#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-২৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★খুশিইইইইই,,,,
চিৎকার করে ঠাস করে চোখ খুলে উঠে বসলো প্রহর। সারা শরীর অসম্ভব রকম কাঁপছে। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। কেমন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে পর।হাপাতে লাগলো, অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকালো ও। নিজেকে হসপিটালের একটা কেবিনে আবিস্কার করলো প্রহর। ও এখানে কি করছে? খুশি? আমার খুশি কোথায়? খুশি কি তাহলে… না না না কিছুতেই না। খুশিইই খুশিইই.. অস্থির হয়ে প্রহর নিচে নামার চেষ্টা করলো। তখনই হঠাৎ ফাহিম দৌড়ে এসে প্রহরকে ধরে বললো।
–প্রহর তো জ্ঞান ফিরেছে? ঠিক আছিস তুই?
–ঠিক আছি মানে? আমার আবার কি হবে?
–আরে খুশিকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই তো তুইও ওখানে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলি। গত চার ঘন্টা যাবৎ তুই বেহুঁশই ছিলি।
–অ অজ্ঞান ছিলাম? তা তারমানে ওসব কি স্বপ্ন ছিল? খুশি? আমার খুশি? ফা ফাহিম আমার খুশি? খুশির অপারেশন??
ফাহিম স্বস্তিময় হাসির রেখা টেনে বললো।
–তোর বিশ্বাস জিতে গেছে প্রহর। খুশির অপারেশন সাকসেসফুল হয়ে গেছে। তোর খুশি আবারও ফিরে এসেছে তোর কাছে।
প্রহর অশ্রুসজল চোখে ফাহিমের দিকে। প্রহরের দেহে এবার প্রাণের সঞ্চালন হচ্ছে। খুশি ফিরেছে। আমার খুশি ফিরেছে আমার কাছে। প্রহরের আনন্দ যেন ধরছে না। প্রহর উঠে দাঁড়িয়ে বললো।
–ফাহিম আমি খুশির কাছে যাবো। কোথায় খুশি?
–খুশিকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি। জ্ঞান ফেরার পর কেবিনে শিফট করবে।তখন দেখতে পারবি।
–না না আমি এখুনি দেখবো। দূর থেকে হলেও দেখবো। ওকে এক নজর না দেখলে নিঃশ্বাস নিতে পারবোনা আমি।
কথাটা বলেই প্রহর নিচে নেমে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে ছুটে গেল। ফাহিম আটকানোর চেষ্টা করেও পারলোনা। প্রহর বাইরে এসে দেখলো অবজারভেশন রুমের বাইরে করিডরে সবাই বসে আছে। প্রহরকে আসতে জিদান সাহেব এগিয়ে গেলেন ওর কাছে। প্রহর ওর বাবার দিকে তাকিয়ে অস্থির কন্ঠে বললো।
–বা বাবা আমার খুশি। খুশি কোথায়?
জিদান সাহেব ছেলেকে আস্বস্ত করে বললেন।
–ভয়ের কিছু নেই প্রহার। খুশি হলো ফাইটার। ঠিকই মৃত্যুকে ফাইট করে হারিয়ে দিয়েছে। আমাদের কথা রেখেছে ও। আমাদের খুশি মা এখন ঠিক আছে।
প্রহর অশ্রুসজল চোখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–আমি জানতাম বাবা আমার খুশি আমাকে ছেড়ে যেতেই পারে না। আল্লাহ আমাকে এতবড় শাস্তি দিবে না। বাবা খুশি কোথায়? আমি একবার ওকে দেখবো। প্লিজ বাবা।
–কিন্তু অবজারভেশন রুমে তো কাওকে যেতে দেয়না। কেবিনে শিফট করার পর দেখিস।
–না না আমি এখুনি দেখবো। শুধু দূর থেকে একবার দেখবো।
প্রহর অবজারভেশনের করিডরের দরজা ঢেলে ভেতরে ঢুকলো। সেখানে রিসিপশনে বসে থাকা নার্সরা প্রহরকে বাঁধা দিল ভেতরে ঢুকতে। তবে প্রহর কিছুই মানতে রাজি না। সে শুধু বারবার খুশিকে দেখার জেদ করে যাচ্ছে। অগত্যা আর না পেরে দূর থেকে দেখার পারমিশন দিলো ওকে। খুশির রুমের কাছে এসে দরজায় লাগানো কাচের ভেতর থেকে খুশিকে দেখলো প্রহর। সারা মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো জ্ঞানহীন খুশি শুয়ে আছে। প্রহরের চোখের বরষা অঝোর ধারায় বইছে। কাচের ওপর দিয়েই হাত বুলালো প্রহর। ওর ঝাঁসির রানি যুদ্ধ জয় করে ফিরেছে। আমার কাছে ফিরেছে। হৃদয়ের স্পনদ ফিরে পেয়েছে প্রহর। শেষ হয়েছে ওদের জীবনের কঠিন পরিক্ষা।
___
রাত ৮ টার দিকে জ্ঞান ফিরে আসে খুশির। ডক্টর এসে বলে গেলো সবাইকে। একটু পরে খুশিকে বেডে শিফট করা হবে। সবার মাঝে এক অপরিসীম প্রশান্তির লহর ছড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণ যতটুকু ভয়, চিন্তা কাজ করছিল। তারও লেশমাত্র অবকাশ রইলো না। সবার মুখে ফুটে উঠলো প্রাপ্তির হাসি।
কেবিনে শিফট করার পর খুশির মা বাবা আর নিভান পাঁচ মিনিটের জন্য একটু দেখা করে আসলো। কারন ডক্টর বলেছে বেশিক্ষণ রুগীর কাছে ভীড় করা যাবে না। বেশি কথা বললে খুশির সমস্যা হতে পারে । তাই ওরা অল্প কিছু সময়ের জন্য শুধু দেখে চলে আসলো। এরপর এলো প্রহর। দরজা খুলে মৃদুপায়ে ভেতরে ঢুকলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে খুশির পাশে টুলের ওপর বসলো। প্রহরের আভাস পেয়ে ভারি চোখের পলক দুটো ধীরে ধীরে খুলে তাকালো খুশি। পাশে তাকিয়ে দেখতে পেল ওর দিওয়ানা পাগলকে। মায়াময় চোখে তাকিয়ে হাসির রেখা আনলো ঠোঁটের কোনে। ব্যাস এতটুকুই যেন প্রহরের শরীর মনকে প্রশান্তির অথই সমুদ্রে ভাসানোর যথেষ্ট। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দাশ্রু। খুশির একহাতে স্যালাইন লাগানো। প্রহর খুশির অন্য হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। খুশির হাতের উল্টো পিঠে অধর ঠেকালো প্রহর। মাথা ঝুঁকিয়ে অধর ঠেকালো খুশির কপালে। আনন্দাশ্রু জমে গেল খুশির চোখের কোনে। তবে সেটা চোখের কোন বেয়ে নিচে পড়তে দিলোনা প্রহর।তার আগেই নিজের অধর দ্বারা শুষে নিলো সে। মায়াবী কন্ঠে বলে উঠলো।
–নো মোর টিয়ারস খুশিরাণী। ইট’স টাইম টু সেলিব্রেট ইউর ভিক্টোরি। অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ সুইটহার্ট।
খুশি মুচকি হেঁসে ভাঙা গলায় বললো।
— আই নো আই নো, আই অ্যাম সো শক্তিশালী। যমরাজ কে এক ঢিসুম মেরে কুপোকাত করে দিয়েছি ।
অশ্রু চোখেই হাসলো প্রহর। ব্যাস এভাবেই খুশি সারাজীবন ওর পাশে থাকুক। আর কিছু চাইনা ওর।
__
করিডরে একসারিতে লাগানো চেয়ার গুলোর একটাতে বসে আছে বেলি। সাহেলা বেগম ওকে বাসায় চলে যেতে বলেছিল। তবে খুশিকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না তার। তাই এখানেই বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই খুশির সাথে দেখা করে এসেছে। মেয়েটাকে ভালো হতে দেখে তার এখন স্বস্তি লাগছে। হঠাৎ একটা ধোঁয়া ওঠা গরম কফির ওয়ান টাইম কাপ কেউ ধরলো বেলির সামনে। বেলি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো জিদান সাহেব। বেলি সৌজন্যমূলক মৃদু হেসে বললো।
–আরে শুধু শুধু কেন কষ্ট করতে গেলে?
জিদান সাহেব বেলির পাশে বসে বলে উঠলেন।
–বারে এতে আমার কেন কষ্ট হতে যাবে? কফি কি আমি বানিয়েছি নাকি? কফি তো বানালো ক্যানটিনওয়ালা আমিতো শুধু নিয়ে এলাম। গরম গরম কফি টা খেয়ে নাও। শরীর মন ফ্রেশ হয়ে যাবে।
বেলি কফির কাপটা হাতে নিলো। জিদান সাহেবও তার নিজের কফিতে চুমুক দিলো। বেলি কফি খেতে খেতে ইতস্ততভাবে বলে উঠলো।
–জিদান তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।
–হ্যাঁ বলো,জিজ্ঞেস করার কি আছে?
–আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে তোমার খুশির কথা মানার কোন দরকার নেই। দেখ আমি জানি তুমি খুশির ওই অবস্থায় ওকে মানা করতে পারোনি। তাই ওর মন রাখতে রাজি হয়ে গেছ। তবে তোমার এসব করার দরকার নেই। আমি খুশিকে বুঝিয়ে বলবো। ও নিশ্চয় বুঝতে পারবে।
জিদান সাহেব বলে উঠলেন।
–আর আমি যদি বলি আমি আমার মনের ইচ্ছেতেই রাজি হয়েছি তাহলে?
বেলি চকিত দৃষ্টিতে তাকালো জিদান সাহেবের দিকে। জিদান সাহেব স্মিথ হেঁসে বললেন।
–হ্যাঁ বেলি, তুমি হয়তো ভাবছ আমি খুশির রাখতে বা তোমার ওপর দয়া করে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তবে এমন টা না। আমি আমার নিজের খুশিতেই রাজি হয়েছি। আসলে আমি উপলব্ধি করেছি জীবনে একটা যোগ্য সঙ্গিনীর খুবই প্রয়োজন। যার কাছে নিজের ভালো মন্দের কথা মন খুলে বলতে পারবো। কিংবা আমার না বলা কথাও সে বুঝে যাবে। জানো পাপিয়া আমার বউ হলেও ও কখনো আমার মনের কথা বুঝতে পারেনি। তবুও আমি কখনো ওর ওপর অভিযোগ করিনি। ভেবেছি সবাই তো আর এক হয়না। ও নাহয় একটু অন্যরকম। তবে ওর ওভাবে চলে যাওয়ার পর অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। নিজেকে কেমন ইডিয়ট মনে হচ্ছিল তখন আমার। কিন্তু আমি এই কষ্ট কারো সাথে শেয়ার করতে পারতাম না। কারণ তখন প্রহরকে সামলানোটাই আমার সবচেয়ে বড়ো প্রায়োরিটি ছিল। এভাবে নিজের অনুভূতি গুলো নিজের মাঝেই চেপে প্রহরকে মানুষ করা আর বিজনেসের ভেতর ডুবে থাকলাম। কিন্তু দিনশেষে ঠিকই নিজেকে খুব একা মনে হতো। মনে হতো কেউ একজন যদি থাকতো তাহলে তার কাঁধে মাথা রেখে নিজের সুখ দুঃখ শেয়ার করতে পারতাম।যদিও প্রহর বড়ো হবার পর থেকে আমাকে অনেক বার বিয়ে করতে বলেছে। তবে আমার মন চায়নি আর। কারণ একবারই মনমতো জীবনসঙ্গী বেছে নিতে ভুল করেছি। আবারও যদি সেই একই ভুল করি তাহলে কি হবে? আর সে যদি প্রহরকে আপন করে না নিতে পারে সেই ভয়ে কখনো সেই পথে পা বাড়াইনি। তবে একাকীত্ব এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়াই। আর এতো বছর পর তোমাকে দেখে কেন যেন মনে হলো তুমিই হয়তো আমার একাকীত্ব দূর করতে সাহায্য করতে পারবে। কারণ তোমার ভালো বন্ধু আমার আর কেউ নেই। তুমিই একমাত্র আমাকে ভালো ভাবে বুঝতে পারো। তাই খুশির কথায় আর দ্বিতীয় বার ভাবিনি আমি। তবে এটা একান্তই আমার ইচ্ছে। তুমি যদি মানা করতে চাও অনায়াসে করতে পারো। তোমার ওপর কোন চাপ নেই। তুমি যা ডিসিশন নিবে তাই হবে।
কথাগুলো বলে কফি শেষ করে উঠে গেল জিদান সাহেব। আর বেলি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। সত্যিই কি সে তার ভালোবাসার পূর্ণতা পেতে চলেছে।
__
এক সপ্তাহ পর খুশিকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ দিয়ে দিলো। এখন অনেক টা উন্নতি হয়েছে খুশির। মাথার ব্যাথাটাও অনেক কমে গেছে। বাসায় আনার পর থেকে প্রহর দিনরাত খুশির সেবায় নিয়জিত থাকে। এক মুহূর্তের জন্যেও খুশিকে একা ছাড়ে না। খাইয়ে দেওয়া, গোসল করানো,নিয়মিত মেডিসিন দেওয়া সহ যাবতীয় কাজই প্রহর নিজের হাতে করে। খুশিকে নিজের পায়ে এক পাও হাঁটতে দেয়না প্রহর। যেখানে যাবে খুশিকে কোলে নিয়ে যায়। যেন খুশি কোন ছোট বাচ্চা যাকে ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবে। এই অতিরিক্ত কেয়ারে খুশির মাঝে মধ্যে খুব বিরক্ত লাগ। সে বিরক্তির সুরে বলে,
–আরে এতো পুতুপুতু করার কি আছ? আমি কি নবজাতক শিশু নাকি আজব? এভাবে চলতে থাকলে তো আমি নিজের পায়ের বোধশক্তিই হারিয়ে ফেলবো। তখন সারাজীবন কাঁধে নিয়ে নিয়ে ঘুরো লেঙরা বউকে।
প্রহর তখন মুচকি হেঁসে বলে।
–ঘুরতে হয় ঘুরবো। তোমার তাতে কি? আমার বউকে আমি সারাজীবন কোলে কাঁধে নিয়েই ঘুরবো।
প্রহরের কথায় তখন আবার চোখ ভরে আসে খুশির। কেউ কাওকে এতটা কিভাবে ভালোবাসতে পারে? মন চায় তখন এই পাগলটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে।
দেখতে দেখতেই কেটে গেল আরও বিশটা দিন। খুশি এখন প্রায়ই সুস্থ। মাথার ব্যান্ডেজও খুলে দিয়েছে। মাথায় আবার নতুন করে চুল গজিয়েছে খুশির। এখন নিজে নিজেই চলাফেরা করে। যদিও প্রহর বেশি চলাফেরা করতে মানা করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। খুশিতো খুশিই। তাকে আবদ্ধ করে রাখা খুবই দুর্বোধ্য কাজ।
আজ খুশির অপারেশনের এক মাস পূর্ণ হয়েছে। খুশি এখন অনেক টা সুস্থ হওয়ায় প্রহর আবার অফিস যাওয়া শুরু করেছে। খুশি হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রহর আর অফিসে যায়নি। এতদিন জিদান সাহেবই সবকিছু সামলেছেন। তবে এবার বাবাকে রেস্ট দিয়ে প্রহর আবারও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। যদিও বেশিসময় থাকে না সে। দ্রুত কাজ সেরে বাসায় চলে আসে সে। খুশির চিন্তা যে তাকে থাকতে দেয়না। ও জানে ও না থাকলে খুশি একটুও নিজের খেয়াল রাখে না। মেডিসিন গুলোও ঠিকমতো নেয় না। তাইতো খুশির কাছে না আসা পর্যন্ত ওর চিন্তার কমতি থাকে না।
সময় তখন রাত ১০ টা, প্রহর একটু ওর বাবার সাথে বিজনেসের ব্যাপারে কিছু আলাপ করতে গিয়েছিল। কথা শেষে সে ফিরে এলো ওর রুমে। রুমে এসে দেখলো খুশি রুমে নেই। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ দেখে বুঝলো খুশি ওয়াশরুমে গিয়েছে। প্রহর বেডের পাশে ছোট ল্যাম্প টেবিলের কাছে গিয়ে খুশির মেডিসিন গুলো চেক করতে লাগলো। ঠিকমতো মেডিসিন গুলো নিয়েছে নাকি তাই দেখছে। তখনই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে স্বাভাবিক ভাবেই পাশে ফির তাকালো প্রহর। আনমনে ফিরে তাকিয়ে আবারও মাথা ঘুরাতে নিলেই আটকে গেল তা। ধীরে ধীরে আবারও ফিরে তাকালো খুশির পানে।মুহূর্তেই থমকে গেল প্রহর। নির্বোধ নির্বিকার হয়ে গেল সে। চোখের পলক পড়তে আর হা হওয়া মুখটা চাপতে ভুলে গেল। ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আবেদনময়ী মহীয়সী রমনীকে দেখে হৃৎস্পন্দন কম্পন করা থামিয়ে দিল।
খুশি একটা শর্ট জিন্স আর স্লিভলেস সাদা শর্ট টিশার্ট পড়েছে, যার নিচে পেটের অর্ধভাগ দৃশ্যমান। টিশার্টের ওপরে লং একটা বুক কাটা জর্জেটের কটি পড়েছে। খুশির এই মাত্রাতিরিক্ত আবেদনময়ী রুপ প্রহরকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে।চোখের পর্দায় মাদকতা ছড়িয়ে পড়ছে। হাতের শক্তি হারিয়ে হাতে থাকা ঔষধ গুলো সব নিচে পড়ে গেল। এই শীতের মৌসুমেও যেন অতিরিক্ত গরমের প্রভাব অনুভব করছে প্রহর। গলা শুঁকিয়ে আসছে তার। খুশি ঠোঁটের কোনে আবেদনময়ী হাসি ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো প্রহরের কাছে। প্রহরের একেবারে কাছে এসে দুই হাতে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে বললো।
–কি হয়েছে মিঃ হাসব্যান্ড? মুখটা একটু চাপাও নাহলে মশাগুলো সব বিনা দাওয়াতে ঢুকে পড়বে।
প্রহর শুঁকনো ঢোক গিলে নিয়ে আমতাআমতা করে বললো।
–এ এসব কি খুশি? শীতের দিনে এমন কাপড়চোপড় কেউ পড়ে? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
খুশি আরও একটু বেশি আবেদনময়ী ভঙ্গিতে বললো।
–আচ্ছা তাই বুঝি? তাহলে এতো শীতের মাঝে তুমি ঘামছ কেন সুইটহার্ট?
কথাটা বলে খুশি ঠোঁট গোল করে প্রহরের মুখের ওপর ফু দিতে লাগলো। বেচারা প্রহরের অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে যাচ্ছে। খুশি ফু দেওয়া শেষে বললো।
–এখন ঠিক লাগছে? নাকি আরেকটু ঠান্ডা হাওয়া দিবো? গলাও শুঁকিয়ে গেছে নাকি? ঠোঁট দুটো শুষ্ক হয়ে গেছে। চলো এদের একটু সিক্ত করে দেই।
খুশি এবার প্রহরের অধর পানে এগুতে লাগলো।কিন্তু প্রহর খুশিকে থামিয়ে দিয়ে বললো।
–খুশি এক মিনিট, আমার কথা শোন। দেখ তুমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হওনি। এখুনি এসবের সময় হয়নি। এতে তোমার সমস্যা হতে পারে।
খুশি প্রহরের ঠোঁটের ওপর তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বললো।
–হুঁশশ অনেক হয়েছে। কি অসুস্থ অসুস্থ লাগিয়ে রেখেছ? অ্যাম নট ইউর পেশেন্ট। অ্যাম ইউর ডিয়ার ওয়াইফ। সো ট্রিট মি লাইক দ্যাট।
খুশি প্রহরের কপাল আর গালে আঙুল বোলাতে বোলাতে বললো।
–জানো কক্সবাজারে তোমার ওই ব্যাড বয় ইমেজ টা কিন্তু আমার হেব্বি লেগেছিল। জাস্ট কিলিং। কিন্তু এখানে এসে তুমি আবারও সেই আগের বোরিং নীতিবান হয়ে গেছ। আই ওয়ান্ট দ্যাট গাই।
–আমার কথাটা তো…
আর বলতে দিলোনা প্রহরকে। তার আগেই আলতো করে ধাক্কা দিয়ে প্রহরকে বেডে ফেলে দিলো। তারপর গিয়ে প্রহরের পেটের ওপর চড়ে বসলো খুশি। প্রহরের দুই হাতের মাঝে নিজের হাত ঢুকিয়ে বেডের সাথে আটকে ধরে বললো।
–আই ওয়ান্ট মাই লাবিডাবি হাসব্যান্ড রাইট নাও।
–দেখ খুশি সোনা বোঝার চেষ্টা করো তোমার কষ্ট হবে।
খুশি প্রহরের কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলো না। মাথা ঝুঁকিয়ে প্রহরের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে লো ভয়েসে বললো।
–এই কষ্ট সুখের কষ্ট। আমার কিছুই হবে না। সত্যিই বলছি। প্লিজ প্রহর…
প্রহরতো এমনিতেই খুশিতে নিমজ্জিত। তারওপর প্রিয়তমার এমন আবদার ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই ওর। আর শক্ত রাখতে পারলোনা নিজেকে। নেশায় ডুবে গেল সে নিজেও। তার নেশা আরও বাড়িয়ে দিলো খুশির কোমল অধরের ছোঁয়া। যা এই মুহূর্তে খুশি ওর গলা আর ঘাড় জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। খুশি প্রহরের শার্টের বোতাম খুলে গলা বুক জুড়ে অধরের স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাগল হয়ে যাচ্ছে প্রহর। দুই হাতে খুশির কোমড় জড়িয়ে ধরে খুশিকে নিচে নামিয়ে দিলো। নিজে খুশির ওপর ঝুঁকে খুশির সারামুখে অধরের স্পর্শ চিহ্ন এঁকে দিতে দিতে লাগলো। তারপর অধর মেশালো খুশির অধরে। খুশির অধরসুধাপান করতে লাগলো। খুশিও প্রহরের মাথার চুল খামচে ধরে নিজেকে ভাসিয়ে দিলো প্রহরের মাঝে। অধর ছেড়ে খুশির গলায় নেমে এলো প্রহর। গলা ঘাড়ে ভরিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার ছোঁয়ায়। কম্পন শুরু হয়ে গেছে খুশির মাঝে। প্রহর মাথা তুলে খুশির চোখে চোখ রেখে বললো ।
–খুশি আবারও বলছি তোমার কিন্তু কষ্ট হবে। তুমি বললে আমি এখনো থেমে যাবো।
খুশি কোন কিছু না বলে প্রহরের সাথে অধরযুগল মিলিয়ে নিলো। প্রহর খুশির জবাব পেয়ে গেল। তাই সে খুশিকে নিয়ে ডুব দিলো প্রেম সাওরের অথই সমুদ্রে। সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে হারালো দুজন স্বপ্নের রাজ্যে।
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৩০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★স্নিগ্ধ আলোর সরু এক কিরণ জানালার পর্দা ভেদ করে এসে প্রবেশ করলো রুমে। আধার সরিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তুললো নতুন উদ্যমের নতুন সুপ্রভাত। প্রভাতের আলোয় পরিস্ফুটিত হলো চাদরে মোড়ানো আলিঙ্গনরত এক সুখী দম্পতির। ঘুমন্ত মুখশ্রীতেও যেন সুখ রাজ্যের সমাহার ছড়িয়ে আছে। তাদের প্রনয়লীলা দেখে প্রকৃতিও মুচকি হাসছে। যে হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়ছে ধরনী জুড়ে।
ঘুম ভেঙে আসতেই ঢিপঢিপ ধ্বনি তরঙ্গ কানে এলো খুশির। আঁখি যুগল মেলে তাকালো সে। প্রহরের উন্মুক্ত বুকে আবিস্কার করলো নিজেকে।মুচকি হেসে কিছুক্ষণ কান পেতে শুনতে লাগলো প্রহরের হৃৎস্পন্দন। তারপর আস্তে করে মাথা তুলে তাকালো সে। প্রহরের বুকে নিজের নামের ট্যাটু টা দেখতে পেল খুশি। আলতো করে হাত বোলালো সেখানে। ট্যাটু টা যতবারই দেখে ততবারই আবেগপ্রবণ হয়ে যায় খুশি। নিজেকে তখন দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবতী মনে হয়। মাথা নামিয়ে গভীর করে অধর ছোঁয়াল ট্যাটু করা জায়গায়। এরপর আরেকটু উজিয়ে গিয়ে প্রহরের মুখোমুখি হলো। প্রহর এখনো ঘুমে বিভোর। ঘুমন্ত মুখটাতে কতো সুন্দর প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে। খুশি মুচকি হেঁসে প্রহরের কপালেও পরম আদরে নিজের অধর ছোঁয়ালো। তারপর প্রহরের দিকে মায়াময় চোখে তাকিয়ে প্রহরের গালে আলতো করে হাত বোলাতে লাগলো। এখন একটু শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। তাছাড়া জেগে থাকলে তো সারাক্ষণ শুধু আমার চিন্তাতেই অস্থির হয়ে থাকে। এতটা কেন পাগল এই ছেলেটা? আই মিন কেউ কতটা ভালোবাসলে কষ্ট পাবে ভেবে নিজের বউকে আদর করতে চায়না। এত ভালো ও কিভাবে বাসতে পারে? আর এই পাগল টাকে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কতো কষ্ট দিয়েছি। কতো যন্ত্রণা দিয়েছি। দিনের পর দিন কতো কষ্ট পেয়েছে আমার জন্য। সেজন্য নিজেকে হয়তো কখনো মাফ করতে পারবোনা। তবে আমি প্রমিজ করছি প্রহর। এখন থেকে আমার জীবনের একটাই উদ্দেশ্য হবে তোমাকে সুখী রাখা। নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে শুধু তোমাকে সুখী করার চেষ্টা করবো। তোমার মুখের এই প্রশান্তি আমি বিলীন হতে দিবোনা। কিছুতেই না।
এসব ভাবতে ভাবতে আবেগপ্রবণ হয়ে চোখে পানি চলে আসে খুশির। চোখের পানি টপ করে পড়ে প্রহরের মুখের ওপর। নড়েচড়ে উঠে প্রহর। কপাল কুঁচকে চোখ মেলে তাকায় সে। চোখ খুলেই খুশির অশ্রুসজল চোখ দেখে ঘাবড়ে যায় প্রহর। অস্থির হয়ে দুই হাতে খুশির মুখটা ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–হেই খুশিরাণী কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন? শরীর খারাপ করছে? দেখেছ বলেছিলাম না তোমার কষ্ট হবে? এখন হলো তো? নিশ্চয় তোমার শরীর খারাপ হচ্ছে তাইনা? দোষ আমারই। আমার নিজেকে আরও নিয়ন্ত্রণ করার দরকার ছিল। আমার জন্য তোমার এখন শরীর খারাপ……
আর বলতে পারলোনা প্রহর। খুশি তার অভিনব কৌশলে প্রহরের মুখ বন্ধ করে দিলো। খুশির আচমকা এ্যাকশনে প্রহরও থ হয়ে গেল। খুশি প্রহরের অধর ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো।
–এত ঘাবড়ানোর কিছুই নেই মিঃ হাসব্যান্ড। চোখের পানি সবসময় শুধু কষ্টেরই হয়না। কখনো কখনো অতি সুখেও চোখে বরষা শুরু হয়। আর আমার এখনকার চোখের পানিও আমার অতি সুখের বহিঃপ্রকাশ। যে সুখের রাজ্য তুমি আমাকে দিয়েছ।
প্রহর খুশির গালে হাত বুলিয়ে মায়া ভরা বললো।
–সে যাইহোক, দুঃখের হোক বা সুখের হোক তোমার চোখে কোন পানি আসবেনা ব্যাস। আমার সহ্যশক্তির চেয়েও বেশি তোমাকে কাঁদতে দেখেছি আমি। আর পারবোনা। তোমার চোখে আর এক ফোঁটা পানিও আমি দেখতে চাইনা। আমি আমার আগের সেই হাস্যজ্বল প্রাণচঞ্চল দুষ্টুপরি টাকে দেখতে চাই। যার চঞ্চলতা আর উদ্দীপনায় সারাবাড়ি মেতে উঠবে।
খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–আচ্ছা তাই? ওকে জো হুকুম জাঁহাপনা।
কথাটা বলেই খুশি গায়ের চাদর টা টান দিয়ে ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে পেঁচিয়ে নিল। বেচারা প্রহর থতমত খেয়ে তড়িঘড়ি করে বিছানার বেডশিট টান দিয়ে নিজের ইজ্জত ঢাকার চেষ্টা করে বললো।
–আরে আরে সকাল সকাল নিজের হাসব্যান্ড এর মানহানি করছ?
খুশি বাঁকা হেসে বললো।
–বারে তুমিই তো বললে আগের ফর্মে ফিরে আসতে। তাইতো করছি। তোমার দুষ্টুপরির দুষ্টুমি ইশটাট( স্টার্ট)
–আচ্ছা তাই বুঝি? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
প্রহর উঠে দাঁড়িয়ে বেডশিট টা কোমড়ে পেচিয়ে নিয়ে খুশির দিকে অগ্রসর হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে খুশিও দৌড় দিল প্রহরের হাত থেকে বাঁচার জন্য। প্রহরও খুশির পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। খুশি খিলখিল করে হাসছে বেডের চারপাশে দৌড়াচ্ছে। প্রহর হাসিমুখে ছুটছে খুশির পেছনে। ছুটতে ছুটতে একসময় খুশিকে ধরে ফেললো প্রহর। দুই হাতে পেছন থেকে খুশির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে খুশিকে উঁচু করে ধরে গোলগোল ঘুরতে লাগলো। আর খিলখিল করে হেঁসেই যাচ্ছে । প্রহর এবার খুশিকে দাঁড় করালো,তারপর আবার পাঁজা কোলে তুলে নিলো। খুশি মুচকি হেঁসে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরলো। প্রহর খুশিকে নিয়ে ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকে পড়লো।
__
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খুশিকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে প্রহর। আজ খুশিকে শাড়িতে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে প্রহরের। তাই সে নিজের হাতেই ওর বউকে শাড়ীতে সুসজ্জিত করছে। শাড়ী পড়ানো শেষে প্রহর খুশিকে রেডি করিয়ে দিল। খুশির কপালে আবেগের পরশ এঁকে দিয়ে খুশির হাত ধরে নিচে নেমে এলো। নিচে এসে দেখলো জিদান সাহেব সোফায় বসে পেপার পড়ছেন। প্রহর আর খুশিকে দেখে জিদান সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন।
–সকাল হলো তাহলে? বলছে যে ঘুম থেকে উঠতে তো বেলা দুপুর করলেন। তা বাসার কাজকাম গুলো কে করবে শুনি? সকালের ব্রেকফাস্ট কে বানাবে? কোন দায়িত্ববোধ আছে কি নেই? এই শিক্ষা পেয়েছেন?
জিদান সাহেবের হঠাৎ এমন কথায় প্রহর খুশি দুজনই অবাক হলো। প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–বাবা তুমি…
প্রহর কিছু বলতে যাবে তার আগেই খুশি মাথা নিচু করে মলিন সুরে বললো।
–সরি এসবি। ভুল হয়ে গেছে। এরপর থেকে আর এমন হবে না।
জিদান সাহেব বলে উঠলেন।
–আরে আরে তুমি কেন সরি বলছ বৌমা? আমি কি তোমাকে বলছি নাকি? আমিতো এই নালায়েক টাকে বলছিলাম। এতবেলা হয়ে গেছে জনাব ব্রেকফাস্ট না বানিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। শুনি কাজকাম গুলো কে করবে শুনি? এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে?
প্রহর এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ওতো ভুলেই গিয়েছিল যে, ওর বাবা আরেক ড্রামাবাজ। খুশিও এবার মুচকি হেঁসে বললো।
–থাক থাক এসবি আজকের মতো মাফ করে দিন ওকে। বেচারা রাতভর অনেক খাটাখাটুনি করেছে তো।
খুশির কথায় প্রহরের কাশি উঠে গেল। চোখ বড়বড় করে তাকালো খুশির দিকে। কি পাগল মেয়েরে বাবা। শশুরের সামনে কেউ এসব বলে? খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–আই মিন রাত জেগে জেগে আমার সেবাযত্ন করেছে তো। তাই হয়তো সকাল সকাল উঠতে পারেনি বেচারা। এবারের মতো ছেড়ে দিন। এরপর থেকে আমি ওকে সময়মতো উঠিয়ে দেবো।
জিদান সাহেব বলে উঠলেন।
–হ্যাঁ তো? বউয়ের সেবা করা তো ওর দায়িত্ব। এতে এতো ফুটেজ খাওয়ার কি আছে? তার বদলে কি কাজে ফাঁকি দেবে নাকি? আজকে তোমার জন্য ওকে মাফ করে দিলাম। নাহলে আজ ওকে দেখিয়ে দিতাম এই জিদান সাহেব কি জিনিস।
প্রহর বুঝে গেল এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে ওর ইজ্জতের আবর্জনা হয়ে যাবে। এই বউ শশুর এক জায়গায় হলে ওর আর কোন ভেলুই থাকে না। দুইটা একই কোয়ালিটির। প্রহর তাই মাথা নেড়ে ওখান থেকে সরে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। প্রহর যেতেই খুশি জিদান সাহেবের হাতের সাথে হাইফাই দিয়ে দুজনেই হেঁসে উঠলো।
প্রহর কিচেনে এসে ব্রেকফাস্ট বানানোর কাজে লেগে পড়লো। এক চুলোয় খুশির জন্য দুটো ডিম সিদ্ধ দিয়ে আরেক চুলোয় ওর বাবার জন্য অমলেট বানানোর জন্য ফ্রাই প্যান গরম করতে দিলো। টোস্টার মেশিনে ব্রেড দিলো টোস্ট করতে। তারপর পেঁয়াজ কাটা শুরু করলো। হঠাৎ পেছন থেকে খুশি এসে জড়িয়ে ধরলো প্রহরকে। প্রহর মুচকি হেঁসে হাতের পেঁয়াজ আর ছুরিটা রেখে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো।
–তুমি কেন এখানে এসেছ? কিচেনের গরমে মাথা ঘুরাবে তোমার। তুমি বাইরে গিয়ে বাবার সাথে বসো। আমি পাঁচ মিনিটের ভেতরেই ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসছি।
–আমার কিছু হবে না। আর নাস্তা আমি বানাচ্ছি। তোমার এসব করতে হবে না। বাড়ির বউ হিসেবে আমারও তো কিছু দায়িত্ব আছে।
–তোমাকে না বলেছি বেশি পাকনামো দেখাতে আসবেনা। চুপচাপ বাইরে গিয়ে বসো।
–দেখ ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আমি এখন রান্না শিখে গেছি।
খুশি মলিন সুরে বললো।
–তুমি যখন কাছে ছিলে না। তখন তোমার কথা মনে করে করে রোজ কিছু না কিছু বানাতাম। আর তোমাকে ভেবে নিজেই সেগুলো খেতাম। প্রথম প্রথম খুব বাজে হতো। তবুও খেতাম। কারণ তুমিওতো আমার ওই বাজে খাবার গুলো বিনাবাক্যে খেয়ে নিতে। এভাবে একসময় আমার রান্নার হাতও ভালো হয়ে গেল। এখন আমি ভালোই রান্না করতে পারি।
খুশির মলিন চেহারা দেখে প্রহর বলে উঠলো।
–এই এই খবরদার কাঁদবে না কিন্তু। চোখ দিয়ে যেন কোন পানি বের হতে না দেখি। নাহলে কিন্তু আমি সত্যিই মার দিবো তোমাকে।
খুশি প্রহরের দুই গাল টেনে টেনে ঠোঁট চোখা করে বললো।
–অঁওওওওও… এত্তো কিউট কেন তুমি? আমার কিউটি লোলি পোলি টোলি মোলি গুলগুলি…
প্রহর হেঁসে উঠে বললো।
–তুমি আর তোমার এসব আজব ল্যাঙ্গুয়েজ। কোথাথেকে পাও এসব? আচ্ছা যাইহোক এখন যাও বাইরে যাও। আমি এখুনি নাস্তা নিয়ে আসছি।
খুশি ঠোঁট উল্টে আদুরে গলায় বললো।
–একটু থাকি না??
–নো মিনস নো। যাও বাইরে যাও।
খুশি মুখ ছোট করে বললো।
–ওকে..
খুশির লটকানো মুখ টা দেখে প্রহর মৃদু হাসলো। দুই হাতে খুশির মুখটা ধরে আলতো করে একটা চুমু খেল খুশির অধরে। তারপর বললো।
–এখন যাও প্লিজ।
খুশি হাসিমুখে বললো।
–আচ্ছা।
__
ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করছে সবাই। প্রহর বরাবরের মতোই খুশিকে খাইয়ে দিচ্ছে। কাটা চামচে খাবার তুলে খুশির মুখে দিচ্ছে। জিদান সাহেব খেতে খেতে বললেন।
–প্রহর একটা কথা ছিল।
–হ্যাঁ বাবা বলো।
–বলছিলাম তোদের বিয়েটা তো হঠাৎ করে হলো। কাওকে জানাতেই পারিনি। এখন যেহেতু খুশি মাও সুস্থ হয়ে গেছে। তাই ভাবছি সামনের শুক্রবারে বড়ো করে একটা রিসিপশন পার্টি রাখবো। তুই কি বলিস?
–ওকে বাবা। তোমার যেমন ইচ্ছে।
–ঠিক আছে তাহলে সামনের শুক্রবারেই রিসিপশন পার্টির আয়োজন করি।
__
এতদিন পর নিভান আবার ওর আগের স্কুলে এসেছে। সারেরা পরিচিত থাকায় এতদিন পরেও আবার স্কুল কন্টিনিউ করতে পারছে ও। অবশ্য নিভানের বাবা এসে টিচারদের সবকিছু খুলে বলেছিল। তাই তারাও আর মানা করেনি। নিউ টেনে ওঠার পরপরই হঠাৎ ওভাবে চলে যেতে হয় ওদের। আর আজ পাঁচ ছয় মাস পর আবার আসছে ও। ওর নজর শুধু খুজে চলেছে একজনকেই। হঠাৎ চলে যাওয়ায় স্পৃহাকে কিছু বলতে পেরেছিলোনা তখন। পরবর্তীতে আর যোগাযোগ করতে পারেনি ও। মেয়েটা নিশ্চয় ওর ওপর কতো রেগে আছে। কথাও বলবে কিনা কে জানে?
হাঁটতে হাঁটতে সেই বটতলায় এলো নিভান। যেখানে ওরা রোজ বসে আর্টক্লাস করতো আর সময় কাটাতো। বটতলার কাছে আসতেই স্পৃহাকে দেখতে পেল নিভান। মেয়েটা কেমন মন মরা হয়ে বসে আছে। নিভান হাসিমুখে এগিয়ে গেল ওর কাছে। কাছে এসে বললো।
–হায় স্পৃহা,, কেমন আছ?
নিভানকে দেখে চমকে গেল স্পৃহা। তবে হঠাৎ মুখশ্রী কঠিন করে বললো।
–এক্সকিউজ মি? তুমি কে? আমি কি চিনি তোমাকে?
নিভান অবাক হয়ে বললো।
–কি বলছ স্পৃহা? আমি নিভান। তুমি চিনতে পারছনা আমাকে?
–সরি আমি নিভান ফিভানকে চিনি না।
কথাটা বলে স্পৃহা ওখান থেকে চলে যেতে লাগলো। নিভান বুঝতে পারছে স্পৃহা মারাত্মক রেগে আছে। নিভান স্পৃহার হাত ধরে আটকালো ওকে। স্পৃহা রাগী চোখে তাকিয়ে বললো।
–এসব কি অসভ্যতামো? ছাড়ো বলছি।
নিভান বিনয়ী সুরে বলে উঠলো।
–অ্যম রিয়েলি সরি স্পৃহা। তোমার রাগ করা একদম জায়েজ। কিন্তু একবার আমার কথাটা তো শোন প্লিজ। আই ক্যান এক্সপ্লেইন ইউ।
–আমি তোমার কোন কথায় শুনতে চাইনা। ছাড় আমাকে। কিছু বলার থাকলে আগেই বলতে। এভাবে হঠাৎ করে হারিয়ে যেতে না। তোমার কাছে যদি আমার বিন্দুমাত্র দাম থাকতো তাহলে অন্তত একটা বার আমাকে বলে যেতে। কিন্তু বলোনি তাহলে এখন কি বলতে চাও? জানো তোমার ওভাবে হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়ায় আমার কতো খারাপ লেগেছিল? তুমি কিভাবে জানবে?
কথা বলতে বলতে স্পৃহার গলা ধরে এলো। স্পৃহা হাত ছাড়িয়ে আবারও চলে যেতে লাগলো। নিভান এবার স্পৃহার সামনে এসে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে দুই কান ধরে অনুনয়ের সুরে বললো।
–প্লিজ স্পৃহা অ্যাম সরি। দেখো তুমি ভুল ভাবছ।তুমি আমার কাছে অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। আমার জীবনে তুমিই আমার একমাত্র ফ্রেন্ড। আসলে আমাদের জীবনে হঠাৎ এমনকিছু হয়েগিয়েছিল যে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ আমাদের এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তাই তোমাকে জানানোর সময় ধরে পাইনি। আমাদের আগের সব নাম্বারও বদলে ফেলেছিলাম তাই যোগাযোগ করতে পারিনি। প্লিজ একটা সুযোগ দাও আমাকে। আমি তোমাকে সব খুলে বলছি।
নিভানের আকুতি মিনতি দেখে স্পৃহার একটু মায়া হলো। এবার একটু নরন হয়ে বললো।
–ঠিক আছে ঠিক আছে ওঠ এবার। স্কুলের মধ্যে তামাশা করতে হবে না। পাঁচ মিনিট দিচ্ছি যা বলার বলো।
নিভান এবার মুচকি হেঁসে বললো।
–ঠিক আছে তাহলে চলো বটতলায় গিয়ে বসি।
স্পৃহা আর নিভান গিয়ে বটতলায় বসলো। নিভান ধীরে ধীরে সবকিছু খুলে বললো স্পৃহাকে। সব শুনে স্পৃহারও খারাপ লাগলো। স্পৃহা এবার মুচকি হেঁসে বললো।
–ঠিক আছে এবারের মতো মাফ করে দিলাম তোমাকে। আর যেন না হয়।
–একদমই না। আর কখনো এমন হবে না।
নিভান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো।
–দেন ফ্রন্ডস এগেইন?
স্পৃহাও হাসিমুখে হাত মিলিয়ে বললো।
–উই আর অলওয়েজ ফ্রেন্ডস।
___
আজ শুক্রবার, খুশি আর প্রহরের রিসিপশন পার্টি আজ। পার্টি সেন্টারে জমজমাট আয়োজন করা হয়েছে। ফেইরিলাইটস আর রঙবেরঙের ফুলে সেজেছে পুরো হল। সব মেহমানরা এসে গেছে। প্রহরও মিনিট পাঁচেক হলো রেডি হয়ে বসে আছে মঞ্চে। কিন্তু খুশিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ও। নজর শুধু খুশিকেই খুঁজছে। ফাহিম কে কয়বার জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু সেও কিছু বলছেনা। অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে প্রহর। সেই কখন থেকে দেখেনা ওর খুশীরাণীকে। নাজানি কত সুন্দর লাগছে আজ ওকে। প্রহরের যেন আর তর সইছে না।
হঠাৎ সব লাইট বন্ধ হয়ে গেল। স্পট লাইট পড়লো সামনের ডান্স ফ্লোরে। সাথে সাথে মিউজিক প্লেয়ারে মিউজিক চালু হয়ে গেল। চারজন লোক মিলে কাঁধে করে একটা সিংহাসন নিয়ে আসছে। যার ওপর স্টাইল নিয়ে বসে আছে খুশি। মেরুন রঙের লেহেঙ্গা, মাথায় দোপাট্টা, আর চোখে কালো চশমা। খুশির এই সোয়্যাগ আবতার দেখে প্রহরের মুখ গোল আলুর মতো হা হয়ে গেল। মঞ্চের মাঝখানে এসে খুশিকে নামিয়ে দিলো। খুশি নেমে দাঁড়িয়ে চশমাটা হালকা নিচু করে প্রহরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মেরে দিলো। প্রহর হেঁসে দিল। খুশি হেলেদুলে হাত নাড়িয়ে নাচতে নাচতে গেয়ে উঠলো।
♬ তু জানু বানু জো কেহতা হে
♬ বিবি তেরি হু লাগতাহে সামে মোর সামে
♬ মে সামে সামে জো কেহতা হু
♬ মারাদ মেরা তু লাগতাহে সামে মোর সামে
(খুশি সিড়ি বেয়ে প্রহরের কাছে যেতে যেতে গাইলো)
♬ তেরে পিছে পিছে চালু জেইসে
♬ তেরে পিছে পিছে চালু জেইসে
♬ মান্দির কি সিড়িপে চারু সামে
(প্রহরের পাশে এসে বসে গাইলো)
♬ তেরে বাগল বেঠু এইসে জেইসে
♬ শীবজি বাগল গৌরি মোর সামে
(খুশি প্রহরের হাত ধরে নিচে আনতে আনতে গাইলো)
♬ ও ডাগার জাবা তেরি নাজার
♬ লে যায়েগি প্রেম নাগার সামে আয় সামে
(নিচে এসে প্রহরের চারপাশে ঘুরে নাচতে নাচতে গািলো)
♬ আরে সামে,আজা সামে,বালাম সামে
♬ সানাম সামে
♬ আজা সামে, বালাম সামে,সানাম সামে..
প্রহরও খুশির হাত ধরে ডান্স করতে লাগলো। শেষের দিকে জিদান সাহেব ফাহিম সহ খুশির পরিবারের সবাই এসে উড়াথুড়া নাচা শুরু করে দিলো। আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমেই শেষ হলো ওদের রিসিপশন পার্টি।
চলবে…….
চলবে…….
/