#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-২১
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট বসে আছে দুর্জয়। চারপাশে এলিট শ্রেণীর মানুষেরা।হৈ-হুল্লোড় নেই। প্রশান্তিদায়ক স্থান। সামনে দামী দামী সুস্বাদু খাবারের পসরা। চমৎকার পরিবেশ।কিন্তু, দুর্জয়ের চমৎকার লাগছে না। সকাল থেকে তেমন কিছু খায়নি ও। এত এত সুস্বাদু খাবার সামনে পেয়েও খাওয়ার রুচি নেই। কারণটা কী? বিয়ে! দুর্জয়ের ভেতরটা হাঁসফাঁস করে বিয়ে নামক শব্দ মনে করতে।
পরশু গ্রাম থেকে দুর্জয়ের আব্বা কল করেছিলেন। মারিয়ার পরিবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। পাশাপাশি গ্রাম ওদের। একই কলেজে পড়েছে। একই সাথে ডাক্তার হয়েছে। এখন সহকর্মী ও বন্ধু। মারিয়া সুন্দরী, স্মার্ট, বুদ্ধমতি ও অভিজাত। ওকে অপছন্দ করার মতো কিছু নেই। যে কোনো পুরুষকে আকৃষ্ট করবে এক পলকে। এক দশকের বেশি সময় ধরে মারিয়ার সাথে পরিচয় কিন্তু বন্ধু ভিন্ন অন্য কোনো নজরে দেখেনি ওকে দুর্জয়। আকর্ষণবোধ করেনি। ওকে বিয়ে করতে তাতেই কি সংকোচ?
“ছয় নম্বর ওয়ার্ডের পেশেন্টের অবস্থা এখন কেমন?” মারিয়া জুসের গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল। দুর্জয় ওকে ছাড়া আশপাশে তাকায়,
“স্ট্যাবল।”
“ওহ!”
এরপর আবার সেই নীরবতা। এমনটা কিন্তু হয় না। ওরা একসাথে বসলে কথা হারায়নি। আজ যেন দুজনেই সংকুচিত। মারিয়া আড়েঠাড়ে ওকে দেখছে৷ তাতেই ঘামছে দুর্জয়। অথচ, আগে চোখে চোখ রেখে কথা বলত। কয়েকবার ভেবেছে উঠে যাবে। উঠে যেতে আর পারছে না। মারিয়া কী ভাববে! বাবার কানে গেলে!
“তোমার কি কিছুই বলার নেই, দুর্জয়?” বলল মারিয়া। জোরপূর্বক হাসল দুর্জয়,
“কী বলব সেটাই ভাবছি।” বিড়বিড় করে একটু পরে শব্দ করে বলল,
“তুমি কী চাও ম্যারি?”
“যদি বলি তোমাকে, তবে কি তোমার মধ্যে থেকে অস্বস্তিভাবটা যাবে?” দুর্জয় একটু যেন লজ্জিত হলো। মারিয়া সংকোচ কাটিয়ে সহজ গলায় বলল,
“শোনো দুর্জয়, আমি সোজাসাপ্টা কথা বলা পছন্দ করি। তোমার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার আগে আব্বু আমার মত জানতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে তোমার মতো ছেলে পাওয়া আজকাল রেয়ার। এখনই তিনি তোমাকে একজন ভবিষ্যৎ সেরা এনেস্থেসিওলজিস্ট মনে করেন। তাঁর মেয়ে হয়ে আমার তো সেই মতকে সম্মান দেখানো উচিত, তাই না? আমি হ্যাঁ বলেছি। ডোন্ট ফ্লাটারইওরসেল্ফ বাট অনেস্টলি বলছি তুমি যে কোনো মেয়ের স্বপ্নের প্রিন্স চার্মিং। সো ইয়া, আই ওয়ান্ট ইউ। অ্যাজ অ্যা ফ্রেন্ড, ফিয়োন্সি অ্যান্ড ইন ফিউচার অ্যাজ অ্যা লাইফ পার্টনার। তোমার অমত থাকলে বলতে পারো। সেই জন্যই মূলত এই ডেট। এখন তুমি বলো, তুমি কী চাও?”
দুর্জয় কী চায়! গত কয়েকদিন খুব ভেবেছে। এখনও ভাবছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে ও। জীবনে কোনো ব্যাপারে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। রিয়েলিটিতে বিশ্বাসী। সেই নিক্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খুব চট করে নিয়েছে। কিন্তু এই এক ব্যাপারে ওর এত সিদ্ধান্তহীনতা!
“তোমার কি অমত রয়েছে?”
“ম্যারি, আমি আসলে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই। তুমি আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। এ ভিন্ন অন্য নজরে তোমাকে সত্যি দেখিনি।”
“তোমার ধারণা আমি অন্য নজরে দেখেছি? নো। তবুও এই বিয়েতে আমি মত দিয়েছি। কেন জানো? কারণ আমি প্রাকটিকাল। আমার মনে হয়েছে আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জায়গাটা ভালো। অজানা কারো চাইতে তোমার সাথেই সংসার করা সহজ হবে৷ তাছাড়া আমরা দুজনে শীঘ্রই রেসিডেন্সির জন্য পেনসিলভানিয়ায় যাচ্ছি। সহকর্মীর থেকে হাজবেন্ড ওয়াইফ হিসেবে গেলে মন্দ হবে না। বরং নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। একে অপরকে ও অপরের কাজকে বুঝব ভালো। সব ভেবেই আমি মত দিয়েছি। আমার যতদূর ধারণা তোমার পছন্দের কেউ নেই। তাহলে বি প্রাকটিকাল দুর্জয়। আর যদি কেউ থাকে তো! আছে কি কেউ?”
মারিয়া ভ্রু তোলে। দুর্জয়ের গলা শুকায়। বলল,
“কেউ নেই।” কথাটা কেমন অবিশ্বাস্য শোনালো ওর কাছেই। কিন্তু সত্যিই বলেছে। পছন্দ বলতে যা বোঝাতে চাচ্ছে তেমন কেউ তো নেই ওর।
“তাহলে আজ থেকে অন্য নজরে দেখা শুরু করো আমাকে। বিয়ে আমি তোমাকেই করব। তোমার যদি প্রেম টেম ফ্যান্টাসি থাকে তো নো প্রবলেম। আমরাও প্রেম করব। আহামরি কিছু তো নয়। বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো। যা হেল্প লাগবে আমি করব। আচ্ছা, আমাকে তো তোমার অপছন্দ নয়?”
“না।”
“তাহলে তোমার বাবাকে হ্যাঁ করে দিয়ো। আমাদের উভয়ের জন্যই এটা ভালো হবে। এক্সকিউজ মি।”
মারিয়ার মোবাইল বেজে উঠল। দুর্জয়ের মাথা ভার ভার লাগছে। মারিয়াকেই তবে বিয়ে করতে হবে! খারাপ তো হবে না। মারিয়ার কথা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু কী সহজভাবে বলে গেল। ও এমনই। সবকিছুতে প্রাকটিকাল। প্রাকটিক্যালি ওকে বিয়ে করলেই দুর্জয় লাভবান হবে। কিন্তু বিয়ে তো বিজনেস না। দুর্জয় আধুনিক হলেও ওর মনটা বোধহয় সেকেলে। নয়ত এই লাভেও খুশি হতে পারে না কেন?
“আমি তাহলে উঠছি দুর্জয়। ক্লিনিক থেকে কল এসেছে।” ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মারিয়া। আশেপাশের কয়েকজনের দৃষ্টি ওর দিকে ওঠে সাথে সাথে। ক্রিম রঙের সুন্দর পাকিস্তানি থ্রি পিস পরেছে। গায়ের রঙের সাথে পোশাক যেন মিলেমিশে গেছে। স্ট্রেইট চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো। মুখে মানানসই মেকাপ। গহনা বলতে ওই একজোড়া সাদা পাথরের ছোট্ট কানের দুল আর হাতে দামী ঘড়ি। যে কেউ ওকে পেলে ভাগ্যবান মনে করবে নিজেকে। যেচে এসেছে বলেই কি এমন উদাসিনতা দেখাচ্ছে ও?
“স্ট্রেস নিয়ো না। প্রিন্স চার্মিওয়ালা মুখে এত চিন্তা ভালো দেখায় না। বাসায় গিয়ে ঘুম দাও। চললাম।”
মারিয়া চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও দুর্জয় সেখানেই বসে রইল। দমকা বাতাসের মতো একরাশ ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরে। সিটে হেলান দিলো। চোখ বুঁজবে এমন সময় কেউ ডেকে উঠল,
“এই ঈপ্সা!”
দুর্জয়ের স্থবির ভেতরটায় মুহুর্তে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। চকিতে তাকায়। কিছুটা হতাশা, কিছুটা স্বস্তি পায় যখন দেখে এ সেই ঈপ্সা নয়। কিন্তু পরক্ষণেই ওর বোধ নাড়া দেয়। ঈপ্সার নামে এতটা বিচলিত কেন হবে? ও তো কেউ না। গুম ধরে বসে রইল। রাগ হচ্ছে। কেন হচ্ছে, কার উপর হচ্ছে ও জানে না। তবে সূত্র ওই এক নামে। ঈপ্সা! দুর্জয় সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো মারিয়াকে ও বিয়ে করবে। নয়তো কে জানে ওই এক নাম ওর ধ্বংসের কারণ হবে না!
শুক্রবার ছুটিরদিন। নিরুপমা এই দিনটায় ঘর গোছগাছ করে। দুপুরের রান্না দেরিতে বসায়। পাশের মসজিদের মাইকে ভেসে আসছে জুম্মাবারের খুতবা। ঘর মুছতে মুছতে খুতবা শুনতে লাগল ও। ওর মা চুলে তেল নিচ্ছে। মাঝে মাঝে বিলি কেটে উকুন এনে দু নখে চেপে চেপে মারছেন। মুখে কী সব বিড়বিড় করছেন।
ভাত চড়ানো চুলায়। মাড় উতলে পড়ার শব্দে ঘর মোছার ন্যাকড়া ফেলে উঠে দাঁড়াল নিরুপমা। চুলার জ্বাল কমিয়ে ফিরে আসতে সদর দরজার নক পড়ে।
“এই সময় আবার কেডা আইল?” আপনমনে বিরক্তি নিয়ে বললেন নিলুফা বেগম। বাড়িওয়ালা আসেনি তো! নিরুপমার বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে। লোকটাকে ওইদিনের পর থেকে এড়িয়ে চলছে।
“কী রে দাঁড়ায় আছোস যে? যা খোল দরজা।”
নিরুপমা ওড়নায় ভালোভাবে নিজেকে ঢেকে নিলো। দরজার কাছে গিয়ে বলল,
“কে?”
“আমরা কুরিয়ারের অফিস থেকে এসেছি।”
নিরুপমা কিছু অর্ডার করেনি। তাহলে কুরিয়ার অফিসের লোক ওর বাসার দরজায় কী করে? দরজা খুলে একপাশে দাঁড়াল। বাইশ ও ত্রিশের বয়সী দুজন হ্যাংলা পাতলা গঠনের পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। বয়স্ক পুরুষটি ভ্যানচালক। তাঁর জীর্ণ মলিন পোশাক তাই বলে।
“আসসালামু আলাইকুম।” কুরিয়ার বয় বলল। নিরুপমা মৃদু হেসে জবাব নেয়,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
“আপু, আপনি এয়ার কুলার অর্ডার করেছিলেন। সেটাই নিয়ে এসেছি।”
সামনের কার্টনে মোড়া বস্তুটাকে দেখিয়ে বলল ছেলেটা। নিরুপমা যেন আকাশ থেকে পড়ে। হঠাৎ ওর পেছনে কেউ এসে দাঁড়ায়। মানুষটা কে বুঝতে পেরে সরে দরজায় মিশে যায় নিরুপমা। বোরকায় আবৃত এহসাস ফিসফিস করে বলল,
“আমি অর্ডার করেছি। ভেতরে আসতে দাও।” বলেই নিরুপমার ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে। এই দৃশ্য দেখবে বলেই হয়তো এয়ার কুলার অর্ডারের কথাটা আগে বলেনি। নিরুপমাকে ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ না দিয়ে হেঁটে চলে গেল রুমে।
এয়ার কুলারের নাম শুনে নিলুফা বেগম পছন্দের খেলনা পাওয়া শিশুর মতো আপ্লূত হয়ে বলে উঠলেন,
“আমার জন্যে এয়ার কুলার আনছোস? আমি জানতাম, আমার মাইয়্যা আমারে কষ্টে থাকতে দিতো না। ও বাপ, এই যে এইহানে আনো ওইডা।”
কুরিয়ার বয় সে কথা শোনার আগে নিরুপমা থামিয়ে দিলো।
“মা, এটা তোমার জন্য আনা হয়নি।”
“তাইলে কার জন্য আনছোস?”
মায়ের আশাহত মুখটা দেখে নিরুপমার ভীষণ খারাপ লাগল। মায়ের কথার জবাব না দিয়ে কুরিয়ার বয়কে অপেক্ষা করতে বলে অন্যরুমে গেল। লোকটা ছদ্মবেশ ছেড়ে ফেলেছে। পরনে হালকা নীলের টিশার্ট আর কালো টাউজার। চুল উসকোখুসকো। মোবাইলে গেমস খেলছিল।
“ওদের কি আসতে বলব?” রুক্ষ গলায় বলল নিরুপমা। এহসাস গেমস খেলতে খেলতে বলল,
“কাদের?”
“যাদের এয়ার কুলার আনতে বলেছেন।”
“ওহ!” গেমসের টার্নিং পয়েন্টে আছে। এখন চোখ বা মনোযোগ সরালেই এহসাস হেরে যাবে৷
ওর এই ওহ শুনে রাগে নিরুপমার ব্রম্মতালু জ্বলছে। মোবাইলটাও এই লোক দখল করে নিয়েছে। সব দখল করে নিচ্ছে। নিরুপমার জানটা বাকি এখন৷
“ওহ? আমি কি ওদের গিয়ে ওহ বলব?”
এক পলক তাকায় নিরুপমার রাগান্বিত মুখে এহসাস। ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ একপাশে বেঁকে যায়। তারপর আবার গেমসে মনোনিবেশ করে বলে,
“ওদের বলো তোমার মা যেখানে বলে সেখানেই ওটা সেট করতে।”
“মানেটা কী?”
“মানেটা হলো, এয়ার কুলার আন্টির জন্য অর্ডার করেছি। এখন যাও৷”
“আপনাকে কে বলেছে ওটা অর্ডার করতে?”
“কেউ বলেনি৷ আমি আমার ইচ্ছার মালিক। কেন? তোমার কোনো সমস্যা আছে অমাবস্যা?” এহসাস তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। গেমে হারতেই হলো। বিরক্তে মোবাইল পাশে ছুঁড়ে ফেলে ভুরু তুললো ও। নিরুপমা ঢোকের সাথে গলার ঝাঁঝটা গলাধঃকরণ করল।
“আমি ওটা নেব না।” নমনীয় হলেও জেদ বজায় রইল নিরুপমার কথায়। এহসাসের চোয়াল কঠিন হয়,
“তোমাকে কে দিয়েছে? ওটা আন্টির জন্য।”
“আন্টিও নেবে না।”
“আন্টি বলেছে?”
“আমি যা বলব তাই।”
এহসাসের মেজাজ একটু আগেও ফুরফুরে ছিল। এই মেয়েটা সেটা বদলে দিয়েছে। এমনই করে। এহসাস তো চেষ্টা করছে সভ্য হতে, ধৈর্যশীল হতে। কিন্তু নিরুপমা বার বার ওর ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়। ওর নজরে এহসাস খু*নি, অ*ত্যাচারী, ডা*কাত… পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ লোক। হাজার ভালো কাজ করলেও সেটা অগ্রহনযোগ্য। বিছানা ছেড়ে উঠে এলো ওর সামনে।
“নিজেকে কী ভাবো? আমি যা বলব তাই! এই বাসার প্রাইম মিনিস্টার তুমি? আচ্ছা হলেও বা। বর্তমানে সেটা নাম সর্বস্ব। আমি যেখানে থাকি সেখানের সব ক্ষমতা আমার হয়। সুতরাং আমি যখন বলব দিন তখন দিন। আবার যখন রাত বলব রাতই ভাববে৷ ক্লিয়ার?”
নিরুপমা প্রতিবাদ করতে চায়। জ্বলন্ত চোখ দুটো নীরবে সেটাই যেন করে।
“ক্লিয়ার?” এহসাস ধমকে ওঠে। নিরুপমা চমকে যায়। ভয়ও পায়। মাথা নাড়ায় না আজ। ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে গেল। রাগ প্রকাশে ব্যর্থ হয়ে নিরুপমার জ্বলন্ত চোখ দুটো টলমল করে। এই টলমল জল বিধ্বংসী বানের জল হয়ে যদি বহু দূরে ভাসিয়ে দিতে পারত লোকটাকে!
চলবে,,,