অবিশ্বাস পর্ব ২

‘অবিশ্বাস’
সাবিহা আফরিন

২.

‘ওর আর দোষ কি! সব দোষ তো তোর বৌ’র। তোর বৌ নিজের রূপ দেখিয়ে মিজানকে পাগল না করলে সেকি আর তোর বৌয়ের সাথে বিছানায় আসতো? স্বামী থাকতে পরপুরুষকে ঘরে ঢুকিয়ে…! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আমার বলতেও রুচিতে বাঁধছে।’ রাহেলা বেগমের বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তবুও নিজের চোখে সমস্তটা দেখার পর তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না।

লজ্জায় ঘেন্নায় অপমানে নীরার চোখ ছলছল করে উঠল। বসা থেকে উঠে দৌড়ে শাশুড়ীর কাছে গেল নীর। শাশুড়ী রাহেলা বেগমের দু’হাত চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’মা, মা আপনি বিশ্বাস করুন আমি এসবের কিচ্ছু জানি না। ঐ.. ঐ লোকটা কোথা থেকে এল, কিভাবে এল আমি সত্যিই কিছু জানি না মা। বিশ্বাস করুন।’

রাহেলা বেগম নীরার ধরে থাকা হাত দুটোকে ঝারি মেরে সরিয়ে দিয়ে বললেন,’বিশ্বাস আর তোমাকে? হাহ..! আচ্ছা আমার ছেলে কি তোমাকে কম ভালোবেসেছিল যার জন্য একটা পরপুরুষকে নিজের বেডরুমে এনে ঢোকালে? তোমাকে আমি নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসে ছিলাম। বিশ্বাস করে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এমনকি আমার একমাত্র আদরের ছেলেটাকে পর্যন্ত সম্পূর্ণ তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আজ তুমি তার এই প্রতিদান দিলে? শেষ পর্যন্ত আমার ছেলের বন্ধুর সাথে…! ছিঃ! আবার বিশ্বাস করতে বলছো কোন মুখে? লজ্জা করে না তোমার?’ শেষ কথাটা চোয়াল শক্ত করে বললেন তিনি।

‘মা..!’

‘খবরদার একদম আমায় মা বলে ডাকবে না। তোমার মতো মেয়ের মুখ থেকে মা ডাক শোনাও পাপ।’ রাহেলা বেগম নীরা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

নীরা রাহেলা বেগমের দিকে কিছুক্ষণ আহত চোখে তাকিয়ে থেকে আশফাকের দিকে তাকালো। ঘরের এক কোণে চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে আছে সে। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। এবার আশফাকের কাছে ছুটে গেল নীরা,’বিশ্বাস করুণ আমি আপনাকে ঠকাই নি। আমি সত্যিই জানি না ঐ লোকটা এ ঘরে কি করে এল? আমায় বিশ্বাস করুন আমি অসতী নই আশফাক, আমি অসতী নই।’ বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে উঠল নীরা।

ঘেন্নায় সারা শরীরে একটা তীব্র জ্বলুনি ধরে গেল আশফাকের। এই মেয়েটাকে সে এতদিন ধরে তার সমস্তটা উজাড় করে ভালোবেসে এসেছে? কিন্তু তার প্রতিদানে কি পেল সে? আজ যদি অন্য কেউ এসে নীরার নামে যাচ্ছেতাই বলতো তবুও আশফাক কোনোদিন বিশ্বাস করতো না। কিন্তু আজ নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবে কিভাবে? ছিঃ! ভাবতেও ঘেন্না হচ্ছে। আজ নিজ চোখে যা দেখল তারপর তার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। সমস্ত ভালোবাসা নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন যা বেঁচে আছে সেটা হল শুধুমাত্র নীরার প্রতি ঘৃণা, এক তীব্র ঘৃণা। আশফাক রক্তচক্ষু নিয়ে নীরার দিকে তাকালো। ভয়ে নীরার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আশফাক শীতল গলায় বলল, ‘তাহলে মিজান এ ঘরে এল কি করে?’

নীরা ভয়ে একটা শুকানো ঢোক গিলল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি সত্যি জানি না উনি কি করে এ ঘরে এল। কিন্তু.. কিন্তু বিশ্বাস করুণ আমি ওনাকে এ ঘরে আনি নি। আর না কখনো ওনার সাথে আমার কোনো অবৈধ সম্পর্ক ছিল। উনি মিথ্যে বলেছে বিশ্বাস করুন আমায়। আমি সত্যিই কিচ্ছু জানি না।’

হঠাৎ আক্রোশে ফেটে পড়ল আশফাক। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নীরার গালে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় বসিয়ে দিল। আঘাত সইতে না পেরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো নীরা। আশফাক নীরার চুলের মুঠি ধরে টেনে দাঁড় করালো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল নীরা।

‘আর কত মিথ্যে বলবি তুই? বল আর কত মিথ্যে বলবি?’ চিৎকার করে উঠল আশফাক। ভয়ে কেঁপে উঠল নীরা।

‘এত ভালোবাসার পরেও তুই অন্য পুরুষের কাছে গেছিস। আমার ভালোবাসায় কিসের কমতি ছিল? তোর শরীরের এত জ্বালা যে শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধুর সাথে….!’ আর বলতে পারলো না আশফাক।

প্রচণ্ড ঘেন্নায় চোখ বন্ধ করে ফেলল নীরা। চোখের কোণ উপচে জল পড়ছে তার। নীরা পেটে হাত রেখে কান্না মিশ্রিত গলায় বলল,’আমার অনাগত সন্তানের কসম খেয়ে বলছি আমি অসতী নই। আমি সত্যি এসবের কিচ্ছু জানি না।’

আশফাক তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,’সন্তান! হাহ! কে বলতে পারে যে এই সন্তান মিজানের নয়?’

‘কি বলছেন আপনি এসব?’ আঁতকে উঠলো নীরা।

‘চুপ একদম চুপ। বেশ্যা দেখেছি আমি কিন্তু তোর মতো বেশ্যা দেখিনি। ছিঃ! আমারা ভাবতেও ঘেন্না হয় যে তোর মতো মেয়েকে এতদিন আমি নিজের সমস্তটা উজাড় করে ভালোবেসে ছিলাম। তোর মতো মেয়েরা সব করতে পারে। এমনকি নিজের সন্তানের নামে শপথ করে হাজারটা মিথ্যেও বলতে পারে।’ দাঁতে দাঁত পিষে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল আশফাক।

তীব্র ঘেন্নায় সারা শরীর রি রি করে উঠলো নীরার। এসব কথা শোনা আগে তার মরণ কেন হল না। এই মুহূর্তে তার নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে ঘৃণিত মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

‘আশফাক!’ আর্তনাদ করে উঠল নীরা।

আশফাক সাথে সাথে নীরার গাল দুটো হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’খবরদার তোর ঐ নোংরা মুখে আমার নামও উচ্চারণ করবি না। জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।’

‘তোর সাথে আর এক মুহূর্তও না। আজই এ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবি তুই।’

নীরা বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আশফাক কি সত্যি সত্যিই তাকে বের করে দেবে? আশফাককে ছাড়া সে বাঁচবে কি করে? নীরা সঙ্গে সঙ্গেই আশফাকের পায়ে পড়ে গেল। আশফাকের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল,’দোহাই লাগে এত বড় শাস্তি দেবেন না। আমি আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। আমায় একটিবার বিশ্বাস করুন। আমি সত্যি আপনাকে ঠকাই নি। আমি শুধু আর শুধুমাত্র আপনাকেই ভালোবাসি।’

রাহেলা বেগম মুখ ঝামটা মেরে বললেন, ‘উহ নাটক! যত্তসব!’ তারপর আশফাককে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুই ওর কথায় একদম কান দিবি না বাবা। এসব মেয়েরা সব পারে। এই যে এই কান্না! এইসব হল ওর নাটক। হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে কিনা তাই চোখের জল ফেলে তোর মন ভোলানোর চেষ্টা করছে। খবরদার তুই কিন্তু ওর ফাঁদে একদম পা দিবি না।’ তিনি আর এক মুহূর্তের জন্যেও নীরাকে বিশ্বাস করতে চান না। তার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। আর তার জন্য শুধুমাত্র নীরা নিজেই দায়ী। কম তো ভালোবাসেনি এই মেয়েকে। নিজে পছন্দ করে ছেলে বিয়ে করিয়েছিলেন তিনি। বিয়ের পর কখনো নীরাকে ছেলের বৌ হিসেবে দেখেন নি। নিজের আর কোনো সন্তান না থাকায় সব সময় নীরাকে তিনি নিজের মেয়ে ভেবে এসেছেন। আর আজ এই মেয়ে তাদের এভাবে ঠকালো?

আশফক আবারও নীরার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে বলল, ‘ভালোবাসা হাহ! তুই বুঝিস ভালোবাসা কি? কাকে বলে?’ আশফাকের চোখটা হঠাৎ ছলছল করে উঠল। এক তীব্র বেদনার ছাপ ফুটে উঠল ঐ দু’চোখে।

তারপর আবার চোয়াল শক্ত করে ফেলল আশফাক,
‘তোর মতো মেয়ের মুখে ভালোবাসার শব্দটা মানায় না। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, তোর সাথে আমার সব সম্পর্ক এখানেই শেষ। চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে। এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।’ নীরাকে ছেড়ে চিৎকার করে উঠল আশফাক। প্রচণ্ড রাগে থরথর করে তার গা কাঁপছে।

‘না, কোত্থাও যাবো না আমি। আমার স্বামী সংসার ছেড়ে আমি কোত্থাও যাবো না।’এবার নীরাও চিৎকার করে উঠল।

‘কি নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েরে বাবা! দেখেছিস দেখছিস এখনো কেমন তেঁজ। তোমার জায়গায় আমি হলে তো লজ্জায় গলায় দঁড়ি দিতাম।’ প্রচণ্ড ঘেন্নায় মুখ বিকৃতি করে ফেললেন রাহেলা বেগম। নীরাকে যেন আর এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারছেন না তিনি।

আশফাক যেন ক্রোধে ফেটে পড়ল। নীরার চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে বলল,’তুই যাবি না মানে? তোর ঘাড় যাবে। তোর মতো অসতী মেয়ের এ বাড়িতে কোনো জায়গা নেই। চল..চল বলছি..’

নীরার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে গেটের বাহিরে বের করে দিল আশফাক। তারপর মুখের ওপর ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। নীরা দরজা আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল,’প্লিজ আশফাক শুধু একটা বার বিশ্বাস করুন আমায়। আমি সত্যিই এসবের কিছু জানি না। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমি..আমি অসতী নই আশফাক আমি অসতী নই। আমার গর্ভের সন্তানের দেহে শুধুমাত্র আপনার রক্ত বইছে। শুধুমাত্র আপনার। মিজানের সাথে আমার কোনোদিন কোনো সম্পর্ক তৈরী হয়নি। আশফাক…’ ডুকরে কেঁদে উঠল নীরা।

তারপর আবার দরজা করাঘাত করতে লাগল,
‘মা…ওমা..মা.. দরজাটা খুলুন না মা। বিশ্বাস করুন আমি আপনার ছেলেকে ঠকাই নি। আপনাদের কাউকে ঠকাই নি। আমি শুধু আপনার ছেলেকেই ভালোবাসি। আশফাক ব্যতিত অন্য কারো জায়গা আমার এই মনে নেই মা, বিশ্বাস করুন। অামি শুধু আপনাকে ভালোবাসি আশফাক শুধু আপনাকে।’

নীরা এভাবে বহুক্ষণ দরজা ধাক্কালো। কিন্তু কেউ দরজা খুলে দিল না। অবশেষে বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো নীরা।

নীরাকে বের করে দেওয়ার পর আশফাক রাগের বশবর্তী হয়ে বেডরুমের সমস্ত জিনিসপত্র ভাঙ্গচুর করল। নীরার ব্যবহৃত সমস্ত জিনিস এমনকি নীরার সমস্ত ছবিও পুড়ে ছাই করে ফেলল সে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here