গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত
-ইশরাত জাহান অনিন্দিতা
মেয়েটাকে প্রথম যেদিন হাসপাতালে দেখে সেদিনই হাত পা ভেঙে মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায় অভি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি রুমের সামনে দেখেছিলো মেয়েটিকে। পেটে হাত রেখে যন্ত্রণা সামলাতে সামলাতে হেঁটে যাচ্ছিলো। ঠিক ওই মুহূর্তে অভির সামনে শুধু মেয়েটিই ছিলো। সাদাকালো ঢোলা লম্বা কামিজ। গলায় কালো ওড়না প্যাঁচানো। বাঁ হাতে কালো ব্যান্ড। অনামিকায় আংটি। চুলগুলো পেছন টেনে বাঁধা। অবাধ্য কিছু চুল ঘামে ভিজে লেপ্টে গেছে কপালে। অভি মুগ্ধ মোটাসোটা মেয়েটিতে। পাশ থেকে রুপন্তী কলম দিয়ে খোঁচা দিলো অভিকে।
-হাঁদার বাচ্চা। প্রফেসর রাউন্ডে যাচ্ছেন।অন্য দিকে কি দেখিস?
আচমকা যেন হুঁশ ফিরলো ওর। পেট চেপে ধরে কোঁকাতে কোঁকাতে বললো,
-স্যার। পেটে খুব চাপ দিচ্ছে। বলেই ছুটলো।
রাশভারী প্রফেসর আচমকা বললো ‘ বাথরুমটা বোধহয় অভির উল্টোদিকে। ছেলেটা যাচ্ছে কই? ‘
অভি দৌড়াতে দৌড়াতে বাইরে চলে এসেছে। চারিদিকে চোখ বুলাতেই মেয়েটিকে দেখলো। এক মহিলার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে হাসতে হাসতে।
অভি মেয়েটির পিছু নিলো। পেছন থেকে কথা শুনতে থাকলো। মহিলাটি জিজ্ঞেস করছে,
-ওই ভূতি। কিছু খাবি?
-না খালা
-শসা খা
-না
-ডাব
-না
-পেয়ারা
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ফেললো।
-আমার পেটেরটা হচ্ছে শয়তান।
এইবার দুইজনই হাসলো।
দুজন খুনসুটি করতে করতে মেইন গেটে পৌঁছে গেছে। অভি পেছন পেছন আছে। দুজন প্রজাপতিতে উঠে বসলো।অভি বিপদে পড়লো। রাউন্ডে যাবে বলে মানিব্যাগে বেশি টাকা ছিলো না। কি করবে! যা থাকে কপালে ভেবে উঠলো বাসে। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। অভি ভীড়, ঠেলাঠেলিতে মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়ালো। কাছে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে দেখতে লাগলো। অভি অবাক হলো। মেয়েটির বয়স কুড়ি কি একুশ।এখনকার সময়ে এই বয়সী কোনো মেয়ে তো বাচ্চা নেয় না! আসাদগেটে হার্ড ব্রেক করলো গাড়ি। মেয়েটি অন্যমনস্ক ছিলো। সিটের সাথে ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিলো প্রায়।ধরে ফেললো অভি। মেয়েটা অভির দিকে তাকালো। শিউরে উঠলো ও। এ কোনো জীবিত মানুষের চোখ হতে পারে না। এত নিষ্প্রাণ চাউনি!কিন্তু স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বললো ‘ধন্যবাদ ‘।
-ধন্যবাদ পরে দিয়েন। আমার একটা উপকার করেন। পিক পকেট হয়েছি। কাইন্ডলি যদি ভাড়াটা দিতেন।
মেয়েটি হাসলো। হাসলে মেয়েটির গালে টোল পড়ে।ঠোঁটের নীচে অদ্ভুত একটা ভাঁজ পড়ে।
-কোথায় যাবেন?
-বসিলা
-আচ্ছা
অভি খুব দ্রুত চিন্তা করছিলো মেয়েটির সাথে কিভাবে দ্বিতীয়বার যোগাযোগ করবে। আচমকাই পেয়ে গেলো। টাউনহলের কাছে এসে জ্যামে পড়েছে। এ হলো মোহাম্মদপুরের বিখ্যাত জ্যামের শুরু। দুজনই বসেছে এতক্ষনে। অভি মুখটা যথাসম্ভব করুণ করে বললো,
-শুনুন মিস
-অনিন্দিতা
নামটা খুব পছন্দ হলো অভির। অনিন্দিতা। বাহ!
-আমাকে আর একটু হেল্প করবেন প্লিজ?
-বলুন
-আমাকে দুশো টাকা ধার দিন প্লিজ। আমি কালই আপনাকে পৌঁছে দিব। আমি ফ্রড নই। ইন্টার্ণ ডক্টর ফ্রম এসএসএমসি।এই যে আমার আইডি। আমি অভি রায়হান।
অনিন্দিতা কিছু না বলে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলো।
-আপনার কন্ট্যাক্ট নম্বর?
অভির ফোনে নম্বর তুলে দিলো। বসিলা পর্যন্ত আর দ্বিতীয় কোনো কথা বললো না অনিন্দিতা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। অভি তাকিয়ে রইলো অনিন্দিতার দিকে। মেয়েটির চুপচাপ স্বভাব ঠিক মানায় না। যেন জোর করে আটকে দেয়া হয়েছে বহতা নদী।
.
কয়েকদিন ধরেই অভির উড়ো স্বভাব নজরে এসেছে প্রিয়ন্তীর। ছেলেটা গর্ভকালীন মায়ের যত্নআত্তি নিয়ে পড়া শুরু করেছে। একদিন ঠাট্টা করে জিজ্ঞেসই করে ফেললো,
-কি রে! গোপনে বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছিস নাকি?
অভি চোখ বন্ধ করে হাসে। প্রিয়ন্তী অভির এই পরিবর্তন মানতে পারছিলো না। কারণ অভিকে ভীষণই ভালোবাসে প্রিয়ন্তী। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো অভিকে জিজ্ঞেস করবে কি হয়েছে।তখনই অভিকে আসতে দেখলো। সাথে একটি মেয়ে। ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো।
-প্রিয়, এইটা অনিন্দিতা
-অনিন্দিতা, এইটা প্রিয়ন্তী
কথা বললো মেয়েটি।
-হাই প্রিয়ন্তী।
প্রিয়ন্তী খেয়াল করলো মেয়েটি ক্যাজুয়াল। ওর মধ্যে জড়তা নেই।
-শোন প্রিয়। অনিকে একটু শিপ্রা ম্যামের কাছে নিয়ে যা না। চেক আপ করায়ে দে। প্লিইইইজ।
প্রিয়ন্তী অভির ব্যাবহারে এতক্ষন শুধু অবাকই হচ্ছিলো। অভির সাথে একটা মেয়েকে দেখে যে সারপ্রাইজড হয়েছে! প্রাইমারী শক কাটিয়ে বললো,
-যাচ্ছি।
রিপোর্ট গুলো দেখে শিপ্রা চৌধুরী বললো,
-অনিন্দিতা
-ইয়েস
-ইউ উইল বি আ সাউন্ড মাদার বোথ ফিজিক্যালি এন্ড মেন্টালি। কিন্তু তুমি বোধহয় ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করো না। তোমার বেবিটার জন্য হলেও ঠিকমতো খেতে হবে,ঘুমুতে হবে। এখন সাত মাস চলছে। তোমার কমপ্লিট রেস্ট দরকার। বুঝেছো?
-ইয়েস ডক
-গুড লাক
-থ্যাংক ইউ
প্রিয়ন্তী অনিন্দিতাকে নিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথেই অভি এসে ধরলো।
-কি বললো ম্যাম?
-ও ঠিকমতো খায় না। বাকী সব ওকে।
অভি ক্ষেপে গেলো।
-আপনাকে বলেছি না ঠিকমতো খাবেন?কথা শোনেন না কেন?কি সমস্যা?বাচ্চাটাকে তো সুস্থ রাখতে হবে। নাকি?
-আচ্ছা। ভুল হয়েছে ।স্যরি।
হেসে ফেললো অভি।আপনি স্যরি বলছেন? অদ্ভুত! গত পাঁচমাসে প্রথম শুনলাম।
.
অভি যেদিন অনিন্দিতার থেকে নম্বর পেলো। সেদিন রাতেই ফোন দেয়। অনিন্দিতাকে টাকাটা ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু প্রায় সময়ই ফোন দিত অনিকে। অনি স্বাভাবিক ভাবে না করে। কিন্তু অভি বলেছিলো ‘আমি আপনাকে প্রথম দেখেই ভালোবেসেছি। আপনি বিবাহিতা তাতে তো আমার সমস্যা নেই।আমি বন্ধুর মত আপনার পাশে থাকতে চাই। আপনার জীবনের একটা অংশ হতে চাই।’ অনিন্দিতা কিছু বলে নি। কিছু বলতে পারেনি। কিছু কথার পরে বলার কিছু থাকেনা আসলে।
.
অভি খেয়াল করেনি।কিন্তু প্রিয়ন্তী ব্যাপারটা ঠিকই খেয়াল করেছে। অনিন্দিতা কখনোই ওর বরের ব্যাপারে কিছু বলে না। প্রিয়ন্তী অনিন্দিতার ব্যাপারে খোঁজ নেয়া শুরু করতেই পেয়ে গেলো। মনে মনে বললো ‘অনিন্দিতা, আমার অভিকে তুমি কিছুতেই কেড়ে নিতে পারবা না।’
.
অভির ইচ্ছে অনিন্দিতার মেয়ে হবে। অনিন্দিতা যেন জানেই ওর ছেলে হবে। বাইরে বেরিয়েছিল কিছু কেনার জন্য। অনিন্দিতা যা কিনলো সব বাচ্চা ছেলেদের পোষাক। কেনাকাটা শেষে অভি বললো
-চলুন কিছু খাবেন
-আপনি দেখছি সবসময় আমাকে খাওয়ানোর তালে থাকেন।
-এখন দুজনের জন্য খেতে হবে, জানেন তো।
অনিন্দিতা হাসলো। অভির ফোন বাজলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-এক্সকিউজ মি অনি।প্রিয়ন্তী ফোন দিচ্ছে।ধরি?
অনিন্দিতা ঘাড় কাত করে সায় দিলো।
.
অভি বসে আছে প্রিয়ন্তীর সামনে। মানিক মিয়া এভিনিউয়ের প্রশস্ত রাস্তার দুপাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে।
-শুরু কর
থমথমে গলায় বললো অভি ।
প্রিয়ন্তী ফোন করেই অভিকে মানিক মিয়া এভিনিউতে আসতে বলে। অভি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলো।কিন্তু প্রিয়ন্তীর শেষ কথাটা ওকে টেনে এনেছে এখানে।
-অভি, আমি জানি তুই অনির সাথে আছিস। আমি যা বলবো তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং অনির সম্পর্কেই।ইন্টা
রেস্টিং কিছু তথ্য পেয়েছি। আসতে পারিস।চারটেয় আমি মানিক মিয়া এভিনিউতে থাকবো।
এরপর অভি অনেকটা তাড়াহুড়ো করে অনিকে বাসায় রেখে এসেছে।
-তোর ফোনে একটা গান আছে না? আমার মল্লিকা বনে ‘।
-হ্যা
-গানটা প্লে কর
-প্রিয় প্লিজ।কাম টু দ্যি পয়েন্ট ফর গড’স সেক।
-সেইটেই বলছি।গানটা প্লে কর।
অভি বিরক্ত হলেও গানটা প্লে করলো।প্রিয়ন্তী বললো,
-কন্ঠটা চেনা চেনা লাগছে না তোর?
অভি না করতে যেয়েও ঝট করে সোজা হলো।
-মাই গুডনেস!প্রিয়! অনিন্দিতা!
-হ্যা। অনিন্দিতা রুহানি। রবীন্দ্রসংগীত আর গিটারের চমৎকার ফিউশন করেছিল কলেজে পড়তেই। নামও ছড়াচ্ছিলো। তারপর হুট করেই হারিয়ে যায়।সতেরো সালের শুরুর দিকে। মেয়েটি ওর বাবার অপজিট দলের এক এমপির ছেলের সাথে রিলেশনে জড়ায়। ফ্যামিলি থেকে তাজ্য হয়। ছেলেটির সাথেই থাকতো।ছেলেটার অনিচ্ছায় গান, লেখালেখি ছেড়ে দেয় মেয়েটি। চারুকলায় ভর্তি হয়। ছেলেটির অনিচ্ছা স্বত্বেও । অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে।অনিক, এমপির ছেলে,এবোরশন করাতে বললেও জিদ করে অনিন্দিতা ।ছেলেটি ছেড়ে যায়। এখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ও। জব করে একটা অনলাইন পত্রিকার সাব এডিটর হিসেবে। পড়া, বাচ্চা, জব সব কন্টিনিউ করছে।
অভি চুপচাপ শুনছে। একটা মানুষ এর চেয়ে কি বেশি ভালোবাসতে পারে?
-এখন বল, তুই ওই মাগীকে ছাড়বি কি না?
অভি হতবিহবল হয়ে গেলো প্রথমটায়।তারপর ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো প্রিয়ন্তীর গালে।
-ভুল হোক যাই হোক। অনিন্দিতা মেয়ে ।সম্পর্কে শুদ্ধ অশুদ্ধ হয় না। ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে ভুল করলেও কিন্তু ভ্রুণ হত্যা করেনি ও।বরঙ এই ঘুণে ধরা সমাজের চোখ রাঙানি সয়ে একটা প্রাণের জন্ম দিচ্ছে।ওকে বকার আগে জানবি আমি ওকে ভালোবাসি। ওকে সব অবস্থাতেই ভালোবাসবো । আমি ওর কিচ্ছু না জেনে ওর পাশে থাকতে চেয়েছিলাম।এখন সারাজীবন ওর পাশে থাকতে চাই। যেন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও বলতে পারি ‘আমাদের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপ্টা গেছে ।কিন্তু কেউ কারো হাত ছাড়িনি শেষপর্যন্ত । ‘ তুই লেখাপড়া শেখা কুৎসিত মনের মেয়ে। তোর থেকে বয়সে ছোট একটা মেয়েকে দ্যাখ। ছিঃ।
.
পরিশিষ্টঃঅভি পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে পারছে না। বাইরে বিয়ে বাড়ির হৈ চৈ । অনিন্দিতা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো।
-উফ! তোমাকে নিয়ে আর পারিনা অভি।বুড়ো হয়ে গেলে অথচ কিচ্ছু শিখলে না।কিভাবে যে ডাক্তারি করো!
– ডাক্তারি শেখার পর ভেবেছিলাম সব শিখবো।তার আগেই তুমি এসে গেলে ।তাই ডাক্তারি কোনমতে শেখা হলেও বাকীগুলো আর শেখা হয়ে ওঠেনি কি না!
-হ্যা! যতো দোষ নন্দ ঘোষ কি না!
অনিন্দিতা চলে যাচ্ছিলো। অভি কোমর টেনে ধরে চকাস শব্দে চুমু দিলো। তখনি ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলে উঠলো।
ছেলে মেয়ে দুটিই উঠে এসেছে। মেয়েটার বিয়ে। অনিন্দিতার জমজ ছেলে মেয়ে হয়। অভিই নাম রাখে। নন্দিতা আর ভেন্দেত্তা। ভি ফর ভেন্দেত্তা মুভি দেখার পর থেকে নাকি তার এই ইচ্ছে। শেষ পর্যন্ত অভিকে আটকাতে পারেনি। প্রাচীন নক্ষত্রের মত অনিন্দিতাকে ঘিরে ফেলেছে স্নিগ্ধ মায়ায়। একটু ভালোবাসার জন্যই তো এত ছুটে চলা। একটু মায়ার জন্যই তো বেঁচে থাকা।।
গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত
-ইশরাত জাহান অনিন্দিতা