হঠাৎ শাড়ির আঁচলে টান পড়ায় আমি পেছনে ফিরলাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।নিচের দিক থেকে টান পড়ায় এবার নিচে তাকিয়ে দেখলাম একটা পাঁচ বছরের ছোট বাচ্চা আমার শাড়ির আঁচল ধরে টানছে।আমি এবার নিচে বসে পড়লাম। ছোট বাচ্চা ছেলেটি দেখতে মাশাল্লাহ অনেক কিউট।ওকে এক পলক দেখতেই চোখ যেন থমকে গেল আমার কারো কথা মনে পড়ে গেল।তার মুখটা ভেসে উঠছে আমার চোখের সামনে।কতটা মিল আছে এই চেহারায়,এই চোখে, এই ঠোঁটে,ভ্রুযুগলও তেমনই।চোখে সেই মায়া।যে মায়ার বাধনে বেধে গিয়েছিলাম আমি।অপলকে তাকিয়ে তার মুখ অবয়বের দিকে। কতটা পরিচিত এই অবয়ব।গালে হাত ছোয়াই আমি বাচ্চাটার।আমি যেন আটকে গেছি থমকে গেছি সেই চেহারায়।সাত বছর পর কখনোই এমন কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।হয়তো ভাবিনি অতীতটা আবার ঘা দিয়ে উঠবে।যাকে বুকের মাঝে খুব যত্নে লুকিয়ে রেখেছি।
চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।বাচ্চা ছেলেটা স্নতপর্নে দুহাতে আলতো করে সে অশ্রু মুছে দিল।কিছুক্ষণ বাদে হুশ ফিরলো আমার।আমি এবার বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
—“নাম কি তোমার বাবু?আর এখানে একা কি করছো? ”
সে আমার কথা শুনে কিছু বললো না।আমি আবারও বললাম,
—“কি হলো বলো আমায়? আচ্ছা তুমি কি হারিয়ে গেছো?”
এবার সে তার মাথা উপর নিচ করলো।আমি অবাক হলাম ও কি তাহলে কথা বলতে পারে না।তাই হয়তো তখন কিছু বলে নি।এবার আমি মুচকি হেসে বললাম,
—“একদম ভয় পেয়ো না তুমি।আমি তোমাকে তোমার আম্মুর কাছে নিয়ে যাবো।”
বলতেই মুচকি হাসি উপহার দিলো ও আমায়।ওই হাসিতে আমার বুকটা ধক করে উঠলো।কত চেনা এই হাসি একদম বুকে গিয়ে লাগার যেমন প্রথম বার এই হাসি দেখে আমার বুকে তীরের মত বিধেছে ঠিক তেমনই।
কিছুক্ষণ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম সেই অমায়িক হাসির পানে।তারপর আমিও মুচকি হেসে উঠে দাড়ালাম।ওর হাতটা শক্ত করে ধরে চলতে শুরু করলাম।শপিংমলের কাউন্টারে সেখানে গিয়ে লোকটাকে বললাম,
—“এক্সকিউজ মি।বাচ্চাটা হয়তো ওর পেরেন্টসকে হারিয়ে ফেলেছে।একটু মািকে এনাউন্সমেন্ট করে দিন যে বাচ্চাটা এখানে আছে।বলেই আমি ওকে নিয়ে পাশের একটা চেযারে বসে পড়লাম। ওকে কিছু জিজ্ঞেস ও করতে পারছি না।ও তো বলতেই পারে না কি জিজ্ঞেস করবো।তাই ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করা হলো না।আমার ব্যাগে একটা ক্যাডবেরি ছিল ওইটা দিলাম ওকে। ও ওটা নিযে খেতে লাগলো।আমি মুচকি হাসলাম।হয়তো ওর ও আমার মত চকলেট খুব পছন্দ।কিছুক্ষন পর হঠাৎ একজন লোক পিছন দিক থেকে ছুটে এসে বললো,
—“ফারান”
আমি তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে তাকাই।তারপর যাকে দেখলাম তাকে দেখে আমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সেই পরিচিত মুখ।যা আমার হৃদয়ে আঁকা।মনের রং তুলি খুব সযত্নে যার ছবি একেছিলাম।সেই মানুষটা যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম।শুধু কি ভালোবাসতাম হবে নাকি ভালোবাসি হবে।মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলাম। ভালবাসতাম কেনো হবে ভালোবাসি হবে।যাকে মনের মনি কোঠরে আজও যত্নে রেখেছি।
সে ছুটে আসতেই বাচ্চাটি তার কাছে ছুট লাগালো।লোকটি বসে পড়লো হাঁটু ভেঙে। আর বাচ্চাটি তার গলা জরিয়ে ঝাপটে ধরলো।সে বাচ্চাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে অজস্র চুমু খেল।তারপর বললো,
—“বাবাই তুমি ঠিকাছে?কোথাও লাগে নি তো তোমার?তুমি ভয় পেয়েছিলে?আরও কত প্রশ্ন।মুচকি হাসলাম আমি সাথে আমার ভিতর থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলো।আজ সাত বছরে এটাই আমার একমাত্র সম্বল।দীর্ঘনিশ্বাস, প্রতিটা নিশ্বাসই আমার এক একটি দীর্ঘশ্বাস। যেনো বুকে জমানো ব্যাথাগুলোকে এই দীর্ঘশ্বাসের সাথে বিলীন করে দেওয়ার প্রচেষ্টা। কিন্তু তা আর সম্ভব হয় না।ওদের কথপোকথন শুনে বুঝতে পারলাম।ওরা বাবা ছেলে। কিন্তু বাচ্চার মাকে দেখতে পাচ্ছি না।আমার চোখ তাকে খুজতে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ পর বাচ্চার হাত ধরে সে এসে আমার সামনে দাড়ালো আর বললো,
—“আপনাকে অনেক ধন্য…….
আটকে গেলেন উনি। অবাক চোখে তাকিয়ে আমায় দেখছে।হয়তো চেনার চেষ্টা করছে। এত বছরের দুরত্ব। না চেনাটাই স্বাভাবিক। আর এখন তো আমি কতটা পাল্টে ও গেছি।চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ি।চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথাই।আর তাছাড়া আমি তো উনার জন্য স্পেশাল কেউ ছিলাম না যে উনি আমাকে মনে রাখবেন।আমি জাস্ট উনার একজন সাধারণ বন্ধুই ছিলাম।
উনি এবার ভ্রুকুচকে বলে উঠলেন,
—“আরে আপনি কথা না?আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি।কতটা বদলে গেছেন আপনি।চিনতে পারা মুসকিল। ”
আমি ঠোঁটে সৌজন্যতার হাসি ফুটিয়ে বললাম,
—“যাক চিনতে পেরেছেন তবে।ভুলে যাননি।অবশ্য মনে রাখার মতও কেউ ছিলাম না।”
আমার এ।ন কথায় উনি অবাক হলেন বেশ।চোখ ছোট ছোট করে বোঝার চেষ্টা করতে চাইছেন আমার অব্যক্ত উক্তি। আমি এবার একটু হাসি প্রশস্ত করেই বললাম,
—“আরে ঘাবড়াবেন না।আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম।তো বলুন কেমন আছেন?”
বরাবরের। ত এবারও প্রশ্নটা আমিই করলাম।এটা আমার অভ্যাস। কারন তার ভালো থাকাই আমার বেচে থাকার কারন।আজও মোনাজাতে শুধুই তার ভালোথাকার, সুখে থাকার জীবনে সফলতা লাভ করার প্রার্থনাই করি।তাই জানতে হবেই তিনি কেমন আছেন। অবশ্য ভালোই থাকবেন।ছেলে বউ নিয়ে ভরপুর সংসার। ভালো তো থাকতেই হবে তাই না।সবাই তো আর আমার মত অপূর্নতার জীবন বেছে নিবে না।আমার ভাবনার মাঝেই উনি বলে উঠলেন,
—“যতটা আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন ততটাই ভালো আছি।আপনি বলুন আপনি কেমন আছেন? ”
আমি এবার স্বশব্দে হেসে দিলাম আর বললাম,
—“আমি অনেক ভালো আছি মিষ্টার।”
আমার এমন হাসিতে উনি বোকা বনে গেলেন। আমি গলা খাকারি দিযে বললাম,
—“সরি সরি। আসলে হঠাৎ আজ এভাবে আপনার সাথে দেখা হবে। বুঝতে পারি নাই।তাই হেসে ফেললাম।আপনি বলুন আপনার মিসেস কই?”
কথাটা বলতেই উনার মনটা খারাপ হয়ে গেল।আমি কিছুটা হতবাক হলাম।উনার চোখে কষ্ট দেখতে পাচ্ছি। উনার চোখ পড়তে পারি আমি।যতবারই উনাকে দেখেছি।উনার চোখে দেখলেই যেন কত কিছু বুজতাম।যেনো উনার চোক দুটো জীবন্ত কত কথা বলচে আমার সাথে।
উনার এমন চোখের চাহনি আমার বুকের ভিতর তোলপাড় শুলু করে দিল।কান্না গুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে।খুব কষ্টে আটকে রেখেছি।তাদের।অবাধ্য অশ্রুকনা শুধু যেখানে সেখানেই ঝড়ে পড়তে চায়।বোঝে না কেনো এরা সব জায়গায় ঝড়ে পড়তে নেই।তাতে অনেক লুকিয়ে থাকা অনুভূতিরা ধরা দেয় সহজেই।তাই খুব কস্ট হলেও আটকে রাখছি তাদের। এবার জোরপূর্বক হাসি টেনে বললাম
—“কি এমন কাজে দুজনে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে ছেলের কথাই ভুলে গেলেন।এত মিষ্টি একটা বাচ্চা ও একা একা আপনাদের ছেড়ে দুরে চলে এলো।”
বাচ্চাটা মানে ফারান এবার মুখ খুললো বললো,
—“মামুনি আমি হারিয়ে যায় নি। বাবাই আমাকে বসিয়ে দিয়েছিল আর বলেছিল যেনো কোথাও না যাই।আমি তো বেলুনের জন্য বেরিয়ে যাই।পরে রাস্তা ভুলে যাই।”মিষ্টি মিষ্টি কন্ঠে আদো আদো স্বরে বললো।আমি ওর কথা শুনে তব্দা মেরে দারিয়ে।আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না ও কথা বলছে।আমি এবার হাঁটু গেরে বসে পরি।আর বলি,
—“বাবু তুমি কথা বলতে পারো?”
—“হুঠাৎ এ কথা কেনো বলছো কথা। ”
—“আমি এবার কাচুমাচু করে বললাম যে,
—“আসলে আমি ভেবেছিলাম যে ও কথা বলতে পারে না।কারন যখন আমি ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম ও কিছু না বলেই মাথা নাড়াচ্ছিলো তাই আরকি। সরি।”
—“আরে না না। তুমি সরি কেনো বলছো। ও এমনি খুব দুষ্টু।কোন কিছুই সিরিয়াসলি নেয় না।ও জানে না যে এতক্ষণে আমার কি অবস্থা হয়েছিল। ওকে ওখানে না পেডে পুরো মলে খুজেছি আমি।”
আমি মুচকি হাসলাম।মনে মনে বললাম।আপনার কার্বন কপি তো তাই।একদম আপনার মত হয়েছে।
—“হুম।আপনার মত হয়েছে তো তাই।”
—“এভাবে দাড়িয়ে কথা বলবা।চলো কোথাও বসি।বসে কথা বলি।”
বুকটা ছ্যাত করে উঠলো আমার উনি আমায় তুমি করে বলছেন।এই নিয়ে সাত বার উনি আমায় তুমি করে বললেন।আগে যতবারই বলতো শুধু বলতো তুমি একটা পিচ্চি। আমি ওই কথাটাতেই মরে যেতাম নিশ্বাস আটতে আসতো।যতবার উনি আমায় তুমি করে বলেছেন ততবারই এমন অনুভুতি হয়েছে।কি অদ্ভুত তাই না।ভালোবাসাটা যেমন অদ্ভুত তার অনুভূতি গুলো ও হয় অদ্ভুত। তাই তো বলে যে যারা ভালোবাসে তারা নাকি পাগল।আসলে ভালোবাসলে পাগল হয় নাকি পাগল হয়ে ভালোবাসে।আগে তো আমি এমন ছিলাম না।একটা চঞ্চল উড়নচণ্ডী মেয়েকে পাগল করে দিয়েছে এই মানুষটা। তার ভালোবাসায় পাগল করেছে আমায়।সত্যি আমি পাগল।যারা পুরোটা পড়বে।তারা আমাকে পাগল ই বলবে।কিন্তু পাগলের মত ভালোবাসতে না পারলে সে ভালোবাসা কি আদৌ ভালোবাসা হয়।আজকালকার দিনে ভালোবাসা নেই বললেই চলে। সবটাই মোহ আর কিচ্ছু না।সবারই কিছু না কিছু পাওয়ার মোহে রয়েছে।যে যেটাকে পাওয়ার মোহে রয়েছে সে সেটাকে ভালোবাসে।আমরা আশেপাশে অনেক প্রেম বা লাভ স্টোরি দেখতে পাই।কিন্তু সবার ভালোবাসা বা প্রেম পূর্নতা পায় না। আমি মনে করি প্রেম আর ভালোবাসার মধ্যে তফাৎ আছে।প্রেম আর ভালোবাসা এক না।আচ্ছা সে নিয়ে না হয় পড়ে কোন একদিন আলোচনা করবো।আজ গল্পে ফেরা যাক।
—“কি হলো মিস কথা। উপসস সরি মিস না মিসেস।মিসেস কথা কোথায় হারিয়ে গেলেন?”
উনার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম।আর তাচ্ছিল্য হেসে বললাম,
—“মিসেস না মিসই ঠিক আছে।আচ্ছা আপনার মিসেস আসুক তারপর না হয় যাই কি বলেন”
—“আপনি চলুন। “বলেই উনি কফিশপের দিকে হাঁটা দিলেন।ফারান আমার হাত ধরে হাটতে শুরু করলো।আমিও মুচকি হেসে চললাম ওর সাথে।
ভাবছি ছেলের নিজের নামের সাথে মিল করেই রেখেছেন।ফয়সাল আহমেদ স্রোত। সবসময় পারফেক্ট একজন মানুষ উনি।রুপে গুনে কোন দিক দিয়েি কম নয়।তাই বলে এই বলবো না যে সিনেমার হিরোর মত।কিন্তু তার থেকেও কম নয়।এটিটিউড, ভাব একটু আছেই।কিন্তু সেটা সবক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন না।খুবই সাধারন একজন। কিন্তু সাধারনের মধ্যে অসাধারণ একটা ব্যক্তিত্ব।সবাই তো আর রুপ দেখে পাগল হয় না।কেউ কেউ মায়ায় জরিয়ে যায়।মায়া এক পররকার আসক্তি বা নেশা।যা থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। যেমনটা আমি পারিনি।ভাবতে ভাবতেই চলে এলাম একটা কফিশপে।শপিংমলের একটা পাশে ফুডকোডে আছে।
#চলবে কি???
#অপেক্ষার_শেষ_প্রহর
#সূচনা_পর্ব
#লেখনিতেঃহৃদিতা_ইসলাম_কথা
🌼