অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -০১

বাজির মতো পরপর দুটো বিকট শব্দে সন্ধ্যার নীরবতা ভঙ্গ হয়ে যায়। তারপরেই কান্না আর আহাজারির রোল উঠল। নিরুপমা দৌড়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। রাস্তায় মানুষের জটলা। কারণটা কী এখানে দাঁড়িয়ে ঠিক বুঝতে পারছে না৷ এমন সময় ওর মা ভেতরের ঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন,

“ভর সন্ধ্যে বেলা আবার কেডায় মরল রে নিরু? শান্তি মতো দুদন্ড চোখ বন্ধ করার জো নেই। দুনিয়ার এত জায়গা থাকতে তুই ভাড়া নিলি এই বস্তি এলাকায়। তা নিবি না ক্যান। জন্মের পর থেইক্যা আমারে শান্তি দিছোস, যে এহন দিবি।
ওই ছেরি জবাব দ্যাস না ক্যান?”

এখান দাঁড়িয়ে জবাব দিলে রাস্তার লোকগুলো শুনতে পাবে। মুখ তুলে তাকাবে ওর দিকে। নিরুপমা তা চায় না। চুপ করে রইল। কিন্তু ওর মা জবাব না পাওয়া পর্যন্ত চুপ থাকবে না।

স্বামীর মৃত্যুর শোক তারপর পক্ষাঘাতগ্রস্ততার ধাক্কায় নীলুফা বেগমের মাথায় খানিক দোষ ধরা পড়েছে। সামান্যতেই রেগে যান। ধৈর্যের কাছেও ঘেঁষেন না। রাগলে তাঁর মুখে শ্রাব্য অশ্রাব্যের পার্থক্য থাকে না। নিরুপমা জবাব দেয়নি বলে রেগে গেলেন৷ যাচ্ছে তাই ভাষায় গালি-গালাজ শুরু করেছেন। সেসব ভাষা কোনো মা তাঁর মেয়েকে বলে না, হয়তো একজন স্বাভাবিক মানুষও বলে না অপরকে৷ কিন্তু ও জানে ওর মা আর আগের মতো স্বাভাবিক নেই। তবুও ওই অশ্রাব্য ভাষাগুলো শুনে গা ঘিনঘিন করে। ব্যালকনি থেকে সরে যাবে তখনই রাস্তার অপরপ্রান্তে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনতে পেল। ছুটে গেল নিরুপমাদের ভাড়া বাড়ির সামনে দিয়ে পূর্ব দিকের অন্ধকার গলিতে। এখান থেকে পূর্ব দিক যতদূর তাকানো যায় ও তাকিয়ে রইল।

“নিরুপমা?”

নিচ তলার সামনে দাঁড়িয়ে বাড়িওয়ালা চাচা ওকে ডাকছেন। কালো, লম্বা হ্যাংলা গড়নের মানুষটা। পঞ্চাশোর্ধ হবে হয়তো। তাঁর নিত্যদিনের পোশাক খাদি পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। মাঝে মাঝে টুপিও পরেন। আজ মাথায় টুপি আছে। তাঁর ডাক শুনে রাস্তায় দাঁড়ানো কয়েকজন দোতলার দিকে তাকায়। নিরুপমার বড্ড অস্বস্তি হয়। ব্যালকনিতে আলো নেই। রাস্তার হেডলাইটে ময়লা জমেছে। সেই আলোও তেমন তীব্র নয়। মৃদু আলোতে বাড়িওয়ালা ওকে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে না। ওর গায়ের শ্যামলা রঙ সহজেই অন্ধকারে মিশে গেল। ব্যালকনির অন্ধকার আরেকটু সরে দাঁড়ায়। মাথার ওড়নাটা সামনে টেনে জবাব দিলো,

“জি, চাচা।”

“মা, একটু দেখে এসো তো ছাঁদের দরজায় খিল দেওয়া কি না। রাতে তোমাদের ঘরের দরজাও ভালো করে এঁটে রেখো। দেখি আমি কালই গিয়ে বাড়ি ঘেরার ব্যবস্থা করে আসব। দিনকাল যা পড়েছে! তোমার চাচিরা সবাই গেল ও বাড়ি। আমাকেও তো যেতে হবে। হাজার হোক আত্মীয় বলে কথা।” একমনে বিড়বিড় করলেন তিনি। বেশ উদ্বিগ্ন তাঁর মুখ। নিরুপমা ইতস্তত করে শেষমেষ প্রশ্নটা করেই ফেললো,

“কিছু কি হয়েছে চাচা?”

“শুধু কিছু না মা, সাংঘাতিক কিছু। পুব দিকের পাশা হকের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। তাঁর ছোটো ছেলে গুলিবিদ্ধ। অবস্থা আশঙ্কাজনক। তোমার চাচির বোনের ছেলে। সে কী আর ঘরে থাকতে পারে এই অবস্থায়?
আজ রাতে ফিরতে নাও পারি। যাও মা, তাড়াতাড়ি গিয়ে ছাদের দরজা লাগানো কি না দেখে আসো। সাবধানে থেকো। আমি গেলাম।”

জবাবের আশা না করেই তিনি পুব দিকে হাঁটা ধরলেন। নিরুপমা আগের মতো ভীতু নেই। বাবার হঠাৎ মৃত্যু, মায়ের স্বাভাবিকতা হারানোর পর জীবনকে ও নতুনভাবে, খানিক নির্মমভাবে দেখেছে। মেয়ে মানুষ ভয়-ডর নিয়েই চলে। নিরুপমাকে জোর করে ভুলে চলতে হয়। কিন্তু বাড়িওয়ালা চাচার কথায় ওর মন কেমন যেন করছে।

দোতলা এই বাড়িটিতে বর্তমানে ওরাই একমাত্র ভাড়াটিয়া। সামনের রুমগুলো এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি৷ ইটের গাঁথুনি অর্ধেক তুলেছে কেবল। নিচতলার পুরোটা নিয়ে বাড়িওয়ালা থাকেন। নিচতলা বললেও ওটা বেশ উঁচু সামনের রাস্তার তুলনায়। আজ এই বাড়িতে ও একা থাকবে জেনে কেমন যেন লাগছে! একা! মা আছে না? নিরুপমা মনে মনে হাসে সেই সান্ত্বনা শুনে।

দেড় রুমের এই ফ্লাটে নিরুপমা মাস তিন হয় উঠেছে। ও আর মা। দুজনের জন্য বেশ। বাবার পেনশনের ভাগের টাকায় এরচেয়ে ভালো ভাড়া বাসা ও আর পায়নি। কিন্তু এই এলাকায় ঢুকতে ওর মা অসন্তোষে ফেটে পড়েন। এমন অনুন্নত, ঘিঞ্জি মহল্লায় ফের বাস করতে হবে? ভাগ্য ফের তাঁকে অতীতের দুরবস্থায় ঠেলে দিলো! এই দিন দেখবেন বলে তো ওমন দোজবেরে লোকটাকে বিয়ে করেছিলেন না। দিনরাত ভাগ্যকে কষেন তার সাথে নিরুপমাকে। দুটোই যেন এক, অপয়া।

“কতক্ষণ ধইরা চিল্লাইতাছি শুনতে পাস নাই। তোর কানে আমি গরম পানি ঢাইলা দিমু ছে-না-ল। আমার পা দুটো চলে না বইলা খুব বাড় বাড়ছে তোর? আমার ডাহে জবাব দেস না। মর মা-গি, মইরা ধুইয়া যা। মর।”

মেয়েকে দেখতে পেয়ে ফের গা-লি শুরু করলেন নিলুফা বেগম। নিরুপমা না শোনার ভান ধরে সদর দরজার খুলে বেরিয়ে এলো। সিঁড়িতে আলো নেই৷ লাইটটা সাথে আনতে ভুলে গেছে। আজকাল বড্ড ভুল হচ্ছে কি! দরজার দিকে ফের ঘুরতে থমকে দাঁড়ায়। মা রাগে গজরাচ্ছেন আর বকছেন। সামনে দেখলে আবার বকবেন। নিরুপমা সিঁড়ির দিকে ঘুরল। এইটুকু অন্ধকারে আর কী হবে! ধীর পায়ে উঠে ছাঁদের দরজার কাছে গেল। দরজা হা করে খোলা। শা শা করে বাতাস বইছে। ঘরে বসে এই বাতাস এতটা টের পাইনি। বড়ো ভালো লাগল নিরুপমার। দরজা না লাগিয়ে ছাঁদে পা রাখে। চারিদিক থেকে ধেয়ে আসা প্রবল বাতাসের ঝাপটায় ওর ওড়না সরে গেল। খোঁপা খুলে চুল এলোমেলো হলো। বেপরোয়া উড়ছে।

মাথা তুলে তাকাল নিরুপমা। রুপোলি চাঁদ আকাশে। জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ছে জমিনে। চোখে ঘোর লাগে ওর। এমন সৌন্দর্যে কার-ই না ঘোর লাগে!

এই বাড়িটির পেছন দিকে জঙ্গলি গাছের ঝোপ। কয়েকটার ডালপালা ছাঁদ ছাড়িয়ে গেছে। বেশ মোটা আর পুরোনো গাছগুলো৷ ডানদিকের দুটো পরিত্যক্ত জমি পরে একটা বাড়ি। বা’দিকে ডোবা। তারপাশ দিয়ে পুব দিকের গলি। সামনের রাস্তার ওপাশে নতুন বাড়ি উঠছে। কদিন সেখানে কাজ বন্ধ। ওদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশপাশের বাড়িগুলো একটু ফাঁকা ফাঁকা। কিন্তু তার আগে ঘিঞ্জি মহল্লা। এদিকে যে হারে বালু ফেলে ডোবা ভরছে তাতে বছর কয়েক পরে এই স্থানেও ঘন বসতি গড়ে উঠবে।

অবাধ্য চুলগুলোকে কোনোরকমে ওড়নার তলে বন্দি করে পুবদিকে তাকালো নিরুপমা। ছাঁদে দাঁড়িয়ে আহাজারি আরও স্পষ্ট শুনতে পেল। মানুষের খুব ভিড় ওদিকটা। একটা মানুষ আরেকটি মানুষের বুকে কী অবলীলায় গুলি চালিয়েছে! আচ্ছা তখন তাদের দুজনের মনে কী চলছিল? একজনের মনে প্রতিহিংসা, ক্রোধ আর ঘৃণা। অন্যজনের মনে তখন মরণ ভয়। মৃত্যু কি ওদের সব কষ্ট দূর করেছে? যে গুলি চালিয়েছে তাকে আনন্দ দিয়েছে? মৃত্যু আনন্দ আনতে পারে? কখনোই না। মৃত্যু কেবল কষ্ট দেয়, যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। নিরুপমা তো তাই জেনেছে। অদূরের ওই ক্রন্দনরোলে জ্যোৎস্না বিলাস আর ভালো লাগে না।

হঠাৎ সিঁড়িতে একটা শব্দ হলো। চকিতে দরজার দিকের অন্ধকারে তাকাল ও। কেউ না। কিন্তু শব্দটা যে শুনেছে। মনের ভুল! তবুও সাবধানের মার নেই। ও খুব সতর্কে সিঁড়ির মুখে এলো। মনের ভুলই। কেউ তো নেই। একা একা এখানে না দাঁড়ানোই ভালো। নিরুপমা ছাদের দরজা লাগিয়ে ঘরে এলো। ওর মা বিছানায় শুয়ে পড়েছে।

“নিরু?”

ঠিক মায়ের মমতা জড়ানো গলায় ডাকলেন। অনেকদিন এমন ডাক নিরুপমা শোনেনি। ওর মা পাশ ফিরলেন না। বকতে বকতে একসময় তিনি ক্লান্ত হয়ে যান। কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকেন। সচারাচর এর ব্যতিক্রমও ঘটে। তখন ওর মা একদম স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না সময়টা।

“বলো মা।”

সদর দরজা লাগিয়ে মায়ের ঘরে লাইটের সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে মায়ের পাশে বসল।

“তুই আমার ওপর রেগে আছিস, না?”

“একদম না।”

“মিথ্যা বলছিস তুই। কই তখন যে নিরু, নিরু বলে ডাকলাম জবাব দিলি না!” বাচ্চাদের মতো গলা ভিজে এলো নিলুফা বেগমের। নিরু কপাল কুঁচকে ফেলল,

“কখন? আমি তো এখনই এলাম মা।”

“আবার মিথ্যা বলছিস? এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে? একটু আগেই না ঘরে ঢুকলি। কত ডাকলাম, জবাবই দিলি না।”

নিরুপমা শঙ্কিত হয়ে ঘরের এদিক ওদিক তাকালো। ওই শব্দটার কথা বার বার মনে পড়ছে। ওর মাও কি শুনেছে সেটা?

“তুমি আমাকে দেখেছিলে?”

“না, লাইটটা বন্ধ করে দিলি যে ঘরে ঢুকেই। চোখটাও কি আর আগের মতো আছে। কিন্তু তুই ছাড়া আর কে ঢুকবে? কেন আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছিস বল তো?”

ধ্বক করে উঠল নিরুপমার বুকের ভেতর। বাইরে যাওয়ার আগে তো এই ঘরের লাইট নিভিয়ে যায়নি। সুইচটা অবশ্য দরজার কাছে। মা লাঠি দিয়ে ওটা প্রায়ই অন-অফ করতে পারেন৷ এখনও নিশ্চয় তেমন করেছেন তারপর ভুলে গেছেন। এছাড়া আর কী! মনের ভয়টাকে আস্কারা দিতে চায় না নিরুপমা। মাকেও জেরা করা ঠিক হবে না। ঠান্ডা মেজাজ ফের চড়ে যাবে। উঠে দাঁড়ায়। প্রসঙ্গ পালটে বলে,

“আমি রাগ করিনি মা। তোমাকে আমি এত ভালোবাসি যে রাগ আসেই না।”

রান্নাঘরের আর বাথরুমের লাইট জ্বেলে ভালো করে দেখে নিলো নিরুপমা। নিলুফা বেগম খুশি হলেন। উঠে বসে বললেন,

“সত্যি বলছিস?”

“খুব সত্যি মা। এবার বলো রাতে কি খাবে? ইলিশ মাছ বের করি ফ্রিজ থেকে? হালকা ভেজে ভাত মাখিয়ে দেবো, হ্যাঁ?”

নিরুপমা নিজের ঘরের দিকে গেল। এই ঘর অবশ্য অন্ধকারই ছিল। তবুও আলো জ্বালালো। চোখ বুলিয়ে নিলো সর্বত্র। সন্দেহজনক কিছু নজরে এলো না। মনে মনে খানিক স্বস্তি পেল। ও ঘর থেকে নিলুফা বেগম সোৎসাহে বললেন,

“ইলিশ! হ্যাঁ বের কর। কিন্তু ভাজিস না। কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, তেল, হলুদ, নুন আর জিরে চটকে বেশ খানিক পানি দিয়ে মাছটা জ্বাল দিবি। তোর বাবা পছন্দ করতেন। মানুষটা বেশ ভোজনরসিক ছিল। আমার হাতের রান্না সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। তোর বড়ো মায়ের রান্না না কি মুখে যেত না৷ এ নিয়ে কম হিংসে করত তোর বড়ো মা। আমাকে কী বলত শুনবি…..”

নিলুফা বেগম সতীনের অত্যাচারের সেই নিষ্ঠুর স্মৃতিগুলো মেয়েকে শোনাতে লাগলেন। নিরুপমার আটাশ বছরের জীবনে আটাশ শতবারেরও বেশি শুনেছে মায়ের মুখ থেকে। অন্য সময় হলে দুঃখ প্রকাশ করত। এখন মনোযোগ অন্যদিকে। ব্যালকনিও ঘুরে এলো একবার। মনেরই ভুল। মা আর ও ছাড়া কেউ নেই। মায়ের কথার গুরুত্ব দেওয়া বোকামি বটে। তাঁর কি মাথা ঠিক আছে!

বাবার পছন্দের ইলিশ ঝোল রাঁধতে বলেও খেলেন না ওর মা। মৃত স্বামীর কথা মনে করে কাঁদলেন। নিরুপমার অনেক অনুনয়ে দুধ মাখিয়ে দুগাল ভাত খেল। এরজন্য বকাও শুনতে হলো ওকে। মরা বাপের কথা স্মরণ করে কেন কাঁদল না! কেন খেতে জোর করল! কী পাষাণ তাঁর মেয়েটা! সব অভিযোগ, তিরস্কার চুপ করে শুনে একপ্রকার যুদ্ধ করে মা’কে ঔষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিলো৷ যতক্ষণ না ঘুমালেন শিওরে বসে মাথা টিপে দেয়। মা ঘুমিয়ে পড়তে উঠে গেল। রাতে অল্পই খায় ও। এক টুকরো মাছ ভেঙে অর্ধেক করে খেল। বাকিটা ফ্রিজে রেখে রান্নাঘর পরিষ্কার করে রুমে ফেরে৷ চুল বাঁধার ঝামেলায় আজ আর গেল না। শুয়ে পড়ল বিছানায়।

রাত অনেক হয়েছে৷ বিছানায় শুয়েও ঘুম এলো না৷ ও ঘর থেকে মায়ের নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্যদিনের চেয়ে আজকের রাতটা যেন বেশি থমথমে। ভূতের ভয়ের চেয়ে অন্য এক ভয় ওকে বেশি ধরেছে। এপাশ-ওপাশ করল। মায়ের কথা আর সেই শব্দ ও ভুলতেই পারছে না। সিঁড়ির সেই শব্দটা কীসের ছিল? মানুষের পায়ের শব্দ না ভিন্ন কিছু! আবার ওসব ভাবছে! সব মনের ভুল। আল্লাহর নাম নিতে নিতে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুমিয়েও গেল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল কে জানে! হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছে। কেউ যেন প্লেট, পাতিল নাড়ছে। ঘুম জড়ানো চোখে ভালো করে শব্দটা শুনতে চাইল। এবার আর মনের ভুল না। চোখ মেললো। তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়। ওর মাথার কাছে সবসময় কাঠের মোটা লাঠিটা রাখা থাকে। একা থাকলে কত কী রাখতে হয়।

আলো না জ্বেলে লাঠি তুলে পা টিপে টিপে চললো রান্নাঘরের দিকে। মায়ের ঘর পেরিয়ে রান্নাঘর। মা অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। ঘুমের ঔষুধের প্রভাবে বিকট শব্দেও তার এখন ঘুম ভাঙবে না। তাঁর মেয়েটিকে তাঁর চোখের সামনে মেরে ফেললেও টের পাবেন না তিনি। নিরুপমার গলা ধরে এলো। আরও এগিয়ে যেতে ভারি পায়ের শব্দ কানে আসে। সেই সাথে নিরুপমার বুকের ধুকপুকানিও বাড়ে৷ হঠাৎ ও থেমে যায়। এখন ফুলন দেবী সাজতে যাওয়া বোকামি। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকলেই হয়তো ভালো হবে। পরে বিপদ বুঝে ব্যবস্থা নেবে৷ নিরুপমার অস্থির মস্তিষ্কের বুদ্ধিতে তখন যা এলো তাই করল ও। ফিরে এলো রুমে৷ লাঠিটা কাছাকাছি রাখল। চোখ বন্ধ করলেও কান দুটো সতর্কে খাঁড়া। মিনিট খানেক পরে এই ঘরে পায়ের শব্দ। একটু থামল। নিরুপমা পিটপিট করে তাকাতেই একটা ছায়া দেখতে পেল। লম্বা ছায়ামানবটি ঠিক ওর পায়ের সোজা খাটের মাথায় দাঁড়ানো। কোনো অশরীরির যেন। কিন্তু ও জানে এ ঠিক অশরীরী নয়। দৃষ্টি স্থির ওর দিকে। নিরুপমার বুক কাঁপছে। ঘেমে নেয়ে একাকার। ছায়ামানবটি ওর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। নিরুপমা কী করবে এখন? উঠে লাঠিটা দিয়ে আক্রমণ করবে? সুযোগ মতো সোজা ওর মাথায় বসিয়ে দেবে৷ ব্যস! কেল্লাফতে। কিন্তু ওইটুকু সাহসই নেই ওর দেহে। ছায়া মানব ওর সামনে বসল। একটু ঝুঁকে আসতে নিরুপমা লাফ দিয়ে উঠল। ছায়া মানব কিছু বুঝে ওঠার আগেই লাঠিটা দিয়ে সজোরে দিলো বাড়ি৷ কিন্তু হায়! ওর লাঠির গতিকে হারিয়ে দিয়ে ছায়ামানব সরে যায়। লাঠির আঘাত তার মাথায় না কাঁধে লাগল। ব্যথায় গোঙানি দিয়ে উঠল৷ তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরুপমার ওপর। এক হাতে ওর লাঠি ধরা হাতটি অন্য হাত ঠোঁটের ওপর।

“চিৎকার করবেন না। ফেলে দিন হাতের লাঠিটা। ফেলুন।” ব্যথাতুর গলায় বলল ছায়ামানব।

নিরুপমা আরও শক্ত করে ধরে আছে লাঠিটি। পা দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে। ছায়ামানব তাতে রেগে যায়।

“শান্ত হোন, শান্ত হোন বলছি।” চাপা অথচ কর্কশ গলায় ধমকে ওঠে। ভয় পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য শান্ত নিরুপমা। ছায়ামানব কৌশলে ওর হাত থেকে লাঠিটি দূরে ফেললো। নিরুপমার নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। ছায়ামানব বুঝল যেন। হাত ঢিলে করল। কিন্তু সরালো না। নিরুপমার মাথা কাজ করছে না। ছাড়া পেয়ে ফের চিৎকার করে উঠতে ছায়ামানব আবার ওর মুখ চেপে ধরে। বিরক্তভরা হাঁপ ছাড়ল।

“জানতাম যা বলব উলটোই করবেন। যখন কেউ বলে শান্ত হতে শান্ত হতে হয়। নয়তো অপরজন বাধ্য হয় শান্ত করতে।”

তারপরেই মাথায় খুব জোরে কিছু আঘাত করতে নিরুপমার চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে এলো। চেতনা হারালো কিছুক্ষণের মধ্যে।

আবার যখন চোখ খুললো তখন প্রায় রাত্রি দ্বিপ্রহর। ঘরময় জ্যোৎস্নার আলো লুটোপুটি খেলছে। সেই আলোতে পায়ের কাছে খাটে আধশায়িত ছায়ামানবকে দেখতে পেল। দুচোখ মুদে আছ। জ্যোৎস্নার আলোয় ছায়ামানব এখন রক্তমাংসের মানুষ। পরনে টিশার্ট আর.. মাথা ব্যথা নিয়ে নিরুপমা সভয়ে শোয়া থেকে উঠে বসতে গিয়ে টের পেল ওর হাত ও পা বাঁধা। মুখে কাপড় গুঁজে দিয়েছে। নড়াচড়া করতে যুবক চোখ মেলে তাকায়। নিরুপমা দুচোখে ভয় নিয়ে যুবকের ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে রইল। যুবক হাত চালালো অবিন্যস্ত চুলে। যেন ভীষণ বিরক্ত। সরে এলো নিরুপমার দিকে। এবার ওর মুখে চাঁদের পূর্ণ আলো পড়েছে। রক্তমাংসের ছায়ামানবের মুখ স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে নিরুপমা। একমাথা এলোমেলো বাবরিচুল, মুখ ভর্তি আগাছার মতো বেড়ে ওঠা দাড়ি গোঁফ। বড়ো বড়ো চোখদুটোতে সে কী নিস্পৃহতা!

“ঘুম ভাঙল, অমাবস্যা?” বিদ্রূপের সুরে বলল সে। চোয়ালের দাঁড়ি চুলকে উঠে দাঁড়ায়। নিরুপমার দৃষ্টি তখনই পড়ে যুবকটির ডান হাতের ধাতব বস্তুটির ওপর। পি-স্ত-ল! ভয়ে ওর শরীর জমে যায়। ওর আতঙ্কিত মুখে চেয়ে যুবক হাসল। শব্দহীন হাসি। তবুও শিউরে উঠল নিরুপমা। সে আরও কাছে এলো। ধাতব বস্তুটা নাড়াচাড়া করে বলল,

“আশা করি এবার চিৎকার করার ভুলটা করবেন না, করবেন কী?”

সবেগে মাথা নাড়ায় দুদিকে নিরুপমা। যুবকের ঠোঁট একপাশে বেঁকে গেল। ওর মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে ফের বলল,

“গুড, গার্ল।”

খুক খুক করে একটুখানি কেশে স্থির হয় ও। সভয়ে বলে,

“আমি কাওকে কিছু বলব না। প্লিজ ছেড়ে দিন। চলে যান এখান থেকে।”

“তারমানে আপনি বুঝতে পেরেছেন আমি কে?” ব্যালকনির দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় যুবকটি। নিরুপমা ঢোক গিললো।

“আমি জানি পাশা হকের ছেলেকে আপনিই গুলি করেছেন। আপনি একজন খু_” যুবক ঘাড়ের ওপর থেকে ওর দিকে ভুরু তুলে তাকাতে নিরুপমা চুপসে যায়।

“ক্লেভার গার্ল আপনি মিস অমাবস্যা। মেয়েদের এতটা চালাক হতে নেই।” শেষ কথাটা বিড়বিড় করে বলে ফের সামনে ঘুরে তাকায়। প্রথমবার যখন অমাবস্যা বলেছিল নিরুপমা শুধরে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। কিন্তু বারবার একই ভুল কার ভালো লাগে। সেটাও নিজের নামের।

“আমার নাম অমাবস্যা নয় নিরুপমা।”

যুবক ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে মৃদু শব্দে হেসে ওঠে। দিয়াশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট পুড়িয়ে লম্বা টান দেয়। ধোঁয়া ছেড়ে ওর দিকে ফিরে বলে,

“নিরুপমা? না, ওই নাম আপনার জন্য না। কারণ আপনার উপমা অমাবস্যার সাথে বেশ যায়।”

চলবে,,,
#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব: ০১
লেখনীতেঃ তানিয়া শেখ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here