#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-২৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★সমুদ্রের অশান্ত মধুর কলতান ভেসে আসছে খুশির কানে। ঘুমের মাঝেই ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেখা ভেসে উঠলো। ঘুমু ঘুমু ফোলা চোখদুটো মেলে তাকালো খুশি। বাঁশের জানালার ফাঁক দিয়ে মিষ্টি রোদের কিরণ এসে লাগছে মুখমন্ডলে। শীতের সকালে এই মিষ্টি রোদের উঞ্চতা খুশির ঠোঁটের সীমিত হাসিটাকে আরও প্রসারিত করে দিলো। কোমল বদন মুচড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে মৃদুভাবে উঠে বসলো।খোলা এলোমেলো চুলগুলো হাতের সাহায্য খোঁপা করে নিলো। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে গায়ের কম্বল টা সরিয়ে নিচে নেমে দাঁড়াতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো।চোখের সামনে হঠাৎই সব ঝাপসা হয়ে এলো। শরীরের ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই প্রহর দৌড়ে এসে ধরে ফেললো।খুশির জন্য ব্রেকফাস্ট করে এনেছিল সে। তবে রুমে নিয়ে খুশিকে ওভাবে ঢুলতে দেখে ঘাবড়ে যায়। হাতের ট্রে টা বেডের ওপর রেখে দ্রুত খুশিকে ধরে ফেলে। খুশিকে ধরে বেডে বসিয়ে গালে হাত বুলিয়ে চিন্তিত সুরে বললো।
–হেই দুষ্টুপরি কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?
খুশি বুঝতে পারছে কাল থেকে ওর মেডিসিন গুলো না নেওয়ায় এমন হচ্ছে। কিন্তু সেটাতো আর প্রহরকে বলা যাচ্ছে না। তাই খুশি জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো।
–আ আরে কিছুই না। ওই কাল রাতে একটু কান্না কাটি করেছিলাম না। তাই একটু মাথা ব্যাথা করছে।
প্রহর শাসনের সুরে বললো।
–তো তোমাকে ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে কে উঠতে বলেছে? বিছানায় আরাম না করে তুমি উঠেছ কেন? আমিতো তোমার নাস্তা এখানেই আনছিলাম। এখন শান্ত মেয়ের মতো এখানে চুপটি করে বসো। আর ব্রেকফাস্ট করে নাও।
–আরে কি বলছ? আমি ফ্রেশ না হয়েই কিভাবে খাবো?
–আরে একদিন ফ্রেশ না হলে কিছুই হয় না। শুধু কুলি করে খেয়ে নাও।
–একদমই না। আমি আগে ফ্রেশ হবো। তারপর নাস্তা করবো।
–আচ্ছা ঠিক আছে। বেড টি টাতো খাও। এটা তো বেডেই খেতে হয়। তাইতো এর নাম বেড টি।
প্রহরের জোরাজুরিতে খুশি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চা টা খেয়ে নিল। তারপর উঠে ফ্রেশ হতে গেল। প্রহর ততক্ষণে চায়ের কাপ দুটো রেখে আসলো। কিছুক্ষণ পর খুশি বের হয়ে আসলে দুজন একসাথে নাস্তা করে নিলো। নাস্তা শেষে খুশি হঠাৎ বলে উঠলো।
–এক কাপ চা দিতে পারবে প্লিজ? সকাল বেলা চা খেতে না পারলে কিছুই ভালো লাগে না।
খুশির কথায় ভ্রু কুঁচকে আসলো প্রহরের। একটু আগেই তো খুশি চা খেল। তাহলে এখন এভাবে বলছে কেন? প্রহর সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
–খুশি তুমি কি মজা করছ আমার সাথে? একটু আগেই না চা খেলে? এখুনি ভুলে গেলে? তুমি ঠিক আছো তো? আরেক কাপ চা খেতে চাইলে সেটা সরাসরি বললেই তো হয়।
খুশির মনে পড়লো ডক্টর বলেছিল ব্রেনের টিউমার ধীরে ধীরে ব্রেনের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ছে। আর মস্তিষ্কের অন্যান্য কার্যেও প্রভাব ফেলছে। যার দরুন খুশির শরীরে নানান প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। যেমন মাঝে মধ্যে ভুলে যাওয়া, হঠাৎ অদ্ভুত আচরণ করা, কখনো হঠাৎ ইমোশনাল হয়ে যাওয়া আবার হঠাৎই রেগে যাওয়া। আর অতিবাহিত দিনের সাথে এই সমস্যা গুলো আরও বাড়তে থাকবে। কিন্তু প্রহরকে এখন কি বলবে? কিছু একটা ভেবে খুশি হঠাৎ জোরপূর্বক উচ্চস্বরে হেঁসে উঠে বললো।
–দেখেছ আমি সবসময় তোমাকে বোকা বানিয়ে দেই। তুমি কখনো আমার চালাকি ধরতে পারোনা।আজও পারলে না।
খুশির কথা প্রহরের কেমন বিশ্বাস যোগ্য মনে হলোনা। তবুও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভারাক্রান্ত কন্ঠে বললো।
–হুম ঠিকই বলেছ। তুমি সবসময় আমাকে বোকা বানিয়ে দাও। তবে আজকাল তোমার বোকা বানানোর প্রটোকল টা কেমন পাল্টে গেছে। আমার না কেন যেন খুব ভয় হচ্ছে। এমন কিছু কি আছে যা আমার জানা দরকার? যদি থেকে থাকে তাহলে প্লিজ বলে দাও আমাকে। এমন যেন না হয় যে,পরবর্তীতে জানানোর জন্য তুমি অনেক দেরি করে ফেলো। ট্রাস্ট মি খুশি,দেন আই উইল বি নট এ্যাবল টু ফরগিভ ইউ।
নিজের মর্মবেদনা কোনভাবে সামলে নিয়ে খুশি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো।
–প্রহর প্লিজ আমি তোমাকে আগেও বলেছি। এমন কিছুই না। প্লিজ বারবার এক কথা বলোনা।
প্রহর মলিন সুরে বললো।
–ঠিক আছে তুমি আরাম করো এখন।
কথাটা বলে প্রহর বাইরে চলে গেল। খুশি প্রহরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বেদনার্ত কন্ঠে বললো।
–ইভেন অ্যাম নট ফরগিভ মাইসেল্ফ টু হার্ট ইউ লাইক দিস। অ্যাম সরি প্রহর।
___
ফাহিম ঘুম থেকে উঠতেই দেখলো তিশা ওর জন্য কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফাহিম উঠে বসে তিশার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে বেডের পাশের টেবিলে রেখে বললো।
–আপনার আর এসব করার দরকার নেই। ইউ আর ফ্রী নাউ। যান ফ্রেন্ডসদের সাথে গিয়ে এনজয় করুন।
তিশা হালকা অবাক হয়ে বললো।
–কেন? আমি কি কোন ভুল করেছি?
–আরে না না। আপনি কোন ভুল করেননি।
–তাহলে এভাবে বলছেন যে? আপনি তো বলেছিলেন আপনি যতদিন এখানে আছেন আপনার সব কাজ আমাকে করতে হবে।
–হ্যাঁ বলেছিলাম। তবে আমি জানাতাম না যে, আমিও সেই একই কাজই করছি যা আপনি এতদিন এক্সপেরিয়েন্স করেছেন। আমিও তো সেই আপনার বাবা, দুলাভাই এর মতো একটা মেয়ের ওপর নিজের মিথ্যে অহংকার ফলাচ্ছি। যদিও এসব কিছু শুধুই মজার ছলে হয়েছে। তবুও কাজটা তো সেই একই হচ্ছে। কিন্তু আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তাই অ্যাম সরি। আপনাকে আর এখন থেকে এসব কিছু করতে হবে না। আর হ্যাঁ চিন্তা করবেন না। আমি বিয়ের ব্যাপারে কিছুই বলবোনা।
তিশা মুচকি হেসে বললো
–ইটস ওকে সরি বলার দরকার নেই। আমি আপনার সাথে যা করেছিলাম তাতে যে কারোরই রাগ হবারই কথা। দ্যাটস হোয়াই অ্যাম সরি।
–আচ্ছা যা হবার তাতো হয়ে গেছে। পুরোনো সবকিছু ভুলে এক নতুন ভাবে শুরু করি। ক্যান উই ফ্রেন্ডস?
তিশাও হাসিমুখে বললো।
–ইয়েস উই ক্যান।
–ওকে দেন আপনাকে কি আমি তুমি সম্বোধন করতে পারি? না মানে ফ্রেন্ডসদের মাঝে আপনি সম্বোধন সুট করে না।
–হ্যাঁ অবশ্যই। এমনিতেও আপনি আমার বড়োই হবেন। তো আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।
–থ্যাংক ইউ তিশা। আচ্ছা শোন আমি আমার কিছু ফ্রেন্ডের সাথে আছ হিমছড়ি যাচ্ছি। তো তুমি তোমার ফ্রেন্ডসদের সাথে চাইলে আসতে পারো আমাদের সাথে।
–ওয়াও আমার তো অনেক ইচ্ছে হিমছড়ি যাওয়ার। ঠিক আছে আমি বলছি ওদের। ওরা নিশ্চয় রাজি হবে।
–আচ্ছা তাহলে ঘন্টাখানিক পর রিসিপশন এরিয়ায় এসো তোমরা ঠিক আছে?
–আচ্ছা।
তিশা বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ফাহিম মুচকি হেঁসে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মেয়েটাকে নিয়ে কেমন অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে ওর মনে। মনে হচ্ছে এবার সত্যি সত্যিই বিয়ের পিড়িতে বসতেই হবে। __
সমুদ্রের মাঝে জমে থাকা বড়ো বড়ো পাথরের ওপর বসে আছে খুশি। হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে দৃষ্টির বান চালিয়েছে সামনের সুদর্শন যুবকটার পানে। যে আপাতত ফঁলা 🦯দিয়ে মাছ ধরতে ব্যাস্ত। গায়ের শার্ট খুলে রেখে প্যান্ট টা হাটু পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে পানিতে নেমেছে প্রহর। নীল সমুদ্রের পানি এই যুবকটাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে।এতো কেন সুদর্শন এই ছেলেটা? চোখের নজরকে তো অনেক আগেই বেইমান করে দিয়েছে। এখন বুঝি আমাকে চরিত্রহীন করার ষড়যন্ত্র করছে সে। এসব যে তার সুক্ষ্ম মস্তিষ্কের অভিসন্ধি তা ভালোই বুঝতে পারছে খুশি। তাইতো ওকে এনে এখানে তার সামনে বসিয়ে রেখেছে। যাতে নিজের পরিকল্পনার প্রয়োগ করতে পারে আমার ওপর। এভাবে চলতে থাকলে কিভাবে হবে? নিজের সাথে যুদ্ধ করে কতক্ষণই বা টিকে থাকতে পারবে ও?
হঠাৎ প্রহরের প্রফুল্ল স্বরে খুশির ঘোর কাটলো। প্রহর একটা বড়ো মাছ ধরতে সক্ষম হয়েছে সেটাই দেখাচ্ছে ওকে। প্রহর মাছটা একটা পাত্রে রেখে খুশির কাছে এসে কোন কথাবার্তা ছাড়াই সোজা খুশিকে কোলে তুলে নিলো। খুশি হড়বড়িয়ে উঠে বললো।
–আরে আরে সমস্যা কি তোমার? বলা নেই কওয়া নেই সবসময় খালি তুলে নাও কেন? আমার কি পা নেই নাকি?
–প্রাকটিস করছি বাবু। আমাদের ফুটবল টিমের প্লেয়ারদের পালতে হবে না? তারই প্রাকটিস করছি বুঝেছ?
প্রহর কথা বলতে বলতে খুশিকে নিয়ে পানিতে নামছে। খুশি সেটা দেখে চোখ বড়বড় করে বললো।
–এই এই তুমি পানিতে নামছ কেন? ভিজে যাবো তো আমি।
–হ্যাঁ তো ভেজার জন্যই তো নিয়ে যাচ্ছি। দুদিন হলো গোসল করোনা। আর কতদিন বিনা গোসলে থাকার প্ল্যান আছে? জানি নোংরা থাকা তোমার ফেবারিট বিষয়। তবে আমার মোটেও না। আমার অপরিষ্কার একদম পছন্দ না। তাই তোমাকে এখন গোসল একদম ফ্রেশ হয়ে যেতে হবে।
–গোসল করতে হবে মানে? তাও এই ঠান্ডা পানিতে? মোটেও না। আর তাছাড়া আমি চেঞ্জ করে পড়বো কি?আমার কাছে কি কাপড়চোপড় আছে নাকি?
–তোমার প্রেমিক কে কি এতো কাচা প্লেয়ার মনে হলো? তোমাকে যদি আনতে পারি তাহলে তোমার জন্য কাপড়চোপড় আনা কি খুব একটা কঠিন ব্যাপার? তাই এসব বাহানাবাজি করে কোন লাভ নেই। গোসল তো তোমাকে করতেই হবে।
খুশির কোন বাহানাই ফলপ্রসু হল না। প্রহর ওকে পানিতে নামিয়েই দম নিলো। খুশিকে কোলে নিয়েই পানির গভীরে নামলো প্রহর। ডুব দিলো স্বচ্ছ পানির গহ্বরে। শীতে কেঁপে উঠল খুশি। আকড়ে ধরলো প্রহরের গলা।শীতের মাঝে এই অত্যাচারের জন্য প্রহরের ওপর চরম ক্ষিপ্ত হচ্ছে খুশি। গোসল শেষে আবারও উঠে এলো খুশিকে নিয়ে। ঘরে এসে নামিয়ে দিলো খুশিকে। প্রহরের ব্যাগের ভেতর থেকে একটা প্যাকেট এনে বেডের ওপর রেখে বললো।
–চেঞ্জ করে এটা পড়ে নাও। আমি বাইরে যাচ্ছি।
প্রহর বাইরে যেতেই খুশি প্যাকেট খুলে দেখলো একটা আকাশি নীল শাড়ি আছে তাতে। খুশি বুঝতে পারলো এই জবরদস্তি গোসল করানোর উদ্দেশ্য কি। কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। ওর কাছে আর কোন কাপড়চোপড় নেই। তাই না চাইতেও এটাই পড়তে হবে। কিন্তু ওতো শাড়ি পড়া ভালো করে জানেও না। প্রহরকে এটা বললে সে আরও সুযোগে সৎ ব্যবহার করতে চলে আসবে। না না এরচেয়ে ভালো আমি নিজেই যা পারি তাই করি। খুশি চেঞ্জ করে নিজেই কোনরকমে শাড়িটা পেঁচিয়ে নিলো। কিন্তু বাইরে যেতে পারছেনা ও। শাড়ি পরে প্রহরের সামনে যেতে কেমন যেন লাগছে ওর। তাই ওভাবেই রুমে বসে রইলো। তবে সেটা আর বেশিক্ষণ পারলো না। কিছুক্ষণ পরই দরজায় কড়া নাড়লো প্রহর।এতক্ষণে প্রহর বাইরেই নিজের কাপড় চেঞ্জ করে নিয়েছে। তাই এবার খুশিকে ডাকছে। আর আবারও ব্যার্থ হয়ে দরজা খুলে দিল খুশি।
দরজা খুলে দিলে প্রহরের নজর ধন্য হলো প্রিয়তমার দর্শনে। এই পেঁচানো অগছালো ভাবে পড়া শাড়িতেও পৃথিবীর সবচেয়ে অপরুপা মনে হচ্ছে সামনের রমনীকে। যে রমনীতে প্রহর বারংবারই ধরাশায়ী। ভালোবাসা বুঝি এমনই। নিজের ভালোবাসার মানুষকে সব রুপেই অবিস্মরণীয় লাগে। প্রহর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে খুশির কাছে এসে বললো।
–শাড়ি পড়তে পারোনা আমাকে বলোনি কেন? এসো আমি ঠিক করে পড়িয়ে দিচ্ছি।
খুশি আমতাআমতা করে বললো।
–না না থাক আমি এভাবেই ঠিক আছি।
প্রহর ঠোঁটে দুষ্টু হাসির রেখা ঝুলিয়ে খুশির দিকে ঝুঁকে বললো।
–কেন? ভয় হয় বুঝি? আমি কাছে আসলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে না তাইনা?
খুশি গলা ঝেড়ে বললো।
–এ এমন কিছুই না।
–ঠিক আছে শাড়ি পরাতে দাও তাহলে নাহয় বিশ্বাস করবো।
–ওকে পড়িয়ে দাও। আমার কিছু যায় আসে না।
প্রহর মুচকি হেসে খুশির শাড়ি ঠিক করে দিতে লাগলো। শাড়ি পরাতে গিয়ে প্রহরের হাতের স্পর্শ লাগছে খুশির অঙ্গে।কোন বিনার তার যেন বেজে উঠলো প্রতি ইন্দ্রে। শিহরণ জাগছে খুশির মনে। মন মস্তিষ্কের মাঝে শুরু হচ্ছে সংগ্রাম। দূর্বল হয়ে পড়ছে খুশি। যেকোনো সময় মন মস্তিষ্কের এই লড়াইয়ে মস্তিষ্ককে প্রবলভাবে হারিয়ে দিবে মন। কিন্তু ওকে হারলে যে চলবে না। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।
শাড়ি পড়ানো শেষে প্রহর দুই হাতে খুশির মুখটা আগলে ধরে মোহিত নয়নে তাকিয়ে বললো।
–আজতো তোমাকে দেখে সমুদ্রও হিংসা করবে। এই নীল শাড়িতে যে তুমি ওই নীল সমুদ্রের সৌন্দর্য কেও হার মানছি দিয়েছ।
প্রহরের যাদু যেন খুশিকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বশ করে নিচ্ছে। পারছেনা নিজেকে আটকাতে। প্রহর নামের আগুন যে ওর শক্ত করে রাখা বরফের পরদটাকে ধীরে ধীরে গলিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে খুশি প্রহরের কাছ থেকে সরে যেতে লাগলো। কিন্তু তাতেও ব্যার্থ হলো সে। প্রহরের হাতে আটকা পড়লো ওর হাত। প্রহর খুশির হাত ধরে মায়াবী কন্ঠে বললো।
–হার হাইনেস উইল ইউ ডান্স উইথ মি প্লিজ?
খুশির এখন বড়ো অসহায় লাগছে নিজেকে। করুন চোখে তাকালো প্রহরের পানে। এমন কেন করছে প্রহর? এমন করলে কিভাবে শক্ত রাখবে ও নিজেকে? এইযে এই বিনয়ী আবদারকে এখন কিভাবে মানা করবে ও? ও যে পারে না মানা করতে। খুশির হ্যাঁ বলার অপেক্ষায় রইলো না প্রহর। নিজের ফোনের প্লে লিস্ট থেকে একটা গান প্লে করে ফোনটা বেডের ওপর রাখলো। খুশিকে টান দিয়ে নিজের কাছে এনে নিজের বাম হাত খুশির ডান হাতের মাঝে দিয়ে, আর ডান হাতটা গলিয়ে দিলো শাড়ির ফাঁকে খুশির উন্মুক্ত কোমড়ে। খুশির চোখে স্থির দৃষ্টি রেখে স্লোলি মোশনে নাচতে আরম্ভ করলো।
♬ মেরে হাত মে,তেরা হাত হো
♬ সারি জান্নাতে মেরে সাথ হো
♬ তু জো পাস হো ফির কেয়া ইয়ে জাঁহা
♬ তেরে পিয়ার মে হো যাউ ফানা
দুজনের চোখের দৃষ্টি এক হয়ে আছে। চোখের ভাষায় আবেগের আদান প্রদান হচ্ছে। প্রহরের চোখের ওই সীমাহীন মায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে খুশি। পারছেনা আর নিজেকে আটকাতে।দুনিয়ার বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। নেতিয়ে পড়ছে সে। প্রহরের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে সে। আর খুশিতে মত্ত প্রহর আরও নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। খুশিময় নেশা। যে নেশা প্রতিনিয়ত ঘায়েল করে ওকে।
দুজনেই হারিয়ে যাচ্ছে কোন এক মোহনীয়তার গভীরে। প্রহরের তীক্ষ্ণ নজর পড়লো খুশির অধর যুগলে। মাথা ধীরে ধীরে ঝুকিয়ে এগুলো সে ওই অধরপানে। খুশিও ঘোরের মাঝেই চোখ বুজে নিল। অতঃপর মিলিত দুজনের অধরযুগল। অধরসুধাপান করতে লাগলো দুজন। খুশির কোমড়ে চলছে প্রহরের হাতের বিচরণ। খুশির বদনে কম্পন জেগে উঠছে। যা প্রহরের নেশাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রহর এবার ধীরে ধীরে নেমে এলো খুশির গলায়। অধরের ছোঁয়া লাগাতে লাগলো খুশির কাঁধ আর গলায়। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে খুশির। প্রহরের মাথার পেছনের চুল খামচে ধরলো সে।
এই মধুর মুহূর্তে হঠাৎ খুশির মাথার যন্ত্রণা আবারও শুরু হয়ে গেল। এবার প্রচন্ড বেগে যন্ত্রণা শুরু হলো। খুশির মাথা ফেটে যাচ্ছে। সহ্য করতে পারছেনা ও। দুই হাতে মাথা চেপে ধরলো। ব্যাথার আর্তনাদে মুখ দিয়ে হালকা আওয়াজ বের হলো।
–আহহ
থেমে গেল প্রহর। এক ঝটকায় মাথা তুলে তাকালো খুশির দিকে। খুশিকে এভাবে দেখে আৎকে উঠলো প্রহর। দুই হাতে খুশির মুখ ধরে আতঙ্কিত কন্ঠে বললো।
–এই খুশিরাণী কি হয়েছে? এমন করছ কেন? কি হয়েছে আমাকে বলো?
কথা বলতে পারছেনা খুশি। মাথা ব্যাথার সাথে এবার বমিভাব শুরু হলো। খুশি মুখে হাত চেপে দৌড়ে গেল ওয়াশরুমের ভেতর। ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিয়ে গরগর করে বমি করে দিল। বমি করে ক্লান্ত হয়ে গেল খুশি। নিচে বসে হাঁপাতে লাগলো ও। প্রহরের এদিকে ভয়ে আত্মা কাঁপছে। ও ওয়াশরুমের দরজার কাছে এসে খুশির বমি করার শব্দ শুনতে পেল। প্রহর আরও আতঙ্কিত হয়ে দরজায় চাপড় মেরে বলতে লাগলো।
–তুমি ঠিক আছ খুশি? আমাকে ভেতরে আসতে দাও। প্লিজ কথা বলো।
বমি করে এখন একটু আরাম লাগছে খুশির। মাথা ব্যাথাটাও কমে এসেছে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে নিজেকে একটু ফ্রেশ করে নিলো।দুদিন হলো ওর মেডিসিন গুলো ঠিকমতো না নেওয়ার কারণে এমন হচ্ছে। তবে বাইরে প্রহরের ডাকে অন্তর কেঁপে উঠল খুশির। এখন কি বলবে সে প্রহরকে? ওই পাগলটাকে এখন কি বুঝ দিবে? বাইরে গেলেই প্রহর এখন ওর সামনে সওয়াল-জবাব শুরু করে দিবে। এখন তো আর কোন বাহানাও দেয়া যাবে না। আর সত্যি টা বলা কোনমতেই বলা সম্ভব না। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে খুশির। কিছুক্ষণ ভাবার পর হঠাৎ ওর মাথায় ভয়ংকর এক ভাবনা এলো। এখন এই একটাই উপায় আছে ওর কাছে । হ্যাঁ ওকে এটা করতেই হবে। এটার পর প্রহর ওকে ঘৃণা করতে বাধ্য হবে। আর ওর পিছাও ছেড়ে দিবে। বুকের ভেতর পাথর চেপে সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হলো খুশি।
খুশি বের হতেই প্রহর খুশির মুখ করে চিন্তিত সুরে বললো।
–কি হয়েছে তোমার খুশি? বলো আমাকে প্লিজ।
খুশি মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত কথাটা বলার জন্য। চোখ বন্ধ করে হাতের মুঠো শক্ত করে নিজেকে শক্ত রাখার প্রবল চেষ্টা করছে। ও যা বলতে যাচ্ছে তারপর হয়তো প্রহর ওর মুখও দেখতে চাইবে না। চিরতরে চলে যাবে ওর জীবন থেকে। তবুও ওকে এটা করতেই হবে। খুশিকে চুপ থাকতে দেখে প্রহরের ভয় ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে। প্রহর অস্থির কন্ঠে বললো।
–অ্যাম স্কেয়ারড খুশি। প্লিজ টেল মি হোয়াট হ্যাপেন্ড?
খুশি এবার চোখ খুলে নিচের দিকে তাকিয়ে ঢোক চিপে দৃঢ় গলায় বললো।
–ককি আবার হবে? সব মেয়েদের বিয়ের পরে যা হওয়ার কথা তাই হয়েছে।
প্রহর প্রথমে ভ্রু কুঁচকে খুশির কথার মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করলো। অতঃপর বিষয় টা যখন ওর মস্তিষ্কে প্রবেশ করলো তখন কিছুক্ষণের জন্য ও বোধশক্তিহীন হয়ে পড়লো। খুশির বলা কথাটা যেন কথা ছিলনা। ওটা ছিল এক দল বিষাক্ত তীর। যা প্রহরের হৃদপিণ্ডের এফোড় ওফোড় হয়ে গেল। শরীরের সব শক্তি যেন হ্রাস পেল।খুশিকে ধরে রাখা হাত দুটো ঝট করে সরিয়ে নিল প্রহর। অনুভূতি শূন্য হয়ে নিজের কদম পেছাতে লাগলো সে। ব্যালেন্স রাখতে না পেরে নিচে পড়ে গেল প্রহর। আজ শেষ আশা গুলোর সাথে ওর আত্মার যেন মৃত্যু হলো আজ। ওর মাঝে যেন সব শূন্য হয়ে গেল। প্রহর কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে বাইরে চলে গেল। প্রহর চলে যেতেই খুশি মুখে হাত চেপে ওখানেই বসে পড়ে কাঁদতে লাগলো। প্রহর কে আজ ও সত্যি করে সরিয়ে দিল।
প্রায় দু ঘন্টা পর ফিরে এলো প্রহর। প্রহরের দিকে তাকাতেই আৎকে গেল খুশি। প্রহরকে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। চোখ দুটো লাল টকটক করছে। মুখটা রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। প্রহর এসেই খুশির দিকে না তাকিয়ে নিচ দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলে উঠলো।
–চলুন আপনাকে রিসোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসি।
প্রহরের মুখে আপনি ডাক শুনে খুশির বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। তবে ও যা করেছে তাতে তো এটা হবারই ছিল। তাই খুশি কিছু না বলে মাথা ঝাকিয়ে প্রহরের পিছু পিছু গেল। প্রহর খুশিকে একটা প্রাইভেট শিপে করে কক্সবাজার ফিরে এলো। তারপর গাড়িতে করে রিসোর্টে ফিরে এলো। সার রাস্তায় প্রহর একবারের জন্যও খুশির দিকে তাকালো না। আর না কোন কথা বললো। রিসোর্টে এসে গাড়ি থামলো। খুশি শেষবারের মতো কিছু বলতে গেলে প্রহর হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললো।
–প্লিজ নামুন। আর আমি আপনার সাথে যাকিছু করেছি পারলে ক্ষমা করে দিয়েন। আমার এই মুখ আর কখনো আপনাকে দেখতে হবে না কথা দিচ্ছি। এখন আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।
খুশি অশ্রুসিক্ত চোখে গাড়ি থেকে নেমে এলো। সাথে সাথেই প্রহর গাড়ি নিয়ে চলে গেল। খুশি অশ্রু ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। আজ আরও একবার ওর প্রেমকাব্যের সমাপ্তি ঘটলো#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-২৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★ কালো নিশি ঢলে পড়েছে চারপাশে। তবে এই রাতের থেকেও বেশি কালো অন্ধকার ঘিরে খুশির জীবনে। এই অসহনীয় যন্ত্রণার থেকে তো মরণ ঢের ভালো। তবে এইমুহূর্তে নিজের চাইতে বেশি প্রহরের চিন্তা হচ্ছে। আজকে প্রহরকে একেবারে অন্যরকম লাগছিল। এর আগে কখনো এমন দেখা যায় নি ওকে। নাজানি ওর ভেতর কি ঝড় চলছে? ওর মেন্টাল স্টেটমেন্ট এই মুহূর্তে ঠিক নেই। ও আবার উল্টো পাল্টা কিছু করে না বসে। এসব চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে খুশি। রুমের মাঝে পায়চারী করছে শুধু। কয়েকবার প্রহরের নাম্বারে ফোন দেওয়ার চেষ্টাও করেছে কিন্তু প্রহর ফোন ধরেনি। তারপর থেকে ওর ফোন বন্ধ আসছে।
বারে বসে একের পর এক এলকোহল পান করে যাচ্ছে প্রহর। তবে কিছুতেই কিছু হচ্ছে। বুকের আগুন কিছুতেই কমছে না। কানে শুধু বারবার খুশির বলা সেই কথাটাই ভাসছে। তার সাথে বাড়ছে দহন জ্বালা।সারা শরীর জ্বলছে দাউ দাউ করে। এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবীটাকে নিজের আগুনে পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। যন্ত্রণায় সারা শরীর ফেটে যাচ্ছে। সহ্য করতে পারছে না আর প্রহর। গ্লাস বাদ দিয়ে এবার পুরো বোতল হাতে তুলে নিলো। এক দমে শেষ করে ফেললো পুরো বোতল। তবুও শান্তি পাচ্ছে না। কিছুতেই কমছে না এই মরণযন্ত্রনা। ক্রুদ্ধ হয়ে হাতের বোতল উঠিয়ে সজোরে নিচে আছাড় মারলো। বারে রাখা সব বোতল গুলো ঠেলে ফেলে দিলো। আর মুখ দিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করতে লাগলো। বারের ওয়েটাররা এসে প্রহরের ধরে আটকানোর চেষ্টা করে বলতে লাগলো।
–স্যার স্যার প্লিজ তামাশা করবেন না। বাকি কাস্টমার রা ডিস্টার্ব হচ্ছে।
প্রহর ওয়েটারের কলার চেপে ধরে ক্ষিপ্র কন্ঠে কিছু।
–কাস্টমারদের ডিস্টার্ব হবে সেই ভয় করছিস? আর আমার কি হ্যাঁ? আমার কি? আমার লাইফ ডিস্টার্ব হয়ে যাচ্ছে তার কি? আর কিসব মাল রেখেছিস তোরা? আমি কোন কিছু ভুলতে পারছিনা কেন? এমন কোন কিছু নেই তোদের কাছে যা নিলে আমি সব ভুলে যেতে পারবো? বল আছে এমন কিছু?
ওদের মাঝে এক ওয়েটার প্রহরের কানে আস্তে করে বললো।
–স্যার মাল আছে।ওটা গোপন মাল। আপনি কি নিবেন? একবার নিলে সব ভুলে যাবেন। তবে টাকা একটু বেশি লাগবে স্যার।
প্রহর পকেট থেকে নিজের ভিজিটিং কার্ড বের করে ওয়েটারকে দিয়ে বললো।
–এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছিস তুই কার সাথে কথা বলছিস? টাকার চিন্তা ছাড় আর মাল নিয়ে আয়।
–স্যার ওটা ইলিগ্যাল জিনিস এখানে আনা যাবে না। আপনি আমার সাথে চলুন।
প্রহর ওয়েটারের সাথে আলাদা একটা রুমে এলো। ওয়েটার একটা বক্স এনে তার ভেতর থেকে একটা ড্রাগস এর শিশি আর একটা সিরিঞ্জ বের করলো। ওয়েটার সিরিঞ্জে ড্রাগস ভরে প্রহরকে পুশ করতে গেলে প্রহর ওয়েটারের হাত থেকে সিরিঞ্জ টা নিয়ে বললো।
–তুই যা আমি একাই করে নিবো।
— কিন্তু আপনি একা নিলে সমস্যা হতে পারে। এটার ওভার ডোজ হয়ে গেলে আপনার অনেক ক্ষতি হতে পারে। এমনকি আপনার জানও যেতে পারে।
প্রহর তাচ্ছিল্যকর হাসি দিয়ে বললো।
–এরচেয়ে ভালো আর কি হতে পারে। তোকে যেতে বললাম তুই যা।
–কিন্তু স্যার,,
প্রহর এবার রাগী কন্ঠে বললো।
–আই সেড গেট লস্ট।
ছেলেটা এবার ভয় পেয়ে চলে গেল। প্রহর সিরিঞ্জের দিকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে বললো।
–ইউর লাভ বিকাম পয়জন খুশি। এন্ড নাও ফাইনালি ইট’স ডিসট্রই মি। বাট আই লাভ দিস অলসো।
প্রহর শিশির পুরোটাই নিজের হাতে পুশ করে নিলো। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রহর ঢলে পড়লো।
ওয়েটার ছেলেটা বাইরে এসে অন্য ওয়েটারকে বললো।
–ভাই ওই স্যারতো পুরো ওভার ডোজ নিয়ে ফেলেছে। এখন কি করবো? উনিতো মারা যেতে পারে?
অন্য ওয়েটার বললো।
–আচ্ছা দ্বারা আমি ওই স্যারকে চিনি। উনি মেহরাব ইন্ডাস্ট্রির মালিক। এখানে ওনাদের রিসোর্ট আছে। আমি রিসোর্টে ফোন করে বলে দিচ্ছি।
___
সারাটা রাত অস্থিরতায় কেটেছে খুশির। একটুও ঘুমাতে পারেনি। মনটা প্রচুর অশান্ত হয়ে যাচ্ছে। অজানা কোন ভয়ে বুকটা ধুকপুক করছে। একবার প্রহরের কোন খবর না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। আজ ওরা চলে যাবে। জারিফ এসে প্যাকিং করতে বলে গেছে। একটু পরেই বের হতে হবে। কিন্তু যাওয়ার আগে একবার প্রহরের খবর না পেলে ও যে শান্তি পাবে না। প্রহরের নাম্বার সেই রাত থেকে বন্ধ আসছে। তাই এবার খুশি সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ফেলে ফাহিমের নাম্বারে ফোন দিল। দুইবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো। খুশি বলে উঠলো।
–দেব,,,আই মিন ফাহিম ভাইয়া আমি খুশি বলছি।
ফাহিম ওপাশ থেকে তিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো।
–এখন কেন ফোন করেছেন আপনি? আর কি চান? আপনি যা চেয়েছিলেন তাতো করে ফেলেছেন। এখন আর কিসের জন্য ফোন করেছেন?
খুশি ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–মা মানে? প্রহর কি ঠিক আছে? ওর কিছু হয়নি তো?
–ওয়াও আপনি সত্যিই গ্রেট। প্রহরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে এখন ওর জন্য চিন্তা দেখাচ্ছেন?
অন্তর কেঁপে উঠল খুশির। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–মৃ মৃত্যুর মুখে মানে? কি বলছেন আপনি? ভাইয়া প্লিজ বলুন না প্রহরের কি হয়েছে? ও ঠিক আছে তো?
–হ্যাঁ মৃত্যুর মুখে। প্রহর কাল ড্রাগস এর ওভার ডোজ নিয়ে ফেলেছে। ওখানকার কেউ ফোন করে জানায় আমাদের। আমি তখনই রাতে গিয়ে ওকে হসপিটালে নিয়ে আসি। এখনো জ্ঞান ফেরেনি ওর।
পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল খুশির। খুশির হৃৎস্পন্দন থমকে গেল। মুহুর্তেই অনুভূতিশুন্য হয়ে পড়লো ও। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। ওপাশ থেকে ফাহিম আরও বলতে লাগলো।
— আর এসব কিছু আপনার জন্য হয়েছে। আপনি জানেন এখন আমার নিজেকেই প্রহরের কাছে অপরাধী মনে হয়। কারণ কোথাও না কোথাও আপনার সাথে সম্পর্কে জড়াতে আমিই ওকে পুশ করেছিলাম। আর তার ফলসরুপ এতো কষ্ট পাচ্ছে ও।এরচেয়ে তো ভালো হতো আপনি ওর জীবনে কখনো আসতেনই না।কেন আমার বন্ধুটার সাথে এমন করলেন? ওতো সবটা উজাড় করে আপনাকে শুধু ভালোই বেসেছিল। তাহলে কেন করলেন ওর সাথে এমন? প্রহরের কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবোনা। আর না আপনাকে।
কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দিলো ফাহিম। খুশি শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে ঠাস করে নিচে বসে পড়লো। পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেছে মুহূর্তেই। এ এটা কি হয়ে গেল? এমনটা তো ও চাইনি। যাকে ভালো রাখার জন্য এতো কিছু করলাম। সেই কিনা আজ মৃত্যুর মুখে? না না এ হতে পারে না। আমার প্রহরের কিছু হতে পারে না। আমি থাকতে আমার প্রহরের কিছু হতে দিবোনা। যাকে বাঁচানোর জন্য আমি এতকিছু করলাম, আমার বিরহে যদি সে নিজেই না বাঁচে। তাহলে এসবের কি ফায়দা? না না আমি আমার প্রহরকে কিছু হতে দিবোনা। আমি আজই সব বলে দিবো প্রহরকে। হ্যাঁ সব বলে দিবো। আর দূরে যাবোনা ওর থেকে। কখনোই না।
খুশি উঠে দাঁড়িয়ে এলোমেলো পায়ে দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল। নিচে এসে রিসিপশন থেকে প্রহর কোন হসপিটালে আছে সেটা জেনে নিলো। আর এক মুহূর্তও দেরি না করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। যেতে যেতে শুধু একটাই দোয়া করছে ওর প্রহর যেন ঠিক থাকে। ওর যেন কিছু না হয়।
হসপিটালে এসে দৌড়ে ভেতরে গেল খুশি। বুক কাঁপছে ওর। ভেতরে যেয়ে যেন প্রহরকে ঠিক দেখে এটাই দোয়া করছে। রিসিপশন থেকে প্রহরের কেবিন নাম্বার জেনে নিয়ে দ্রুত পায়ে সেদিকে এগুলো। পড়িমরি করে দৌড়াতে গিয়ে সিড়ির ওপর পড়ে গেল খুশি। হাত পায়ে প্রচুর ব্যাথাও পেল। তবে সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই খুশির। আবারও উঠে দাঁড়িয়ে এলোমেলো পায়ে এগুলো প্রহরের রুমের দিকে। প্রহরের কেবিনের দরজায় এসে দেখতে পেল প্রহরের জ্ঞান ফিরেছে। ফাহিমের সাথে কথা বলছে ও। প্রহরের জ্ঞান ফিরেছে দেখে খুশির দেহে যেন প্রাণের সঞ্চালন হলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুমের ভেতরে কদম বাড়ালো খুশি।
প্রহরের নজর পড়লো খুশির দিকে। তবে খুশিকে দেখে ওর চেহারার ভাবভঙ্গির তেমন পরিবর্তন হলোনা। ফাহিম পেছনে ফিরে খুশিকে দেখে একটু অবাক হলো। খুশির কাছে এগিয়ে এসে বললো।
–ভাবি,,আই মিন আপনি এখানে কি করছেন? সরি তখন আমার মাথা ঠিক ছিলনা তাই উল্টো পাল্টা বলে ফেলেছি। তবে আপনার এখানে আসা ঠিক হয়নি।
খুশি অনুনয়ের সুরে বললো।
–প্লিজ ভাইয়া আমাকে একটু প্রহরের সাথে দেখা করতে দিন? শুধু পাঁচ মিনিট।
–দেখুন একটু আগেই প্রহরের জ্ঞান ফিরেছে। আপনাকে দেখে প্রহর আবার হাইপার হয়ে যেতে পারে। তাই আপনি এখন চলে যান প্লিজ।
প্রহর এবার বলে উঠলো।
–ইট’স ওকে ফাহিম। অ্যাম ফাইন। আসতে দে উনাকে। দেখি কি বলতে চান উনি।
ফাহিম একবার প্রহরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুমের বাইরে চলে গেল।
খুশি আস্তে আস্তে প্রহরের বেডের কাছে এসে দাঁড়াল। প্রহরের দিকে তাকিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বললো।
–প প্রহর তুমি ঠিক আছ?
প্রহর রুষ্ট চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো।
–আনফরচুলেটলি অ্যাম অলরাইট। অ্যাম সো সরি মিস খুশি, ওহ সরি মিসেস খুশি। অতি দুঃখের সহিত বলতে হচ্ছে যে আমি একদম ঠিক আছি।
খুশি আহত কন্ঠে বললো।
–এসব কি বলছ প্রহর?
–ঠিকই তো বলছি। আপনি নিশ্চয় দেখতে এসেছিলেন আপদটা সত্যি সত্যিই বিদায় হলো কিনা। কিন্তু স্যাডলি আপনাকে সেই অসীম খুশিকা দিতে পারলাম না। আপনার আশায় তো বালিচাপা পড়ে গেল। সত্যিই আপনার সাথে এটা একদম ঠিক হলোনা। আপনি কতো আশা নিয়ে এসেছিলেন আমার মৃত ডেডবডি টা দেখে নিজের মনকে প্রশান্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেটা আর হলোনা।
প্রহরের কথার এই বিষাক্ত তীর খুশির হৃদপিণ্ড ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। খুশির সব কথাগুলো গলার মাঝে এসে আঁটকে গিয়ে দলা পাকিয়ে গেল। তবুও কোনরকমে ঢোক গিলে কিছু বলার চেষ্টা করতে নিলেই প্রহর আবারও বলে উঠলো।
–জানেন আজ নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো ইডিয়ট মনে হচ্ছে। আপনার মতো একটা স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতিণীর জন্য আমি আমার জীবন টা পর্যন্ত দিতে চলেছিলাম। আই মিন আমার মতো অপদার্থ দুনিয়াতে আর একটাও হবে না। মানুষ একবার চোট খেয়ে শেখে। পরবর্তীতে আবারও সেই ভুল করার বোকামি করে না। অথচ এই আমি দুই দুইবার একই ভুল করলাম। নারী যে কতবড় ধোঁকাবাজ হয় সেটা আমি আগে থেকে জানা সত্বেও, আবারও আপনার পাতা ফাঁদে পা দিলাম। আর তার যথাযথ ফলও পেয়ে গেলাম। আই ডিজার্ভ ইট এক্সুলি।
প্রহরের তিক্ত কথায় খুশির ভেতরে যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। খুশি অশ্রুসজল চোখে বলতে নিল।
–প্রহর আমার কথাটা তো শো….
খুশিকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে প্রহর দৃঢ় কন্ঠে বললো।
–ব্যাচ অনেক শুনেছি আপনার কথা। আর না। আর আপনার এই মিথ্যে চোখের পানি আমাকে আর ভেজাতে পারবেনা। আমি বুঝে গেছি আপনার মনকামনা। আপনি চান আমি সারাজীবন আপনার বিরহে দেবদাস হয়ে থাকি। আর আমার কষ্ট দেখে আপনি দেখে আপনি পৈচাশিক আনন্দ পান। তবে আপনার এই মনকামনা পূরণ হতে দেবনা আমি। আপনাকে আর জিততে দেবনা। অনেক হয়েছে। আর না। এবার আমিও আপনাকে দেখিয়ে দেবো যে,আমার জীবনে আপনার আর কোন স্থান নেই। ইউ আর নট এক্সিস্ট টু মি। আপনাকে ছাড়াও আমি ভালো থাকতে পারি। ইভেন বেটার থাকতে পারি। দাঁড়ান আপনাকে এখুনি সেটার প্রমান দিয়ে দিচ্ছি।
প্রহর এবার উচ্চস্বরে ফাহিমকে ডাক দিলো। একটু পরেই ফাহিম তড়িঘড়ি করে ভেতরে এলো। প্রহর ফাহিমকে উদ্দেশ্য করে বললো।
–ফাহিম বাবাকে একুনি ফোন কর। ফোন করে বল আমার জন্য মেয়ে দেখতে। যেকোনো মেয়ে হলেই চলবে। আমি দুইদিনের মাঝেই বিয়ে করতে চাই।
ফাহিম অবাক হয়ে বললো।
–প্রহর কি বলছিস তুই? আচ্ছা আগে আমরা এখান থেকে বাসায় যাই তারপর দেখা যাবে।
–নো দেখাদেখি। তোকে যা বললাম তুই তাই কর। এখুনি, এই মুহূর্তে।
–ওকে ওকে আমি বলছি। তুই হাইপার হোস না। আমি বাইরে গিয়ে আঙ্কেল কে ফোন করছি।
ফাহিম আবারও বাইরে চলে গেল। খুশি শুধু নীরব দর্শকের মতো সব দেখে যাচ্ছে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। রাজ্যের সব যন্ত্রণা যেন খুঁজে খুঁজে খুশির ঠিকানায় চলে এসেছে। এতো কষ্ট কেন হচ্ছে ওর? এটাই তো ও চেয়েছিল। প্রহর ওকে ঘৃণা করে নিজের জীবনে অগ্রসর হবে সেই পরিকল্পনায়ই তো এত সংগ্রাম করলো ও। তবে আজ যখন সবকিছু ওর পরিকল্পনা অনুযায়ীই হচ্ছে তাহলে এতো কেন যন্ত্রণা হচ্ছে? বুকটা কেন পুড়ে যাচ্ছে ওর? হোক যন্ত্রণা। যত ইচ্ছা হোক। তবুও ওকে এই বিষ পান করতেই হবে। ওতো এখানে এসেছিল প্রহরকে সবটা জানাতে। কিন্তু এখন যখন প্রহর নিজেই ওকে ভুলে নিজের জীবনে অগ্রসর হচ্ছে তখন ও আর প্রহরের পথে বাঁধা হবে না। কিছুতেই না।
প্রহর আবারও বলে উঠলো।
–আপনি এখন যেতে পারেন মিসেস খুশি। আপনার এই মুখ আর আমি কোনদিনও দেখতে চাইনা। আপনি মরে গেলেও দেখতে আসবোনা।
গলার মাঝে আটকে থাকা কান্নাগুলো গিলে নিয়ে খুশি জোরপূর্বক মুচকি হেঁসে বললো।
–আমি চাইও না আমি মরে গেলে তুমি আসো।
প্রহরের বুকটা হঠাৎ কেন যেন কেঁপে উঠল। খুশি আরও বললো।
–তোমার ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা রইলো। ভালো থেকো সবসময়।
কথাটা বলে খুশি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো। অসার হয়ে আসা পা জোড়া অনেক কষ্টে সামনে বাড়ালো। প্রহরের চোখে রক্ত জমে যাচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত করে নিয়েছে।হাতের রগগুলো ফুলে উঠেছে। দাঁত কিড়মিড় করে নিজের ইমোশন কে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে যতযাই বলুক না কেন। বেহায়া, অবাধ্য মন এখনো চাইছে খুশি না যাক। ফিরে আসুক ওর কাছে। প্রহরের মন জানে, খুশি যদি শুধু একবার এসে বলে প্রহর আমি আর যাবোনা। আমি ফিরে এসেছি তোমার কাছে। আমাকে বুকে টেনে নাও। প্রহর সবকিছু ভুলে খুশিকে নিজের বুকে টেনে নিবে। আর দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করবেনা ও। কিন্তু না। খুশি এলোনা।ওইতো দরজার বাইরে চলে যাচ্ছে। আবারও ওই হৃদহরণী আমার হৃদয় ভেঙে চলে যাচ্ছে ।
দরজার বাইরে পা রাখলো খুশি। খুশির যেন শরীর আর সায় দিচ্ছে না।পা যেন অনেক ভারি হয়ে গেছে আজ। দেয়ালের সাথে হাত ভর দিয়ে অনেক কষ্টে পা ফেলছে সে। করিডরে বসে থাকা কারোর ফোন থেকে কোন সুর ভেসে আসছে।
♬ পাস আয়ে দুরিয়া ফিরবি কাম না হুয়ি
♬ ইক আধুরি সি হামারি কাহানী রাহি
♬ আসমা কো জামি ইয়ে জারুরি নেহি জানলে,, জানলে
♬ ইস্ক সাচ্চা ওহি জিস কো মিলতি নেহি মাঞ্জিলে মাঞ্জিলে
♬ রাঙ থে নূর থা যাব কারিব তু থা
♬ ইক জান্নাত সা থা ইয়ে জাহা
♬ বাকত কি রেত পে কুছ মেরে নাম ছা
♬ লিখ কে ছোড় গায়া তু কাহা
🎶 হামারি আধুরি কাহানি
🎶হামারি আধুরি কাহানি
__
ফ্লোরে প্রাণহীন দেহের মতো অবহেলায় পড়ে আছে খুশি। নজর তার সামনে হাতে ধরে থাকা ফোনের স্ক্রিনে। যেখানে বর কনের বেশে বসে আছে প্রহর এবং তার বঁধু।যেই বেশে কখনো তার থাকার কথা ছিল। আজ সেখানে অন্য কেউ বসে আছে। খুশি সেদিনই কক্সবাজার থেকে ফিরে আসে।প্রহর ওর কথা রেখেছে। দুদিনের মাথায়ই সে বিয়ে করছে। তার বিয়ের ছবি মিডিয়ায় আপলোড করেছে ঘন্টা দুই পূর্বে। তখন থেকেই এভাবে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে খুশি। চোখের দৃষ্টি শূন্য। আজ নেই কোন বেদনা বা বিষাদের ছাপ।চোখে নেই কোন অশ্রু। আজ আর কোন অনুভূতি কাজ করছে না খুশির মাঝে। কেবলই শূন্যতার মরুভূমি।
ধীরে ধীরে অসার হয়ে আসছে খুশির শরীর। হাত পায়ের শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। চোখের সামনে ঝাপসা ছেয়ে যাচ্ছে। হাতে রাখা ফোনটা আর ধরে রাখতে পারলো না। হাতের শক্তি হারিয়ে ছেড়ে দিলো ফোনটা। চোখের পলক চেপে এলো আপন গতিতে। অন্ধকারের তলদেশে ডুবে গেল খুশি। যাক ডুবে। সে আর ফিরতে চায়না। ফিরতে চায়না এই স্বার্থপর পৃথিবীতে। এটাই যেন হয় ওর শেষ ঘুম।
চলবে….
3/