#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৫২
.
.
” চেয়ারে বসো। ”
” দাঁড়ানোতেই ঠিক আছি। আপনি কেন ডেকেছেন বলুন। ”
” আগে বসো-ই না। ”
স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই নিদ্রা বসল। তিহান বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” অতীতের সবকিছু ভুলে নতুন করে কি শুরু করা যায় না? ”
” এই প্রশ্নটা আমায় না করে নিজেকে করলে হয়তো মনমতো উত্তর পাবেন। ”
” নিজের মনকে স্থির করেই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। ”
” তাহলে আমায় বলতে হবে বিয়ের আগে আমার এমন কোনো অতীত নেই, যার জন্য সেগুলোকে ভোলার চেষ্টা করতে হবে। ”
” সেটা আমি জানি। ”
” তাহলে কোন অতীতের কথা বলছেন আপনি? ”
” তোমার আমার অর্থাৎ আমাদের সম্পর্ককে জুড়ে সকল ধোঁয়াশাময় অতীতগুলোর কথা বলছি আমি। ”
” সেই দিনগুলো আপনার কাছে ধোঁয়াশা হতে পারে আমার কাছে না। যদি সে দিনগুলোকে ধোঁয়াশাই মনে করতাম তাহলে আজ এ বাড়িতে থাকতাম না। আর না আপনার সন্তানকে নিজের গর্ভে লালন করতাম। সেই দিনগুলোকে ধোঁয়াশা মনে করলে প্রতিটি অনুভূতিকে বাতাসের সাথে মিশিয়ে সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুনভাবে নতুন কারো সাথে জীবন শুরু করতাম। আপনি আসবেন না জেনেও, আমায় কখনো ভালোবাসবেন না জেনেও মুখ থুবড়ে এখানে পড়ে থাকতাম না। ”
” বিশ্বাস করো নিদ্রা আমি অনেক করে চেয়েছি আমার আগের জীবনকে ভুলে…..”
তিহানের কথার মাঝে নিদ্রা বলল,
” আপনি হসপিটালে আসার পর আপনার শপিং ব্যাগে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া ডায়েরিটি দেখেছিলাম।তাই আমি ধরে নিব আপনি সেই ডায়েরির প্রতিটি পাতা খুব যত্নসহকারে নিজের মাঝে ধারণ করেছেন। যার অপরাধবোধেই আজ আপনি আমার মুখোমুখি। তা-নাহলে এ দিনটি হয়তো কখনোই আমাদের মাঝে আসতো না।
আর আমি এ-ও জানি, আপনার ফিরে আসা কেবল আপনার সন্তানের জন্য আমার জন্যে নয়। তারপরও আমার ছেলে তার বাবার স্নেহ পাবে এটাই আমার জন্য অনেক। তো সে যাই হোক আপনিও জানেন আমার অজানা কিছু নেই, আর আমিও জানি আপনার থেকে আমার জানার কিছু নেই। তাই এই আগের জীবনের চ্যাপ্টারটা আজীবনের জন্য এখানেই ক্লোজ হওয়া ভালো। জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাইলে কিংবা সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাইলে কিছুকিছু সম্পর্ক, কিছুকিছু ঘটনা, কিছুকিছু কথা অপ্রকাশিত রাখাই ভালো। এতে সবার জন্যই মঙ্গল। ”
তিহান কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই নিদ্রা আবারও বলল,
“ও একটি কথা পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া ভালো। একটু আগে সুখে শান্তিতে বাঁচার কথা বলেছি বলে এই মনে করবেন না যে, আমি আপনার সাথে সুখী দাম্পত্যের জীবনের কথা বলেছি। কারণ আপনার সাথে আমার এই জীবদ্দশায় হয়তো আর মিলবে না।তবে হ্যাঁ, কেবল নিহানের দিকে তাকিয়েই লোক দেখানো সংসার নামক সম্পর্কে আমি জড়াবো। এর থেকে বেশি নয়।”
“একটি বার কি সুযোগ দেয়া যায় না নিদ্রা? মন থেকে বলছি আমি সুখী হতে চাই।আমি তোমাকে আর আমাদের নিহানকে নিয়ে একান্তই নিজের একটি ভুবন সাজাতে চাই।কিন্তু তুমিহীনা সেই ভুবন যে আমার পক্ষে সাজানো সম্ভব নয়।প্লিজ প্লিজ নিদ্রা, শেষবারের মতো একটি সুযোগ দাও আমায়।বুকে হাত দিয়ে বলছি এ জীবন থাকতে তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করব না।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিদ্রা।বলল,
“বিশ্বাসের ঘর একবার ভেঙে গেলে সেই ভাঙা বিশ্বাসের ঘর দ্বিতীয় বার জোড়া লাগে কি-না আমার জানা নেই।”
নিদ্রা রুমে ফিরে যেতেই তিহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বসে রইলো।
.
রাতের পর সকাল গড়িয়ে, সকালের পর বিকেল কিন্তু এখনো নিদ্রার সাথে তিহানের কোনো কথা হয়নি।সেই যে গতরাতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিদ্রা বেলকনি ছেড়ে ঘরে এলো তারপর আর একটি বারের জন্যও তিহানের মুখাপেক্ষী হয়নি নিদ্রা। তিহান কথা বলার জন্য বহুবার চেষ্টা করে বৃথা হয়ে শেষমেশ ছাদে এসে মুখভার করে বসে আছে।
এদিকে তানহাকে নিয়ে হাঁটার জন্য ছাদে উঠতেই তিহানকে ঘাড় কাত করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে অতল। তানহাকে নিয়ে তিহানের পাশে বসে বলল,
“কী রে, এভাবে মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস যে,নিদ্রাহীনতা ঝেঁকে ধরেছে না-কি?”
“কী যে বলো না ভাইয়া। আর কোথায় আমি মুখ ফুলিয়ে বসে আছি? চুপচাপ বসে থাকলেই কি মুখ ফুলানো হয় না-কি!”
“কীভাবে বসলে মুখ ফুলানো হয় সেটা আমার থেকে তুই-ই ভালো জানিস।কারণ ছোট থেকে ঘাড় কাত করে মুখ ফুলানোর অভ্যাসটা তো তোর তাই এ ব্যাপারে তোরই ভালো জ্ঞান থাকবে।”
অতলের হাত চেপে তানহা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তোমার না সব বিষয়ে ফাইজলামি করাটা এক বদভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। কোথায় ভালো করে জিজ্ঞেস করবে তা না করে কোন আমলে কী করতো তা নিয়ে বসে গিয়েছ। ভালো করে কোনোকিছু জিজ্ঞেস করতে তোমার পকেটের পয়সা খরচ হয় বুঝি?”
অতল পরনের টি-শার্ট টিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল,
“পরনে তো আমার টি-শার্ট আর লুঙ্গি। ভালো করে দেখলাম টি-শার্টে পকেট নেই আর লুঙ্গিতে পকেটের তো প্রশ্নই আসে না। যেখানে পকেট নেই সেখানে পকেটের পয়সাটা পাবো কোথায় খরচ করার জন্য?”
“চুপ আর একটা কথাও তুমি বলবে না।যা বলার এখন আমি বলব তোমার মুখ দিয়ে যেন টু শব্দটি না বের হয়।”
দাঁত কিড়মিড়িয়ে অতলের থেকে চোখ ফিরিয়ে তিহানের দিকে তাকালো তানহা।বলল,
“নিদ্রা এখনো মানেনি?”
তিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি জানি আমার ভুলের ক্ষমা হয় না, কিন্তু নিদ্রা…সে কি ভুল করছে না? আমি যে এতবার নিদ্রার সাথে কথা বলতে চেয়েছি, সবকিছু ভুলে ওকে আর নিহানকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি ও কি বুঝে না? কেন দিচ্ছে না একটি সুযোগ? কেন এভাবে দূরে ঠেলে দিচ্ছে আমায়? আমিও যে মানুষ আমারও যে কষ্ট হয় কেন বুঝে না?”
বলেই চোখের জল ফেলে দিল তিহান।আবারও বলল,
“আমি মানছি সেদিন কাউকে কিছু না বলে কয়ে চলে গিয়ে ভীষণ জঘন্যতম একটি কাজ করেছি। কিন্তু কেন করেছি সেটা কেবল আমিই জানি। সেদিন যদি ওভাবে গা ঢাকা না দিতাম এই নতুন তিহানকে নিদ্রা কখনোই পেত না। সেদিন এ বাড়ি ছেড়ে কেবল আমার দেহ না, সাথে বিধ্বস্ত মনটাও গিয়েছিল। আর এই যে এতদিন পর ফিরে এসেছি সেই পুরনো তিহানকে মেরে এ এক নতুন তিহান নামক আমিকে নিয়ে ফিরে এসেছি। এ আমির মাঝে অতীত বলতে কিছুই নেই, আর না আছে সেই বিধ্বস্ত মনটা।এ আমির মাঝে যে এক নতুন সতেজ মনের বাস।এক নতুন তিহানের বাস। যে মনের অলিগলিতে কেবলই রয়েছে নিদ্রা নামক ভালোবাসার বিচরণ। আর এটা সম্ভব হয়েছে কেবলই নিদ্রার থেকে নিজেকে দূরে রাখার ফলে। তা নাহলে এই আমিকে হয়তো কখনোই ফিরে পেতাম না। কিন্তু আমি এবারও ব্যর্থ। আমার ভালোবাসা বুঝার ক্ষমতা কারোই হলো না।”
“এ কথাগুলো আমাদের সামনে না বলে নিদ্রার সামনে বলতে পারোনি?তোমার কি মনে হয় নিদ্রা এ কথাগুলো শুনলে তোমার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারতো?”
“আপনার কি মনে হয় ভাবি আমি চেষ্টা করিনি?আর আমার চেষ্টা করলেই তো হবে না,যাকে বলব তাকেও তো শোনার আগ্রহ থাকতে হবে।”
“তাহলে তোমার এখন কি করণীয়?”
“জানি না,আমি সত্যিই কিছু জানি না।”
“ধরো নিদ্রা তোমার কথা শুনবে না,তাই বলে কি তুমি হাত-পা গুঁটিয়ে বসে থাকতে পারবে?”
“এছাড়া কি আমার আদৌ কিছু করার আছে ?”
“তোমার বিয়ে করা বউকে তোমার কিছু করার না থাকলে কি পাশের বাড়ির লোকের করার আছে? তোমার বদলে সে কি তোমার বউকে পাজ কোলে নিয়ে ধেইধেই করে নাচবে? তবে হ্যাঁ, তুমি চাইলে আমরা তোমায় বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করতে পারি কিন্তু কাজে না।”
তানহার কথা শুনে মন খারাপের মাঝেও তিহান হো হো করে হেসে দিল। বলল,
“ভাবি, কী যে বলেন না…..তবে হ্যাঁ, বুদ্ধি দিলে কিন্তু মন্দ হয় না।”
“আগে আপনি আজ্ঞে করা বন্ধ করো তারপর বুদ্ধির জন্য এসো। তুমি আমার থেকে বড় তাই তোমার মুখে আপনি ডাক টা অস্বস্তি লাগে। তুমি আমায় নাম ধরেই ডেকো তাহলে যেকোনো বিষয়ে ফ্রি ভাবে কথা বলতে পারব।”
বলেই অতলের দিকে তাকালো তানহা। অতলের চোখেমুখ জুড়ে পূর্ণ সম্মতির লক্ষণ দেখে হাসি মুখ করে তিহানের দিকে তাকালো তানহা। এদিকে তানহার কথা শুনে তিহানও এক পলক অতলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না না, সমস্যা নেই। সম্পর্কে আপনি আমার বড় ভাবি। আপনাকে তুমি করে নাম ধরে ডাকা টা দৃষ্টি কুটুর দেখায়।তাই আমার মনে হয়…. ”
তিহানের কথার মাঝে অতল বলল,
“আহা,না করছিস কেন? তোর ভাবি তো ঠিক কথাই বলেছে। ও তোর থেকে বয়সে ছোট। এখন তুই যদি ওকে আপনি আজ্ঞা করিস ওর তো অস্বস্তি লাগবেই। তারচেয়ে ভালো না তুই ওকে নাম ধরে ডাক। এতে ওর অস্বস্তিও লাগবে না,স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলতে পারবি।”
“কিন্তু……”
“কোনো কিন্তু না,তোকে যা বলেছি তাই হবে।”
“আচ্ছা বেশ, তবে তাই হবে।এখন থেকে আর ভাবি না তানহা বলেই ডাকব। ”
অতল হেসে বলল,
“এইতো গুড বয়।”
“তোমার ভাই বলে কথা গুড বয় না হলে কি চলে!”
মাঝখান দিয়ে তানহা বলে উঠল,
“তোমাদের দু’ভাইয়ের কথা শেষ হলে এবার প্ল্যানের দিকে যাই আমরা? ”
অতল ও তিহান একত্রে জিহবায় কামড় দিয়ে বলে উঠল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই।”
“তাহলে শোনো…..”
তানহার প্ল্যান শুনে দু’হাতে তালি বাজিয়ে বসা থেকে লাফিয়ে উঠল তিহান।বলল,
“ওয়াও…..জাস্ট ওয়াও একটা প্ল্যান করেছ। আমি নিশ্চিত আগের পদ্ধতি কাজে না দিলেও এটা দিবেই দিবে।এখন শুধু অপেক্ষা আগামীকালের।”
প্ল্যান শুনে অতল থ হয়ে গেল। একগালে হাত রেখে বলল,
“আমার বউয়ের মাথায় যে এতো দুষ্টু খেলা আছে তিহান সমস্যায় না পড়লে তো জানতেই পারতাম না।তবে হ্যাঁ, এই প্ল্যান গুলো জানায় আমার জন্য অনেক ভালো হলো। একেক সময় একেক ভাবে এপ্লাই করব। ”
তানহা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হাও ফানি!”
তিহান ভ্রু কুচকে বলল,
.
.
চলবে….
(