ঁ#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -৪
___________
(১১)
–“বাসায় এসেছি মাত্রই।আজকের দিনের জন্যে আবারও আমি ঋণী,আদ্রিন।ঋণ শোধ করার সুযোগটা অবশ্যই দিবেন।”
এতটুকু মেসেজ পড়েই আদ্রিনের আঁখি জ্বলজ্বল, মনটায় ভর করলো এক রাশ প্রশান্তি।ব্যস্ত মিটিংয়ের ফাঁকে কতবার যে মেয়েটার মেসেজের অপেক্ষায় অস্থির হয়েছে, তা কেবল আদ্রিনের ভেতরকার সত্তার জানান আছে।নিশ্চিন্ত মনে অধর প্রশস্ত হলো ছেলেটার। ভরা মিটিংয়ে আদ্রিনের এহেন রূপে সকলে বিস্মিত।এই ডিল বাদ পড়লে আদ্রিনের কোম্পানির লাখ টাকার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা।আর এই অবস্থায়,আদ্রিনের হাসিটা মিটিং রুমে উপস্থিত সকলের নিকট বড্ড বেমানান।তাছাড়া,মিটিংয়ে এইভাবে আদ্রিনের হাসিখুশি মুখশ্রীর দেখা মেলা ব্যাপক দুষ্কর।
মোবাইল পকেটে পুরে নিশ্চিন্ত মনে সম্মুখে দৃষ্টি জ্ঞাপন করতেই আদ্রিন ভরকালো।উপস্থিত সকলের বিস্ফোরিত নজর তার পানেই।পরপর দুবার কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলো সে।থমথমে সুর ভেসে এলো সেই কর্শক ভাষার মানুষের,
–“আমাকে নতুন দেখছেন?”
উপস্থিত সকলের দৃষ্টি ঘুরলেও বিস্ময় হ্রাস পেলো না একরত্তি।
–“স্যার, ডিল ক্যান্সেল হওয়ার চান্স বেশি।আর আপনি হাসছেন?”
মিটিংয়ে বিদ্যমান একজন মুখ ফস্কে বলেই ফেললো।
–“ডিল হবে না কি হবে না,এর জন্যে আমি বসে বসে কাঁদবো?আমার হাসা কী বারণ?”
বেশ বিক্ষিপ্ত সুরে শুধালো আদ্রিন।
আচমকা তৃপ্তির সম্মুখে থাকা রসিক মানুষটার আসল রুপ কাঁ’পিয়ে তুলছে মিটিংয়ের মাঝে লোকজনকে।চাকরির ভয়ে সকলে নিশ্চুপ।
আদ্রিনের কুঞ্চিত ভ্রুদ্বয় এবং শক্ত চোয়াল লক্ষ্য করে তন্ময় হচকালো।রগচটা আদ্রিনের ক্ষেপে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়।সে পরিস্থিতি সামাল দিতে বুকে পাথর রেখে বললো,
–“স্যার,আমি কনফারেন্স শুরুর জন্যে রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি।”
–“ডু ইট ফাস্ট।”(তাড়াতাড়ি করো)।
আদ্রিনের তীক্ষ্ণ স্বরে বুলেটের গতিতে হাত চালাচ্ছে তন্ময়।সাথে বাকি সবাই,নিজস্ব প্রেজেন্টেশনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে।আজকের দেওয়া প্রেজেন্টেশন তাদের চাকরি বাঁচানোর অন্যতম ক্ষেত্র।
ইন্ডিয়ার বিশিষ্ট শিল্পপতি “আশিক জৈন” এর টিম এবং সে স্ক্রিনে দৃশ্যমান।সকলের ধারণা আজকের এই ডিলটা আদ্রিনের হাত ছাড়া হবে।কারণ,আশিক জৈন সর্বদা নিজের পার্সেন্টিজ বেশি রাখতে চায়।আর আদ্রিন,এমনটা কখনো মেনে নেওয়ার পাত্র নয়।মিটিং শুরু হলো সুষ্ঠু ভাবে।আশিক জৈনের এক-এক টিম মেম্বার প্রেজেন্টেশন দেওয়া শেষে আদ্রিনের টিমের সকলে এমনভাবে প্রেজেন্টেশন দিলো, এতে উপস্থিত ইন্ডিয়ান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সকলে কিংকর্তব্যব্যিমূঢ়।
বিপরীত স্ক্রিনে ভাসমান থমথমে আশিকের মুখশ্রী,
আদ্রিনের মেজাজকে শীতল করে।অধরে তার তির্যক হাসি।সে যদি কর্মচারীর প্রতি রগচটা না হয়,তাহলে কেউই তাদের চাকরির মান রাখতো না।যেমন তেমন শুধু চাকরি করেই যেতো।কিন্তু,এখন!সকলে প্রাণপনে চেষ্টায় এই ডিল হাসিলের। ডিল হবে তো তাদের চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিত।নিজের মনোভাবে আদ্রিন নিজেই সন্তুষ্ট।এইভাবেই সে কর্মচারীর প্রতি বেশ শক্ত মনোভাব ব্যক্ত করে না,তার নিজস্ব প্রফিটের কারণে আদ্রিন অফিসের সকলের নিকট একঘেয়ে আর তিরিক্ষি মেজাজের বস।
পরিশেষে আশিক জৈনের বক্তব্যের পর আদ্রিন নিজ বক্তব্য পেশ করতে হিন্দি ভাষায় আওড়ালো,
–“আপনি নিশ্চিত বুদ্ধিমান,মিস্টার আশিক। বেশী প্রফিট খাওয়ার আশায় এমন সোনায় সোহাগ ডিল আপনি নিশ্চয় মিস করবেন না?এছাড়াও বাংলাদেশে আসলে,আপনাকে আমি আরো কিছু ডিলের অফার করবো।সেগুলো নিশ্চয় আপনার পছন্দ হবে।বুঝতেই তো পারছেন!শুধু টাকা আর টাকা।”
আশিক জৈন চমকিত।সে আসলেই ভাবেনি,
এইখানকার কর্মচারীর প্রেজেন্টেশন তার মনোভাব বদলাতে সক্ষম হবে।তার উপর তাদের অধিপতি আদ্রিনের চালু হিন্দি ভাষায় বলা কথাগুলো সত্যিকারের অর্থের সন্ধানের সুভাস পাচ্ছে সে।এই প্রথম আশিক বাংলাদেশী এমন শক্তিশালী ডিলার পেয়েছে।যারা,তার সাথে কম প্রফিটে বিজনেসে রাজি হয়নি। উল্টো তাকে বাধ্য করেছে একই শেয়ারে ডিল করার।আশিক জৈন সন্তুষ্ট।এতো সময় বাদে তার অধরে দেখা মিললো কাঙ্খিত জিনিস,
–“ডিল ফাইনাল কারো,আহানান শেখ আদ্রিন। ইউর টিম ইজ ভেরি পাওয়ারফুল অ্যান্ড আই লাইক ইউর প্রসেস।আপকি পাস মে সিরফ মেরে মানি হি মানি দেখ রাহাহু।ইয়ে ডিল মে মাজা আয়েগা।”(ডিল চূড়ান্ত করো,আদ্রিন।তোমার টিম অনেক শক্তিশালী এবং তোমার প্রসেস আমার ভালো লেগেছে।তোমার কাছে আমি কেবল টাকা আর টাকার সন্ধান পাচ্ছি।এই ডিলে ব্যাপক আনন্দ হবে।)
–“অফকোর্স,মিস্টার আশিক। জাস্ট, কাম টু বাংলাদেশ।অ্যান্ড সেন্ড দা পেপার সুন।আদ্রিন ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।”(অবশ্যই জনাব আশিক।আপনি বাংলাদেশে আসুন।এবং পেপার পাঠিয়ে দিন দ্রুত।আদ্রিন আপনার অপেক্ষায়।)
কনফারেন্সের সমাপ্তি হলো।তন্ময় তার চেয়ারে বসা অবস্থায় হাসি মুখে বললো,
–“অভিনন্দন স্যার,আমরা পেয়েছি ডিল।”
–“আমি আগেই জানতাম।আমি ডিল পাবো।এই কাজে যে হেরফের করবে,তার চাকরি অনায়াসে যাবে।তাই নিজের বেস্ট দিয়ে নিজের চাকরি বাঁচাবেন সবাই।”
উঠে দাঁড়ায় আদ্রিন।সাথে সকলে শ্রদ্ধাবোধ জানাতে তার অনুকরণ করে।
অতঃপর হাতের দুই আঙ্গুল নাড়িয়ে বসার ইঙ্গিত দিয়ে গমগম পদচরণে কক্ষ ত্যাগ করলো।সকলের সম্মুখে তিরিক্ষি মেজাজ বিকিয়ে রাখলেও নিজ ক্যাবিনে শান্তির আড়মোড়া ভাঙলো সে।এই ডিল তার কোম্পানিকে আরো উচ্চপদে নিতে ব্যাপক দরকার ছিলো।আর সেই ডিল বাস্তব অর্থে বাস্তবায়ন হতে এখন কেবল সময়ের প্রয়োজন।প্রশান্তির শ্বাস ফেলে আদ্রিন।
(১২)
তৃপ্তির ড্রইং কোচিং চলে সপ্তাহের শনি, সোম এবং বুধবার।বাকি রবি,মঙ্গলে তৃপ্তি সাফার ড্রইং টিউশনে যায়।এর জন্যে মাস শেষে সাফার মা চার হাজার টাকা ধার্য করেছে।এই নিয়ে খুশির অন্ত নেই তৃপ্তির।প্রথমে কথা তিন হাজার টাকার হলেও,তৃপ্তির ধৈর্যের সমেত সাফাকে সামলানো সাথে তার অপূর্ব শিল্প দেখে রিয়ানার এই সিদ্ধান্ত।তবে,তার ভাই কেনো হঠাৎই তৃপ্তিকে টিউটর হিসেবে রাখতে বললো,আয়ত্বে এলো না রিয়ানার।ভাইয়ের কাছে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছেটাও নেই।কারণ,কাঙ্খিত জবাব আদ্রিন হতে আশা করা দুষ্কর।তৃপ্তি থেকেও জিজ্ঞাসা করবে এই ব্যাপারে,এমনটাও মানতে নারাজ তার মন।মেয়েটা যদি খারাপ কিছু ভাবে!অগত্য চুপ করলো রিয়ানার অশান্ত মন।হাতে ট্রে নিয়ে সাফার কামরায় এলো হাসিমুখে।
তৃপ্তির কোলে বসেই সাফা আঁকিবুকি করছে।টেবিলে ট্রে রাখতেই তৃপ্তি মাথা তুলে তাকায়।রিয়ানা নামের এই মেয়ে বড্ড মিশুক।এতো চাকর বাকর থাকা সত্বেও মেয়েটা নিজেই তার জন্যে নাস্তা নিয়ে আসে সর্বদা।দুইজনের দৃষ্টি মিলতেই সৌজন্যবোধক হাসলো।
–“সাফা ঠিকভাবে করছে তো?”
–“জ্বী আপু।খুব দ্রুত আয়ত্বে এসে যায় সাফার।”
–“হ্যাঁ,মেয়েটা একটু পটু।আর তোমাকে বেশ দেখতে পারে,তাই তোমার কথা বেশি শুনে।”
তৃপ্তি অধর ছোঁয়ালো সাফার মাথার উপরিভাগে,
–“সত্যি সাফু?তুমি আমাকে পছন্দ করো?”
সাফা মাথা নাড়ায় কেবল।আওড়ালো না কিছুই।মেয়েটা ছবি আকায় মত্ত।
–“ঠিক আছে,করাও তুমি।চা খাও।তোমাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে।আমি আসি।”
রিয়ানার দৃষ্টি ক্লান্তি ভরা তৃপ্তির পানে।মেয়েটার বাবা বিত্তশালী হওয়া সত্বেও কেনো এই মেয়ে এতো দৌড়ঝাঁপ করে এটা তাকে বেশ ভাবায়।তৃপ্তির টানা আঁখিতে কিসের যেনো একটা দু’শ্চিন্তা,বড্ড মায়া হয় রিয়ানার।সে কামরা হতে বেরুনোর পূর্বেই তৃপ্তির চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চোখ বুঁজে নেওয়াটা লক্ষ্য করে।এই মুহূর্তে হয়তো তৃপ্তির এই চায়ের বড্ড দরকার ছিলো!
সাফাকে ড্রইং করানো শেষে তৃপ্তি দ্রুত রিক্সায় উঠলো।তার এখন গোডাউনে ছুটতে হবে।নতুন কাপড়ের শিপমেন্ট চলে এসেছে।আলেয়া ইতিমধ্যে সেথায় পৌঁছে।হাত ঘড়িতে সময় পরখ করলো তৃপ্তি।বিকাল পাঁচটা বেজে বত্রিশ মিনিট।অথচ শীতকালের দরুণ এই সময়কাল এখন সন্ধ্যার জানান দিচ্ছে।তৃপ্তি ওড়নার এক অংশ মাথায় তুলে দিলো।শীতের প্রকোপ হুরহুর করে বাড়ছে।পড়নে জ্যাকেট আকড়ে ধরে তৃপ্তি শক্ত হয়ে বসে।
হঠাৎই তার দৃষ্টি আটকালো রাস্তার পাশে সাদা গাড়ির পানে,সাথে সেই গাড়ির সম্মুখে দাঁড়ানো দুইজন ছেলের প্রতি। এদের মাঝে লম্বা ছেলেটার অবয়ব মিলে যাচ্ছে আদ্রিনের সমেত।সেদিনের পর আদ্রিনের সাথে তার দেখা হয়নি।তবে তাদের কথা হয় রোজ মেসেজে বা ফোনে।বেশিক্ষণ না হলেও,অল্প সময়কালের জন্যে হলেও আদ্রিন খোঁজ নেয় তৃপ্তির।ব্যাপারটা তৃপ্তির বেশ লাগে।দিনশেষে এমন এক মানুষ তার সন্ধান নেওয়াটা তৃপ্তির নিকট পাথরের বুকে ফুল ফোঁটার মতোই অনবদ্য।আদ্রিন তো জানিয়েছে সে ব্যস্ত কাজে।বিরাট ডিল সামলানোর কারণে তার সাথে দেখা করতে পারছে না।অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে ঠিকই।
তৃপ্তির কোথাও একটু কষ্টের অনুভব।তবে সে দমে যায়।আদ্রিনের ব্যাপারে যতো কম ভাববে সেটা তার জন্যেই কল্যাণকর।অতএব,মেয়েটা আদ্রিনের ব্যাপার এড়িয়ে যেতে চামেলীর নিকট ফোন লাগালো।তার এই অহেতুক কথাবার্তা চলবে গোডাউনে পৌঁছানোর আগ পূর্বে।উদ্দেশ্য একটাই,মস্তিষ্ক যেনো আদ্রিনের বিষয়টা নিয়ে এতো চিন্তিত না হয়।
গোডাউনের সামনে আলেয়া দাঁড়িয়ে।তৃপ্তি ব্যাগ হতে নায্য টাকা তুলে দেয় তার হাতে,
–“সব এসেছে কাপড়?”
–“হ্যাঁ।কাপড়গুলো বেশ সফট।আজকেই আমি লাইভে আসবো কাপড় নিয়ে। আই স্বয়ার,এইবার বেশি সেল হবে।সাথে আমরা প্রথম কয়েক পিসের জন্যে ডিসকাউন্ট দিবো।”
আলেয়া বেজায় খুশি।
–“ঠিক আছে।আমি তোর বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিবো মালামাল।গুছিয়ে দেওয়া সম্ভব না।কারণ দেখছিস তো রাত হচ্ছে।আমি যতোই সাহসী হয় না কেনো,এই রাতের বেলা একা আসা যাওয়া ব্যাপক রিস্ক।”
তৃপ্তি বেশ ঘাবড়িয়ে।কারণ,ইদানিং দেশের অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন।মানুষরূপী জানো’য়ারের থাবার আ’শঙ্কায় মেয়েরা আতঙ্কিত।যেখানে দিবাকালীন রক্ষে হয় না,সেখানে নিশীথে একা আসা যাওয়াটা বেশ দু’র্বিষহ।
–“ওকে দোস্ত।আমি জানি,তুই কি পরিস্থিতিতে
আছিস।চল পিক করে নিই আমাদের জিনিস।”
–“চল।”
দুইজন মিলে কাজের উদ্দেশ্যে ছুটলো।
.
যথারীতি সব মালামাল নিয়ে তৃপ্তি এবং আলেয়া তার বাড়ির সামনে উপস্থিত।বাড়ির গার্ডের সাহায্যে দুই সই মিলে সকল মালামাল সঠিক স্থানে রেখে একাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো তৃপ্তি।আবাসিক এলাকার হলুদ সোডিয়াম লাইটে আবছা কুয়াশা বেশ মুগ্ধকর।এইখানে রিক্সার চলাচল একেবারে দুষ্কর।আবাসিক এলাকা বলে কথা।তাই খানিকটা হেঁটে মোড়ে আসলেই কাঙ্খিত রিক্সা পাওয়া যাবে।গুনগুন স্বরে একাই পথ পাড়ি দিতে গিয়েও পা থমকে গেলো তৃপ্তির।সেই গাড়িটি সাথে আদ্রিনের অবয়ব।তৃপ্তির ঘোর লাগে।সে আসলেই বুঝছে না এর সত্যতা।তখনো আদ্রিন,আর এখনো!কিভাবে সম্ভব?নাকি সবই ধুলোময়।তৃপ্তি হচকালো।সেই অবয়বের সম্মুখে যেতেই তার ঘোর ভাঙলো যেনো।ঠিকই তো এই লম্বা অবয়ব আদ্রিনের।পড়নে তার কোট-প্যান্ট।মাথার উপরভাগে বাধ্য চুলের ভাঁজে খানিক বাদে বাদে হাত বুলিয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি মেলে কিছু দেখছে সে। অপর পাশে কেউ বসে গাড়ির নিচু অংশ চেক করছে।
তৃপ্তি ভাবলো এড়িয়ে যাবে।তবে,এর পূর্বেই আদ্রিনের দৃষ্টি তার ভিত্তিতে আটকে।পালিয়ে যাওয়া চোরের ন্যায় তৃপ্তির মুখশ্রী।শেষমেশ দেখেই ফেললো আদ্রিন।তৃপ্তির এমন দেখেই না দেখার ভান মোটেও ভালো লাগেনি আদ্রিনের,
–“কি ব্যাপার,দেখেই না দেখার ভনিতা?”
তৃপ্তির মুখ বন্ধ।সে আসলেই কি করতে চেয়েছে নিজেই অবুঝ।
–“নাহ। চিনতে পারিনি।”
তৃপ্তির কণ্ঠে অসস্তি।
–“রিক্সা থেকে ড্যাবড্যাব তাকিয়েও চিনোনি?”
আদ্রিনের পুনরায় প্রশ্নে তীব্র ঝটকা অনুভব করলো তৃপ্তি।ছেলেটা তাহলে তাকে লক্ষ্য করেছিলো সেক্ষণেই।অথচ তৃপ্তি ভেবেছে কেবল সেই!তৃপ্তির ভাবনার ফোড়ন কে’টে আদ্রিন তাকে পুনরায় প্রশ্ন করলো,
–“বেশি বিরক্ত আমার উপর?হলেও কিছু করার নেই। আমি তোমাকে এভাবেই বিরক্ত করে যাবো।”
–“আসলে,আমি অবাক হয়েছি কিছুটা।আপনি ব্যস্ত বলেছিলেন অফিসে।তাছাড়া,আপনি ছিলেন রাস্তায় সাথে অন্য একজন ছিলো।আমি কাজে যাচ্ছি…”
তৃপ্তি অনুশোচিত হওয়া থেকেও ব্যাপক ঘাবড়িয়ে।কারণ,আদ্রিন।আজ তার কথাবার্তা এবং গাম্ভীর্যতা বড্ড ভীত করছে।সোডিয়াম আলোতে আদ্রিনের আঁখি জোড়া কেমন পরিবর্তনশীল;সেই প্রথম দিনের মতো,যেদিন সে বেদোরম পি’টিয়েছে অপহরণকারীকে।
–“যায় করো,আমাকে ইগনোর করার মতো ভুল করবে না।”
আদ্রিন তৃপ্তি হতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বসে থাকে ছেলেটিকে বলল,
–“কাজ হয়েছে,রুদ্র?”
–“স্যার,হবে না।গ্যারেজে নেওয়া লাগবে।”
–“শিট।”
আদ্রিনের অস্ফুট বিরক্তি।
ছেলেটা উঠে দাঁড়ায়।আদ্রিন পকেট হতে গাড়ির চাবি নিক্ষেপ করলো ছেলেটার পানে,
–“তাই করো তবে।কাজ শেষে বাড়িতে নিয়ে যেও গাড়ি।”
–“আচ্ছা, স্যার।”
রুদ্র চাবি ক্যাচ ধরে বললো।
আদ্রিন তৃপ্তির দিকে ফিরলো।মেয়েটা এখনো সংকুচিত।
–“যাবে?নাকি এইখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”
–“নাহ।যাচ্ছি।”
তৃপ্তির হাঁটার গতি ধীর।
আদ্রিন প্রথমে দ্রুত গতিতে হাঁটলেও এখন তার গতি তাল মিলাচ্ছে তৃপ্তির সাথে।
–“কোথায় যাবে?”
–“বাড়িতেই।আপনি?”
–“ঐদিকেই যাবো।কাজ আছে।”
আদ্রিন পুনরায় চুপ।তৃপ্তি বুঝলো না আজ আদ্রিনের হলো কি?সে কি তৃপ্তির সাথে রাগ করে?সে প্রশ্ন করার পূর্বেই আদ্রিন তাকেই শুধালো,
–“আমি সাথে গেলে সমস্যা হবে? মানে এতো রাতে একা যাবে?”
–“আমি তো যায়।তবে একটু ভয় লাগে। ব্যাপার না।কিন্তু,আপনি সাথে গেলে সমস্যা হবে না।”
তৃপ্তি হাসলো।মেয়েটার হাসি মধুমাখা।আদ্রিনের হৃদ গহীনে কোথাও চেপে থাকা প্রাণঘা’তী রাগটা মিশে গেলো,
–“রিক্সা নিচ্ছি তবে।”
আদ্রিনের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই পাশের গলির সোসাইটি হতে খালি রিক্সার আগমন হয়।যথারীতি ঠিকানা বলে আদ্রিন উঠে পড়ে রিক্সায়।পরপর ধীরে সুস্থে তৃপ্তি উঠে।
তৃপ্তি যদি খেয়াল করতো,তবে সে বুঝতো;পেছনে থাকা আদ্রিনের গাড়ি সচল।রুদ্র সেই গাড়ি নির্দ্বিধায় চালিয়ে যাচ্ছে।আদ্রিনের মনোকামনা যদি একরত্তি বুঝতো তৃপ্তি!
বলিষ্ঠদেহী আদ্রিনের পাশে সঠিকভাবে বসতে হিমশিম খাচ্ছে তৃপ্তির তনু।ছেলেটার কুনোই এর সাথে নিজস্ব কুনি লাগতেই গায়ে জ্ব’লন্ত তাপের আভাস পাচ্ছে।আদ্রিন নিজেকে গুটিয়ে বসার চেষ্টা করেও অক্ষম।তার গায়ের মাংসপেশী সে চেপে বসলেও তো কমবে না।তৃপ্তির হাসি পেলো যেনো।সে মুচকি হেসে বলল,
–“আপনি ঠিকভাবে বসুন।”
–“তুমি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার সাহস আর দ্বিতীয়বার যেনো না দেখাও।”
তৃপ্তির হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠস্বরের বিপরীতে আদ্রিনের কণ্ঠে গম্ভীরতা।
–“আপনি কি আমার সাথে রেগে?”
বাঁক ফিরলো আদ্রিন।দৃষ্টি মিললো তাদের।আদ্রিনের আঁখিতে মা’দকতা।তৃপ্তি বুঝেও বুঝলো না।সে কেবল চেয়ে আদ্রিনের সেই মারাত্মক চাহনী।
–“যেদিন রেগে যাবো,সেদিন তোমার এই কঠিন চোখ রেহাই পাবে না।তার অশ্রুর মুক্তাদানা ঠিকই কোটর হতে বাহির হবে।”
–“ওরে বাবা।”
তৃপ্তি হাসলো শব্দ করে।পরক্ষণে বেখেয়ালি তৃপ্তি স্পিড ব্রেকার খেয়াল না করলে,রিক্সার ঝাঁকুনিতে পড়ে যেতে নেয়।তবে,সে পাশে বসা আদ্রিনের হাত আঁকড়ে ধরে।আদ্রিন নিজেই বিচলিত।কাছে টেনে নেয় তৃপ্তিকে।
–“সাবধানে চালান,মামা।”
আদ্রিনের কথায় রিক্সা চালক মাথা দোলায়।
–“আচ্ছা,আপনি কিভাবে এইখানে এলেন বললেন না তো?”
–“বন্ধুর সাথে দেখা করেছিলাম।সে চলে গেলেও আমি আটকে পড়লাম গাড়ির জ্বা’লায়।এরপর তোমার সাথে দেখা”
আদ্রিনের বলা মিথ্যে ধরতে পারলো না তৃপ্তি।
–“আচ্ছা। আমাকে দেখে তখন থামাননি কেনো?আমি আপনার কলের অপেক্ষায় ছিলাম।অপেক্ষা ছিলো বিফল।”
–“ভেবেছি তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো তাই!আর কল না দিয়ে সরাসরি দেখা হয়েছে,এটাই কি বড় ভাগ্য নয়?”
আদ্রিনের বাহু এখনো তৃপ্তির দখলে।এই দিকটায় যেনো মেয়েটার খেয়াল নেই।তবে,পরবর্তী কথাটা বলার পূর্বেই তৃপ্তি নিজ হাতের অবস্থা বুঝে দ্রুত হাত সরালো।তার আজ হলো কি?পরক্ষণে নিজেকে সামলে সে বললো,
–“আমি না আপনার কথা কিচ্ছুটি বুঝলাম না।কেমন ধাঁধা মনে হচ্ছে।সত্য,মিথ্যার সংমিশ্রণ।”
মজার ছলেই জবাব দিলো তৃপ্তি।
–“সত্য মিথ্যা নিয়েই আমাদের জীবন।যে যেভাবে খুশি থাকে এই সত্য মিথ্যা নিয়ে,এটা একান্তই তার ব্যাপার।তুমি বলো,তোমার কি মনে হয়?”
আদ্রিন কথা সাজাতে পটু কেবল তৃপ্তির বেলায়।
–“উফ, আওলিয়ে যাচ্ছে সব।আচ্ছা,আমাদের হুটহাট দেখা হওয়াটা ব্যাপক মজার।তাই না?”
তৃপ্তির অধরে প্রশান্তির হাসি।
–“হ্যাঁ।”
–“উম, আপনার শীতকাল পছন্দ?”
তৃপ্তির পরপর প্রশ্নে অন্তর জ্বলজ্বল আদ্রিনের।মেয়েটার একেকটা প্রশ্ন আদ্রিনের স্বস্থি।ধীরে ধীরে মেয়েটা আদ্রিনে বুদ হবে এটাই তার দৃঢ় বিশ্বাস।তবে,তৃপ্তির মতো মেয়েকে নিজের প্রতি দূর্বল করাটা একটু কষ্টসাধ্য।কিন্তু,আদ্রিন কম নয়।সে ঠিক জানে,নিজের মেহেবুবার হৃদয়ে কিভাবে স্থান করে নিতে হয়।
–“পছন্দ।আর তোমার?”
ভাবনার ছেদ কে’টে বললো সে।
–“অনেক পছন্দ।আচ্ছা আমাদের যদি কখনো যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় আপনি কি আমাকে ভুলে যাবেন?”
তৃপ্তির দ্বিধাহীন প্রশ্ন।এই প্রশ্নেই আদ্রিনের ভেতরকার সত্তা জ্ব’লে উঠলো তীব্র দাম্ভিকতায়।ইহকালে তৃপ্তির বলা কথাটা কি আদৌ সত্য হতে দিবে আদ্রিন?সামনের স্পিড ব্রেকার লক্ষ্য করে তৃপ্তির সামনেই অপর পাশের রিক্সার নামানো হুডে এক হাত রেখে তাকে না ছুঁয়েই আগলিয়ে বললো,
–“আমাদের মাঝে ‘ভুলে যাওয়া’ শব্দটা বড্ড বেমানান।তুমি বরং আমাকে সারাজীবন মনে রাখার প্রস্তুতি নাও।এটাই তোমার জন্যে কল্যাণকর,মেহেবুবা।”
চলবে…..
কপি করা বারণ।কেমন হয়েছে গল্প অবশ্যই জানাবেন।গল্পটা পুরোই আমার মনের কল্পনার সংমিশ্রনে লিখা। কারো ধর্ম,জাতিকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনা।গল্পকে কেবল গল্প হিসেবে নিবেন,অন্য কিছুর সাথে মেলাবেন না।সকল ধর্মের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা রয়েছে।
ছবি কালেকশন: Ankitaaww (ইনস্টাগ্রাম)