#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৩৭
.
.
” নজর লাগবেও না মা। তুমি ভেবো না। ”
” কীভাবে দিন পার হয়ে যায় বুঝায় যায় না। তোকে বর সাজে দেখে মনে হচ্ছে সে ক’দিন আগের কথা যেদিন তোকে কোলে করে এই বাড়িতে ঢুকেছিলাম। আর আজ সেই তোর বিয়ে। ”
পাশ থেকে আনিস খন্দকার মুচকি হেসে বললেন,
” ঠিক বলেছ মরিয়ম। আমারও সেদিন গুলোর কথা মনে পড়ছে। ”
” হুম। আমার দুটো ছেলেই কীভাবে বড় হয়ে গেল তাই না? ”
তানহার পাশ কেটে মা-বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অতল। আর দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
” মা! বাবা! তোমাদের স্মৃতিচারণ শেষ হলে এবার আমরা রওনা দিই? কনে পক্ষ যে পথ চেয়ে বসে আছে আমাদের। ”
মরিয়ম বেগম চোখ মুছে তিহানের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
” হ্যাঁ, বাবা। চল এবার আল্লাহর নাম করে শুভ কাজে বেরিয়ে পড়ি। ”
” হুম, মা। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এরচেয়ে বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। বেলা থাকতে থাকতে তো বউ নিয়ে ফিরতে হবে আমাদের তাই না? ”
” হুম। তিহান বাবা আমার বিসমিল্লাহ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়। আর তানহা তুমি অতল মিলে তিহানকে গাড়ির কাছে নিয়ে যাও। আমি আর তোমার বাবা তোমাদের মিরাজ কাকা’কে সব বুঝিয়ে দিয়ে আসছি। কেমন? ”
তানহার ইচ্ছে না থাকলেও মরিয়ম বেগমের সম্মান রক্ষার্থে হাসি মুখ করে বলল,
” আচ্ছা মা। আপনারা আসুন আমরা সামনে এগুচ্ছি। ”
” আচ্ছা মা। যাও তবে তোমরা। ”
অতল তিহানের সাথে হাঁটলেও তানহা তিহানের ধারের কাছেও রইলো না। সোজা চলে গেল গাড়ির কাছে। তার পেছনে কেউ আছে কী নেই তারও পরোয়া করল না। নিজের মতো হেঁটে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই গাড়িতে বসে পড়ল।
.
নিদ্রার মা অর্থাৎ আইরিন বেগম সেই কখন থেকে মেয়ে নিদ্রার সাথে চিল্লিয়ে যাচ্ছে। তারপরও ঠিক রাখতে পারছে না মেয়েকে। বাড়ি ভরতি মেহমান সকলেই যেন আইরিন বেগমের উপর ভীষণ ক্ষিপ্র। যে মেয়ে ঘন্টা খানেক বাদে অন্যের ঘরে চিরতরে চলে যাবে সেই মেয়ের সাথে মা হয়ে এরকম আচরণ কেউই যেন সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু কেউ মুখে কিছু বলছে না। তবে মুখে না বললেও চোখের ভাষা দেখেই বেশ বুঝতে পারছে আইরিন বেগম তাদের মনের ভাবনা। কিন্তু এখানে আইরিন বেগমেরও যে কিছু করার নেই। বাধ্য হয়েই মেয়েকে বিয়ের সাজেও শাসন করছে। তা নাহলে অন্যান্য মেয়েদের সাথে পাল্লা দিয়ে কনের সাজেও বিয়ের ভীড়ের মাঝে ছুটোছুটি শুরু করবে নিদ্রা।
আইরিন বেগম বিছানার কোণে বসে নিদ্রার দিকে ক্ষিপ্রতায় ভরপুর দৃষ্টি ছুড়ে বললেন,
” এতদিন যা করেছিস না’হয় করেছিস।কিন্তু আজ…আজ কি এসব আচরণ তোর সাথে মানাচ্ছে? তুই কি বান্ধুবীর বিয়ে খেতে এসেছিস নাকি তুই নিজে বিয়ের কনে সেজে বসেছিস? কোনটা? ”
নিদ্রা অন্যসময়ের মতো কোন অযুহাত না দেখিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে অপরাধের ন্যায় তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।
এদিকে আইরিন বেগম মেয়ের এরকম অপরাধীর মতো মুখ দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করে শান্ত গলায় বললেন,
” আমি কে? তোর মা হই না? ”
নিদ্রা মুখে কিছু না বলে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি দিল।
মেয়ের সম্মতি পেতেই আইরিন বেগম বললেন,
” তাহলে তুই বল মা আমি কি তোর খারাপ চাব কোনদিন? কোনো মা’ই কি চাবে তার সন্তানের ক্ষতি হোক কিংবা মানুষ তার সন্তানকে নিয়ে পেছনে কথা বলুক? ”
” না মা। ”
” তাহলে আমি কি করব বল? তুই যে বিয়ের কনে হয়েও চাতক পাখির মতো ছটফট করছিস মানুষ কী বলবে ভাবতে পারছিস? আমাদের আত্মীয়স্বজনরা না-হয় এই বিষয় নিয়ে ভাববে না। কারণ তারা জানে তুই কেমন। কিন্তু তোর হবু শ্বশুরবাড়ির লোক কি কেউ জানে তোর এই চঞ্চলতার কথা? আমার মনে হয় জানে না। আর জানলেও তার পরিমাণ স্বল্প জানে। কিন্তু এসে যখন দেখবে তোর বিয়ের সাজেও তোর চঞ্চলতার এই অবস্থা তখন কী ভাববে বুঝতে পারছিস? ”
” হুম। ” গাল ফুলিয়ে বলল।
” গাল না ফুলিয়ে মায়ের কথা বুঝার চেষ্টা কর মা। আমি তোর ভালোর জন্যই কথাগুলো বলছি। ”
” হুম। ”
নিদ্রা ও তার মা আইরিন বেগমের কথার মাঝে ৪/৫ টা মেয়ে ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ” বরযাত্রী এসে গিয়েছে! বরযাত্রী এসে গিয়েছে। চলো, তোমরা কে কে যাবে দ্রুত চলো। ”
মেয়েগুলো বরযাত্রী আসার খবরটুকু দিয়েই সেকেন্ডের মাঝে উধাও হয়ে গেল। আইরিন বেগম নিদ্রাকে আরও কিছু কথা বুঝিয়ে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বললেন,
” আর দুষ্টুমি করিস না মা। কেমন? ”
” আচ্ছা, মা। ”
” যেভাবে যেভাবে বলেছি সেভাবে সবকিছু করে সুন্দর ভাবে স্থির হয়ে বসে থাক। ঠিক আছে? ”
” হুম মা। ”
” তাহলে আমি চললাম। বরকে বরণ করতে হবে যে! আর এই বরণ করারও যে কিছু নিয়ম পালন করতে হবে আমায়। ”
কথাটুকু বলতে বলতেই আইরিন বেগম চলে গেল বরযাত্রীর কাছে।
তিহান গাড়ি থেকে নেমে বিয়ে বাড়ির গেইটের সামনে যেতেই বেশ কয়েকটি ছেলেমেয়ে এসে তিহানকে আটকে ফেলল। তিহানের চারিপাশে ঘেরাও দিয়ে দাঁড়িয়ে একে অপরকে চোখ টিপ মেরে খিলখিল করে হেসে উঠল। তার মাঝে একটি মেয়ে ফিসফিস করে অন্যদের বলল,
” আমাদের জিজু তো সেই লেভেলের হ্যান্ডসামরে! আমিতো পুরাই ক্রাশ খেয়ে গেলাম!”
মেয়েটির ফিসফিসানো কথা শুনে অতল সাইড থেকে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
” হ্যান্ডসাম কি শুধু তোমাদের জিজুই নাকি?ডানে বামেও নজর দিও ক্রাশ খেয়ে বনবাসে চলে যেতে হবে হা হা…”
অতলের কথা শুনে তানহা ভ্রু দুটো কুচকে আস্তে করে বলল,
” তুমি কি দিনদিন পাগল হয়ে যাচ্ছ? ”
” কেন বলতো? ”
” আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? আজব তো! তুমি যে ইয়ার্কি মারছ এটা কি তোমার সাথে মানায়? তুমিতো তোমার ভাইয়ের ছোট ভাই না যে, তুমি ওদের সাথে মজা করবে! ওদের সাথে সেই সম্পর্কই তোমার নয়। তুমি তিহানের বড় ভাই। মানুষ কী ভাববে বলোতো! ”
অতল চোখের দৃষ্টিতে হাসির ভাব ফুটিয়ে বলল,
” আচ্ছা তানহা, তোমার কি আমার ইয়ার্কিতে প্রবলেম নাকি…মেয়েদের সাথে কথা বলায়? ”
” তুমি যেরকম ভাবছ সেরকম কিছুই না অতল। আমি তোমাকে ভালো করে চিনি তুমি কেমন! তুমি কতদূর অবধি যেতে পারো সবই আমার জানা। ওসব মেয়ে টেয়ে নিয়ে আমার কখনোই তোমাকে সন্দেহ হয়নি যে আজ হবে। আমিতো বলেছি তুমি সম্পর্কে তিহানের বড় ভাই তোমার এসব দুষ্টুমির কথা শুনে যদি কেউ কিছু ভাবে তাই। কারণ সাধারণত এসব মজা বরের ছোট ভাই, বোন কিংবা বন্ধুরা করে থাকে। আর তুমি হচ্ছো সেখানে বরের বড় ভাই। ”
” ওহ্! আচ্ছা। তবে আমাদের এদিকে ব্যাপারটি চলে। তুমি এই নিয়ে ভেবো না।আমিতো তিহানের বড় ভাই বলেছি এরকমও বিয়ে দেখেছি যেখানে বরের সমবয়সী মামা-কাকারাও দুষ্টুমি করে থাকে। কেন! আমাদের বিয়ের সময়ই তো হয়েছিল। মনে আছে তোমার? আমার ছোট কাকী কি বলেছিল? ”
” হুম মনে আছে। ”
” তাহলে? এসব কোনো বিষয় না। আর এমনিতেও আমি আর তিহান ঠিক করেছিলাম আমরা দু’জন দু’জনের বিয়েতে খুব মজা করব। ও তো আর করতে পারেনি সেই ভাগটা না-হয় আমিই পুষিয়ে দিব। হা হা.. ”
” ওহ্! ”
” হুম। ”
বলেই অতল সামনের দিকে তাকাতেই কনে পক্ষের মেয়েটি অভিমানী স্বরে বলল,
” দু’জনের কথা শেষ হলে এবার তো আমাদের দিকে একটু তাকান! আমাদের নজর ডানে বামে দিতে বলে সেই যে আপনি নিজের নজর ওই আপুটির উপর দিয়ে রাখলেন আমরা তো এখানে সবাই হতাশ! ”
” কেন? কেন? এতো হতাশ কেন? ”
” ওমা! আমার ক্রাশ যদি অন্যের দিকে তাকায় হতাশ হবো না? ”
” এবার তোমার স্টাইলে বলি? ”
” মানে! ”
” ওমা! তোমার ক্রাশ না কিছুক্ষণ আগে আমার ছোট ভাই তিহান অর্থাৎ তোমাদের কনের বর না ছিল? ”
অতলের কথা শুনে কনে পক্ষের সবগুলো ছেলে এবং মেয়ে ডুগ গিলে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল। অতল ব্যাপারটি বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,
” তোমাদের দেখতে কিন্তু বেশ লাগছে। বাই দা ওয়ে তোমার নাম কী আপু? আর তুমি এবং তোমরা কী হও কনের? ”
মেয়েটি কাঁপা গলায় বলল,
” আমরা সবাই কনের ক্লোজ ফ্রেন্ড। আর আমার নাম…আমার নাম….! ”
” নাম বলতে ভয় লাগছে বুঝি? ভয় পেয়েও না কারো কাছে নালিশ করব না। বিয়ে বাড়িতে এরকম একটু আধটু দুষ্টুমি হয়েই থাকে এসব কখনো ধরতে নেই। ”
” হুম। ”
” এবার বলো তোমার নাম কী? ”
” আমার নাম… ”
পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠস্বরে বলে উঠলো,
” অনেক হয়েছে দুষ্টুমি এবার আসল কথায় আসি আমরা। ”
মেয়েটি সামনে আসতেই অতল বলল,
” তুমি নিদ্রার কাজিন লিমা না? নিদ্রাদের বাসায় প্রথম যেদিন আমি আর বাবা এসেছিলাম সেদিন তো মনে হয় তুমিই আমাদের সমাদর করেছিলে। তাই না? ”
” যাক বাবা! আমার বেয়াই মশাইর তাহলে আমার কথা মনে আছে দেখছি। ”
” থাকবে না কেন? কেবলই তো ক’দিন আগের কথা। বেশিদিন তো হয়নি। আর এতো ভোলা মনাও আমি নই কিন্তু! ”
” তাই নাকি? ”
” আজ্ঞে, হ্যাঁ। ”
” আপনি ভোলা মনা হোন আর যাই হোন আজ আপনাকে দিয়ে কোনো কাজ নেই আমার। আজতো কেবল আমাদের দুলাভাইকে দিয়ে কাজ। কী দুলাভাই ঠিক বললাম তো? ”
তিহান মুখে কিছু না বললেও ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা বজিয়ে রাখল। আর সেই হাসি দেখে লিমা নিজের ডান হাত মেলে তিহানের সামনে ধরে বলল,
” তো দুলাভাই ছেড়ে দিন এবার। ”
তিহানের কাঁধে হাত রেখে অতল ভ্রু কুচকে বলল,
” কী ছেড়ে দিবে সেটা তো বুঝিয়ে বলো। ”
” কী আবার! টাকা! গেইটের টাকা। ”
” গেইট জিনিসটা কী একটু বুঝিয়ে বলবে? তারপর না-হয় টাকার প্রসঙ্গে আসছি। ”
” আপনি কথা ঘুরাবেন তাই তো? ”
” না না, কথা ঘুরাবো কেন? আমিতো সত্যি জানি না তাই জানতে চাইলাম। ”
এদিকে তিহানের আস্তে আস্তে মেজাজ চরম পর্যায় বিগড়ে যাচ্ছে। তার মোটেও ভালো লাগছে না তার অমতের বিয়েতে এতো হাসি তামাশা। এমনিতেই বিয়ে না করার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু বাবা-মায়ের কথার জন্য যাও রাজি হয়েছে বিয়েতে তারমাঝে এতো কাহিনী মোটেও সহ্য হচ্ছে না তার। তাই বর হয়েই সবার কথার মাঝে লিমাকে বলে উঠলো,
” আমার ধারণা তুমি আমার ছোট হবে। তাই তুমি বলেই সম্বোধন করে ফেললাম। এই নাও টাকা আর এই গেইট বিষয়ক ঝামেলাটা এখানেই ক্লোজ করে দাও। এসব চিৎকার, চেঁচামেচি আমার মোটেও ভালো লাগে না। প্লিজ মাইন্ড করো না। ”
” না দুলাভাই এটা কোনো বিষয় না। চেঁচামেচি ভালো নাই লাগতে পারে এটা দোষের কিছু না। তবে আপনি ভীষণ ভালো। তাইতো এখানে মাছের বাজার না বসিয়ে টাকাটা দিয়ে দিলেন। তবে এখানে দিয়েছেন কত? ”
” গুনে দেখো পুরো দশ হাজার আছে। ”
” দশ হাজার! আপনি কোনো কথা না বলে সোজা দশ হাজার দিয়ে দিলেন! ”
” তোমরা দশ হাজার থেকে এক টাকাও কম দাবি করতে না। সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। তাই আগে থেকেই বান্ডিল করে রেখেছি। ”
অতল মুখ ফুলিয়ে পাশ থেকে বলল,
” এটা কিন্তু মোটেও ঠিক করলি না তিহান। বিয়ের মজাই তো এখানে আর সেই মজাটা তুই এভাবে পানসে করে দিলি? কাজটা একদমই ভালো হলো না। ”
.
.
চলবে…..