১.
বেডরুমের দরজা হাঁট করে খুলতেই পায়ের তলার মাটি সরে গেল অাশফাকের। পুরো পৃথিবীটা কেমন টলে উঠলো তার। শরীরের সব রক্ত একসঙ্গে এসে জমাট বাঁধলো। থর থর করে কাঁপছিল তার ঠোঁট। হাত দু’টো মুষ্টি বদ্ধ হয়ে এল। আশফাক গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল,’নীরা..’
চিৎকারে গলার সমস্ত রগ ছিঁড়ে যাবার উপক্রম।
চিৎকার শুনে খাটে শুয়ে থাকা নারী পুরুষ উভয়েই হুমড়ি খেয়ে উঠে পড়ল। মিজান দ্রুত উঠে ফ্লোরে পড়ে থাকা শার্টটা কুড়িয়ে নিয়ে পরে ফেলল। নীরা কোনোরকমে গায়ে ওড়না চাপিয়ে কি হয়েছে এমন ভঙ্গিতে ঘুম ঘুম চোখে পিটপিট করে চাইলো আশফাকের দিকে। সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না।
আশফাকের পাশেই দাড়িয়ে ছিলেন আশফাকের মা রাহেল বেগম। রোজ বিকেলে নিয়ম করে হাটতে বের হন তিনি। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। অন্যান্য দিনের মতো আজ খানিকটা দুর্বল বোধ করার কারণে আশপাশটায় এক চক্কর লাগিয়েই ফিরে এলেন তিনি। বাড়ি ফিরতেই মেইন গেটের সামনে সদ্য অফিস থেকে ফেরা ছেলেকে দেখে চমকে উঠলেন। অফিস ছুটির অনেকটা আগেই আজ আশফাক চলে এসেছে। আশফাক মা’কে দেখে এক গাল হেসে ‘সারপ্রাইজ’ বলে এসে জড়িয়ে ধরলো। আজ আশফাকের অফিসের কাজ দ্রুত শেষ হওয়ায় অফিস ছুটির অনেকটা আগে আগেই বাড়িতে ফিরে এসেছে। রাহেলা বেগম সদর দরজার সামনে এসে ব্যাগ হাতড়ে ঘরের চাবিটা বের করলেন। দরজার লক খুলতে গিয়ে দেখলেন দরজা লক আগে থেকেই খোলা। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে তিনি যাবার সময় বাহিরে থেকে দরজা লক করে তার সাথে চাবি নিয়ে গেছিলেন। তার ছেলের বৌ নীরা দুপুরের খাবারের পর ভাত ঘুম দেয় বলেই প্রতিদিন তিনি বিকেলে হাটতে যাওয়ার পূর্বে দরজায় বাহিরে থেকে লক করে যান। যাতে পরবর্তীতে ফিরে এলে তার বৌমাকে আর কষ্ট করে ঘুম ভেঙে উঠতে না হয়। বেচারি এমনিতেই সারাদিন ভীষণ খাটাখাটুনি করে এই এতটুকু সময়ই পায় রেস্ট নেওয়ার জন্য। তাই তিনি তার অতো আদরের বৌমার ঘুমটা মোটেও ভাঙতে ইচ্ছুক নন। হাজার হোক তার অমন সোনার টুকরো বৌকে কি করে কষ্ট দেবেন তিনি? আজকালকার যুগে ক’জনের ভাগ্যেই বা অমন মিষ্টি আর ভালো বৌমা জোটে। ভাবতেই ভীষণ গর্ব বোধ করেন তিনি।
কিন্তু মাঝেমধ্যেই তিনি হাটা শেষে বাড়ি ফেরার পর খেয়াল করেন দরজার লক খোলা। অথচ তার স্পষ্ট মনে পড়ে প্রতিদিন যাবার সময় তিনি দরজা লক করেই বের হন। তিনি অবশ্য এসব খুব একটা পাত্তা দেন না। ভাবেন বয়স হলে তো মানুষের এমন একটু আধটু ভোলার রোগ হয়েই থাকে। হয়তো তারও হয়েছে। তাই তিনি আর এই বিষয়টাকে কখনো খুব একটা পাত্তা দেন না।
দরজা খুলে রাহেলা বেগম ছেলেকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। তারপর ছেলের সাথে মিষ্টি হেসে কুশলাদি বিনিময় করতে করতে এলেন আশফাকের বেডরুমের সামনে। আর দরজা খোলার পর যা দেখলেন তা দেখার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। মুহূর্তেই একমাত্র আদরের ছেলে বৌকে নিয়ে তার সমস্ত অহংকার ভেঙে গুড়িয়ে গেল। নিজের ছেলের বেডরুমেই কিনা ছেলে বৌয়ের সাথে অন্য পুরুষ! ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! লজ্জায় ঘেন্নায় নিজের হাতে চোখ ঢেকে ফেললেন তিনি,’ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! আমি সামান্য বাহিরে গেছিলাম আর এর মধ্যেই…! এই মেয়েকে নাকি আমি আমার বাড়ির বৌ করে এনেছিলাম। ভাবতেও ঘেন্না হচ্ছে ছিঃ! এইদিনও দেখার ছিল। এসব দেখার আগে আমায় পৃথিবী থেকে কেন নিয়ে গেলে না আল্লাহ।’ রাহেলা বেগম আর্তনাদ করে উঠলেন।
সদ্য ঘুম থেকে ওঠা নীরার দিকে ঘেন্নায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে অাশফাক। নীরার মায়াবী মুখটাও আজ কেন জানি পৃথিবীর সব থেকে কুৎসিত মনে হচ্ছে তার কাছে। বুকের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা বাঘটা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। একটা হিংস্র আক্রমনাক্তক পশু বেরিয়ে এল। আশফাক বুনো মষের মতো তেড়ে এসে মিজানের কলার চেপে ধরল। চিৎকার করে বলল,’ইউ বাস্টার্ড। তোর সাহস কি হল আমার বেডরুমে ঢোকার!’
মিজান নির্লজ্জের মতো হেসে বলল,’যাক সত্যিটা তাহলে জেনেই গেছিস। একদিকে ভালোই হল, আমার আর নীরার মাঝে আর কোনো বাঁধাই রইল না।’
‘ইউ…তোকে আমি খুন করে ফেলবো যদি আর একবার তোর ঐ নোংরা মুখে নীরার নাম নিস তো!’ মিজানের শার্টের কলারটা আরও শক্ত করে খামচে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল আশফাক।
মিজান বাঁকা হাসলো,’ নীরার সাথে প্রেম আমার বহুদিন ধরেই। ও তোকে ভালোবাসে না। আর কোনোদিন বাসেও নি। কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছিল না। নীরা শুধু আমাকে ভালোবাসে। শুধু আমাকে।’
এতক্ষণে যে পুরো ঘটনাটা নীরার বোধগম্য হল। ঘুমের রেশটা তার এখন পুরোপুরি কেটে গেছে। মিজানের কথা শুনতেই তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল,’ছিঃ! কিসব বলছেন আপনি? কেন মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন আমায়?’
মিজান চোখ বড় বড় করে নীরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একি নীরা ডার্লিং হাসবেন্ড ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই পল্টি নিয়ে ফেললে? এত ভয় পাও? আরে কেন এত ভয় পাচ্ছ বল তো? আমাদের সম্পর্কের কথা ওকে সব বলে দাও। বলে দাও যে সেই প্রথম দেখাতেই তুমি আর আমি একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার হাসবেন্ড আর শাশুড়ী বাড়িতে না থাকলে মাঝে মধ্যেই তো তুমি আমাকে বাড়িতে ডাকতে। আর এই বেডরুমের এই বিছানাতেই তো আমরা…’
মিজান আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগেই অাশফাক তার নাক বরাবর সজোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল।
‘ইউ ব্লাডি ডাফার! আই উইল কিল ইউ।’ চিৎকার করে উঠলো আশফাক। তারপর উড়াধুড়া আরও কয়েকটা ঘুষি মারলো। এত মার খাওয়ার পরও মিজান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরাবরের মতোই নির্লজ্জের মতো হাসলো,’তুই যাই করিস না কেন নীরা আমাকেই ভালোবাসে। নইলে এই মুহূর্তে তোর বেডরুমে আমার কি কাজ থাকতে পারে? আর ও তোকে ছেড়ে কোনো না কোনোদিন আমার কাছে ঠিক চলেই আসতো।’
মিজানের কথায় নীরা হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর চিৎকার করে বলতে উঠল,’ কি বাজে বকছেন? আমি কেন আপনাকে ডাকতে যাব? কেন প্রতিশোধ নিচ্ছেন?’ বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ফেলল নীরা।
আশফাক এবার নীরার দিকে তাকালো। তার চোখ দুটো টকটকে লাল। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল নীরার। আশফাক মিজানের কলার চেপে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেটের বাহিরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। মিজান হাত দিয়ে কলার ঠিক করতে করতে ফের নির্লজ্জের মতো হেসে নীরার উদ্দেশ্যে বলল,’তুমি একদম ভয় পেও না নীরা ডার্লিং। আমি ঠিক আছি। তুমি ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত আমার কাছে চলে এসো কেমন। লাভ ইউ। বাই..’ নীরার উদ্দেশ্যে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে হাত নাড়ল মিজান। প্রচণ্ড ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিল নীরা।
আশফাক যেন ক্রোধে ফেটে পড়ল। হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মিজানের ওপর। পাগলের মতো কিল ঘুষি মারতে লাগলো মিজানকে। আশফাকের মা রাহেলা বেগম এসে ছেলেকে বহু কষ্টে ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা আটকে দিলেন।
চলবে…
‘অবিশ্বাস’
সাবিহা আফরিন