অশ্রুমালা পর্ব ৩৯+৪০

#অশ্রুমালা
part–39
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

প্রাচুর্য মাথায় হাত রেখে তার অফিসের কেবিনে বসে আছে। সবে মাত্র সকাল। তাও শুক্রবার। তাই কর্মচারীর আনাগোনা খুব কম। চার-পাঁচ জন কর্মচারী এসেছে মাত্র।আজকে অফিস বন্ধ। প্রাচুর্য এতো সকালে অফিসে আসে না। তার ঘুম খুব গভীর। নয়টার আগে চোখ খোলে না সে। নয়টার দিকেই প্রতিদিন উঠে, দশটা-সোয়া দশটায় অফিস পৌছায় সে। কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম ঘটেছে৷ এখন কেবল মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। এতো জলদি এসে পড়েছে সে। কারন দুই রাত ধরে তার চোখে ঘুম নেই। প্রচুন্ড ক্লান্ত সে। চোখ জ্বালা করছে প্রাচুর্যের। এমনি সকালে উঠলে তার মাথা ব্যথা করে। আজকেও চিনচিন ব্যথা করছে মাথা। প্রাচুর্য চোখ বুজল। হুট করে ফোন বেজে উঠল। সে বিরক্তি প্রকাশ করে ফোনের শব্দে। ফোনের শব্দটা মাথার ভেতরে গিয়ে লাগে তার। সে চোখ খুলে ফোন হাতে নিতেই বিরক্তিটা তিক্ততায় রুপান্তর হলো। রিশাদের কল। এই ব্যাট তাকে কেন এতো সকালে ফোন করছে?

প্রাচুর্য ফোন রিসিভ করে বলে, কি হয়েছে কল দিচ্ছেন কেন?

রিশাদ ওপাশ থেকে বলে উঠে, প্রাচুর্য আপনি আমাকে না বলে বাসার বাইরে কেন গিয়েছেন?

প্রাচুর্য কটমট করে বলে, সিরিয়াসলি আপনার মনে হয় শেখ প্রাচুর্য আপনার পারমিশন নিয়ে বাইরে যাবে?

–অবশ্যই।

–মাই ফুট।

–মাই ফুট না আপনি বাধ্য প্রাচুর্য। বারবার ভুলে যান কেন?

–রিশাদ আপনি কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করছেন৷ আপনি কি আমার সম্পর্কে কিছু জানেন না? জানেন না আপনি? আমি কতোবড় বিসনেস ম্যান। স্টিল আপনি আমার সাথে লড়তে এসেছেন। ফলাফল কিন্তু ভালো হবে না৷

রিশাদ রিল্যাক্স মুডে বলে, দেখেন ভাই, আপনি এখন আমার হাতের কাঠপুতুল। আমি যা বললো, তাই করতে হবে।

–আই উইল কিল ইউ! (দাতে দাত চিবিয়ে প্রাচুর্যে)

রিশাদ হোহো করে হেসে উঠে বলে, এতো মেজাজ ভালো না প্রাচুর্য ভাই৷ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলো রাগ।রাগ কম করবেন। ভুলে যাবেনা আপনার হবু বউয়ের ইজ্জত আমার কাছে!

প্রাচুর্য ফোন বাম কান থেকে ডান কানে নিতে নিতে বলে, কোন দিন যে তোকে নিজের হাতে মাইরা ফেলাই সেই ভয়ে থাকে হারামজাদা৷

–গালি দিবেন না প্রাচুর্য। আমার রাগ উঠলে কিন্তু ক্ষতি আপনারই হবে। সো বি কেয়ারফুল। আর শোনেন আজকে দুপুরে বিরিয়ানি করতে বলেন তো। খেতে মন চাচ্ছে।

প্রাচুর্য ফোন খট করে কেটে দিল। প্রাচুর্যের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে খুব বিচলিত। মূলত নেহাকে নিয়েই। নেহার একটা এমএমএস তার অজান্তেই রিশাদের কাছে কিভাবে যেন পৌছে গেছে৷কিংবা রিশাদ কোনভাবে নেহার আপত্তিকর ভিডিও ধারন করেছে৷

সেই এমএমএস দেখিয়ে রিশাদ তাকে ব্লাকমেইল করে তার বাসায় আশ্রয় নিয়েছে৷ প্রাচুর্য সব জানে। রোদেলার সাথে রিশাদ কি করেছে সব জানা সত্ত্বেও সে কিছুই করতে পারছে না। পারছে না রোদেলাকে সাহায্য করতে৷ রোদেলাকে সাহায্য করার চাইতে তার কাছে নেহাকে সেইভ রাখা বেশি দরকার। সেদিন রাতেই সে নিজেই রিশাদকে জানিয়েছিল পুলিশ গোডাউনে এটাক করবে। রিশাদ তো রোদেলাকে নিয়েই প্রাচুর্যের বাসায় লুকাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রাচুর্য রোদেলা আনতে দেয় নি। রিশাদকে আনার জন্য একটা মোটর সাইকেল ইচ্ছা করেই পাঠিয়ে দিয়েছিল যেন রিশাদ পাচ মিনিটের মধ্যে রোদেলাকে নিয়ে মোটর সাইকেলে উঠে বসতে না পারে।হয়েছেও তাই। রিশাদ একা রোদেলাকে মোটর সাইলেকে নিতে পারে নি, পুলিশ ও কাছাকাছি চলে এসেছিল তাই রিশাস একাই ভেগে এসেছে।এই ভুল করার জন্য রিশাদ তার কাছে দশ লাখ টাকা চেয়েছে। ব্যাটার সাহস দেখে প্রাচুর্য হতভম্ব!

ভাগিস প্রাচুর্য বুদ্ধি ঘাটিয়ে মোটর সাইকেল ঠিক পুলিশ আসার তিন-চার মিনিট আগে পাঠিয়েছে। তা নাহলে রোদেলা কে তারই বাসায় রিশাদ অত্যাচার করত আর সে অসহায়ের মতো চোখ বুজে সহ্য করত। ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে তার।

প্রাচুর্য অনেক বেশি নিরুপায়। রোদেলার জন্য তার খারাপ লাগছে। সে জানত না রিশাদ রোদেলার এক্স হ্যাসবেন্ড। ইন ফ্যাক্ট হুট করে আননোন নাম্বার থেকে রিশাদ তাকে ব্লাকমেইল করতে লাগে সাত দিন আগে থেকে। প্রথমে টাকা চেয়েছিল। প্রাচুর্য সুন্দর মতো দিয়ে ব্যাপারটা মিটমাট করে ফেলে। কিন্তু রোদেলাকে কিডন্যাপ করার দিন আবারো তাকে ব্লাকমেইল করে নিজের অপকর্মের সাথে প্রাচুর্য কে জড়িয়ে ফেলে রিশাদ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোদেলার ফোন তার বেডরুমে রেখে আসে। প্রাচুর্য এখন পর্যন্ত যা যা করেছে সব রিশাদের নির্দেশে। কারন ব্যক্তিগত ভাবে তার রোদেলার সাথে কোন শক্রতাই নেই। আবেগের সাথে আগে ছিল কিন্তু সেই শক্রতার মাত্রা এতোটাও বৃহৎ না যে আবেগের এতোবড় ক্ষতি করবে সে। প্রাচুর্য কখনোই জেনে বুঝে কারো ক্ষতি করে না। প্রাচুর্যের সাথে টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস রিশাদের লোক থাকে। তবে প্রাচুর্য চুপ বসে নেই। সে গোপনে সেই ভিডিও খুজছে৷ একবার হাতে লাগলেই রিশাদকে কুত্তা দিয়ে কামড়িয়ে কামড়িয়ে তিলে তিলে মারবে সে৷ রিশাদের একয়া ব্যবস্থা না নেওয়া পযন্ত সে শান্তি পাচ্ছে না কোনভাবেই। প্রাচুর্য এটাও বুঝে পাচ্ছে না রিশাদ তাকেই কেন ব্লাকমেইল করল? তার ঘাড়েই কেন মামদো ভূতের মতো বসে পড়ল?

রিশাদের কোম্পানির সাথে তারা গত মাসে পাটনার শীপে গিয়েছে। সেই প্রজেক্টের কাজ সব শেষ। প্রাচুর্য ঠিক মতো কোন দিন রিশাদের সাথে কথাও বলেনি। তারপর ও কেন রিশাদ তাকেই টাগেট করল কে জানে ?

প্রাচুর্য আবারো চেয়ারে হেলান দিল। সাত দিন পর তার বিয়ে। অথচ মাথায় এতো এতো লোড। কিভাবে সব হ্যান্ডেল করবে সে? প্রাচুর্যের মনে হচ্ছে তার মাথায় টেন ইনটু টেন টু দি পাওয়ার প্যাসকেল সমান চাপ প্রয়োগ করছে!

★★★

–বিরিয়ানিতে কি কি মশলা দিতে হয়? প্রশ্ন করল আবেগ৷

রোদেলা হালকা গলায় উত্তর দেয়, সব ধরনের মশলাই দিতে হয়।আর বাসায় বিরিয়ানির মশলা থাকলে সেটাও দেওয়া যায়।

–ও। আলু কি গোল গোল করে কেটে দিব?

–হ্যা৷

–আচ্ছা। আর পিয়াজ বাটতে হবে?

–না। ফ্রিজে বাটা পিয়াজ রাখা আছে।

আবেগ সব শুনে বলল, তাহলে রান্না বসিয়ে দিই?

রোদেলা মাথা নাড়িয়ে আবেগকে সায় দেয়। আবেগ খুব উৎসাহের সাথে চুলা জ্বালালো। চুলায় হাঁড়ি বসালো। আজকে কাচ্চি বিরিয়ানি করা হচ্ছে। আবেগ ঠিক করেছে আজকে সে রান্না করবে। আর তাকে হেল্প করবে রোদেলা।

রোদেলা মাংস ধুয়ে রান্না বসালো। আবেগ রান্না করবে বললেই শেষমেষ রোদেলাই রান্না করল। আধ ঘন্টার বেশি রান্নাঘরে থেকে আবেগের অবস্থায় যায় যায়। পিয়াজের ঝাঝ, রান্নার ঝাঝে তার নাকের অবস্থা করুন। শীতেও সে ঘেমে গেছে। আবেগ রান্নাঘরে আসে না বললেই চলে।

রোদেলা মাংসের মধ্যে পোলাওয়ের ঢেলে দিয়ে নাড়তে লাগলো। চুলার উত্তাপে থাকা যাচ্ছে না। আবেগ একটা হাচি দিয়ে বলে, তোমরা মেয়েরা এতোক্ষন কিভাবে রান্নাঘরে থাকো? শীতকালেই আমার এই অবস্থা! জানি না গরম আসলে কি অবস্থা হবে!

রোদেলা মৃদ্যু হাসল। কিছু বলল না। সে রান্নায় মনোযোগ দিল।

আবেগ বারবার উপরে তাকাচ্ছে তা দেখে রোদেলা বলল, উপরে তাকিয়ে কি দেখছো?

আবেগ উপরে তাকিয়ে থেকেই চিন্তিত গলায় বলে, ভাবছি রান্নাঘরে একটা ফ্যান লাগাবো। বাইরে থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ এনে মাঝখানে সিলিং ফ্যান বসাব।

রোদেলা প্রথমে ভ্রু কুচকালো তারপর শব্দ কিরে হেসে বলে, রান্নাঘরে কেউ কোন দিন ফ্যান লাগায় নাকি!

–তোমাদের জন্যই এই প্রয়াস! যেন গরমকালে বেশি গরম না লাগে।

রোদেলা হাসি থামিয়ে বলে, দরকার নেই। আমরা মেয়েরা রান্নাঘরের চুলের উত্তাপে অভ্যস্ত। তুমি যে আমাদেরকে নিয়ে ভেবেছো এটাই অনেক। এবার রুমে যাও। তোমার চোখ লাল হয়ে গেছে। চোখ কি খুব জ্বলছে তোমার?

–কিছুটা।

রোদেলা নিজের ওড়না দিয়ে আবেগের কপালের ঘাম মুছে দিল। আবেগ মুগ্ধ দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে তাকিয়ে থাকে।এতে রোদেলা লজ্জা পায়। সে এক প্রকার জোর করে আবেগকে রান্নাঘর থেকে ঠেকে রুমে পাঠিয়ে দেয়। আবেগ যেতে চাচ্ছিল না কিন্তু তার সহধর্মিণীর সাথে কথাও পেরে উঠতে না পেরে রুমে গিয়ে বসে পড়ে।

রোদেলা মুচকি হেসে চুলার আঁচ কমিয়ে দিল। তারপর ডাইনিং রুমে গিয়ে ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো ।

ঠান্ডা পানি দিয়ে চোখ ধুলে আবেগের আরাম লাগবে৷ রোদেলা রুমে গিয়ে দেখ আবেগ ফোনে কথা বলছে। ফোনের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারল কোন পেশেন্টের সাথে কথা বলছে।

আবেগ ইশারায় রোদেলা কে জিজ্ঞেস করল সে কেন এসেছে। রোদেলা কিছু বলল না। শুধু একটু হাসল। কালকে রাতটা তার খুব ভালো কেটেছে। প্রায় ভোর পর্যন্ত সে আর আবেগ গল্প করেই কাটিয়েছে৷ কতো পুরোনো কথা, গল্প হাসাহাসির মাধ্যমে রাত পাড় হয়েছে।

আবেগ ফোন রেখে বলে, কি হয়েছে?

–ঠান্ডা পানি দিয়ে চোখ ধোও। আরাম পাবে।

–থ্যাংক ইউ সো মাচ!

আবেগ সত্যি সত্যি চোখ ধুয়ে আসল। রোদেলা ততোক্ষনে আবারো রান্নাঘরে চলে গিয়েছে। আবেগ রুমে এসে সমুদ্রকে কোলে নিল।

আবেগ মনে মনে ভাবছে, সমুদ্র যে কবে বড় হবে? কথা বলা শিখবে কবে? হাটাই না কবে শিখবে? আর কতো দিন পর তার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনবে? আচ্ছা! সমুদ্র তো একসময় অনেক বড় হয়ে যাবে। তখন আবেগ বুড়া হবে। সমুদ্রের বিয়ে দিবে তারা। ভাবতেই কি অদ্ভুত লাগছে তার! তার এই ছোট্ট রাজপুত্র একদিন নিজের সঙ্গে করে একটা রাজকন্যা আনবে! এসব কি আদৌ সম্ভব হবে? সে কি সমুদ্রের বিয়ে দেখে যেতে পারবে? পরক্ষনেই আবেগ নিজেই বলে উঠে, অবশ্যই পারব। সমুদ্রের বিয়ে আমি সেনাকুঞ্জে দিব! তারপর নিজেই আনমনে হেসে দেয়।

দুপুরে নামাজের পর সবাই খেতে বসল। রোদেলা সবাইকে পরিবেশন করে দিল খাবার। বিরিয়ানির প্রসংশা সবাই করল। এমন কি মামী নিজেও বলে উঠে, বিরিয়ানি টা তো খুব মজা হয়েছে। রোদেলা মনে মনে খুব খুশি হয়।

খাওয়া শেষ করে গল্পের আসর পাতানো হলো। তখন সাড়ে তিনটা বাজে৷ আজকে গল্পের আড্ডায় ইমতিয়াজ সাহেব ও আছেন। ঠিক চারটায় বেল বেজে উঠল।

প্রতিদিনের মতো ইভানাই গেট খুলতে গেল। এই বাসায় গেট খোলার দায়িত্ব হলো ইভানা। ইভানার মনে হয় বাড়ির সবার ছোট সদস্যর উপর এই দায়িত্বের বোঝা ঝুলে থাকে।

সে গেট খুলে মুচকি হাসল। অথৈ এসেছে। রোদেলাই ডেকেছে৷

অথৈয়ের বাসা ফার্মগেটেই। আবেগদের বাসা আর অথৈয়ের বাসায় মধ্যে রিকশায় গেলে পনের মিনিটের মতো লাগে।

অথৈ বিড়ালের মতো পা ফেলে রোদেলার রুমে আসল। তাকে দেখে রোদেলা খুব খুশি হয়। সেই সাথে আরেক জোড়া চোখ ও শান্তি পায়।

সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে অথৈ যেতে গেলে আগের দিনের মতো মেঘ তার পিছনে আসে। আজকে অথৈ আর মানা করে না। শুধু তাই না। আজকে রিকশায় অথৈ আর মেঘের মধ্যে কথাও হয় বেশ! দুজনের মধ্যে দূরত্ব টা কিছুটা হলেও কমে আসে। এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট মেঘের৷ সে ইচ্ছা করেই অথৈ কে রাগিয়ে তার সাথে কথা বলতে লাগে।

চলবে৷

[গল্পটা কি সবার ভালো লাগছে? রিচেক দেই নি বানান ভুল থাকলে ক্ষমা করবেন। ]
অশ্রুমালা
Part–40
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

মানুষ দুঃখ খুব সহজে না ভুললেও একসময় ঠিকই সব কষ্ট ভুলে যায়। এটাই হয়তো নিয়ম।একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার পর মানুষ কষ্ট গুলো ভুলে যায়। এক্ষেত্রে সময়টা কারো জন্য একদিন, একবছর কিংবা কয়েকবছর হতে পারে!

গ্রামবাংলায় একটা কথার প্রচলন আছে তা হলো, আপন মানুষ মারা গেলে প্রথম দিন খুব কষ্ট হয়, দ্বিতীয় দিনও কষ্ট হয় কিন্তু প্রথম দিনের তুলনায় কম। তৃতীয় দিন আরো কম কষ্ট লাগে। চল্লিশ দিন যেতে যেতে কষ্টটা সয়ে যায়। মানুষের মস্তিষ্ক ও দুঃখের অনুভূতি গুলো দাবিয়ে রেখে সামনে আগানোর তাড়া দেয়।

রোদেলার ক্ষেত্রেও সেইম ঘটন ঘটেছে। প্রথম তিন তিনটা দিন দুঃস্বপ্নের মতো পারি দিলেও আজকে ষষ্ঠ দিনের মাথায় সে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কষ্ট গুলো কমতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে আবেগের ভূমিকা অপরিসীম। আবেগের সাপোর্ট না পেলে রোদেলা পারত না নিজেকে সামলাতে। হেরে যেত নিয়তির কাছে।

আজকে আবেগ হাসপাতালে গিয়েছে। মেঘ ও বাইরে গিয়েছে। সবাই প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। শুধু সে আর ইভানা বাইরে বের হয় না। বাসাতেই থাকে। জাবেদা খাতুন বেশ চুপচাপ হয়ে গেছেন। নিজের রুমেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। মামী আগে থেকেই খুব অলস। সুযোগ পেলেই কাজ থেকে বাচতে চান। তাই পরোক্ষভাবে রোদেলার হাতেই রান্না-বান্নার দায়িত্ব চেপেছে। সে অবশ্য একা না। ময়নার মাও আছে। শুধু রান্না-বান্না করলেই হয় আর কিছু করতে হয় না। ছুটা বুয়া আছে। সে এসেছে বাকি কাজ করে দিয়ে যায়। আর আরো অবশিষ্ট কাজগুলো করে ময়নার মা।

কেবল সকাল দশটা বাজে। নাস্তা সেরে রোদেলা উপন্যাস পড়ছে। কৈশোর থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনেক আগ্রহ তার। লেখালেখি না করলে চমৎকার পাঠিকা সে! এমন ও দিন গেছে এক বসায় পাঁচশ পৃষ্ঠার উপন্যাস শেষ করে উঠেছে৷ যাকে একেবারে আর্দশ পাঠক বলে! আজকে অবশ্য উপন্যাস পড়ছে না সে বরং হুমায়ুন আহমেদের লেখা “বাসর” গল্প টা পড়ছে। চমৎকার লাগছে তার! আহসানের জন্য একটা অদৃশ্য মায়া কাজ করছে৷ লোকটা খুব ভালোবাসত নিশ্চয়ই তার স্ত্রীকে? এখনো মনে রেখেছে নিজের স্ত্রী কে। পড়তে বেশ ভালোই লাগছে রোদেলার। গল্পের মধ্যে ঢুকে গেছে সে।

মিনিট দশেক পর ছোট গল্পটা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু রেশ হয়ে গেল গল্পটার। রোদেলার মাথায় ঘুরঘুর করতে লাগে, আহসানের তার মৃত বউয়ের প্রতি ভালোবাসা আর শেষে বলা ইংরেজি সেই দুই লাইনের কবিতাটা৷

রোদেলা ঝটপট নোটবুক বের করে, গোলাপি রংয়ের কলম দিয়ে কবিতাটা সুন্দর গোটা গোটা হাতে লিখতে লাগে,

Since there is no help, come let us kiss and part

Nay, i have done, you get no more of me

And i am glad, yea glad with all my heart

That thus so cleanly I myself can free

Shake hand for ever, cancel all our vows

And when we can meet any time again

Be it not seen in either of our brows

That we one jot of former love retain

Now at the last gasp of love’s latest breath

When his pulse failing, passion speechless lies,

When Faith is kneeling by his bed of death

And innocence is closing up his eyes

Now if thou wouldst, when all have given him over,

From death no life thou might’st him yet
recover!

শেষের লাইন গুলি রোদেলার মন ছুয়ে গেল। রোদেলা এমনিতেই ইংলিশ কবিতার প্রতি দুর্বল।হয়তো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী জন্যই!

সে ঠিক করল আবেগকে এই কবিতা শুনাবে তারপর বাসর গল্পের চরিত্র তারিনের মতো করে বলবে, বল তো, Since there is no help, come let us kiss and part এর মানে কি?

রোদেলা আনমনে হেসে দিল। তার একটা বদঅভ্যাস আছে তা হলো যখন কোন গল্প বা উপন্যাস পড়বে তখন সেই গল্পের চরিত্রের মধ্যে নিজেকে কল্পনা করে। তাদের বলা সংলাপ ব্যবহার করবে। এই স্বভাবটা একদম বাচ্চাদের মতোন তার। “আমি তপু” পড়ে সে নিজেকে তপুর জায়গায় কল্পনা করেছিল! মিসির আলী পড়ে নিজেকে মিসির আলী ভাবতে লাগত! কি সুন্দর ছিল ফেলে আসা দিনগুলো! কোন চিন্তা ছিল না মাথায়। রোদেলা বইটা সযত্নে রেখে দিয়ে রান্না করতে চলে গেল৷

★★★

আবেগ হাসপাতালে ওয়ার্ড ভিজিটিং করছিল। এমন সময় মেঘের কল আসল। আবেগ দ্রুত ফোন ধরে বলে, হ্যা বল!

–দোস, রিশাদের খবর পাইছি।

–কোথায় আছে ও?

–এটা এখনো জানি না। কিন্তু ওকে কে হেল্প করছে এটা বের করতে পারছি।

আবেগ কটমট করে বলে, কে সে?

–শেখ প্রাচুর্য।

–ওয়েট হুয়াট? কি বললি আবার বল! (আশ্চর্য হয়ে আবেগ)

মেঘ নিলিপ্ত গলায় বলে, নাম ঠিক শুনেছিস। নেহার কাজিন প্রাচুর্য ই রিশাদকে হেল্প করেছে।

আবেগ বিচলিত হয়ে গেল এবং তাড়াতাড়ি করে বলে, কিন্তু কেন ও রিশাদকে হেল্প করেছে?

–জানি না। ওরা বিসনেস পাটনার। মেবি প্রফিট এর জন্য ই হেল্প করছে৷

আবেগ বলে উঠে, আমি প্রাচুর্য কে একজন ভালো মানুষ হিসেবে জানতাম।

–আমিও তো ভালোই ভাবছিলাম। কিন্তু ব্যাটা তো রিশাদের চেয়েও শয়তান। হাউ ক্যান হি হেল্প রিশাদ? বিবেকে বাধছে না ওর? (মেঘ)

আবগ বলে উঠে, প্রাচুর্যের তো বিশাল ব্যবসা। ও যদি রিশাদকে সাহায্য করতে থাকে আমরা কোন দিন রিশাদকে আইনের আওতায় আনতে পারব না।

মেঘ চটাং করে বলে, কে বলছে পারব না? ওই প্রাচুর্য কি হইসে যে আইনের চোখে বালি দিবে? ওরে শুদ্ধে জেলে পাঠাব। শোন আরো একটা কথা?

–কি?

–প্রাচুর্য ওর বাসায় নাই। গত শুক্রবারের পর ও আর অফিস যায় নি। আমার মনে হয়, প্রাচুর্য আর রিশাদ একসাথেই আছে।

–হতে পারে। তুই কি খোজা শুরু করেছিস?

–হ্যা। দেখি কি হয়। তুই সাবধানে থাক।

–হুম। বিকেলে আসবি না?

মেঘ বলল, হ্যা। আসব।

–আচ্ছা।

★★★

বিকেলের দিকে আবেগ বাসায় ফিরল। ততোক্ষনে মেঘ ও চলে এসেছে৷ আবেগ বাসায় এসেই ফ্রেস হতে চলে যায়৷ ফ্রেস হয়ে এসে দেখে অথৈ ও চলে এসেছে। আজকে দুই দিন পর অথৈ আসল। অথৈয়ের চেহারা কালো হয়ে আছে। চোখ ও লাল মনে হচ্ছে আবেগের কাছে।

আবেগ মুখে কিছু জিজ্ঞেস না করে রোদেলার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। সে বসতেই রোদেলা নাস্তা খেতে দিল সঙ্গে চা। নাস্তা সেরে চা মুখে দিতেই আবেগ সোজা রোদেলার দিকে চোখ বড় করে তাকালো।

রোদেলা ভাবলেশহীন ভাবে বলে, তোমার সুগার লেভেল কিন্তু বর্ডার বরাবর। আজকে থেকে আর চায়ে চিনি খাওয়া হবে না।

আবেগ মৃদ্যু হাসল।

এবার অথৈ বলে উঠে, আচ্ছা শুনো সবাই একটা কথা বলার ছিল?

সবাই অথৈয়ের কথা শোনার জন্য তার দিকে তাকালো। মেঘ ফোন চালাচ্ছিল, অথৈয়ের কথা শুনে ফোন চালানো বন্ধ করে তার দিকে তাকায়। এতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অথৈ৷

সে নার্ভাস হয়ে গেল এবং আস্তে করে বলে, কালকে নেহার সাথে কথা হয়েছে।

নেহার কথা শুনতেই আবেগ আর রোদেলার চেহারার রঙ কিছুটা বেরঙিন হয়ে গেল। আবেগ একটু বিরক্ত ও হলো। সে নেহার কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়।

মেঘ গমগমে গলায় বলে, তো? কথা হতেই পারে তোমার ওর সাথে। এজন্য এখন মাইক এনে সবাইকে শুনাতে হবে। আজব!

অথৈ তড়িঘড়ি করে বলে, ওর কালকে বিয়ে।

রোদেলা অবাক হয়ে বলে।,কিহ!

–হুম। ওর কাজিন প্রাচুর্যের সাথে।

প্রাচুর্যের নাম শুনতেই মেঘ আর আবেগ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। যার সন্ধানে আছে তারা, সে কিনা বিয়ে করবে?

মেঘ মনে মনে বলে, বাহ! ভালোই হত, আসামীও এখন বিয়ে করবে। বাসর রাত করবে। আর আমরা পুলিশ বসে বসে ঘুমাব!

রোদেলা বলে, এটা তো সুসংবাদ। আলহামদুলিল্লাহ। নেহা যেন সুখী হয় প্রাচুর্যের সাথে।

অথৈ মুচকি হেসে একটা বিয়ের কার্ড রোদেলার হাতে দিল। রোদেলা বলে উঠে, নেহার বিয়ের কার্ড এটা?

অথৈ কঠিন গলায় বলে, না।

–তো কার বিয়ে লেগেছে?

–পড়ে দেখ ব্রাইডের নাম ।

রোদেলা কার্ড খুলে ব্রাইডের নাম দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলে।

মেঘ আর আবেগ উৎসুক জনতার মতো চেয়ে আছে রোদেলার দিকে।

রোদেলা হতভম্ব হয়ে বলে, তোর বিয়ে?

–হু। (মাথা নিচু করে)

মেঘের যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে তার। বুকটা হুট করে খুব ভারী লাগতে লাগলো। মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কেউ এক টন পাথর ঠেলে দিয়েছে।

রোদেলা বলল, তুই তো কিছুই জানালি না। হুট করে বিয়ের কার্ড দিচ্ছিস এখন! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না রে তোর বিয়ে!

অথৈ বিড়বিড় করে বলে, আমারো বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না। কিন্তু মুখে বলে, বাবা আসলে দেরি করতে চাচ্ছেন না তাই দ্রুত বিয়ের ডেট এগিয়ে আনা হয়েছে। ফয়সাল ও দ্রুতই বিয়েটা করতে চাচ্ছে। আচ্ছা শোন তোদের জন্য বিয়ের মিস্টি এনেছি। খাবি কিন্তু।

–অবশ্যই। (রোদেলা)

মেঘ হুট করে রুম ছেড়ে বের হয়ে গেল। তাকে দেখে আবেগ ও বের হয়ে যায় রুম থেকে। রোদেলা বুঝতে পারছে কেন মেঘ চলে গেল। পুরোনো কথা বলে অথৈকে আর কষ্ট দিতে চায় না রোদেলা তাই কথা ঘুরিয়ে বলে, জানিস, সমুদ্রের ঠান্ডা লাগছে৷ গা টা একটু গরম করেছে।

অথৈ বলে, সেকি! কিভাবে সমুদ্রের ঠান্ডা লাগত?

–জানি না। তুই দেখ তো জ্বর এসেছে কিনা?

অথৈ সমুদ্র কে কোলে নিয়ে তার কপাল, গায়ে হাত রেখে চেক করে বলে,না রে। জ্বর নেই।

রোদেলা একটা সোয়েটার বের অথৈকে দিল আর বলল সমুদ্র কে পড়িয়ে দিতে সোয়েটার টা।

অথৈ সমুদ্রের গায়ে সোয়েটার পড়িয়ে সমুদ্র কে আদর করতে করতে বলল, শোন, আমি আমার মেয়ের বিয়ে সমুদ্রের সাথেই দিব। সমুদ্র কে আমি বুক করে নিলাম।

বিয়ের কথা শুনে সমুদ্র শব্দ করে হেসে হাত নাড়াতে লাগে। তা দেখে অথৈ উত্তেজিত হয়ে গেল এবং বলল, দেখেছিস! সমুদ্র ও আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য খুশিতে লাফাচ্ছে।

রোদেলা সমুদ্র কে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে, বাবাই টা আমার কতো খুশি আজকে!

অথৈ মজা করব বলল,বিয়ের কথা শুনে হাসছে সমুদ্র বাবু।

রোদেলা সমুদ্র কে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলে, মেঘ ভাইয়া তোর আগেই বুকিং দিয়ে ফেলেছে রে। সর‍্যি।

অথৈ রোদেলার কথা বুঝে উঠতে পারছে না তাই বললন,বুঝলাম না।

রোদেলা হেসে বলে, মেঘ ভাইয়া তার মেয়ের সাথে সমুদ্রের বিয়ে দিতে চায়। উনি তোর আগেই বুকিং দিয়ে গেছে রে। আর সিট নাই আমার ছেলের মনে। বুঝলি, আমার ছেলে তো আর দুইটা বিয়ে করবে না। তাই সর‍্যি।

অথৈ ঠোঁট বাকিয়ে মনে মনে বলে, মেঘের মেয়ের সাথে বিয়ে দিস না রে রোদেলা। তোর ছেলের জীবন টা ত্যাজপাতা হয়ে যাবে। মেঘ যেমন বেয়াদব ওর মেয়েও হবে আস্ত একটা বেয়াদব।

রোদেলা সমুদ্র কে বিছানায় শুইয়ে কম্বল মুড়ে দিতে লাগলো।

অথৈ গোমড়া মুখে বলে, তোর মেঘ ভাই এতো সিউর কি করে হলো তার মেয়েই হবে। ওর ছেলেও তো হতে পারে।

রোদেলা এবার অথৈ কে পালটা প্রশ্ন করে, তুই কিভাবে সিউর যে তোর মেয়ে হবে? তোরও তো ছেলে হতে পারে।

অথৈ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, এভাবে তো ভেবে দেখি নি!

রোদেলা মুচকি হেসে বলে, বিয়ের টপিক বাদ। এটা পরে দেখা যাবে। জানিস আমার না খুব শখ সমুদ্র কে ডাক্তার বানাব।

অথৈ রোদেলার গা ঘেষে বসে পড়ে বলে, তোর তো নিজেরই ডাক্তার হওয়ার অনেক ইচ্ছা ছিল৷

রোদেলা ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চুমু খেয়ে বলে, এজন্য ই তো চাই আমার ছেলে ডাক্তার হবে। সাদা এপ্রোন পড়ে হাসপাতালে যাবে। অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা দিবে। সবাই ডাক্তার সাহেব বলে ডাকবে।

–আবেগ ভাইয়ার মতো ডাক্তার বানাবি?

–হু। তবে আবেগের চেয়েও বড় ডাক্তার হবে আমার ছেলে। ও আবেগ তো এমবিবিএস ডাক্তার। আমি চাই সমুদ্র কার্ডিওলজিস্ট হবে। দেশ-বিদেশে অপারেশন করতে যাবে।

অথৈ রোদেলার কাধে হেলান দিয়ে বলে, তুই পারিস বটে। এতো অগ্রিম চিন্তা করে বসে আছিস।

রোদেলা অথৈকে জিজ্ঞেস করে, তুই খুশি তো?

অথৈ কিছু টা চুপসে গিয়ে রোদেলাকে মিথ্যা বলে, হুম ।

রোদেলা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

চলবে।

[ আজকে আমরা চল্লিশ তম পর্বে পা রাখলাম সেই খুশিতে ভাবলাম একটা বোনাস দিব কিন্তু একদিন আগেই বোনাস দিয়েছি তাই আজকে যদি সবাই বড় বড় মন্তব্য করেন তাহলেই রাত দশটায় একটা বোনাস পাবেন আর যদি দেখেন বোনাস দেই নি তাহলে বুঝে নিয়েন, সবাই কমেন্ট করেনি জন্য দেওয়া হয় নি। ধন্যবাদ সকলকে। ভালোবাসা অবিরাম ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here