্পর্শ করে চুমুর ইশারা করে সে।ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে তৃপ্তির।রাস্তায় আচমকা পড়ার দরুণ হাতের তালু তার ছিলে যায়।দ্রুত নিজেকে সামলে উঠে পড়ে।যতোই বাহাদুরি করুক সে।আজ বড্ড ভীত মেয়েটা।একটা ছেলের এমন হুমকি,বাজে স্পর্শ সবকিছুই ভয়ংকর।অতি ভয়ংকর।তৃপ্তি হয়তো পরে কিছু ভাবতে পারবে এই বিষয়ে। এখন সে শঙ্কিত।চোখে রোদ চশমা পড়লো পুনরায়।মুখে স্কার্ফের আস্তরণ।ভাবলেশহীন হেঁটে যাচ্ছে সে রাস্তার ধারে।
তীব্র শব্দে গাড়ি থামে তার পাশে।এতে তার হুঁশ নেই।নিজের বাহুতে সে বেশ পরিচিত মোলায়েম স্পর্শ অনুভব করে।কিঞ্চিৎ চমকে উঠলেও তার মনটা এখন প্রশান্তিতে ভরপুর।তার মুখের স্কার্ফ,কালো রোদ চশমার আড়ালে আঁখির জল সে লুকিয়ে ফেলেছে বিনা ভনিতায়।
.
–“ফোন দিচ্ছিলাম।ধরলে না কেনো?আর এইভাবে আগাগোড়া প্যাকেট হয়ে আছো কেনো?গরম লাগে না?এইযে দেখো আমি সামান্য গাড়ি থেকে দুই মিনিট বের হয়েই ভিজে জপজপে।”
আদ্রিনের নরম সুর।বেশ আহ্লাদ তার কণ্ঠে।তৃপ্তি জমিনে অবস্থিত আদ্রিনের দুপায়ে চেয়ে।আরাফাতের ঘটনা তার মস্তিষ্কে জট পাকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।
–“এই,কি ভাবছো?ভাবছো,এমন প্যাকেট হয়ে আছো তুমি।তাও কিভাবে আমি চিনেছি তোমাকে?”
তৃপ্তির জবাব নেই।আদ্রিন তার জবাবের অপেক্ষা না করে নিজেই উত্তর দিলো,
–“তোমার চেহারা না দেখেও,তোমাকে চেনার জন্যে তোমার অবয়বই যথেষ্ট।”
আদ্রিন তৃপ্তিকে গাড়িতে বসায়।সে ক্লান্ত ভেবে উত্তর দিচ্ছে না,এটাই আদ্রিনের ধারণা।

–“একটু পানি খাবো।”
তৃপ্তির স্বর শান্ত। বিমর্ষে ভরপুর। এইবারও সে ক্লান্ত ভেবে আদ্রিন পানির বোতল এগিয়ে দেয়।তৃপ্তি ঠোঁটের উপরে স্কার্ফ সরিয়ে পানিটুকু খেলো।
–“কি হয়েছে?”
আদ্রিনের প্রশ্নের পর পর এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে মুহূর্তেই।রং সাইড থেকে আগত একটা মোটর বাইকের সাথে আদ্রিনের গাড়ির সংঘর্ষ হয়।সঠিক সময়ে আদ্রিন ব্রেক করায় ব্যাপারটা খারাপ দিকে এগোয়নি।কিন্তু,মেজাজ খোয়ায় আদ্রিন।গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বেশ কড়া সুরে কথা শুনায় সে বাইক চালককে।
তৃপ্তি অবাক হয়ে ভাবে,এই ছেলেই কি এতক্ষণের মধুর কণ্ঠের ছেলেটা?আদ্রিনের তিরিক্ষি কণ্ঠে তৃপ্তি চেপে বসে।হাতের তালুর ক্ষ’ত পোড়াচ্ছে তাকে।
ঘটনা স্বাভাবিক হলে আদ্রিন বিনা শব্দেই গাড়ি চালু করে।শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
–“রেস্টুরেন্ট যাচ্ছি।শেষবারের মতো জিজ্ঞাসা করছি,কি হয়েছে?ক্লান্ত হলে বলো,আমি ক্লান্ত।”

তৃপ্তি তার নরম হু’মকিতে কিঞ্চিৎ ভয় পায়।তাই ভারী কণ্ঠে সে জবাব দেয়,
–“ক্লান্ত আমি।”

আদ্রিন মুচকি হাসে।তৃপ্তির হাতের মুঠোয় নিজের হাতের অবস্থানের জানান দিতেই আর্তনাদ করে উঠলো সে।ভরকে যায় আদ্রিন।সে তো বেশি বল প্রয়োগ করেনি। তাহলে কিসের এত ব্যথাময় আর্তনাদ!গাড়ি দ্রুত সাইড করে আদ্রিন।তৃপ্তির হাতের তালু মেলে ধরে নিজের সম্মুখে।বুকটা কেমন হাহাকার করে উঠে তার।হাতের শুভ্র চামড়া খসে লাল চামড়া দৃশ্যমান।এমন অবস্থা সহ্য করা দুষ্কর।
–“কিভাবে এইসব হয়েছে?কিছু বলছো না তুমি।আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু,তৃপ্তি।”

বিনা উত্তরে তৃপ্তি হাত সরাতে চায়।আদ্রিন এমনটা হতে দেয় না।তার চোখ হতে চশমা সরাতেই আবারও অবাক হয় মানব।তার প্রেয়সীর নিরব কান্নায় আসক্ত।অথচ সে টের পেলো না পাশে বসেই।তৃপ্তির স্কার্ফ সরাতে নিলে বাঁধ সাধে সে।তবে আদ্রিনের জিদের সাথে পেরে উঠে না মানবী।স্কার্ফ সরতেই আদ্রিনের ভেতরকার রাগের আগমন হয় নিমিষেই।তৃপ্তির শুভ্র গালে আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট।আদ্রিনের রক্ত’চ’ক্ষু স্পষ্ট দেখতে পেয়ে তৃপ্তি সশব্দে কেঁদে বলে,
–“আমি কি করেছি,আদ্রিন?সবাই আমাকে কেনো এমন কষ্ট দেয়?আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।এই মনে,এই হাতে,এই গালে।আমি সবসময় নিজেকে আড়াল করতে চাই সকল সমস্যা হতে।কিন্তু….কিন্তু ঘুরে ফিরে আমিই কষ্ট পায়।আমি…দো..দোষ না করেও কেনো এমন কষ্ট পাচ্ছি?”

কোমরে একহাত হাত পেঁচিয়ে অপর হাত মাথায় চেপে বাহুডোরে আগলে নিলো সে তৃপ্তিকে। পীড়াদায়ক হাতেই তৃপ্তি আদ্রিনের পিঠে হাত রাখে।মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে আদ্রিন তাকে বলে,
–“তোমার সব কষ্ট আমি গায়েব করবো,তৃপ।শুধু একটাবার বলো,কিভাবে হয়েছে এইসব?”
তৃপ্তির কান্নার পরিমাণ বাড়ছে।সে ফুঁপিয়ে বললো,
–“আপনি আমাকে কখনোই কষ্ট দিবেন না।আমি দুনিয়ার কষ্ট সহ্য করলেও,আপনার দেওয়া কষ্ট সহ্য করবো না।কখনোই না।”
আদ্রিন আরো শক্ত করে নিজের বাঁধন।এই মেয়েকে সে কষ্ট দিবে?সামান্য ব্য’থা পেয়েছে দেখে আদ্রিনের শ্বাস আটকে আসছে।যে এমনটা করেছে তাকে সে ইহকালে ছাড়বে না।ভেতরকার হিং’স্র সত্তা বি’শ্রী একটা পণ করলো।

–“দিবো না কষ্ট। কাঁদে না,লক্ষ্মী।দেখি।”
তৃপ্তি মাথা উঠায়।আদ্রিন তার শার্টের হাতায় তৃপ্তির গালের পানি পুছে। গালের উপর দৃশ্যমান অস্পষ্ট দাগে আঙ্গুল বুলায় আদ্রিন।পরপর সেখানে নিজের অধর ছুঁয়ে দেয়,
–“আমার আদর।”

গাড়িতে বিদ্যমান ইমারজেন্সি ফার্স্ট এইড বক্স হতে এন্টিসেপটিক নিয়ে তৃপ্তির হাতের ক্ষতস্থানে লাগায় আদ্রিন।
–“আগে কিছু খাবে।কে করেছে এইসব,কিছুই বলা লাগবে না।আমি খবর নিবো।এইদিকে আসো।”
আদ্রিন তৃপ্তিকে নিজ কাঁধে টেনে নেয়।তৃপ্তিও আদ্রিনের শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ বাহু আঁকড়ে করে নির্দ্বিধায়।

আজকের খাবার তৃপ্তি আদ্রিনের হাতেই খেয়েছে।তৃপ্তির মাথা আদ্রিনের বাহুতে ঠেকে।কিছুতেই আরাফাতের ব্যাপারটা মাথা হতে সরছে না তার।এক পর্যায়ে সে আদ্রিনকে বলেই ফেললো,
–“আরাফাত করেছে এমন।সে কেনো হুট করে আমার পেছন নিচ্ছে আমি জানিনা।তাকে আমার ভয় হয়।”
গতবারের কেলানি শেষে আরাফাত পুনরায় এমন কাজ করবে এটা ভেবেই অবাক হচ্ছে আদ্রিন।সে আরাফাতকে আঘাত করতো না।কিন্তু,খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে,তৃপ্তির জন্যেই এইখানে আসে আরাফাত।মেজাজ আবারও বিগড়েছে আদ্রিনের।তবে, সে যথেষ্ট শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
–“ভয় পায় না।আর ঐ নর্দমার কিটকে একেবারেই না।যে আঙ্গুলের দাগ তোমার গালে বসেছে সেই আঙ্গুলই যদি না থাকে,তাহলে ব্যাপারটা সুন্দর হবে না?”
–“জ্বী?”
তৃপ্তি দ্রুত নিজ মাথা তুললো।দ্রুত শ্বাস ফেলা অবস্থায় আদ্রিন তার চুলগুলো বারবার পিছে ঠেলছে। ঘাড় কাত করে সে খানিকটা তৃপ্তির পানে এগোয়।তৃপ্তি আবেশে চোখ বুঁজে।
পরপর তার কানে ভেসে এলো আদ্রিনের শক্তমুখে বলা কথামালা,
–“আমার মেহেবুবার দিকে তাকানো মানা।সেখানে তাকে যে এতো হেনস্তা করেছে আঙ্গুল দিয়ে,সেই আঙ্গুল থাকা একেবারে বেমানান।তোমাকে যেখানে আমি আগলিয়ে রাখি,সেখানে তার এমন সাহসিকতার পুরষ্কার এমন হিংস্রতার সাথে দিতেই হবে।তুমি আমার জীবনে সবচেয়ে দামী।আর এই দামী জিনিস ধুলো পড়া নিষিদ্ধ,পড়লেও সাফ করার দায়িত্ব আমার।”
#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -১৮
___________________
৩৯.
–“হ্যালো আদ্রিন,আপনি কোথায়?আরাফাতকে পাওয়া যাচ্ছে না।আপনি কিছু করেননি তো তাকে?আদ্রিন কথা বলুন!”
তৃপ্তি এক নাগাড়ে কথা শেষে দম ফেললো।পরক্ষণে অপর পাশ হতে অচেনা পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো,
–“ম্যাম,স্যার মিটিংয়ে।মিটিং শেষেই উনাকে আমি জানাচ্ছি।”
ছেলেটা কথা শেষে তৃপ্তির উত্তরের অপেক্ষায় রইলো কিছুক্ষণ।কিন্তু,তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তৃপ্তি ফোন রাখলো খট করেই।
মাথা কাজ করছে না তৃপ্তির।বাসা ভর্তি মানুষ।দুই পক্ষের সকলেই উপস্থিত।তবে অনুষ্ঠান থমকে আছে আরাফাত নামক মানবের কারণে।এই ছেলে আজ সন্ধ্যা হতে নিখোঁজ।সকলে ভেবেছিল ফিরে আসবে,
হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত।এখন অব্দি না ফেরায় তাই সকলে বিচলিত।আরাফাত অর্কের হবু বউয়ের পরিবারের বিশেষ অতিথি।সে বিহীন অনুষ্ঠানের কার্যবিধি কিভাবেই বা চলবে?এছাড়াও সকলে এখন চিন্তিত আরাফাতের জন্যেই।

আদ্রিনের কথার জের ধরেই তৃপ্তি ভাবে আরাফাতের ক্ষতি আদ্রিন করেছে।কারণ,আদ্রিনের চোখে অন্যরকম ক্রোধ দেখেছিলো সে আজ।সেদিনকার ঐ অচেনা ছেলে কেবল তৃপ্তিকে ছুঁতে চাওয়ার অপরাধে আদ্রিন তার গলায় পা বসিয়েছিল।তাহলে আজ সে কি করবে আরাফাতকে?আজ আরাফাতের অপরাধ ছিলো বড্ড ঘৃণিত।

তৃপ্তি নিজের ভারী কারুকাজ খচিত ওড়না তুলে নেয় বিছানা হতে।সে এখন বেরুবে।উদ্দেশ্য তার আদ্রিনের অফিস।তার অফিসের নাইট শিফটের ছুটি হয় রাত ৯টায়।তৃপ্তির আজ আদ্রিনের কথার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন।সে সত্যি কি মিটিংয়ে!সবকিছু মেনে নিলেও অন্যজনের প্রাণ না’শের মতো ক্ষতি করা কিছুতেই তৃপ্তি মেনে নিবে না।আরাফাত যদি সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ করতো,ঘটনা তখন অন্য হতো।কিন্তু এইভাবে,সামান্য কাহিনীর জন্যে তাকে গুম করবে কি আদ্রিন!

নিচে সকলেই ব্যস্ত আরাফাতের খোঁজে।তৃপ্তি চামেলীকে সাত পাঁচ বুঝিয়ে ঘরের বাহির হলো।আদ্রিনের অফিস এই বাড়ি হতে বেশি দূরে নয়।রিক্সায় উঠে সে ফোন চেক করলো।সময় এখন ৮.৪০মিনিট।মিনমিন সুরে সে রিকশাচালককে শুধালো,
–“জলদি চলেন,মামা।”

আদ্রিনের অফিসের ভেতরে কখনো যায়নি তৃপ্তি।কেবল বাহির থেকেই দেখেছিল।প্রথমেই গেইটে দারোয়ান তাকে কিছুতেই প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছিলো না। পরে সে আদ্রিনকে ফোনে না পেয়ে তন্ময়কে ফোন করে।তন্ময় তৃপ্তিকে দুঃখিত বলে দারোয়ানকে ফোন দিতে বলে। তন্ময়ের বক্তব্য শুনে,মুহূর্তেই দারোয়ান মাথা নিচু করে ক্ষমা চায় তৃপ্তির নিকট।তবে তৃপ্তি অপেক্ষা করলো না।অনুমতি পেয়েই ভেতরে ছুট লাগালো ।

এইভাবে ভারী বেশভূষায় তৃপ্তিকে দেখে অফিসের বেশিরভাগ কর্মচারী হতভাগ।রিসিপশনের সামনে এসেই দম ফেলে তৃপ্তি,
–“আদ্রিন আছেন?”
রিসিপশনিস্ট মেয়েটা কিঞ্চিৎ অবাক হয়,
–“স্যার মিটিংয়ে।”
–“কোন ফ্লোরে?”
–“সরি ম্যাম,যাওয়া যাবে না এখন।আপনি বসুন প্লিজ।”
বিরক্তিতে তৃপ্তি “চ” উচ্চারণ করে।তড়িঘড়ি করে আবারও তন্ময়কে ফোন করলো।তন্ময় ফোন ধরতেই বিক্ষিপ্ত কণ্ঠে তৃপ্তি আওড়ালো,
–“আদ্রিন কোন ফ্লোরে আছে?”
–“ম্যাম,আপনি ঠিক আছেন?”
–“আপনারা কোন রুমে মিটিং করছেন?আপনি ফোন ইউজ করছেন,আপনার স্যার কেনো করছেন না?”
তৃপ্তির রাগের পরিমাণ বাড়ছে।
–“আমি বাহিরে,ম্যাম।আপনি রিসিপশনিস্টকে ফোন দিন।আমি উনাকে বলছি।”
তন্ময় অনুরোধ করলো।তৃপ্তিও তার কথা অনুযায়ী কাজ করলো বিনা প্রশ্নে।
অতঃপর একজন স্টাফ তৃপ্তিকে মিটিং রুমের সামনে নিয়ে এলো।তৃপ্তি মিটিং রুমের ওয়েটিং জোনে অপেক্ষারত। বারংবার ঘড়ি দেখছে সে।মিটিং শেষ হয় ৯.৩০এ।একে একে সকলে বেরিয়ে আসছে।তৃপ্তির নজর এক বিন্দু হেরফের হয়নি সেই মিটিং রুমের দরজা হতে।সত্যি কি আদ্রিন ভেতরে!মিনিট এক বাদেই আদ্রিনের অবয়ব ভেসে এলো।চোখ পিটপিট করে তাকায় সে। সত্যিই আদ্রিন।সে যদি মিটিংয়ে থাকে তাহলে আরাফাত কই গেলো?নাকি সবটাই ধোঁয়াশা?

আদ্রিন বের হতেই তাকে ম্যানেজার মোবাইল এগিয়ে দিয়ে ওয়েটিং জোনের দিকে ইশারা করলো।
দুইজনের নজর মিলতেই ভ্রু কুঁচকে আদ্রিন ওয়েটিং জোনে আসলো দ্রুত পা চালিয়ে।তৃপ্তি উঠে।প্রথমেই আদ্রিন তার হাত চেপে তালুর ক্ষত পর্যবেক্ষণ করে। ক্ষতের অবস্থা মুটামুটি।ঔষধের ছাপ স্পষ্ট।

–“হঠাৎ এইখানে এসেছো!”
–“আরাফাত কই?”
তৃপ্তির সোজা প্রশ্ন।

আদ্রিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়।তৃপ্তির হাতের উল্টো পিঠ নিজের গালে ঘষে জবাব দেয়,
–“আমি কিভাবে বলবো?”
–“আপনি আজকে হুমকি দিলেন,তার আঙ্গুল না থাকলে কেমন হবে,এই সেই?আরাফাত এখনো নিখোঁজ।তার জন্যে অনুষ্ঠান থেমে।দেখুন,আমি জানি আপনি রেগে।কিন্তু তাই বলে আইন মানবেন না!তাকে পুলিশে….”
–“আরে!সমস্যা কি তোমার?আমি কিছুই করিনি।দেখলেই তো মিটিং থেকে বেরুলাম এখন।তাকে কিছু করার জন্যে পেলাম কই?সে তো হাওয়া অনেক আগে থেকেই।তন্ময় সেই অনেক আগে থেকেই খোঁজ করছে,পায়নি তাকে। স্টিল তন্ময় আমাকে কল করেনি।”
আদ্রিন কিছুটা পিছু হটে সোফায় বসলো।দৃষ্টি তার গম্ভীর।তৃপ্তি সেই ছেলের জন্যে অফিসে এসে উপস্থিত হবে,এই খবরটা হজম হয়নি তার।

তৃপ্তি ভাবনায় মশগুল।আদ্রিনকে সে বেশি শুনিয়ে ফেলেছে?আদ্রিন বলছেই সে কিছু করেনি।এছাড়াও তৃপ্তি দেখেছে আদ্রিন মিটিংয়ে ছিলো।পরক্ষণে তার মাথায় এলো, তন্ময় আরাফাতের খোঁজে!এরমানে আদ্রিন তার কথা পালন করতে উদ্যত ছিলো!
–“তন্ময় খুঁজছে মানে?আপনি ঠিকই আরাফাতের আঙ্গুল রাখতেন কি?”

তৃপ্তির মুখে আরাফাতের নাম মোটেও পছন্দ হচ্ছে না আদ্রিনের।সে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো তৃপ্তিকে।নির্দেশনা অনুযায়ী তার সামনে অগ্রসর হয় মেয়েটা।আদ্রিন সোফায় গা এলিয়ে দেয়।আচমকা তৃপ্তির কব্জি টেনে তাকে নিজ কোলে বসায় আদ্রিন।হচকিয়ে যায় তৃপ্তি।মুহূর্তেই যেনো অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়েছে সে!
আদ্রিন তার শার্টের দুটো বোতাম খুলে।বুকে ফুঁ দিয়ে তৃপ্তিকে বলে,
–“ক্লান্ত লাগছে।বেশি কথা বলছো তুমি।মাথা ম্যাসাজ করে দাও।”

তৃপ্তি বিমূঢ়।বিস্ফোরিত নজরে কাঁচের দরজার বাহিরে তাকায়।কেউ নেই।কোনো শব্দও নেই।তাও সে দিরুক্তি করে। মেয়েটা উঠতে নিলে আদ্রিন হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে। এতে আদ্রিনের কাঁধে চিমটি কাটে তৃপ্তি,
–“আরে করছেন কি?কেউ এসে পড়বে?”
–“আমার নির্দেশনা অনেক আগেই দেওয়া হয়েছে।কেউ আসার দুঃসাহস করবে না।দেখি আমার দিকে তাকাও।এতো সেজেছো কেনো?ভালো লাগছে না আমার।”
তৃপ্তি কলারে হাত রাখে আদ্রিনের।তাকে কি বাজে লাগছে দেখতে!
–“আমাকে বাজে লাগছে দেখতে?”
–“বাজে!তোমাকে দেখে আমার মনটায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।নিষিদ্ধ ইচ্ছারা কিলবিল করছে।কিভাবে যে সামাল দিই!”
আদ্রিনের অধরে সুন্দর হাসি।তার সামনের দুটো দাঁত একটু বসানো।এর কারণেই তার হাসিটা কেমন মনোমুগ্ধকর!আদ্রিনের পরিপাটি চুলে হাত ছোঁয়ালো তৃপ্তি।আবেশে আদ্রিন চোখ বুঁজে।তৃপ্তির মনে এক অন্যরকম ইচ্ছে জাগলো।ছেলেটার গালে নিজের অধর ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছা।অগ্রসর হচ্ছিলো সে,ততক্ষণে তার মস্তিষ্ক এইসব বর্জন করলো নিমিষেই!
৪০.
তৃপ্তি নিজেকে সামলে নিলো।আরাফাতের ব্যাপারটা আদ্রিন কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি তৃপ্তির।
হুট করে সে আদ্রিনের কোল থেকে নামতে চাইলে আদ্রিন বিরক্তির সুরে তাকে বললো,
–“একটু শান্তিতে বসে আছি।বসতে দাও না!”

–“আপনি বলুন,আরাফাত কই?”

–“আরেকবার ঐ ছেলের নাম নিলে আমি নিজেকে আর সামলাবো না।যেটা করিনি সেটাই করবো তার সাথে!”
আদ্রিনের গলার স্বর গম্ভীর।তার এই কণ্ঠস্বর তৃপ্তি ভয় পায়।চুপ করে যায় তৃপ্তি সাথে সাথেই।
আদ্রিন কিছু বলতে নিলে তৃপ্তির ফোন বেজে উঠে।বাড়ির ফোন দেখে তৃপ্তি আদ্রিনকে ইশারায় চুপ করতে বলে।

–“আরাফাত হাসপাতালে?অবস্থা বেশ শোচনীয়?এক্সিডেন্ট হয়েছে?…….
ঠিক আছে,আমি আসছি।”

–“কি হয়েছে?”
আদ্রিন ক্লান্ত সুরে প্রশ্ন করে।
–“পাওয়া গিয়েছে বেয়াদপটাকে।সে হাসপাতালে।এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনলাম।একদম ভালো হয়েছে।আমার সাথে অপরাধের ফল আল্লাহ্ দিয়েছে।”
তৃপ্তির মতিগতি আদ্রিন বুঝলো না।এতক্ষণ না এই মেয়েই আরাফাতের ক্ষতি করেছে বলে আদ্রিনকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছিলো!আর এখন তারই এক্সিডেন্টের খবর শুনে খুশিতে গদগদ করছে?

–“একটু আগে ঐ ছেলের ক্ষতি করেছি বলে আমাকেই দোষ দিচ্ছিলে।আর এখন হাসছো?”
আদ্রিন সন্দেহভাজন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো।
–“আরে,আমি দোষ দিচ্ছিলাম আপনাকে;কারণ আমি চাই না ঐ নোংরা ছেলের ক্ষতি করে নিজেকে অপরাধী বানান আপনি।তাই আপনার জন্যেই চিন্তা করছিলাম আমি,আরাফাতের জন্যে নয়।”
তৃপ্তি হাসে।
নিজের প্রতি তৃপ্তির যত্ন দেখে মনটা ব্যাকুল হয় মানবের।তৃপ্তির গালে নাক ছুঁয়ে সে বলে,
–“এতো ভাবনা আমাকে নিয়ে!সামলাতে পারছি না নিজেকে,মেহেবুবা।”
তৃপ্তি দ্রুত উঠে দাঁড়ায়,
–“বাড়ি ফিরতে হবে।জলদি যায়।”
তৃপ্তি ওড়না টেনে মাথায় দিলো।আদ্রিন উঠে আড়মোড়া ভাঙে,
–“আজ আমার কাজ অন্যজন করেছে বলে আমার রাগ হয়নি।বরং ভালো লেগেছে।আমার তৃপ যে আমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছে।আসো,ড্রপ করে দিই তোমাকে।”
তৃপ্তির ওড়নার উপরেই অধর ছোঁয়ায় আদ্রিন।আরাফাতকে সে ছাড়বে না।সে সুস্থ হলেই তার করা পাপের শাস্তির হিসেবে পূর্বেই হিসাবটা ঠিক রেখেছে আদ্রিন।আরাফাতের হাতে আঙ্গুল সহ্য হবে না তার।প্রেয়সীর হাত চেপে সে তার হিংস্র চিন্তায় ব্যস্ত।
.
মাথায় ক্যাপ,মুখে মাস্ক।কালো রঙের ফুল হাতা গেঞ্জি।কালো জিন্সের সামনের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিশ্চিন্ত মনে হাঁটছে আদ্রিন।আরাফাতের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে হাসপাতালে আসে সে।তন্ময় তার আগে হাঁটছে।
যদিও জানে আরাফাতের সাথে এখন কথা বলা সম্ভব নয়,তাও সে আরাফাতের অবস্থা দেখার জন্যে ছটফটে।তন্ময় বলেছে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী’ই গাড়ির চাকা আরাফাতের হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের হাড় ভেঙেছে।ভাবুক আদ্রিন এই কাকতালীয় ঘটনায় জর্জরিত আরাফাতকে শাস্তি দিবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কারণ,হাতের আঙুলে শাস্তি তার হয়ে সেই গাড়ি চালকই দিয়েছে তাকে।তবে,এখন আদ্রিনের আফসোস হচ্ছে,নিজের কাজটা অন্যজন করায়।
আরাফাতের কেবিনের সামনে ফাঁকা।তার দেখা শোনা করার লোক হয়তো ভেতরেই।দরজায় লাগানো গোল কাঁচের অংশে দৃষ্টি দিলো আদ্রিন। বেডে শায়িত আরাফাত।তার মাথায় এবং দুই হাতেই ব্যান্ডেজ!পাশের চেয়ারে তার কোনো পরিজন বসে।আদ্রিনের কোনো অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হয়নি।কেবল আফসোস হচ্ছে আরাফাতের এই অবস্থা কেনো তার জন্যে হলো না!
বিপরীতে ফিরে বাহিরে আসার জন্যে উদ্যত আদ্রিন এবং তন্ময়।হঠাৎই তন্ময় মুখ খুললো,
–“আরাফাতের আত্মীয়ের সাথে আমি পাশের কেবিনের আত্মীয় সেজে কথা বলেছিলাম।উনি বললেন তার ভাইপোকে কেউ একজন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পূর্বে ফোন করে ডাকিয়েছিলো।নামটা বলার আগেই আরাফাত জ্ঞান হারায়।কে এমন কাজটা করলো বুঝলাম না।”

–“তাহলে এটা পরিকল্পিত ছিলো।আর এত জায়গা থাকতে হাতের উপরের চাকা গেলো!তাও আমার প্ল্যান অনুযায়ী?ব্যাপারটা আমার হজম হচ্ছে না।কেউ চায়,তৃপ্তি আমার ব্যাপারে খারাপ বুঝুক।আমি কতো হিংস্র এইসব দেখুক!যে এমনটা করেছে,তার ধারণা অনুযায়ী তৃপ্তি ঠিকই তো এসেছিল আমার কাছে।সত্যিটা যাচাই করতে।তবে প্ল্যানকারি বিফল হয়েছে।”
আদ্রিন ক্যাপ,মাস্ক খুললো।গাড়ির সামনের অংশে বসে সে।
–“স্যার,আপনার উপর কেউ নজর রাখছে হয়তো!”

–“নজর রাখার হলে রাখুক।এটা আম্মির কাজ।কিন্তু, আমি তৃপ্তিকে আরাফাতের শাস্তির কথা বলেছিলাম গাড়িতে।এরপর তাকে নামিয়ে বাসায় গিয়েছিলাম।সাদা গাড়িটা রেখে এই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি বিনা চিন্তায়।এইভাবে আমি এই গাড়িটা কম ব্যবহার করি।”
আদ্রিনের কপালের রগ ফুলে উঠছে ক্রোধে। যা বোঝার সে বুঝেছে।তার গাড়িতেই কেউ হিডেন মাইক্রোফোন সেট করেছে। যার দরুণ আদ্রিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী আরাফাতের অবস্থা এমন। যাতে তৃপ্তি বুঝে,আদ্রিন মুখে যতটা হিংস্র কাজে তার চেয়েও বেশি!আর এই জিনিসটা সম্পর্ক নষ্ট করতে যথেষ্ট।

ঘাড়ের ছোট চুলে হাত বুলায় আদ্রিন।তন্ময়কে বলে,
–“গাড়ির ডেস্কে রাখা রিভলবারের বুলেট চেক করো।”
–“কেনো স্যার?”
আতঙ্কিত তন্ময়।
–“আম্মির কথায়,আমার কাছের একজন আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে।তাদের দুজনকে একটু শিক্ষা দিবো।তাদের এই জঘন্য প্ল্যানে আমার আর তৃপ্তির সম্পর্কের কিছুই হয়নি,অথচ দেখো ক্ষতি হবে বিশ্বাস ঘাতকের। আম্মি আমাকে একটু হালকাতে নিয়েছে।এই হালকা ঠিক কতো ভারী হবে এটাই দেখাবো আজ। এই আরকি ঘটনা।কেনো বুঝে না সবাই,আদ্রিন তার মেহেবুবার জন্যে উন্মাদ,দেওয়ানা।চেক দা রিভলভার,তন্ময়!”
আদ্রিনের শেষ বাক্যটায় তন্ময়ের শরীরের উত্তাপ বাড়িয়ে দিলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here