#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -১৯
___________________
৪১.
–“পরিচিত মানুষেরাই কেনো সবসময় ধোঁকা দেয়?রুদ্র,তোমার থেকে এটা আমি আশা করিনি কখনো।আর আম্মি,তুমি নিচে নামতে পারো জানতাম,কিন্তু এত নিচে নামবে এটা ভাবিনি।এখন বলো,কে আগে শাস্তি নিবে?আম্মি না রুদ্র!”
আদ্রিনের চোয়াল শক্ত।বাড়ির সম্মুখে উন্মুক্ত বাগানের দুই চেয়ারে আদ্রিন এবং ইনায়া বসে। ইনায়ার পিছে রুদ্র দাঁড়ানো।আদ্রিনের পাশে তন্ময়।তাক করে রাখা রিভলবারের নিশানা একবার ইনায়ার দিকে নিচ্ছে তো আরেকবার রুদ্রের দিকে।
সকালের ঝলমলে রোদে উজ্জ্বল চারিদিক।চোখে রোদ চশমার আড়ালে কটমট ইনায়া আদ্রিনের পানে চেয়ে।ছেলের সাথে চালাকি করেও পার পায়নি এই চালু নেত্রী।অথচ তার এহেন চালাকির দরুণ কাল রাতের মিটিং সফল করতে সারাটা রাত অফিসে কাটিয়েছে।সকালে বাসায় ফিরতেই আদ্রিনের সম্মুখে আসে সে।তারপরই এমন হিসাব নিকাশ শুরু করে আদ্রিন।
বিরক্ত হচ্ছে আদ্রিন তাদের নিরবতায়।রিভলবারের সাহায্যে কপালের বাম দিকে চুলকিয়ে সে আওড়ায়,
–“এইভাবে বোবা সেজে থাকলে আমার গাড়িতে ডিভাইসটা লাগিয়েছো কেনো, আম্মি?”
ইনায়া রোদ চশমা খুলে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে আদ্রিনের পানে চেয়ে বলে,
–“যা চেয়েছি তা করেছি।কাহিনী শেষ।”
–“কাহিনী এইখান থেকেই শুরু আম্মি।তৃপ্তিকে আমার থেকে আলাদা করার সবচেয়ে বাজে কাজটা করেছো।”
আদ্রিন তির্যক হাসে।
–“মেয়েটাকে আমি তোমার জীবন থেকে সরানোর জন্য যা করার…”
আদ্রিন রেগে যায় বড্ড।হুট করেই ফাঁকা গু’লি ছুঁড়ে সে আকাশের পানে।পরপর চারবার ট্রিগার দাবিয়ে সে চিৎকার করে,
–“শান্তি নামক পদার্থ আমি তৃপ্তির মাঝে পায়।ছোট বেলা হতে আমার যে শান্তি,ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছো তুমি তোমার এই রাজনীতির জন্যে;সেই সব আমি তৃপ্তির মাঝে খুঁজে পায়।আমার প্রশান্তি সে।আমার ভালোবাসা।আমাকে যা ইচ্ছে করতে পারো,কিন্তু তার উপর নজর দিলেও আমি শান্ত থাকবো না।মে’রে দিবো আমি।”
–“সামান্য একটা মেয়ের জন্যে,মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করছো তুমি,আদ্রিন?”
–“এই মা কই ছিলো,যখন আমাকে প্যারেন্টস মিটিংয়ে মা ছাড়া যেতে হতো?এই মা কই ছিলো,যখন আমাকে জ্বরের রাতে দাদীর সাথে থাকতে হতো?এই মা কই ছিলো,যখন তোমার হাতে খাবো বলে আমি সারা দুপুর না খেয়ে বসে থাকতাম? ক্ষুদার তৃষ্ণায় অজ্ঞান হয়েছিলাম কিন্তু তুমি আসোনি।আমার জন্যে তুমি ছিলে না কখনো,কোথাও।জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না।বেশ তো মানিয়ে নিয়েছি নিজের মাকে পাথরের সমতুল্য করে।তাহলে এখন কেনো আমার জীবনে তুমি নাক গলাচ্ছো?”
আদ্রিন উঠে দাঁড়ায়।তার হাত কাঁপছে থরথর করে।রাগ যেনো তার রক্তে বহমান এখন।
–“আদ্রিন!তখন আমি তোমার পিছে সময় দিলে আমার এই নাম কিভাবে বানাতাম?তোমার ফিউচারের কথা ভেবেই আমি…”
–“কি করেছো তুমি আমাকে?আমার জন্যে কি করেছো?তোমার কোনো পলিটিক্সে না আমি আছি,না তোমার কোনো টাকা ভোগ করছি।আমি আমার বাবার টাকায় চলেছিলাম,এখন নিজের টাকায় চলি।হয়তো তোমার মতো বেশি টাকায় না,কিন্তু তাও আমি চলি নিজের মতো।আর আমার তৃপ্তিকে আমি আমার টাকায় রাণী বানিয়ে রাখতে পারবো।আর কখনো যেনো আমার আর তৃপ্তির মাঝে না আসো।আমার রাগের পরীক্ষা করো না।সহ্য করতে পারবে না।”
আদ্রিন নিজ বক্তব্যে শেষ করে রিভলবার ছুঁড়ে মারে তন্ময়ের দিকে।
পরক্ষণে সে রুদ্রের পানে তাকায়,
–“আম্মির ঋণের জন্যে তুমি বেঁচে আছো আমি জানি।আর মায়ের কথায় আমার পিঠে ছুরি মেরেছো এটাও বুঝি।কিন্তু তোমার কি বিবেক ছিলো না?অবশ্য থাকলেও বা কি?ইনায়া ম্যাডাম তো আবার,তাকে বাঁচিয়ে রাখেন না;যে উনার কথা শুনে না।তোমার প্রতি পিছুটান ছিল বলেই আজ কিছু করলাম না।তার উপর আমার তৃপ্তি আমাকে ভুল বুঝেনি,তাই সমস্যা হয়নি। এর কারণে বেঁচে গিয়েছো তোমরা।রাতে দেখা হলে হয়তো রাগের বশে কিছু একটা করেই ফেলতাম।
কিন্তু,সকাল হতে হতে ঠান্ডা মাথায় সব ভেবেছি।আর কখনো তুমি যেনো আমার সাথে কথা না বলো,রুদ্র।”
আদ্রিন চলে যাচ্ছে।
রুদ্র হতবাক।ইনায়ার প্রতি তার মন থেকে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।ইনায়ার প্রতি সে জীবনের ঋণী।নাহলে এমন কাজ সে আদ্রিনের সাথে করতো না।কখনোই না।আদ্রিনের বিশ্বাস ভেঙে রুদ্র যেনো নিজের চোখেই নিচে নেমেছে।অবাধ্য জলে ছড়াছড়ি তার গাল জুড়ে।
ইনায়ার ভাবভঙ্গি নেই।সে আয়েশ করে চেয়ারে বসে।রুদ্রকে নির্দেশ দেয়,
–“তুমি আমার গ্রামে চলে যাও।তোমাকে দিয়ে এইসব কাজ হবে না আর।সেইখানে কেয়ারটেকারের হেড হবে তুমি।ইমোশনাল ফুল একটা।মাসে মাসে খরচের টাকা পাবে।”
রুদ্র ছলছল নজরে তাকালো কেবল।কোনো উত্তর দিলো না।এই মহিলার মনে কি সত্যি দয়া বা অনুশোচনা নামক জিনিসের অভাব!
.
হনহনিয়ে রুমে আসে আদ্রিন।মাথায় তার তীব্র যন্ত্রণা।গতরাত থেকেই চোখের পাতায় ঘুম নামেনি তার।তন্ময় তার সাথেই ছিলো রাতভর।তাই তন্ময়কে অর্ধ দিবসের ছুটি দিয়ে নিজেও ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো আদ্রিন।আজ অফিসের কোনো ধকল সে মেনে নিতে নারাজ।তাই ফোন সাইলেন্ট করে উবু হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।ঘুম আসার আগ মুহূর্ত।আদ্রিনের মাথায় কঠিন সকল সিদ্ধান্ত।মায়ের এমন রূপ হতে তৃপ্তিকে বাঁচাতে সে কি তার অন্য ঘরটায় চলে যাবে?নাকি এইখানে থেকেই তৃপ্তিকে নিজের পরিবারের সাথে সুন্দর একটা সংসার করার অভিজ্ঞতা দিবে?আদ্রিনের আঁখি ঘুমঘুম কিন্তু মস্তিষ্ক সজাগ।ঘুমানোর পূর্বেই তার মন হাতছানি দিয়ে বলছে,
–“যে ঘরেই থাকো না কেনো,তোমার তৃপ্তির শুধু তোমাকেই দরকার।তার একমাত্র শান্তির স্থান শুধু তুমি আদ্রিন। কেবলই তুমি।”
৪২.
অনুষ্ঠানের পরদিন তৃপ্তির ঘুম ভাঙ্গলো বেশ বেলা করেই।রাতের অনুষ্ঠান আরাফাত ছাড়াও বেশ জমজমাট ছিলো।অসুস্থ মানুষটার জন্যে তো দুই মানব মানবীর এতো সাধের অনুষ্ঠান মাটি হতে পারে না!তাই দুই পরিবার ভালই চেষ্টা করলো অনুষ্ঠান সফল করতে।সুতির ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে ভারী চোখে সে নিচে নামলো।বাড়িতে মানুষের আনাগোনা বেশ ভালোই।কাজিন গোষ্ঠীর আওয়াজে আজ ঘর মুখর।
অর্পা হেসে এগিয়ে এলো তৃপ্তির দিকে,
–“উঠেছিস মহারাণী?তোর বন্ধু আলেয়া এসেছিল।কিছু কাপড় দিয়ে বললো,তোকে দিতে।রাতে লাইভ করবি তুই।ফোনটাও কেনো যে সাইলেন্ট করেছিলি! মেয়েটা তোর সাথে যোগাযোগ করতে পারলো না।চামেলী মাসিকে বিরক্ত না করে মেয়েটা নিজেই কাপড় নিয়ে এসেছে।এতো বললাম বসতে।বসেইনি।”
–“ঘুম এসেছিল অনেক।কাপড় রেখেছো?”
তৃপ্তি হাই তুললো।
–“হ্যাঁ,রেখেছি।খেয়ে নে কিছু।এরপর দেখবি।”
–“আচ্ছা। এইভাবেও ক্ষুদা লেগেছে প্রচুর।”
তৃপ্তিকে অর্পা চেয়ারে বসার আহ্বান জানায়।ততক্ষণে দিদা আর কাকিরা টেবিলে খাবার সাজাতে শুরু করেছে।
অর্কের মামী,বেশ চঞ্চল মহিলা।শকুনের লাহান দৃষ্টি দিয়ে তৃপ্তিকে খুঁটিয়ে দেখছে। মা মরা মেয়ের জন্যে কত তেজ এই পরিবারের সকলের ভেবে পায় না মহিলা।তার ছেলের বন্ধুর জন্যে তৃপ্তিকে চাইলে অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় সাফ মানা করে।এতে বাকিরা আর কিছু বলার সাহস পায় না। অরিত্রন চায়,বিয়ের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তৃপ্তির মতামতে হবে।
মহিলা চুপ থেকে কিছু ভাবে।এরপর উঠে তৃপ্তির সম্মুখেই বসে,
–“এই মেয়ে বয়স তো কম হচ্ছে না তোমার।বিয়ে করবে না বুঝি?”
তৃপ্তি খাবারটা গিললো।পরপর বললো,
–“জ্বী?”
–“বলছি,মা নেই।বাবা আছে।বাবা থাকতেই বিয়েটা সেরে ফেলো।আমার…”
–“আপনি আমার ব্যাপারে না ভাবলেই হবে,আন্টি।”
–“কি বেয়াদব!কি বেয়াদব!”
চিৎকার করে মহিলা।
–“জ্বী,আমি বেয়াদব।”
গাল কুঁচকে হাসে তৃপ্তি।এই হাসিতেই যেনো গায়ে আগুন জ্বলে উঠে মহিলার,
–“মায়ের মতোই বদ হয়েছে।কিভাবে এই মেয়েকে এই বাড়িতে এনে রাখে আমি বুঝি না!”
–“আমার মায়ের ব্যাপারে কোনো খারাপ কথা না।আমি সহ্য করবো না এইসব।”
তৃপ্তির চেঁচামেচিতে সকলে উপস্থিত হয় সেথায়।চামেলী এসে জড়িয়ে ধরে তৃপ্তিকে। রাগে,যন্ত্রণায় ফোঁস ফোঁস করছে মেয়েটা।চামেলী বৃথা শান্ত করার চেষ্টায় তাকে।দিদা এসে চেঁচানো শুরু করে,
–“আমার নাতনির বিয়ে নিয়ে কেনো এত মাথা ব্যাথা?অরিত্রন মানা করেছে এই ব্যাপারে,তাহলে আবার কেনো এইসব কথা?”
–“দিদা,আমি বাড়ি যাচ্ছি।অনেকদিন ড্রয়িং ক্লাস মিস করেছি বাচ্চাদের।আজ করিয়ে আসবো।যায়।”
টেবিল হতে মোবাইল তুলে হনহনিয়ে হাঁটছে তৃপ্তি।পেছনে তুলকালাম করছে দিদা।অর্কের মামীর কানে তালা ঝুলানো ছাড়া উপায়ন্তর নেই।
অর্ক বাগানে ছিলো।তৃপ্তি তার সামনে এসে বলে,
–“বাসায় দিয়ে আসতে পারবে,দাদা?”
–“কেনো?”
–“কাজ আছে কিছু। রাতেই এসে যাবো।”
তৃপ্তির সহজ জবাব।
–“ওকে,চল।”
অর্ক গ্যারেজ হতে বাইক নিয়ে বেরুতেই তৃপ্তি সাবধানে ভাইয়ের পিছে বসে।
.
বাচ্চাদের ড্রইং করানো শেষ।তৃপ্তি বাসায় এসে আদ্রিনকে মেসেজ করেছিল আজকে দেখা করার জন্যে। ফোনও দিয়েছিল।কিন্তু,কোনো হাদিস নেই সেথা হতে।তৃপ্তির অস্বস্তি হচ্ছে বাসায়।তাই একই কাপড়েই বাসা হতে বেরুই।আদ্রিনকে পাঠানো পার্কের ঠিকানায়,
নিজেই একা বেরিয়ে পড়লো সে।বিকালের ছাপ আকাশে। সাফাকে ড্রইং করাতে যাবে একেবারে অর্কের বিয়ের পর।রিয়ানার সাথে তার কথা হয়েছে এই ব্যাপারে।
বাসায় থাকা জমানো টাকা হতে কিছু টাকা নতুন পার্সে নিয়েছিল সে।সেই টাকা দিয়েই আজ মেয়েটা একা একা ঘুরবে।আদ্রিনের আসাটা সে মনে মনে কামনা করছে।
বিকালের পরিবেশ বড্ড মনোরম হয়।স্নিগ্ধতায় চারপাশ চেয়ে।শুকনো পাতাগুলো বাতাসে দুলছে রাস্তার কিনারায়,মাঝে। কিয়ৎ বাদে বাদে মোবাইল চেক করছে মানবী। খবর নেই তার প্রেমিকের।থাকবেই বা কিভাবে?গভীর ঘুমে মত্ত তার প্রেমিক।জিদ করে ঘুমিয়ে যাওয়াটা সবচেয়ে প্রশান্তির।
পার্কে বসে তৃপ্তি বাদাম খাচ্ছে। আশে পাশে তার মতো একা মানুষের অভাব নেই।মিনিট দুয়েক পর তার ফোনে অজ্ঞাত নাম্বার হতে একটা মেসেজ আসে,
–“আহানান শেখ আদ্রিনকে আরাফাতকে হ’ত্যা’চেষ্টার কারণে ফাঁসানো হচ্ছে।একটু পরেই প্রেস কনফারেন্স শুরু হবে তার নিজ বাসায়।আপনি গতকাল রাত ৮.৩০টার পর থেকে তার সাথে ছিলেন আমি জানি।আর আরাফাতের এক্সিডেন্ট হয়েছে রাত আটটায়।এছাড়াও আদ্রিন সাহেবকে অফিসে সকলেই দেখেছেন সন্ধ্যা হতে।অফিসের কলিগরা আসছে।আপনিও প্রমাণ হিসেবে আসুন।”
তৃপ্তি দ্রুত উঠে দাড়ায়।এইসবের জন্যেই কি ছেলেটা আজ অনেক ব্যস্ত!ব্যাকুল মনে তৃপ্তি উঠে দাঁড়ায়।এই পার্ক হতে আদ্রিনদের বাড়ি বেশ ভালো দূরত্বে।
৪৩.
গভীর ঘুমে ব্যাঘাত হলো আদ্রিনের দাদুর দরজায় কড়াঘাতে।তাকে নিচে যেতে বলছেন উনি।প্রেস কনফারেন্সে সকলে উপস্থিত।ইনায়া তাকে দ্রুত যেতে বলছে।কিসের প্রেস কনফারেন্স জানতে চাইলে দাদু তাকে সব বলে।নিজেকে নিষ্পাপ প্রমাণ করতে আদ্রিন মুখে পানি ছিটা দিয়েই গার্ডেনে যায়।তার পড়নে সাদা টি শার্ট এবং কালো স্পোর্টস প্যান্ট দেখে সাংবাদিকরা ইতিমধ্যে কানাঘুষা করছে।
তন্ময়কে সে সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে পূর্বেই আসতে বলেছে।আদ্রিন চেয়ারে বসে পড়ে।আরো কিছু সময় লাগবে প্রেস কনফারেন্স শুরু হতে।মূলত নিজের বিজনেসে যেনো সমস্যা না হয় তাই এইখানে আসা তার।ইনায়া তাকে কিছু বলতে চাইছে।তবে ভুলেও সেদিকে মুখ ফেরাচ্ছে না আদ্রিন।
তন্ময় আর চিফ রিপোর্টার এলেই কনফারেন্স শুরু হয়।
–“আপনি কাল রাতে কোথায় ছিলেন,আদ্রিন?আরাফাত আপনাকেই দোষী করছেন নিজের অবস্থার জন্যে।”
একজন রিপোর্টার বললেন।
–“অফিসেই ছিলাম।সিসিটিভি ফুটেজ পেশ করা হোক তন্ময়।”
আদ্রিনের সহজ জবাব।
সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে,আদ্রিন সন্ধ্যায় অফিসে প্রবেশ করেছে এরপর তৃপ্তির সাথেই বের হয়েছে অফিস হতে।
ইনায়া কিছু একটা ইশারা করলো একজন রিপোর্টারকে।সাথে সাথেই প্রশ্নের জোয়ারে ভেসে গেলো আদ্রিন,
–“আপনার সাথে যে মেয়েটা ছিলো উনি কে?আপনার গাড়িতে কি অফিস স্টাফদের লিফট দেন?নাকি সে আপনার রক্ষিতা?তাকে দেখে স্টাফ তো মনে হচ্ছে না।আইডি-কার্ড নেই গলায়।”
–“স্টপ দিজ ননসেন্স।সে কে এটা আমার ব্যাপার।আমি নিজের নিরাপরাধের প্রমাণ দিয়েছি এটাই অনেক।”
আদ্রিন চিল্লিয়ে উঠে।
–“স্যার,আপনি রিয়েক্ট করছেন কেনো?মেয়েটার সাথে আপনার কি সম্পর্ক?এই মেয়েকে নিয়ে আপনার ফিউচার কি?সে কি কোনো স্লাট?”
রিপোর্টার আবার প্রশ্ন করলে গোপনে হাসে ইনায়া।আদ্রিন নিজের চেয়ার সজোরে ভেঙে ফেলে এক আছাড়েই,
–“ডোন্ট ফোর্স মি টু হিট ইউ!”(আপনাকে আঘাত করতে বাধ্য করবেন না।)
এর মাঝেই তৃপ্তি উপস্থিত হয়।আদ্রিনের এমন বিচলিত অবস্থা দেখে সে আদ্রিনকে থামানোর চেষ্টা করে,
–“কি করছেন?সব রেকর্ড হচ্ছে,আদ্রিন।”
তৃপ্তিকে এইখানে দেখে আদ্রিনের ক্রোধের মাত্রা বাড়ে।রিপোর্টাররা যেনো এটাই বিশাল সুযোগ পেলো।সেই বিশেষ রিপোর্টার তৃপ্তির সম্মুখে এসে প্রশ্ন করে,
–“আপনি সেই রক্ষিতাই তো।আপনি উনার বাসায় আসা যাওয়া করেন?একরাতে কতো দেয় আদ্রিন?”
তৃপ্তির মনটা কেঁপে উঠে তীব্রভাবে।আদ্রিন তার দেহ অবয়বের আড়ালে ঢেকে ফেলে তৃপ্তিকে।আশঙ্কায় পরিপূর্ণ তৃপ্তি আদ্রিনের টি শার্ট খাঁমচে।কি শুনছে সে এইসব? এছাড়াও মেসেজের ভাষ্যমতে কলিগরা থাকার কথা এখানে,কিন্তু কেউ নেই তন্ময় ব্যতীত।
রিপোর্টার এর ক্যামেরায় হাত দিয়ে এক নিমিষেই ভেঙে ফেললো আদ্রিন।গগণ স্পর্শী তার চিৎকার শোনা গেলো মুহূর্তেই,
–“বন্ধ করো এইসব ভিডিও।এর একটা ক্লিপ যদি কোথাও যায়, আই স্যয়ার চ্যানেলের সাথে মানুষটাকেই গায়েব করবো আমি।”
ইনায়া ছেলের এমন কথায় ভীত হয়।সবার ক্ষতি করলেও ছেলের ক্ষতি সে চায় না।তাই পূর্বের ক্লিপ রেখে সে এইসব ক্লিপ ডিলেট করার আহ্বান জানায়।যদিও তৃপ্তিকে ছোট করতে চেয়েছে সে,তবে তৃপ্তির জায়গায় তার ছেলের নামটাই দুর্নাম হবে এইসব নিউজে এলে।সবশেষে ইনায়া বলে,
–“প্রথম ইন্টারভিউ ছাড়া আর কোনো ক্লিপ যেনো ভাইরাল না হয়।এই মেয়ে রিলেটেড কিছু দেখলে আমি সেই চ্যানেল বন্ধ করতে পিছপা হবো না।”
.
আদ্রিনের শরীর জ্বলছে।আজ তাকে কি কি শুনতে হয়েছে!মেয়ে রিপোর্টার না হলে সেই রিপোর্টারের গায়ে হাত তুলতে একটু সময়ও লাগতো না তার।আদ্রিন তৃপ্তির হাত চেপে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাচ্ছে।তৃপ্তি বারংবার বারণ করছে যাবে না বলে।সেই রিপোর্টারের কথা শুনে মেয়েটা এইভাবেও অপমানে কেঁদে কুটে হয়রান।নিচের ফ্লোরে সকলে উপস্থিত কেবল আদ্রিনের চাচারা ব্যতীত।তৃপ্তিতে টেনে নিয়ে যেতে দেখে সকলেই তাকে থামানোর চেষ্টা করছে।দাদী অসহায় ভঙ্গিতে বললো,
–“দাদু,মেয়েটাকে এইভাবে নিয়ে যাচ্ছো কেনো?কি হয়েছে?মেয়েটা কাঁদছে তো।”
–“কাদুঁক।কান্নার জন্যেই এইখানে এসেছিল ও।আমি বলেছিলাম এইসব জায়গায় ওকে আসতে?”
আদ্রিনের হুমকিতে কেউ আর এগিয়ে আসেনি।
মিনা,আদিবা সকলে তৃপ্তিকে তেমন একটা পছন্দ না করলেও, আজ সরাসরি দেখে তাদের মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্যে।এইভাবে ওরা জানে তৃপ্তির মা নেই।তার উপর সুতির হালকা কামিজ পড়ে মেয়েটাকে একটু বেশি মায়াবতী এবং কান্নার দরুণ বেশ অসহায় মনে হচ্ছে। বাঁধা দিতে চেয়েও দেয়নি কেউ।থাক,তারা দুজনে একসাথে কিছুক্ষণ।এই মেয়ে ছাড়া কেউ কি পারবে আদ্রিনের রাগ কমাতে?নাহ।পারবে না।
আদ্রিন রুম লক করে।তৃপ্তির মাথা নিচু।ওড়নার একপাশ তুলে মুখ চেপে কাঁদছে সে।সকাল হতেই অপমানের ভারে নুইয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।তার সামনে আদ্রিন রাগী চোখে দাঁড়িয়ে।মিনিট এক পরে রুমে থাকা ফুলদানিতে এক জোরে লাথি দেয় আদ্রিন,
–“এইখানে আসতে কে বলেছে তোকে?আমি বলেছি?ভালো লেগেছে সবার কথা শুনে?বল?আমি বলেছি কখনো বাজে কথা?তাহলে অন্যের বাজে কথার শিকার কেনো হবি তুই?”
তৃপ্তি হকচকিয়ে।আদ্রিনের ব্যবহারে পরিবর্তন ব্যাপক।ভয়ে আরো মুচড়ে গেলো মেয়েটা।হুড়মুড় করে দরজা খুলতে গেলে আদ্রিন তার হাত ধরে থামায়,
–“যতক্ষণ আমার রাগ কমবে না,কোথাও যাবি না।আজকে আমার মেজাজ নষ্ট।যদি পারতাম আমি মেরে দিতাম ঐ মেয়েকে।সে আমার মেহেবুবার নামে কিসব বলে?”
–“আমি কি…কি করেছি?আপনি আমাকে কেনো বকছেন?”
কান্নারত কণ্ঠ তৃপ্তির।
–“তুমি এইসব ঝামেলায় এসেছো কেনো?আমি আসতে বলেছি তোমাকে?”
আদ্রিন কাছে টানলো তৃপ্তিকে।তৃপ্তির মাথা এখনো নিচু।তার কোমরে শক্ত স্পর্শ করে নিজের সাথে আরো মিশিয়ে নেয় প্রেমিকাকে।তৃপ্তি চুপ কিন্তু আদ্রিন থেমে নেই,
–“তোমাকে ভালোবাসি বলে সবসময় ছাড় দিবো এইসব ভাববে না। প্রেস মিডিয়া অনেক বাজে জিনিস।কখনো এইসবের সামনে আসবে না।আমি আছি,আমি সব সামলে নিবো।কিন্তু তোমার নামে কেউ কিছু বললে আমি তাকে ছাড়বো না।আর এই মেয়ের চাকরি যাওয়ার দায়িত্ব আমি নিলাম।”
তৃপ্তি ফোপাঁচ্ছে।আদ্রিন নিজের ঘাড়ে হাত ঘষে। ইস,কি করলো সে!রাগের বশে মেয়েটাকে আঘাত দিয়ে কথা বলেছে ।তৃপ্তির গাল উচুঁ করে আদ্রিন।তৃপ্তির আঁখি জোড়া বন্ধ।
মেয়েটা খুব করে চাইছে আদ্রিনকে সবটা বলুক সে।কিন্তু বলবে না।কিছুই বলবে না।যে মেসেজ পাঠিয়েছে তার কথা জানলে ছেলেটা আবারও অস্থির হবে তার খোঁজে।এইভাবেই কয়েকদিন ধরে আদ্রিনের উপর বেশ ধকল যাচ্ছে।পরক্ষণে নিজের গালে আদ্রিনের স্পর্শ অনুভব করলে মেয়েটা চোখ মেলে।লম্বা মানবটা তার উপর ঝুঁকে।দফায় দফায় চুমুর বর্ষণ হচ্ছে তার মুখমণ্ডলে।
–“আমার আদর।”
আদ্রিনের স্নেহের সুর।
–“আমি বাসায় যাবো।”
তৃপ্তি তাকে দূরে ঠেলে।
আদ্রিন নাছোড়বান্দা।সে তৃপ্তির কোমর চেপে বেশ উপরে উঠিয়ে নেয়।তার নাক সমান হয় তৃপ্তির নাক।আদ্রিন হাসছে।তৃপ্তি হতবাক।একটু আগেই না এই লোক রেগে জ্বলে যাচ্ছিল?আর এখন সেই লোকটা নাকি হাসছে!
–“দিয়ে আসবো বাসায়।আগে বাড়ির সবার সাথে পরিচিত হবে।”
–“সবাই জেনেছে আমার পরিচয়।আর বলা লাগবে না আপনাকে।”
তৃপ্তি জিদ দেখায়।
–“কি জানে সবাই? ঐ রিপোর্টারের কথা মাথা থেকে ফেলো।তুমি আমার জান,আমার মেহেবুবা।”
আদ্রিন নিজের অধর ছোঁয়ায় তৃপ্তির গলায়।তৃপ্তি আবেশে আদ্রিনের ঘাড়ে হাত রাখে,
–“নামান আমাকে।”
–“পারছি না নামাতে।মিশে থাকো আমার সাথে।এইভাবে।আমার হয়ে।”
আদ্রিন পুনরায় নিজ অধর তৃপ্তির গলা, গালে স্পর্শ করা আরম্ভ করলো।সংকুচিত তৃপ্তি নখ দাবিয়ে দিলো আদ্রিনের ঘাড়ে।
এক চোখ চেপে আদ্রিন বাঁকা হেসে তাকে বলে,
–“তোমার নখের ধার বাড়াও বা গায়ের শক্তি বাড়াও।এইসব খামচিতে তোমার আদ্রিনের কিছুই হবে না।”
তৃপ্তিকে নামায় আদ্রিন। রাগের ছিটেফোঁটা নেই এখন তার মাঝে।তৃপ্তির চোখের পানির উপর নিজ আঙ্গুল স্পর্শ করে আদ্রিন আওড়ায়,
–“কাঁদে না আর।সব ঠিক আছে।”
তৃপ্তির কি হলো সে বুঝলো না। হুট করেই সে আদ্রিনকে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে বলে,
–“আপনি আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না তো?”
–“আমি?আমার মেহেবুবা আমার জীবনের সব।তাকে ছাড়া আমার পক্ষে অসম্ভব।তুমি চাইলেই পারবেনা আমার থেকে নিজেকে আলাদা করতে।আমি তোমাকে ভালোবাসবে, বকবো,শাসন করবো,কিন্তু দিন শেষে তোমাকেই বুকে টেনে নিবো।তোমার জন্যে আমি যেমন ভালো,তোমার দিকে কেউ নজর দিলে আমি তার নিকট ঠিক তার চেয়ে বেশি হিংস্র।তুমি শুধু আমার।তুমি আমার কাছে নিরাপদ,সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত।কিন্তু যদি তোমাকে কেউ কষ্ট দেয় তাহলে,আই ক্যান কিল এনিওয়ান ফর ইউ,মেহেবুবা।
আদ্রিন তির্যক হাসে।আরো শক্ত করে হাতের বাঁধন।ভালোবাসার সাগরে ডুবন্ত তৃপ্তি আদ্রিনের শেষ কথার কোনো তোয়াক্কা করলো না।
চলবে…..
কপি করা বারণ।
ইনায়া মহিলাটা আদ্রিন-তৃপ্তির সুখ দেখে কি করে আল্লাহ্ জানেন!
ছবি কালেকশন: ইনস্টাগ্রাম।#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -২০
____________________
৪৪.
–“তুমি কি চাচ্ছো তোমাকে কোলে করে নিচে নিই আমি?আমার আপত্তি নেই।তোমার আপত্তি না থাকলে আসো আমার কোলে।নিচে যেতে হবে আমাদের। দাদীর সাথে পরিচয় করাতে তোমার।”
আদ্রিন তৃপ্তির দুই ধারে হাত মেলে।তার মুখভঙ্গি কঠিন।অর্থাৎ, ফাজলামো করছে না সে মোটেও।
তৃপ্তির হাঁ হুতাশ বাড়ছে।মেয়েটা কেমন গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে।
–“আমি বাসায় যাবো।আমার মনে হয় না আপনার বাসার কেউ আমার সাথে দেখা করতে চায়।স্পেশালি আপনার আম্মু।দেখুন,আমার এখন কোনো কটু কথা শোনার শক্তি নেই।”
মলিন মুখ তৃপ্তির।মেয়েটার মন সংশয়ে ভরপুর।সকাল হতেই সে আজ কটু কথার শিকার হচ্ছে।না জানি নিচে গেলে, আবার কি না কি কথা শুনিয়ে দেয় সকলে!তৃপ্তি ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো দরজায় লেপ্টে।
আদ্রিনের নিঃসংকোচ চাহনি প্রিয়তমার সত্তায়।মেয়েটা কি ভুলে যাচ্ছে,আদ্রিনের সামনে কাউকে তার মেহেবুবার উপর টু শব্দটি করতে দিবে না!আদ্রিন কাছে যায় তার।আলগোছে মাথায় ওড়না তুলে দেয়।কিছু এলোচুলে আঙ্গুল স্পর্শ করে সে বলে,
–“চলো আমার সাথে।কেউ কিছু বললে তার দায়িত্ব আমি নিবো।মনে হয় না কেউ খারাপ আচরণ করবে।অন্তত দাদীর সামনে আসো।এইভাবে দেখা না করলে কি ভাববে?”
তৃপ্তি কিছু বললো না।তার দীর্ঘশ্বাস যেনো সবটার জবাব।
আদ্রিন হাসে।আলতো হাতে মেয়েটার হাতের মুঠোয় নিজ তালু গলিয়ে দেয়।আদ্রিন আগে হাঁটছে, তৃপ্তি পিছে।কিছুদূর যেতেই রাফি আসে তাদের সম্মুখে।রাফির চেহারা হাস্যোজ্বল।হেসেই সে আদ্রিনকে বললো,
–“ভাই,ভাবীকে তাহলে বাসায় নিয়ে এলেই। হাই ভাবী,আমি রাফি।আপনার প্রেমিক পুরুষ বেশ হট, আই মিন মেজাজে তিক্ততা বেশি।”
হাসির বেগ বাড়ে রাফির।আদ্রিন চোখ ছোট করে দৃষ্টি মেলে রাফির পানে,
–“কিসব রাবিশ কথাবার্তা।”
রাফিকে মিনমিন স্বরে তৃপ্তি সালাম দিলো কেবল।মুখ তুলে দেখলো না রাফি নামক মানবকে। তা দেখে রাফি সন্দেহজনক কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“ভাবী কি রাগ করেছে?”
–“নাহ।দুঃখ পেয়েছে।প্রেস কনফারেন্স ভালো হয়নি।যাক,আমি এইসব আর মনে করতে চাচ্ছি না।দাদী নিচে?”
–“ইয়াহ।সবাই নিচে।শুধু বাবা,চাচা আর বড়মা ছাড়া।ওরা পার্টি অফিসে।”
–“গ্রেট।”
কথা শেষে আবারও আদ্রিন চললো দাদীর উদ্দেশ্যে।
তৃপ্তির বুক ফাটছে কিন্তু মুখ ফাটছে না।বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার।
বসার ঘরে উপস্থিত সকলে।দাদী হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো তৃপ্তিকে।তৃপ্তি তাকায় আদ্রিনের পানে।তার ইশারা পেয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যায় সে দাদীর নিকট।প্রথমেই দাদী তার মুখশ্রীতে হাত ছুঁয়ে বলে,
–“দাদু ভাই বকেছে বেশি?কেঁদে তো মুখ লাল করে ফেলেছো।”
কিটকিট হেসে উঠে প্রবীণ মহিলা।তার পাশাপাশি মিনা এবং আদিবা মুখ চেপে হাসি সংবরণ করে।আদ্রিন না আবার রেগে যায়!
–“বকার সময় বকি,ভালোবাসার সময়ে ভালোবাসি।অযথা কেনো বকবো?”
আদ্রিন এক ভ্রু উঁচু করে তাকায়।তৃপ্তির মাথা নিচু।অদ্ভুত লজ্জা লাগছে তার।এইভাবে সকলের সামনে লজ্জায় পড়ার পরিস্থিতি এই প্রথম সম্মুখীন হলো তৃপ্তি।
–“মেয়েটা সেই কবে এসেছে,এখনো কিছু খায়নি।আমি খাবার আনছি।”
মিনার কথায় তৃপ্তি মাথা উঠায়।দৃষ্টির ঘূর্ণিপাকে সকলকে পর্যবেক্ষণ করে নিল সে মুহূর্তেই ।ইনায়ার চেয়ে এদের বেশভূষা সাধারণ।কিন্তু,বিলাসিতার ছাপ স্পষ্ট।তৃপ্তি অস্ফুট স্বরে বলে,
–“নাহ আন্টি।আমি খাবো না কিছুই।”
–“এইসব শোনা বারণ।বাড়ির হবু বউকে কিভাবে অনাদর করি?”
মিনা আলতো হাতে মাথা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে রান্নাঘরের দিকে।তৃপ্তি চুপ।সারাদিনের কটুক্তিতে আজকের এই আদরটা যেনো তার জীবনে আশীর্বাদস্বরূপ।
আদ্রিনের ফোন আসলে সে একটু দূরে যায় কথা বলতে।এক পর্যায়ে তৃপ্তিকে ইশারায় বসতে বলে সে উপরে উঠে যাচ্ছে।এই সিঁড়ির উপরের তলায় কোণার দিকে অন্য আরেকটি সিঁড়ি এবং তৃতীয় তলা এই মুহূর্তে দৃশ্যমান হলো তার দৃষ্টিতে।নিঃসন্দেহে সুন্দর ঘর এটা,বিলাসিতায় ভরপুর।
–“শুনেছি তোমার বাবা হিন্দু!”
তৃপ্তি নজর ঘুরায়।আদিবা নামক মহিলা সোফায় বসে মলিন হাসে।চমৎকার তার চেহারার গড়ন।আচমকা এমন প্রশ্ন করায় তৃপ্তি অবাক হয় খানিকটা,
–“জ্বী?”
–“ছোট বউ,বড় বউয়ের মতো ব্যবহার করবে না।”
দাদীর ধমকে কিছুটা চুপসে যায় আদিবা,
–“না আম্মা এমনিতেই প্রশ্ন করছিলাম।”
–“দাদী আমি আসছি।আমার বাসায় আমাকে খুঁজছে হয়তো। না বলে এসেছি।”
ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যা বললো তৃপ্তি।তার খোঁজে কেউ নেই।মেয়েটার হঠাৎ মন পরিবর্তন হচ্ছে।
–“শুনো মেয়ে,আমার আদ্রিন আমার বেশ আদরের।সে যদি দেখে তুমি নেই এখানে,এইযে জিনিসপত্র দেখছো এগুলো শুধু শুধুই ভেঙেচুড়ে হট্টগোল সৃষ্টি করবে।আমি চায় আমার নাতি সুখে থাকুক।আর সেই সুখ যেহুতু তুমি,তাই কিছুক্ষণ বসো।কেমন রোগা দেখাচ্ছে তোমায়,অসুস্থ নাকি?”
তৃপ্তি চোখ পিটপিট করে।সে ভাবতো আদ্রিনের বাড়ির সবাই হয়তো তৃপ্তিতে প্রথম দেখছে।আদ্রিনও তাদের ব্যাপারে কখনো কিছু বলেনি তার পরিবারে এমনটাই ভেসে আসছিল মেয়েটা।কিন্তু,দাদীর কথায় তার ধারণা বদলায়।সুতির জামাটা দুমড়ে ফেলছে সে নিজের মুষ্টিতে।কেমন এক শূন্য অনুভূতি তার বুকের গভীরে।এর মধ্যে মিনার পিছু পিছু গৃহকর্মী ট্রে হাতে আসে।সেন্টার টেবিলের উপরে ট্রে রেখে আবার চলেও যায়।মিনা তার মাথায় হাত বুলিয়ে নাস্তার প্লেট তার হাতে তুলে দেয়,
–“খাও,মা।”
আঁখি ভরে আসে তৃপ্তির। সে কাঁদতে চায় না।তবে মনের মাঝে কোথাও চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছে।মায়ের কথাটা ঠিক এই সময়েই হাতছানি দিলো তার অন্তরে।কতো আদুরে সুর মিনার।চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করে তৃপ্তি প্লেট হাতে নেয়।মিনা এবং আদিবা মনের দিকে ভালো,মিশুক।মাঝে মাঝে ইনায়ার চালে মাথা বিগড়ে যায়। তারা মন্দ নয়।মনে মনে এরা এও সিদ্ধান্ত নেয়,ইনায়ার চালাকির সাথী না হয়ে মা মরা এই ফুলের মতো মেয়েকেই তারা সাপোর্ট করবে।কি মায়াবী চেহারা!নাকটা চকচক করছে নাকফুলের দরুণ।শুভ্র গালের দুদিকে কেমন রক্তিম। চীন দেশীয় নারীর মতো গালের গড়ন এবং চোখ।এক কথায় মেয়েটা চরম সুন্দরী।
তৃপ্তি চিকেন রোল দুই কামড় দিয়ে প্লেটে রাখে।দাদী যত্ন সহকারে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।
___________________
আদ্রিন দ্রুত এসে তৃপ্তির পাশে বসে এবং তারই আধ খাওয়া রোলে কামড় বসায়।এহেন কাণ্ডে সকলে হাসতে চেয়েও হাসলো না উচ্চস্বরে।মুখ চাপা হাসি নজর এড়ায়নি তৃপ্তির।ছেলেটা এমন কেনো?লজ্জা নেই কি?গুরুজনদের সামনে এইসব করা খুব দরকার?
মুখে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও বললো না তৃপ্তি।চুপ করে অল্প কিছু খেলো।আরো কিছুসময় সেখানেই সকলের সাথে আলাপে কাটলো তার।আদিবার মেয়ে অরুকে তার বেশ ভালো লেগেছে।আড়াই বছরের বাচ্চা মেয়েটা বেশ আদুরে।মাত্র কয়েক পলে তৃপ্তি ভক্ত হয়েছে সে।
বিদায়বেলায় দাদী তার আঙ্গুলে একটা আংটি পড়ায়।গম্ভীর মুখে বললেন,
–“ইনায়া এইসব জানলে খুব বকবে আমাকে।কিন্তু আমার তো নাতিকে চাই। ইনায়াকে না।আমার নাতি আমার সুখের ফোয়ারা।”
তৃপ্তি আংটি নিতে বারণ করলে মিনা আদুরে সুরে বলে,
–“মানা করো না।আদ্রিনের নির্দেশ এটা।ছেলেটা দাদীকে সাথে নিয়ে কিনেছে।বলেছিল যেদিন তার মেহেবুবাকে নিয়ে আসবে পরিচয় করাতে সেদিন দিতে।ভাগ্যবশত সেই দিনটা দ্রুতই এসেছে।”
সকলে বেশ সন্তুষ্ট তৃপ্তির প্রতি।আজ তৃপ্তি চমকের উপর চমক পাচ্ছে যেনো।’মেহেবুবা’ শব্দটাও জানিয়েছে ছেলেটা তাদের?অথচ তৃপ্তি এখনো পরিবারে আদ্রিনের কথাটা জানায়নি।কিভাবে জানাবে?তার বাড়ির অবস্থা এই বাড়ির মতো স্বাভাবিক নয়।তৃপ্তির এখনো অনেক রহস্য জানা বাকি।মায়ের মৃ’ত্যুর রহস্য,বাবার ধর্ম পরিবর্তনের রহস্য।আর সেই রহস্য উন্মোচন খুব দ্রুত করবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটা। চাপা ক’ষ্ট মনে পুশে অধর প্রসারিত করে সে।যাওয়ার পূর্বে দাদী আবারও হু’শিয়ারি দিলো তৃপ্তিকে,
–“আমার নাতিকে দেখে রাখবে।সে যেনো কষ্ট না পায়।বাপ মরা নাতি আমার।”
–“জ্বী,দাদী।”
খুব জড়তায় জবাব দিলো তৃপ্তি।
–“চলো।”
আদ্রিন নির্দেশ দেয় তৃপ্তিকে।বাড়ির পোশাক পাল্টে সে এখন ফরমাল পোশাকে আচ্ছাদিত। গাঢ় নীল শার্টে কি চমৎকার দেখাচ্ছে এই পুরুষকে!
সকলকে বিদায় জানিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লো। গ্যারেজের সামনে আসতেই তৃপ্তি তাকে প্রশ্ন করে,
–“আপনার মাকে দেখলাম না!সকলের সামনে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি।উনি কোথায়?”
–“আম্মির সাথে কাজ নেই তোমার।সকল কাজ তোমার আমার সাথে।”
তৃপ্তি মৌন।কি বলবে সে এই ছেলেকে?পরক্ষণে আদ্রিন গাড়ির কাছে যেতে নিলে সে আবারও বলে,
–“আমি সিএনজি দিয়ে যায়?আমার না গাড়িতে উঠতে ইচ্ছা করছে না।আমি একা যেতে পারবো।”
–“হু?”
এক ভ্রু উচুঁ করে প্রশ্ন করে আদ্রিন তৃপ্তিকে।
–“গাড়িতে যাবো না।”
আদ্রিন এক নজর আকাশের পানে তাকায়। গগণে সূর্যের দাপটতা।কেমন গরম অনুভব হচ্ছে।এই গরমে সিএনজিতে যাওয়া তার নিকট পাহাড় কে’টে আসা একই পরিশ্রমের।তারপরও সে তৃপ্তির পানে চায়,মেয়েটা কেমন আদুরে ভঙ্গিতে দৃষ্টি জ্ঞাপন করছে তার দিকে।হৃদয়ে হরতালের আহ্বান জানায়।
–“অপেক্ষা করো।ব্যবস্থা করছি।”
ফোনেই কাজ সারলো আদ্রিন।মিনিট দশেকের মাঝে সিএনজি এসে হাজির।
তৃপ্তি উঠে দরজা বন্ধ করতে নিলে আদ্রিন হাত দিয়ে থামায়,
–“কি আজব!আমি যাবো না?”
–“আপনি?আমি একা যেতে পারবো।”
তৃপ্তির সাবলীল ভাষা।
–“তোমার সাথে জোর জবরদস্তি না করা ছাড়া উপায় রাখো না আর।”
জোর পূর্বক আদ্রিন তৃপ্তির গা ঘেঁষে বসে।তৃপ্তি আরেকটু চাপলে আদ্রিনও সেদিকে এগিয়ে যায়।মূলত মেয়েটার সাথে ছুঁই ছুঁই হয়ে বসাটা তার উদ্দেশ্য।পুনরায় তৃপ্তি আরেকটু চাপতে নিলে আদ্রিন তার কোমর খামচে ধরে,
–“আমাকে শান্ত দেখলে তোমার ভালো লাগে না তাই না?”
আচমকা এমন হওয়ায় তৃপ্তি আর্তনাদ করে।ছেলেটার খামচে ধরাটা যেনো বাঘের থাবা!
–“ব্য’থা পাচ্ছি।”
–“ব্য’থা পাওয়ার জন্যেই ধরেছি।যতবার দূরে যাবে ততবার এমনটা করবো।আরো বেশি করবো।”
আদ্রিনের মুখে রাগ স্পষ্ট হলেও তার খামচে ধরাটা এখন শীতল স্পর্শে পরিণত হলো।তৃপ্তি মুচকি হাসে।ছেলেটা যতো কঠোর হওয়ার চেষ্টা করুক না কেনো তৃপ্তির কাছে সে হেরে যায়।
আলতো করে আদ্রিনের কাঁধে মাথা রাখতেই আদ্রিন আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে তার ধারে,
–“তোমার কাছাকাছি আসার অধিকার শুধু আমার।এই অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করার সাহস কারো নেই।তোমারও নেই।”
তৃপ্তি কিছু বলে না।কেবল ছেলেটার লম্বা আঙ্গুলের উপর নিজের আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি করে।পরক্ষণে আদ্রিন তার আঙ্গুলে আংটি দেখতে পেয়ে তির্যক হাসে,
–“বাগদত্তা হয়ে গেলে আমার।মানিয়েছে তো রিং।”
পরপর সেই আঙ্গুলে অধর ছোঁয়ায় আদ্রিন।
–“আমি বাসায় কিছু বলিনি আপনার কথা।কিছু কাজ বাকি আছে আমার।এরপর বলবো।জানিনা কি হবে।”
তৃপ্তির ব্যথিত কণ্ঠ।
আদ্রিনের চিন্তা নেই।সে কারো মতামতের তোয়াক্কা করলেই তো!তৃপ্তির চুলের গভীরতায় আঙ্গুল ছুঁয়ে সে জবাব দেয়,
–“এতো ভেবোনা।দিনশেষে এই আদ্রিনের বুকেই তোমার অস্তিত্বের দেখা মিলবে।সব ঠিক হবে।আর না হলে সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আমার।”
অতঃপর তৃপ্তির বুকে প্রশান্তি পায়।ছেলেটা তার সকল অতৃপ্তির কাছে হার মেনে যায়।তৃপ্তির জীবনে একমাত্র প্রশান্তি,তৃপ্তির আবেশ এই ‘আদ্রিন’ নামক মানব।
৪৫.
অর্কের বিয়ে নিয়ে সকলে ব্যস্ত ছিলো।বিয়ের পরের দিনই অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় ব্যবসায়িক কাজে পাড়ি জমায় ইন্ডিয়ায়। যার দরুণ তৃপ্তির মনের পরিকল্পনা সব কল্পনায় থেকে যায়। তৃপ্তি যদি জানতো, তার মায়ের মৃ’ত্যুর সত্যতা এই পরিবারের সবাই জানে; তাহলে মেয়ের অহেতুক বাবার পিছে পড়ে থাকতো না।তার আর বাবার সম্পর্কের এমন করুণ অবস্থাও হতো না।তৃপ্তির বাবার ঘোর মানা থাকায় পরিবারের সকলে চুপ থাকে।কেউ চায় না,অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় তার বউয়ের মৃ’ত্যুর রহস্য জেনে মেয়েটা কষ্ট পাক!মেয়েটা তার মাকে ভীষন ভালোবাসে।
যথারীতি তৃপ্তি এবং বাকি সবাই নিজ ফ্ল্যাটে ফিরে।ক্লাস,নিজের ছোট বিজনেস সবকিছুতে আবারও ব্যস্ত সে।এইসবের মাঝেও আদ্রিন তৃপ্তির দেখা হওয়ার পরিমাণ কমে না।আদ্রিন যেনো তৃপ্তিকে দেখা ছাড়া অতিষ্ট হয়ে উঠে।মাঝে মাঝে ব্যবসায়িক কাজে বিভিন্ন জেলায় ছুটলেও ফিরে এসেই সর্বপ্রথম মেয়েটার সাথে সাক্ষাৎ করে সে।হাজারো অতৃপ্তিতে এই মেয়েটাই যে তার তৃপ্ততা!
অপরদিকে ইনায়া তার সকল পরিকল্পনা বন্ধ রেখেছে।আদ্রিন সম্পূর্ণই তাকে উপেক্ষা করে চলছে এখন।যেদিন ছেলেটা তার সাথে এক অক্ষর কথা বলবে, সেদিনই ইনায়া তৃপ্তির ব্যাপারটা ভেবে দেখবে।আপাতত ইনায়া ছেলের রাগ ভাঙ্গাতে উদ্বিগ্ন।
___________
বৃষ্টির পূর্বাভাস।আকাশে কালো মেঘ।তৃপ্তির ভার্সিটির ক্লাস শেষ।সে এবং বাকি বান্ধুবিরা মিলে আলোচনায় ব্যস্ত।আর মাত্র তিন সেমেস্টার পর তাদের অনার্স লেভেলের ভার্সিটির জীবনের ইতি টানবে।তাই সকলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দূরে কোথাও বেরুবে।ঝটপট প্ল্যান হলো সকলে মিলে বান্দরবান যাবে।এই মেয়ে বন্ধুদের সাথে যোগ দিবে তাদের বিভিন্ন গ্রুপের ছেলে বন্ধুরাও,আবার অনেকের বাগদত্তারা।তৃপ্তি ভেবে নিলো আদ্রিনকেও সে শামিল করবে এই ভ্রমণে।
যেই ভাবা সেই কাজ।আলেয়ার বাসা হতে ফেরার সময় আদ্রিন তাকে নিতে আসে।এই সুবাদেই তৃপ্তি আদ্রিনকে বললো,
–“আমরা ফ্রেন্ডরা মিলে ঘুরত যাচ্ছি বান্দরবান।তিনদিন থাকবো।আমাদের সাথে ওদের ফ্রেন্ড আর ফিয়ন্সেরাও যাচ্ছে।”
–“মেয়েরা মিলে গেলেই হয়।ছেলে যাওয়ার কি দরকার?তুমি যাবে?এতো ছেলের মাঝে তুমি থাকবে ব্যাপারটা আমার ভালো ঠেকছে না।”
তৃপ্তি আদ্রিনের দিকে দৃষ্টি মেলে।ক্লান্ত চেহারায় স্পষ্ট ঈর্ষা।হাসি পেয়েও হাসলো না সে।ছেলেটা নিশ্চয় অফিসে ব্যস্ত সময় পার করেছে!তার উপর এখন আবার ড্রাইভিং করছে।ছেলেটার কি ক্লান্তি নেই?ভাবুক তৃপ্তি বুদ্ধি খাটিয়ে আদ্রিনকে বলে,
–“সামনের লেকের ধারে গাড়ি থামাবেন প্লিজ!”
–“ঠিক আছে।কিন্তু তুমি এত ছেলের মাঝে কেনো যাচ্ছো?”
আদ্রিন নাছোড়বান্দা।তার যেনো উত্তরটা এই মুহূর্তে চায় আর চায়।
তৃপ্তি ঠাট্টার ছল অন্তরে পুষে মুখে বললো,
–“গেলে কি হবে?সবাই যাচ্ছে। আলেয়া আর ওর বয়ফ্রেন্ডও যাবে।আমিও যাবো তাই।অনেক দিনের সখ।”
গাড়ি থামে।তৃপ্তি নেমে পড়ে প্রথমেই।আদ্রিনের পরের বাক্য শুনতে সে প্রস্তুত।
দুজনেই লেকের পাশে বেঞ্চিতে বসে।স্বভাবগত আদ্রিনের বাহু আঁকড়ে ধরে তৃপ্তি।সঙ্গে সঙ্গে থমথমে সুর ভেসে এলো আদ্রিনের,
–“তুমি যেও না,তৃপ।এতো ছেলের মাঝে আমার সহ্য হবে না তোমার যাওয়া।”
সোডিয়াম আলোতে আদ্রিনের ঈর্ষান্বিত ভাব স্পষ্ট।সত্য কথা আড়াল করে তৃপ্তি তার ঈর্ষার পরিমাণ বাড়াতে আবারও বললো,
–“নাহ নাহ,আমি যাবোই যাবো।”
আদুরে আবদার শুনে আদ্রিন তৃপ্তির দিকে ফিরে।পবনের ঝটকায় মেয়েটার চুল এলোমেলো।চোখের ভাষা কেমন গোপনীয়।এমন আদুরে ভঙ্গিতে চেয়ে থাকা মেয়েকে কিভাবে মানা করবে সে?
আদ্রিন তৃপ্তির হাতের উল্টোপিঠে অধর ছোঁয়ায় আদ্রিন,
–“ঠিক আছে, যাও।”
আদ্রিন রাজি হবে বলে ভাবেনি তৃপ্তি।কিছু একটা খটকা সে আন্দাজ করলো।হলোই তা।আদ্রিন ফোন বের করে কিছু একটা করলো।মিনিট দুয়েক পর তন্ময়কে ফোন দিলো সে,
–“মেসেজ দিয়েছি,চেক করো।”
ফোন কেটে আদ্রিন আবারও মোবাইলে ব্যস্ত।তৃপ্তি সব দেখছে এবং বুঝছে।খানিকক্ষণ বাদে আদ্রিন তৃপ্তিকে প্রশ্ন করলো,
–“কোন জায়গায় যাবে বলেছিলে যেনো?”
–“উম,বান্দরবান।”
–“আরে বাহ…”
তৃপ্তি মাঝপথে থামিয়ে দেয় আদ্রিনকে,
–“আপনার মিটিং এর ভেন্যু নিশ্চয় বান্দরবানে পড়েছে!”
চোখ পিটপিট করে তাকায় তৃপ্তি।
আদ্রিন চমকায়,
–“জানলে কিভাবে?”
–“কারণ;আপনি আমাকে একা যেতে দিবেন না বলে, মিথ্যা কাহিনী বানাচ্ছেন।”
আদ্রিনের দুগালে হাত রেখে জবাব দেয় তৃপ্তি।
আদ্রিন হেসে উঠলো শব্দ করে।তৃপ্তির হাতের উপর হাত রেখে বলে,
–“গাড়িতে ঘুমালে,তুমি বড্ড অগোছালো হয়ে ঘুমাও।আমি চাই না সে রুপ অন্যকেউ দেখুক,তোমাকে সামলে নিক।তোমাকে সামলানোর জন্যে আমি যথেষ্ট।”
–“এতো জেলাস!এইসব কি ভালো জনাব উন্মাদ?”
–“ইয়েস ভালো।তোমাকে নিয়ে আমি রিস্ক নিতে চাই না।আচ্ছা,চলো মেহেবুবা।রাত বাড়ছে।”
আদ্রিন উঠে তৃপ্তির অপেক্ষায়।মেয়েটা তার দিকে চেয়ে হাসছে।আদ্রিন ঝুঁকে তার চিবুক স্পর্শ করে,
–“কেনো এমন দুষ্টুমি করছো আজ?আমি কন্ট্রোল হারাচ্ছি।”
মুহূর্তেই ধক করে উঠল তৃপ্তির বুক।নিজেকে সংবরণ করে তৃপ্তি তাকে জানায়,
–“আপনি মিথ্যা নাটক না করলেও আমার সাথে যেতে হতো আপনাকে।এতো ছেলের মাঝে আমি নিজেও আপনাকে ছাড়া যেতাম না।কিন্তু,আপনি এমন জেলাস হবেন আমি জানতাম না।জনাব আহানান শেখ আদ্রিন উন্মাদের পাশাপাশি জেলাসে ভরপুর।”
সাথে সাথেই তৃপ্তি নিজের ললাটে উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করলো।আদ্রিন তার হাত ধরে উঠায় তাকে।পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়,
–“আসল উন্মাদের কিছুই দেখায়নি আমি,মেহেবুবা।তোমার জন্যে আমার উন্মাদনা দেখার সুযোগ কারো না হোক।ভয়ংকর হবে সেই উন্মাদনা।”
আদ্রিনের কণ্ঠে ভালোবাসার সাথে বি’ষাক্ততা ভরপুর। যার বিষাক্ততা ত্যাগ করে কেবল ভালোবাসার অংশটুকু গ্রহণ করলো তৃপ্তি।বেশ সহজ সরল ভাবনা মেয়েটার।
চলবে…..