#অশ্রুমালা
part–33
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
রোদেলা চোখ বড় করে ফেলে। কেউ তার মুখ চেপে ধরে আছে রুমাল দিয়ে। যার জন্য সে ঠিক মতো নিশ্বাস ও নিতে পারছে না! রোদেলা নড়াচড়া-ছোটাছুটি শুরু করে দিল বাচার তাড়নায় কিন্তু খুব একটা লাভ হলো না। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি এক চুল পরিমাণ নড়ল না৷ রোদেলার নাকে একটা কেমন উদ্ভট গন্ধ এসে লাগলো।
রোদেলা চারপাশে তাকাচ্ছে। দুপুর হওয়ায় আশেপাশে তেমন কেউ নেই। আর তাছাড়া আবেগদের বাসা টা একটু ভেতরে আর আবাসিক এলাকা হওয়ায় অযথা ঘুরঘুর স্বভাবের মানুষ দের এদিকে খুযে পাওয়া যায় না। বাসার নিচেও দারোয়ান নেই। উনি এসময় খেতে যান। যে ব্যক্তি তাকে অপহরণ করতে চায় সে সব খবর নিয়েই এসেছে৷ এখন কি করবে রোদেলা?
রোদেলার মুখে ক্লোরোফর্ম দেওয়া হয়েছিল। তাই ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে লাগলো রোদেলা।চোখ ধাপসা হতে লাগে তার। তারপর ও আশেপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে যদি কারো কাছে সাহায্য নিতে পারে?
রোদেলার চোখ বন্ধ হয়ে আসল।
★★★
জাবেদা খাতুন পাশের বাসার ভাবীর কাছ থেকে গল্প-গুজব করে নিজের বাসায় ফিরছেন। পাশের বাসার ভাবী পাশের বাসায় থাকেন না। উপরের তলায় থাকেন। তাও পাশের বাসার ভাবী বলেই তাকে ডাকা হয়। জাবেদা খাতুন পাক্কা দুই ঘন্টা পর নিচে নামছেন।আজকে দুপুরে ইমতিয়াজ রহমান বাসায় আসবেন না। আবেগ ও বিকেলে ফিরবে। তাই কোন তাড়া নেই তার। জমিয়ে আড্ডা দিয়ে এলেন তিনি।
সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই তার চোখ কপালে। বাসার গেট হাট করে খোলা। যে কেউ ঢুকে পড়বে!
জাবেদা খাতুন মনে মনে রেগে গেলেন রোদেলার উপর। মেয়েটা তো ভারী দায়িত্ব-কর্তব্য হীন। এভাবে কেউ গেট খুলে রাখে! চোর ঢুকলেই তো সব শেষ!
উনি বাসায় গিয়ে জোরে জোরে বার কয়েক রোদেলার নাম নেন। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া-শব্দ নেই। জাবেদা খাতুন আরো ক্ষেপে যান। তিনি ড্রয়িং রুমে দাড়িয়ে ছিলেন। গেট লাগিয়ে আবেগের রুমে যেতে লাগলেন উদ্দেশ্য রোদেলা কে কড়া কিছু কথা শুনানো।
কিন্তু আবেগের রুমের সামনে যেতেই সমুদ্রের কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। উনি ভ্রু কুচকে রুমে ঢুকলেন। রোদেলা রুমেও নেই, রুমের বাইরেও নেই। বাচ্চাটা একাধারে কেদেই যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে মাকে খুজছে বুঝি।
উনি উঁকি মেরে বাথরুম দেখলেন। রোদেলা সেখানেও নেই। এদিকে সমুদ্রের কান্নার বেগ বেড়েই যাচ্ছে৷
সময় এখন সাড়ে তিনটা। উনি বাসা থেকে উপর তলার ভাবীর বাসায় যান দেড়টার দিকে।
রোদেলা কে না পেয়ে উনি রুম থেকে বের হলেন। যার বাচ্চা তারই কোন হেল-দুল নাই। বাচ্চা কান্দে মা নাই! কই তার ও দুইটা বাচ্চা ছিল, নিজ হাতে মানুষ করেছে। এভাবে রেখে তো কোথায় যেত না।
জাবেদা খাতুন রোদেলাকে আগেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে রোদেলার এই বাচ্চার দায়িত্ব সে একদমই নিবে না। এইজন্য মাত্র একবার কোলে নিয়েছে।
সমুদ্র কেদেই চলেছে। উনি গেট লাগিয়ে দিলেন। যার বাচ্চা সে এসে থামাবে।
উনি গিয়ে নিজের রুমে বসলেন। উপরতলার ভাবীর সাথে আজকে খেয়ে এসেছেন। বরবটি দিয়ে শিং মাছের ঝোল। উনি টিভি অন করেন।
প্রায় চারটার দিকে উনি বের হলেন রুম থেকে। সে কি বাচ্চা এখনো কান্না করে। তবে কান্নার তেজ কমে এসেছে।
জাবেদা খাতুন আবেগের রুমে গেলেন। সমুদ্রের চেহারা সসম্পূর্ণ লাল হয়ে গেছে। মুখ-চোখ শুকায় গেছে। খিদা লেগেছে বুঝাই যাচ্ছে।
জাবেদা খাতুন অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোলে তুলে নিয়ে ফিডার বানিয়ে সমুদ্র কে খাওয়ালেন। খাওয়ার পর ই সমুদ্র কান্না শুরু করল। জাবেদা খাতুন বিরক্ত হলেন। রোদেলা কই রেখে গেল বাচ্চাকে? এখন কি তাকে রোদেলার বাচ্চা সামলাতে হবে? নিজের নাতি হলে কথা ছিল। কার না কার বাচ্চা এখন তাকে দেখ-ভাল লরে বড় করতে হবে? ঠেকা পড়েছে তার!
সমুদ্র একাধারে কেদেই চলেছে। কিছুতেই থামে না। দুধ খাওয়ার মিনিট পাচ পর হরহর করে বমি করে দিল।
জাবেদা খাতুনের টনক নড়ল এবার। সমুদ্র বুঝি অনেকক্ষণ যাবত না খাওয়া ছিল! রোদেলা কি মাত্র বের হয়েছে নাকি সে উপরে যাওয়ার সাথে সাথে কোথাও বাচ্চা রেখে গেছে? বাচ্চাটার তো কষ্ট হচ্ছে মা কে ছাড়া! কেদে কেদে লাল হয়ে যাচ্ছে। জাবেদা খাতুন বুকে ছড়িয়ে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না। সমুদ্র থেকে থেকে শব্দ করে কানা জুড়ে দিচ্ছে৷
রোদেলা কিসব বলে সমুদ্র কে! সেগুলো শুনে বাচ্চাটা চুপ থাকে। কিন্তু জাবেদা খাতুন তো আর এগুলো বলতে পারবেন না। উনি আবার দুধ খাওলালেন সমুদ্র। বাচ্চাটার চেহারা এই এক ঘন্টার মধ্যে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। শুকিয়ে যাচ্ছে মুখটা। চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে সমুদ্র। নিস্তেজ হয়ে গেছে সে। ঘুমু ঘুমু চোখে মাকে খুজতে খুজতে ঘুমিয়ে পড়ল সমুদ্র।
হাফ ছেড়ে বাচলেন যেন জাবেদা খাতুন!
বিকেলের দিকে আবেগ বাসায় ফিরল। বাসায় ফিরে রুমে এসে তার কেমন যেন লেগে উঠল। রুমে রোদেলা নেই। এতো দিনে রুমে ঢুকে রোদেলাকে দেখার অভ্যাস হয়ে গেছে তার। কিন্তু আজকে রুমে সমুদ্র একা শুয়ে আছে। রুমের কোথাও রোদেলা নেই। আজকে হাসপাতালের একটা ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট এসেছিল তাই খুব বিজি ছিল আবেগ। একবার ও ফোন দেয় নি বাসায় সে।
ফ্রেস হয়ে এসে আবেগ সমুদ্র কে কোলে নিল। আজকে হাসছে না সমুদ্র। বরং তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চেহারায় মলিনতার ছাপ। মুখটা শুকনা আর লাল হয়ে আছে। আবেগ বিচলিত হল। সমুদ্র কি অসুস্থ হল? ওর কি কষ্ট হচ্ছে? আর সমুদ্র কে এই অবস্থায় রেখে রোদেলা কই গেল?
আবেগ আব্বা বলে ডাকল। সমুদ্র চোখ খুলে তাকালো। কিন্তু আজকে মুখে-চোখে উল্লাস বা জৌলসতা নেক। সমুদ্র কে চুমু খেয়ে তাকে কোলে নিয়ে রুমের বাইরে গিয়ে আবেগ জাবেদা খাতুন কে প্রশ্ন করল, মা রোদেলা কোথায়?
জাবেদা খাতুন টিভি দেখতে দেখতে উত্তর দেয়, তোর বউ তুই জানিস! আমি বলছি না ওই মেয়ের কোন কিছুই আমি জানতে চাই না।
আবেগ কথা বাড়ায় না। সে ধরেই নেয় রোদেলা বাইরে কোন কাজে গিয়েছেব।যেতেই পারে। রোদেলা শিক্ষিত একটা মেয়ে। কোথাও হয়তোবা গিয়েছে।
আবেগ বারান্দায় এসে দাড়ালো সমুদ্রকে নিয়ে। সে মূলত বারান্দায় দাড়িয়েছে যেন রোদেলা আসলেই তাকে সবার আগে নিচ থেকে দেখতে পারে। মনে মনে খানিকটা হলেও অশান্ত আবেগ। রোদেলা কে কল দিয়েছে কিন্তু ফোন অফ। সময় যতোই যাচ্ছে ততোই অস্থির হচ্ছে আবেগ। সাড়ে ছয়টা বাজতে চলল কিন্তু রোদেলার আসার নাম নেই। আবেগ অথৈকে কল করেছিল কিন্তু অথৈ রোদেলার ব্যাপারে কিছু ই জানে না। দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে তার মনে। এতো দেরি করার মতো মেয়ে রোদেলা না।
আবেগ অস্থিরতা নিয়েই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। তখনি জাবেদা খাতুন এসে দাড়ালেন বারান্দায়।
আবেগ তাকে দেখে কিছু বলল না।
জাবেদা খাতুন বললেন, কার জন্য অপেক্ষা করছিস?
আবেগ ভ্রু কুচকালো।
তিনি তুচ্ছ স্বরে বলে, ওই অপয়া মেয়েটার জন্য দাঁড়ায় আছিস নাকি?ওর অপেক্ষা করিস না বাবা। ওই মেয়ে তার বড়লোক প্রথম স্বামীর ঘরে চলে গেছে।
আবেগ বিষ্ফরিত চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো।
উনি কঠিন গলায় বলে, তোকে বোকা পেয়ে মেয়েটা তোকে ফাসাইছে। এখন দেখ ঠিকই প্রথম স্বামীর সাথে ফূর্তি করতে গেছে। তোর উপর বাচ্চা গচ্ছায় দিয়ে মেয়ে পালাইছে৷
আবেগ এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খুলে বলে, এসব কি আজেবাজে বকছো মা? রোদেলা কোথাও কোন কাজে গিয়েছে বোধহয়। চলে আসবে একটু পর। ফোন অফ জন্য কিছু জানাতে পারছে না। এই সামান্য ব্যাপারে ও তুমি রিশাদকে কেন টানছো?
জাবেদা খাতুন তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, দুপুরে ওই মেয়ের প্রথম ভাতাড় আমার সামনেই ফোন দিছিল ওকে। তারপর থেকেই মেয়েটা দুধের বাচ্চা রাখে প্রথম ভাতাড়ের সঙ্গে পালায় গেছে।ছিঃ ছিঃ এগুলো কথা মুখেও নেওয়া যায় না রে বাবা। ওই মেয়ের চরিত্র ভালো না। রুপের জালে ফাসায় ছেলেদেরকে। তোলে ফাসাইছে জন্য তুই বুঝতেছিস না। নাহলে তুই ই বল তালাক হওয়ার পর ও কোন ঠেকায় রিশাদ ওকে ফোন দিবে? রিশাদের কি এমন দরকার পড়ছে ওর মতো মেয়েকে কল দেওয়ার? কিন্তু দিসে কল। মানে বুঝিস নি, ওদের মধ্যে এখনো সম্পর্ক আছে।
আবেগ তার মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, প্লিজ চুপ করো না। রোদেলাকে নিয়ে অযথা কোন কথা বলবে না।
জাবেদা খাতুন যেতে যেতে বলে, আমি নিজের চোখে রিশাদকে ফোন দিতে দেখছি রে বাবা। তোর বউ তোকে হাত করে নিসে তাই তুই কিছু বুঝতেছিস না।
আবেগ মায়ের কথা শুনে ভেঙে পড়ল ভেতরে ভেতরে।
সে রুমে ঢুকল। ডেসিং টেবিলের সামনে রোদেলার ফোন। সে দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে দেখল চার্জ নাই ফোনে।
ফোন চাজে দিয়ে অন করে ডায়াল লিস্টে যায় আবেগ। আবেগের বুক ব্যথা ব্যথা করে উঠে। রিশাদের কল এসেছিল। ঠিক দুপুরে কল এসেছিল।
আবেগের চোখে ধাপসা হতে লাগলো। তবে কি মা ঠিক বলেছে? রোদেলা কি তার সাথে ছলনা করেছে? রোদেলা কি তবে ছলনাময়ী?
মূহুর্তের মধ্যে সব কিছু অন্ধকার হতে গেল। সবকিছু মানে সবকিছু!
আবেগ বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে এবং সমুদ্র কে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো।
আসলে মানুষ যখন অতি কষ্ট পায় তখন আর চোখ খোলা রাখতে পারে না! সুখী থাকলে আর চোখ বন্ধ করতে মন চায় না। চোখ খুলে সব সুখ অনুভব করতে মন চায়৷
কিন্তু দুঃখ! সে তো কালো! তাই চোখ খুলে রেখে তাকে পাওয়া যায় না!
আবেগের হুহু করে কান্না করতে মন চাচ্ছে
রোদেলা কোথায়? তার তো মন মানে না!
চলবে।
[ আজকে যদি সবাই সুন্দর সুন্দর আর বড় করে মন্তব্য করেন গল্প সংক্রান্ত তাহলে আজকে রাত দশটার পর একটা বোনাস দিব। আমি সবার মন্তব্য পড়ব আজকে। ধন্যবাদ। ]
অশ্রুমালা
part–34
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
আবেগের চোখ বেয়ে দুই ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে বিছানায় পড়ল। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। এই মূহুর্তে এখনি ঘুমিয়ে যেতে মন চাচ্ছে আবেগের। চোখ খুলে রাখার জন্য ইতিমধ্যে নিজের সাথেই যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
আবেগ বহু কষ্টে চোখ খুলল। যদি সে ঘুমিয়ে পড়ে তবে এই ঘুম তার জন্য মোটেও সুখকর হবে না বরং যন্ত্রনাময় হবে। আবেগের মাথা ভোভো করছে। রোদেলা কোথায়? আবেগের তার মায়ের কথা মোটেও বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রথমে খনিকের জন্য রিশাদের নাম দেখে কষ্ট লাগলেও এখন কেন যেন মনে হচ্ছে রোদেলার কোন সমস্যা হয়েছে। যে মেয়ে এতো বাধা অতিক্রম করে, রিশাদ হতে দূরে চলে এসেছে। রোদেলার ভাষায় জাহান্নাম ছিল রিশাদের সংসার! তাহলে জেনে বুঝে কেউ জাহান্নামে ঝাপ দিবে কেম?
বরং যে জাহান্নামে যাবে সেও প্রতিমূহুর্তে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে চাইবে। দুনিয়ায় যে যতোই পাপ করুক না কেন কেউ ই জাহান্নামে যেতে চায় না।
আবেগ উঠে বসল। রোদেলার ফোনটা আবারো হাতে নিল। ফোনটা ভালভাবে পর্যবেক্ষন করল, ডায়ালের প্রথমে রিশাদের নাম। এর আগে গতকাল বাবাকে করেছে, পড়শু চাচিকে আর বাসস্ট্যান্ডে থাকাকালে আবেগকে ফোন দিয়েছে। রিশাদের নাম সবার আগে। এরপর আর কারো কল আসে নি।
আবেগ ফোন টা রাখতে গিয়ে খেয়াল করল, ফোনের কভারে লাল মাটি লেগে আছে। সে ভ্রু কুচকে ফেলে। এই ধরনের মাটি তো তাদের বাসার একদম পাশেই স্তুপ করে রাখা। সেই মাটি রোদেলার ফোনে আসল কিভাবে? ফোন তো বাসায় তাহলে নিচে থাকা মাটি ফোনে লাগল কেমনে? নাকি কালকে যখন বের হয়েছিল তখন লেগেছিল মাটি? ফোনটার স্ক্রিন ও ভাঙ্গা । কালকেই তো ঠিক ছিল।
আবেগ মনে করার চেষ্টা করল, নাহ, রেস্টুরেন্টের ভেতরেই রোদেলা ফোন ব্যাগে ঢুকিয়েছিল আর বের করে নি।
আবেগের মাথা হ্যাং মারল। সে খনিকের জন্য রোদেলাকে অবিশ্বাস করে বসলেও এখন আর করছে না অবিশ্বাস। মেয়েটাকে সে চেনে। মরে গেলেও রিশাদের কাছে যাবে না। আর রিশাদ ও তো একটা জানোয়ার! তাদের বাসায় এসে কিভাবে রোদেলার উপর তার সামনেই অত্যাচার করতে ধরেছিল।
ধপধপ করে মাথা, চোখ জ্বলছে আবেগের৷ আবেগ নিজের ফোন বের করল। সাইলেন্ট করা। ফোন বের করতেই রোদেলার এই নাম্বার থেকে ছয়টা কল। সে ভ্রু কুচকে ফেলে। কিন্তু রোদেলার ফোনে তো তার নাম ডায়াল লিস্টে নাম নেই।
তবে কি তৃতীয় পক্ষের কেউ রোদেলার ফোন থেকে তার নাম ডিলিট করে দিয়েছে?
আবেগের মনে খটকার পাহাড় জমতে লাগে। সে দ্রুত মেঘকে কল লাগায়।
মেঘ কল ধরতেই গড়গড় করে সব বলে দেয়৷ একদম এ টু জেট সব।
মেঘ সব শুনে প্রথমেই আবেগকে ঝাড়ি দিয়ে বলে, রোদেলা বিকেল থেকে বাসায় নেই আর তুই এখনো বাসায় বসে আছিস? সিরিয়াসলি আবেগ? এই তোর দায়িত্ব বোধ? তুই কিভাবে এক মিনিটের জন্য ও ভাবলি রোদেলা রিশাদের কাছে যাবে? সেইম অন ইউ।
আবেগ কিছু বলতে পারছে না। তার হাত কাপছে। রোদেলা কি বিপদে আছে?
না। না। বিপদে নেই। নিশ্চয়ই কোথায় গিয়েছে। চলে আসবে।
আসলে আপনজন বিপদে আছে এটা কেউ মানতে চায় না। শতভাগ নিশ্চিত হলেও বারবার মনকে ভুল বুঝাতে লাগে। কেউ চায় না তার আপনজন বিপদে পড়ুক।
আবেগ ঘামতে লাগল। তার কানে কিছুই যাচ্ছে না। বাইরে বোধ হয় বাবা মায়ের সাথে চিল্লাচ্ছে। ইভানার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে৷
কি হয়েছে কি? তার রোদেলার কিছু হয়ে গেল নাতো?
আবেগ আর কিছু ই ভাবতে পারছে না। সমুদ্রের কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। সে সমুদ্র কে ঝাপ্টে ধরে কেদে দিল।
আবেগের অনেক কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কেউ চলে যায়? রোদেলা কি একবার ও আবেগের কথা ভাবছে না? যদি ভেবে থাকে একবারো তাহলে বাসায় ফিরছে না? মা কেন আজেবাজে কথা বলছেন? সে কি জানে? যেই মেয়েটার গায়ে মা এতো এতো অপবাদ লাগাচ্ছেন সেই মেয়েটা আবেগের বেচে থাকার চাবিকাঠি!
সেই মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে আবেগও মারা যাবে!
মেঘ দশ মিনিটের মধ্যে বাসায় ফিরল। এসেই আবেগদের বাসার সামনের সিসিটিভি ফুটেজ অন করল। ঠিক পনে দুইটায় একটা কালো মাইক্রোবাস এসে থামে তাদের বাসার সামনে। তার দশ মিনিট পর রোদেলা নামলে তাকে অজ্ঞান করে গাড়িতে ঢুকানো হলো। ফোনটা পড়েছিল নিচে। রোদেলা ফেলে দিয়েছিল। কেউ একজন (চেহারা বোঝা যাচ্ছে না) ফোন হাতে নিয়ে কি কি যেন করে উপরে উঠে গেল। গাড়ি থেমে ছিল না। ডানে বাক নিয়ে চলে গেল৷
এই ফুটেজ দেখেই আবেগ অজ্ঞান হতে গিয়েও পারল না। কি করবে সে? সত্যি ই তো রোদেলা বিপদে পড়েছে? বিপদে পড়লে কি করতে? দোয়া ইউনুস পড়তে হয়। কিন্তু এই মূহুর্তে তার কিছু তেই দোয়া ইউনুস মনে পড়ছে না। আবেগের ভাবখানা এমন দোয়া পড়লেই রোদেলা বাসার সামনে এসে দাঁড়াবে।আল্লাহ তো সাহায্য করে কিন্তু উছিলার মাধ্যমে। এইবার কে তার উছিলা?
মেঘ আবারো ধমক দিয়ে বলে, কেদে লাভ আছে? এতোক্ষন চুপচাপ বসে না থেকে আমাকে কল দিলেও তো পারতি? তোরা কিছু করবি না ভালো কথা, করিস না। আমি ঠিকই আমার বোনকে খুজে বের করব। যা তোর মায়ের কোলে গিয়ে বসে থাক। যা। সর আমার সামন থেকে!
আবেগ হতাশ চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে, সব দোষ আমার। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল রোদেলার কোন বিপদ হয়েছে। এভাবে এতোক্ষণ যাবত চুপ থাকা উচিত হয় নি আমার। আমি কল্পনাও করতে পারি কেউ রোদেলাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবে।
মেঘ কঠিন গলায় বলে, কেন ভাবতে পারিস নি? তোর সামনেই তো রিশাদ দুই দুইবার এটাক করল তার পর ও এই ব্যাপার টা তোর কল্পনার বাইরে আর রোদেলার পালায় যাওয়াটা স্বাভাবিক। জাস্ট স্পিচলেস আমি। তুই জানিস না রিশাদের গুষ্টি শুদ্ধো পলিটিক্স করে। ওদের কতো বড় ব্যসসা। ওদেরকে পল্টনে সবাই চিনে। আরে।,ওই ব্যাটা তো সন্ত্রাস! কিন্তু তোর চিন্তাভাবনা দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। কিভাবে ভাবলি তুই রোদেলা তোদেরকে রেখে,,,,ছিঃ!
–আমি কোন দিন ই রোদেলাকে সন্দেহ করি নি খনিকের জন্য ভড়কে গিয়েছিলাম। সেটা স্বল্প কিছুক্ষণের জন্য।
–এসব বাদ দে। এভাবে কাউকে গুম করা সম্ভব না। বুঝলি, আমি গোয়েন্দা বিভাগে স্পেশালি কথা বলি। ওরা একশন নিবে। বাংলাদেশের গোয়েন্দার কাজ বিদ্যুৎ গতিতে চলে। ওদের কাছে সবার ডাটা থাকে। রিশাদ কই আছে সব বের করে ফেলবে। আমি যাচ্ছি। তুই ও আয়।
–চল।
★★★
গাড়িতে বসে আছে আবেগ আর মেঘ। মেঘের অফিসের জিপে আছে তারা। মেঘ কার কার সাথে যেন কথা বলছে। কিছু ই শুনছে না আবেগ। মেঘ ফোন রেখে আবেগকে উদ্দেশ্য করে বলে, গোয়েন্দা বিভাগ কেস নিসে।
–এতো দ্রুত?
–হুম। আমার পরিচয় দিতেই সঙ্গে সঙ্গে একশন নিচ্ছে৷ সবচেয়ে ভালো হতো মন্ত্রী টাইপের কেউ সুপারিশ করলে। ওদের কিন্তু এক মিনিটের খেল এইসব বের করা। কিন্তু ঢিলামি করে। বড় কেউ
রিকুয়েষ্ট করলে কাজ দ্রুত করে।
–ও।
মেঘ চুপ থেকে বলে উঠে, সব দোষ তোর। রোদেলার কিছু হলে আমি তোকে জিন্দা মাটিতে পুতব। কি দরকার ছিল নাতাশার হেল্প করার? আরে! ও এমপির মেয়ে। ওর কিছু হলে ওর বাপ দেখত। দরকার কি ছিল রিশাদের সাথে ঝামেলা করার। মুরোদ তো নাই তোর কিছু করার আর হতে চাস হাতেম তাই। এখন বুঝ!ডিভোর্স হইসে সরে আসতি সব কিছু থেকে। নাতাশাকে জানানোর দরকার কি ছিল? (রেগে গিয়ে)
আবেগ শান্ত গলায় বলে, একটা মেয়ের সব জেনেও ক্ষতি হতে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। মেয়েটা রিশাদকে ভালোবাসত। বিয়ে করার কথা ছিল। হয়তোবা আমি ওকে সব না জানালে বিয়ে হয়েও যেত। তখন মেয়েটাকেও রোদেলার মতো কষ্ট পেতে হত। ওর বাবা এমপি তাই বলে কি ওকে সেইভ করা যাবে না? ওকে কেন জানাব না আমি? মেয়েটার জীবন নষ্ট হতে পারত!
মেঘ বিরক্ত হয়ে গেল এবং বলল, এখন যে আমাদের রোদেলা বিপদে তার বেলায় কি?
আবেগ জানালার দিকে তাকালো। তার মাথায় কি যেন একটা ব্যাপার আসল।
সে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে, তুই মাত্র বললি না? বড় কোন নেতার সুপারিশ হলে গোয়েন্দা বিভাগ ভালো কাজ করে?
–হুম। তো?
–নাতাশার বাবা আমাকে অনেক বার বলেছে কোন প্রকার হেল্প লাগলে তাকে জানাতে। আমি কি ওনাকে কল দিব?
–অবশ্যই। হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছস ক্যান? কল দে।
আবেগ দ্রুত কল লাগায় এমপি সাহেবকে।উনি ফোন ধরলে আবেগ তার পরিচয় দেয়।
উনি বলে উঠে, ওহ ডাক্তার সাহেব কেমন আছেন?
–স্যার। আমার একটা হেল্প লাগত।
–হ্যা হ্যা বল। কি হেল্প। ভালো কোন হাসপাতালে জব দিব তোমাকে? এই অফার টা আগেও করেছি বাট ইউ রেজেক্ট ইট। বাট এগেইন আস্কড ইউ।
–না। না। আমি খুব বিপদে পড়েছি৷
–সেকি!আগে বলবে না? তোমার কি আর্থিক সাহায্য লাগবে?
–না।
তারপর এমপি সাহেবকে সব জানালো আবেগ।
উনি সবটা শুনে কিছুটা চুপ থেকে বললেন, তুমি আমার মেয়ের জীবন বাচিয়েছো। তুমি সত্য না জানালে আমার মেয়েটার যে কি হত আল্লাহ ভালো জানে। তুমি চিন্তা করিও না। আজকেই এক ঘন্টার মধ্যে তোমার বউকে খুজে বের করার দায়িত্ব আমার। আমার অনেক বড় নেতা -মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ আছে। কোন একটা ব্যবস্থা হয়েও যাবে।
–ধন্যবাদ স্যার৷
–আমি আজীবন তোমার উপর কৃতজ্ঞ, মাই সন। তুমি কোন চিন্তা নিও না। আমি সব হ্যান্ডেল করব। ওই র্যাসকেলটার ও একটা ব্যবস্থা নিব আমি।
★★★
রোদেলা অগোছালো ভাবে মেঝের এক কোনায় পড়ে আছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় লাল দাগ। ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝড়ছে তার। চুলগুলো নেতিয়ে গেছে। কালকেও তো কতো ভাল ছিল সে। আবেগ কতো যত্ন করে তার চুল মুছে দিয়েছিল। রোদেলা নিস্তেজ শরীর নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে৷ এই মূহুর্তে তার মরে যেতে মন চাচ্ছে। বারবার চোখে সমুদ্র আর আবেগের চেহারা ভাসছে। আবেগ কি তাকে খুজে পাবে? নাকি এখানেই মরে যাবে সে?
তখনি রিশাদের আগামন ঘটে।এইবার প্রথম না। এর আগেও একবার এসেছিল সে। তারপর পাষবিক হিংস্রতা দেখিয়েছে রিশাদ। একা পেরে উঠতে পারে নি রোদেলা।
রিশাদ এসে রোদেলার পাশে বসে পড়ে এবং জোড়ে করে বলে, বউ! শুধু শুধু আমাকে রাগাইলা। ক্ষতি কার হলো? তোমারি হলো। কি দরকার ছিল আবেগেরর গুনগান গাওয়ার? আমি তোমার স্বামী। আমার প্রশংসা করবে। অন্য কারো না। আজকে থেকে আমরা আবারো একসাথে সংসার করব। ওকে? তুমি আর আমি! আর কেউ না! সমুদ্র ও না!
রোদেলার মধ্যে আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। সে চোখ বন্ধ করে আছে। অসহ্য যন্ত্রনা সারা শরীরময় প্রবাহিত হচ্ছে।
রিশাদ আবারো বলল, কি গো? চুপ কেন? কথা বল?
রোদেলা চোখ খুলে বলে, আমাকে প্লিজ যেতে দাও।
–সে কি! জামাইয়ের বাসা ছেড়ে কই যাবা?
–আমার স্বামী আবেগ।
–উফ! আবার আবেগের নাম! জাস্ট হেইট দিস নেইম! আজকে থেকে তোমার মুখে কেবল আমার নাম থাকবে। বুঝলে?
রোদেলা উঠে বসল তারপর বলল, আমি বাসায় যাব। আমাকে যেতে দাও রিশাদ৷ আমি আবেগের কাছে যাব।
রিশাদের মাথা আবারো গরম হতে লাগলো। সে রোদেলার গাল চেপে ধরে বলে, এই আবেগের মধ্যে কি আছে যা আমার মধ্যে নাই? ওর চেয়ে বেশি টাকা-পয়সা আছে আমার।
–তোকে আবেগের মতো হতে আরোও একশবার জন্ম নিতে হবে। আর তুলনা করলি না তোর আর আবেগের? তাহলে একটা কথা মনে রাখিস, চাদের সাথে ধুলার তুলনা করা যায়না। তুই আবেগের পায়ের ধুলার সমান ও না!
রিশাদ অনেক জোড়ে রোদেলার গালে থাপ্পড় মারল। রোদেলা ছিটকে পড়ে যায় মেঝে তে। রিশাদ ধীরে ধীরে রোদেলার কাছে এগুতে লাগে। মুখে হিংস্রতার ছাপ!
★★★
রাত দশটার দিকে গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসার মেঘের ফোনে একটা এড্রেস সেন্ট করে।
মেঘ আর আবেগ দ্রুত সেই জায়গায় পৌছে গেল। জায়গা টা একটা গোডাউন।
ভেতরে ঢুকে পড়ে তারা। আশেপাশে কেউ নেই। বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার আর মেঘ-আবেগ।
একটা রুমে ঢুকতেই আবেগ দাড়িয়ে গেল। থমকে গেল। রোদেলা মেঝেতে পড়ে আছে। চারপাশে যেরকম ভাবে মালামাল পড়ে আছে ঠিক সেই ভাবে তার রোদেলা পড়ে আছে মেঝেতে। ফোনের ফ্লাশ অন করে মেঘ। রোদেলার চারপাশে রক্তে ভিজে উঠেছে৷
আবেগ তা দেখে কষ্টে চিৎকার দিয়ে উঠে।
চলবে।
[গতপর্বে প্রায় সবাই ই কমেন্ট করেছিলেন তাও বড় বড় করে! সেজন্য সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ]