অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -২২

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-২২
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

সকাল থেকেই নিরুপমার মাথাটা ভার ভার লাগছিল। স্বাদ গন্ধ তেমন পাচ্ছে না। একটু একটু নাক টানছে। বিকেলে সেটা আরও প্রকট রূপ নিলো। চোখ ও নাক দিয়ে অনবরত পানি পড়ছিল। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথাটা ঘুরে ওঠে। ঝাপসা হয়ে আসে সামনেটা। এই অবস্থায় সেই দিনের কাজ কোনোরকমে শেষ করে বিছানায় গা দেয়। ঘুম আর হয়নি। সারারাত মাথা যন্ত্রণায় বিছানায় ছটফট করেছে। মাঝরাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর উঠল। ভোরে কাঁপতে কাঁপতে উঠে ফজর আদায় করে রান্নাঘরে ঢুকতে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। কপালটা লাগে বেসিনের কোনে। কতক্ষণ বেহুঁশ ছিল জানে না। জ্ঞান ফিরতে বিছানায় আবিষ্কার করে নিজেকে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। কপালে যেন বেশি। কপালে ভেজা ভেজা লাগছে। তপ্ত চোখদুটো পিটপিট করে খুললো। শিওরে বসা মায়ের চিন্তিত মুখটা দেখতে পেল। জলপট্টি চিপে ওর কপালে দিয়ে নিলুফা বললেন,

“এখন কেমন লাগছে রে মা?” নিরুপমার কষ্ট খানিক কমে গেল মায়ের মমতাভরা গলা শুনে। কতদিন শোনে না।

“ও মা কানতাছোস ক্যান? কষ্ট হইতাছে? খালেদা ডাকতর ডাকছে। তুই ভালো হইয়া যাবি। কানদিস না।” চোখের পানি মুছে নিলেন হাতে। বড্ড শীতল ও প্রশান্তিদায়ক লাগছে মায়ের হাতটা।

“আমি এখানে কী করে এলাম মা?”

“জেগে উঠে তো তোকে এখানেই দেখলাম।”

” কিন্তু আমি মাথা ঘুরে রান্নাঘরে পড়ে গেছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।”
নিলুফা বেগম ভাবলেন মেয়েটা জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকছে। জবাব না দিয়ে জলপট্টি বদলে দিলেন। নিরুপমা জবাব না পেয়ে আবার ডাকে,

“ও মা, বললে না?”

সেসময় রান্নাঘরের দরজায় বোরকায় আবৃত এহসাস এসে দাঁড়ায়। নিলুফা বেগম বললেন,

“ও কি সত্যি কইতাছে খালেদা?”

“জি।”

জ্বরের ঘোরেও চমকে তাকায় নিরুপমা। মেয়েলি চিকন গলা। লোকটার ভারি গলার স্বরের সাথে কোথাও মিল নেই। কী অদ্ভুত! একটুও ভালো শোনাল না।

“আমি আরও ভাবছি জ্বরে আবোলতাবোল বকতাছে। ব্যথা টেথা লাগছে কোনখানে?”

নিরুপমা অস্ফুটে কেবল না বলে। কিন্তু কপালে চিনচিনে ব্যথা পেয়েছে। হয়তো সামান্য। মায়ের চিন্তা বাড়িয়ে দরকার কী!

“ও মা, ডাক্তারে আসতে নিষেধ করো। গোসল করার পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাব।”

“তুমি তো ডাক্তার তাই না?” নকল মেয়েলি গলাটা ওর জ্বর আরও বাড়ি দিলো যেন। চোখ দুটো পাকিয়ে রইল। লোকটা সেটা উপেক্ষা করে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

“উনি ওখানে কী করে।” মাকে জিজ্ঞেস করল ও। নিলুফা বেগম বললেন,

“উনি কারে কস?”

নিরুপমা ভুলেই গিয়েছিল লোকটাকে মা ওর বান্ধবী হিসেবে জানে। যার সাথে নিরুপমার তুই তুকারি সম্পর্ক। এই লোককে তুই বলতে খুব বাঁধে। তুই ও কেবল কাছের মানুষদের ডাকে।

“না মানে, খালেদা কী করে ওখানে?” বলল ও।

“কী আর করব? তুই অসুখে শয্যাশায়ী। খাওয়ন দাওয়ন তো লাগব তাই না? ও রানতে গেছে। শুধু রানতাছে! তোর গায়ে কম্বল দিয়ে, জলপট্টি আইনা আমারে বলল কপালে দিতে। দেখি একটু পর তোর গা মুছাইয়া দিতে কমু।”

“না!” নিরুপমা আঁতকে বলে। নিলুফা বেগম সপ্রশ্নে তাকাতে নিরুপমা গলা নামিয়ে বলল,

“গা মুছাতে হবে না। আমি গোসল করব।”

“গোসল করবি? পারবি?”

“পারতেই হবে।” বিড়বিড় করে বলল। নিরুপমার মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। পেট মুচরে ওঠে। বমির উদ্রেক হয়। ওয়াক ওয়াক করতে নিলুফা চিৎকার করে খালেদাকে ডাকেন। খালেদার ছদ্মবেশে এহসাস দৌড়ে এলো। হাতে একটা পাত্র। নিরুপমা ততক্ষণে মেঝে ভাসিয়ে দিলো বমিতে। খোলা চুলগুলো মুখের দুপাশে ঢেকে নোংরায় লুটিয়ে পড়বে তখনই এহসাস চুলগুলো গোছ করে ওর মাকে বলল,

“বেঁধে দিন। আমি পানি নিয়ে আসছি।” নিলুফা বেগম চুলগুলো হাতে নিতে এহসাস পানি নিয়ে এলো। ওর হাত মোজা ভেজা। সেই ভেজা হাতে নিরুপমাকে কুলি করিয়ে পানি পান করালো। ওইটুকু সময় নিরুপমার যেন চেতন ছিল না। যখন চেতন এলো লজ্জায় বিছানায় মিশে গেল। মেঝের নোংরা সেই লজ্জা আরও বাড়িয়ে দেয়। বিছানা ছেড়ে উঠতে চায়।

“কী করছিস?” বললেন ওর মা।

“মেঝে পরিষ্কার করতে হবে না?”

“তুই এই শরীরে পারবি না কি? শেষে আবার বেহুঁশ হবি। আমিও অকর্মা, অথর্ব হয়ে বসে আছি।”

“আন্টি, আমি করছি।” নিরুপমা চকিতে তাকাল লোকটা বলা লোকটার দিকে। বলল,

“না!” লোকটা ভুরু কুঁচকেছে। নিরুপমা না দেখেও বুঝতে পারে। নিলুফা বেগম বললেন,

“না কেন?”

“ও মেহমান মা। ওকে দিয়ে এসব করাব না। আমিই করছি।”

নিরুপমা উঠতে গেল। বালিশ থেকে মাথাটা তুলতে পারল না। নিলুফা বেগম মেয়েকে বিছানায় চেপে ধরলেন।

“চুপচাপ শুয়ে থাক। শরীর চলে না ও মেঝে পরিষ্কার করবে! বেশি কথা বলিস না। আবার বমি করে ভাসাবি। খালেদা মা, যাও কষ্ট করে মুছে দাও জায়গাটা।”

এহসাস এক পলক নিরুপমার নাখোশ মুখে তাকাল। নিরুপমার চাহনি ওকে নিষেধ করছে। এহসাস বুঝতে পারে। বুঝতে পারে বলেই এই কাজ ও অবশ্যই করবে। যাতে নিরুপমার না, অনীহা তাতেই যে এহসাসের আগ্রহ। কাপড় আর পানি এনে জায়গাটা পরিষ্কার করতে লাগল। পিঠটা নিরুপমার দিকে। যে লোকটাকে নিরুপমা অপছন্দ করে, যাকে চোখে সহ্য হয় না সে ওর উদগিরণ পরিস্কার করছে! জ্বরের তীব্রতায় চিন্তাশক্তি শিথিল হয়ে এলো। ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে মাথাটা। নিজেকে আজ ওর এত অসহ্য লাগছে কেন!

ডিনার টেবিলে বসলেই ইকরাম আজাদের খাওয়ার ইচ্ছে মরে যায়। একসময় টেবিলটা সর্বক্ষণ মুখরিত থাকত গল্পে আড্ডায়। নিয়ম করে পরিবারের প্রতিটি সদস্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসত। খেতে খেতে চলত এহসাস ও ঈপ্সার খুনসুটি। কাজলের ধমকে ওরা কেবল মিটিমিটি হাসত। কাজলকে একটুও ভয় পেত না। যত বায়না, দুষ্টুমি ওর সাথে। ওকে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত করে রাখত দুজন। এই বাড়ি মানুষে, হাসিতে, আনন্দে ও ভালোবাসায় ভরা ছিল। কাজলের সাথে সব যেন চলে গেছে। শূন্যতা এ বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে করুণ বীণা বাজিয়ে যায়। ইকরামের কানে তালা লাগিয়ে দেয়, বুকে শেল বিদ্ধ করে সে বিষাদ বীণার সুর। মুখে তোলা এক এক মুঠ আহার অরুচিকর লাগে। এ যেন জোর করে বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া।

“আরেকটু ভাত দিই?” ক্যামেলিয়া লাজুক গলায় বলল।

“না।”একটু পর বললেন,”তোমাকে কতবার বলেছি খাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই। আমার যা লাগবে আমি নিয়ে খাব।” ইকরামের অস্বস্তি হয় ওর পাশে থাকলে। ক্যামেলিয়া ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল পাশে। ইকরাম বললেন,

“খেয়েছ?”

“একটু পর খাব।”

মুখের সামনে নেওয়া ভাতটুকু প্লেটের ওপর রাখলেন। বিরক্ত গলায় বললে,

“এসব কেন করছ তুমি ক্যামেলিয়া?”

“কী সব?”

“এই যে দাঁড়িয়ে থেকে খাবার দেওয়া। আমার পরে খাওয়া। এগুলো তো তোমার কাজ না।”

ক্যামেলিয়া কিছুক্ষণ কথা বলল না। ভাতের চামচটা শক্ত করে ধরে বলল,

“আর করব না।” তারপর চামচটার হাতল ছেড়ে আর দাঁড়ায় না। সিঁড়ির দিকে গেল। ইকরাম গম্ভীর মুখে বসে রইলেন এঁটো খাবারের দিকে চেয়ে। খিদে মরে গেছে। প্লেট ঠেলে উঠে পড়লেন। এত পাপ তিনি ঘুচাবেন কী করে?

ঘণ্টা দুয়েক পরে ক্যামেলিয়া নিচে নামল। ওর চোখের পাতা ভেজা। মুখ শুকনো। এদিক-ওদিক তাকিয়ে লিভিং রুমে এসে এক ভৃত্যাকে জিজ্ঞেস করল,

“সৈয়দ সাহেব ঘুমাতে গেছেন?”

“না, আপনি চলে যেতে উঠে পড়লেন। হাত ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছেন। মনে হয় অফিসঘরে আছেন। কিছু বলতে হবে ভাবিসাব?”

সৈয়দ সাহেবের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে এ বাড়ির ভৃত্য ভৃত্যারা ওকে ভাবিসাব বলে ডাকে। প্রথম প্রথম বিব্রতবোধ করত। এখন জ্বালাবোধ করে। এই ডাক, এই অধিকার সবই নামেমাত্র। এর কোনো ভিত্তি নেই। সব মিথ্যা।

“কিছু বলতে হবে না। ঈপ্সা খেয়েছে?”

ভৃত্যা মাথা নাড়ায় দুদিকে।

“খাবার দাওনি ওকে এখনও? ক’টা বাজে দেখেছ?”

“খাবার নিয়ে গেছিলাম। আম্মা বলছে খাবে না। দুপুরেও খায়নি।”

“আমাকে বলোনি কেন?”

ভৃত্যা মাথা নিচু করে রইল। ক্যামেলিয়া ওকে আর কিছু বলল না। কিন্তু মনে মনে রাগ হলো। অকারণেই হলো। যেখানে অধিকার নেই সেখানে রাগের সাহস দেখায় কী করে?

রান্নাঘরে গিয়ে নিজ হাতে খাবার বেড়ে ঈপ্সার দরজায় নক করল। দরজা খুলে ওকে দেখামাত্রই ঈপ্সার মুখ কঠিন হয়ে যায়। ক্যামেলিয়াকে ও ঘৃণা করে। ওর ঘৃণার দৃষ্টি শরের মতো একটার পর একটা ক্যামেলিয়ার সমস্ত শরীরে আঘাত করে। তবুও হাসে ও। ব্যথায় ব্যথায় ব্যথাশূন্য হয়েছে যে।

“তোমার জন্য খাবার নিয়ে এলাম।” ওর পাশ কেটে ভেতরে ঢুকলো। বিছানায় রেখে বলল,

“এসো খেয়ো নাও।”

ঈপ্সা নড়ল না। ক্রুদ্ধ চোখদুটো অনিমেষ। ক্যামেলিয়া এগিয়ে এসে হাতটা ধরতে গেলে ঈপ্সা সরে দাঁড়ায়।

“ভুলেও আমাকে স্পর্শ করার সাহস করবে না। চলে যাও আমার রুম থেকে।”

“ঈপ্সা!” আহত মুখে বলল ক্যামেলিয়া। ঈপ্সা শ্লেষাত্মক হাসল,

“বাবার মতো আমাকে বশ করতে চাও? সেই মতলবে এসব করছ না?”

“বশ!” ক্যামেলিয়াও মৃদু হাসল। “যদি বলি হ্যাঁ তবে কি বশ করতে দেবে?”

“একটা মানুষ এতটা নির্লজ্জ কী করে হতে পারে বলো তো? হওয়ার কথা ছিলে ভাইয়ের বউ হয়েছ বাবার বউ। মানলাম রাহাত আমার আপন ভাই না কিন্তু ভাই তো। তোমাকে আপু বলে ডাকতাম মনে আছে? এখন কী ডাকব? মা? লজ্জা করে না তোমার?”

ক্যামেলিয়ার গলা ধরে আসে। ঈপ্সা বয়সে কত ছোটো। মা মরা এতিম মেয়ে। ওর কথা মনে নেবে না। মুচকি হেসে বলল,

“হলাম না হয় নির্লজ্জ আমি। ডাকবে মা আমাকে?”

“কোনোদিন না।”
এগিয়ে আসতে ঈপ্সা রেগেমেগে দু’হাতে ধাক্কা দেয় ওকে। ক্যামেলিয়া টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল নিচে।

“ঈপ্সা!”
বাবার বজ্র গলা শুনে চমকে ওঠে। বাবার অগ্নিশর্মা রূপ ওকে ভীত করে। কেঁদে ফেলে। ক্যামেলিয়াকে ও ধাক্কা দিতে চায়নি। মা বলতে বলল দেখেই ভুলটা হয়ে গেল। বাবা কি মারবে সেই জন্য? শুনেছে সৎ মা ঘরে এলে বাবারা আগের মতো থাকে না। নিষ্ঠুর হয়ে যায়। বাবার রক্তিম কঠিন চোখ মুখ দেখে মনে হলো ওর বাবাও বুঝি তেমন বাবা হয়ে গেছে। ঈপ্সা ভয়ে দৌড়ে চলে যায় বাথরুমে।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here