#অশ্রুমালা
part–41 (বোনাস)
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
–কষ্ট পাস না রে। সব ঠিক হয়ে যাবে। (আবগ হালকা গলায় মেঘকে কথাটা বললো।)
মেঘ ভাঙ্গা গলায় জবাব দেয়, আমি পাচ্ছি না কষ্ট । ওর সাথে তো একবছর আগেই সব শেষ হয়ে গেছে।
–তাহলে চোখে পানি কেন তোর? (নরম সুরে আবেগ প্রশ্ন করে)
মেঘ কিছুটা জোরে করেই বলে, আমি কি রোবট? যে আমি অনুভূতিহীন হব? আমার ও কষ্ট হয়, যন্ত্রনা হয়!
–আই এম সর্যি।
মেঘ বিরক্ত হয়ে বলে, তুই কেন সর্যি বললি? বাদ দে এসব। আমি জাস্ট অথৈকে নিয়ে চিন্তিত।
–কেন?
–ফয়সাল ছেলেটা সুবিধার না রে।
–অথৈকে বল তাহলে।
–বলছি। বিশ্বাস করে না ও আমার কথা। ওর বাবাকে জানাইছিলাম ফয়সালের কথা। আমার মনে হয় উনি ইচ্ছা করেই বিয়ের ডেট আগায় আনছে।
–অথৈয়ের বাবা কেন তোকে মানতে পারে না?আগে তোর জব ছিল না কিন্তু এখন তো ভালো পজিশনে আছিস তাহলে কি সমস্যা ওনার?
— আমি এতিম এটা তার পছন্দ না। সে চায় তার মেয়ে একটা হ্যাপি ফ্যামেলিতে সবার সাথে থাকবে। তার মতে আমার মা-বাবা নাই মানে আমার কোন পরিচয় নাই। আর ওনার ইগো অনেক। একবার রিজেক্ট অস্তিত্বহীন। দেখ, সবার মা-বাবা হায়াত নিয়ে আসে না। আমার বাবা-মায়ের হায়াত কম ছিল জন্য তারা আজকে আমার সাথে নেই। এখানে আমার তো দোষ নাই কোন? আল্লাহর ইচ্ছা ছিল এটা তাই হয়েছে এমন। উনি আমাকে অস্তিত্বহীন ভাবে।
তাই সেকেন্ড টাইম মেয়ের জন্য আমাকে প্রস্তাব দিবে না। তার মতে বাংলাদেশে ছেলের অভাব পড়ে নি যে প্রথমে পছন্দ না করা ছেলের কাছে মেয়ে দিতে হবে। সত্যি বলছে উনি! অভাব নাই বাংলাদেশে ছেলের কিন্তু ওনার মেয়েকে আমার চেয়ে বেশি অন্য কেউ ভালোবাসতে পারবে না। এটা গ্যারান্টি দিয়ে আমি বলতে পারব।
বলে রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ায় মেঘ। তারা এতোক্ষন ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল।
মেঘ নিচে অথৈকে দেখতে পেল। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে অথৈয়ের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। মেঘের বুকে মৃদ্যু কম্পন বয়ে গেল। সে একটা নিশ্বাস ফেলে।
এবং আবেগ কে বলে।,আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে একটা জরুরি কথা বলব।
আবেগ নিচুস্বরে হেসে বলে, অথৈকে বাসায় রাখতে যাবি তো? যা ওকে রেখে আয় আগে। তারপর কথা বলব।
মেঘ জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে আবেগের দিকে তাকালো। আবেগ হালকা হেসে বলে, এই কয়েকদিনে তোর ডেইলি রুটিন আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি যা। দাড়িয়ে আছে ও তোর জন্য।
মেঘ আবেগের কথামতো দ্রুত ছাদ থেকে নেমে নিচে যেতে লাগলো। আবেগ রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়িয়ে একবার নিচে তাকিয়ে অথৈকে দেখে নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। কোথাও যেন একটা বিষন্নতা খুজে পাচ্ছে সে৷
অথৈ বাইরে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে এক ধ্যানে চেয়ে আছে। মেঘ আজকে কি আসবে না? অথৈ মনে মনে বলে, না আসলে নাই। সে একাই চলে যেতে পারবে। কিন্তু তার অভ্যাস হয়ে গেছে মেঘের সাথে যাওয়াটা।
অথৈ উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে যেই না চোখ ফেরাবে, ওমনি তার চোখ ধূসর রাঙা শার্ট পড়া মেঘের দিকে গেল। গ্যারেজ থেকে বের হলো মেঘ। মুখে কোন হাসির ছিটেফোঁটা ও নেই তার।
মেঘ অথৈয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,রিকশা পাচ্ছো না.?
–নাহহ। (মিথ্যা কথা বলল সে। অথৈ তো রিকশার খোজ করেই নি)
মেঘ পকেট থেকে জীপের চাবি বের করে বলে,চল গাড়ি করে রেখে আসি।
অথৈ ভড়কে গিয়ে বলে, না না। দরকার নেই৷
মেঘ দুষ্ট হাসি দিয়ে বলে, ভয় পাচ্ছো নাকি তুমি?
–ভয় কেন পাব?
–তাহলে আসো।
মেঘ এক প্রকার জোর করেই অথৈকে গাড়িতে বসালো এবং নিজে ড্রাইভারের সিটে বসল।গাড়ি চলতে শুরু করে।
মেঘ আবারো জিজ্ঞেস করে, তুমি কি ভয় পাচ্ছো যে আমি তোমাকে কিডন্যাপ করব?
–আরে না। (জোড়পূর্বক হেসে অথৈ)
–হুম। বিয়ে কবে তোমার?
–সামনের ২৩ তারিখ ।
–গত দুইদিন কেন এলে না?
–এমনি। প্রতিদিন কি কারো বাসায় আসা যায়?
— তা অবশ্য ঠিক বলেছো। কালকে এখানে আসবে?
–না।
–ও৷
অথৈ নিজেকে থেকেই বলে, আমি আর আসব না। কালকে থেকে অফিস যেতে হবে। অফিস শেষ ই হয় ছয়টার দিকে। তাই আসার টাইম পাব না৷ একয়েকদিন দিন টানা কাজ করব৷ শুক্রবার করেও। রোদেলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি।
মেঘ আহত গলায় বলে, ও আচ্ছা।
অথৈ চুপ হয়ে যায়।
মেঘ বলে, তুমি সুখী হবে তো?
–হুম। মিস্টি এনেছি। খাবে প্লিজ।
মেঘ বাক নিতে নিতে বিড়বিড় করে বলে, মিস্টি না এনে ইদুর মারা বিষ আনলে বেটার হতো।
অথৈয়ের বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। অথৈ নামতে ধরবে তার আগেই মেঘ তার হাত ধরে মিনমিনে সুরে বলে, আই স্টিল লাভ ইউ অথৈ!
অথৈ একথা শুনে চমকে উঠে। তার চোখ ভিজে উঠতে লাগে ।
মেঘ ভেজা গলায় বলে, আরেকবার ভাবো না প্লিজ? তোমার বাবাকে বুঝাও। দরকার পড়লে আমি ও বুঝাই প্লিজ? I can’t live without you!
অথৈ হুহু করে কেদে দিল এবং কাদতে কাদতে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিও মেঘ। আমি পারব না আমার বাবার অমতে যেতে৷ আমাকে মাফ করে দিও। বাবা আমার কাছে এই প্রথম কোন কিছুর জন্য অনুরোধ করেছেন৷ আমি তার কথা ফেলতে পারব না। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।
মেঘ অথৈকে ঝাপ্টে ধরে বলে, আচ্ছা যাও দিলাম ক্ষমা করে। তাও কান্না কইরো না। তুমি সুখে থাকো এইটাই শুধু আমার চাওয়া। এখন এটা অন্য কারো সাথে সুখে থাকলেও আমি খুশি হব।
অথৈ মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ চোখ সরিয়ে নিল কেননা ওই দৃষ্টির দিকে তাকালো মেঘ নিজে ভেঙে পড়বে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, তাহলে তো আর দেখা হচ্ছে না আমাদের। ভালো থেকো। সুখে থেকো। একটা বিষয় মনে রাখবে, এই এতো বড় পৃথিবীতে তোমার জন্য খুবই নগন্য কেউ একজন আছে যে কিনা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার জন্য দোয়া করবে।
অথৈ কিছু না বলে কাদতে কাদতে গেট খুলে বাইরে বের হলো। বাসার ভেতরে ঢুকছে সে।
মেঘ শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শেষবারের মতো অথৈকে দেখে নিচ্ছে। যতক্ষন অথৈকে দেখা গেল সে চোখ জুড়ে দেখে নেয়। আজকের পর আর যদি কোন দিন দেখা হয় তবে আর এই ভালোবাসার দৃষ্টিতে তার অথৈকে দেখতে পারবে না। তখন দৃষ্টি নামিয়ে রাখতে হবে কারন ততোদিনে অথৈ অন্য কারো হয়ে যাবে,,,,,,,,
মেঘের বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। খুব করে হাউমাউ করে কাদতে মন চাচ্ছে তার।
★★★
শৌখিন আর শায়েরী টিভি দেখছিল বসে বসে। শৌখিন এই সাতদিনে একবারো ইভানার সাথে কথা বলে নি। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। ভাগ্যিস সময় থাকতে থাকতে তা উপলব্ধি করছে তা নাহলে কি মস্ত বড় ভুল হয়ে যেত তার মাধ্যমে। ইভানার সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না সে। সে দিব্যি বুঝতে পারছে, ইভানা তার প্রতি অতি মাত্রায় দুর্বল। সেও বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল ইভানার প্রতি। যা তার মতো দরিদ্রদের জন্য দন্ডনীয় অপরাধ!
ইভানার বাবাকে সে চেনে। এই এলাকার নামকরা লোক। সম্মান অনেক। বড় বাজারের সামনে বিশাল ইলেকট্রনিকসের দোকান। আর ইভানার ভাই সম্পর্কে ও জেনেছে সে। খুব ভালো একজন ডাক্তার। ইভানাও ডাক্তারি পড়ছে। এদিকে তার অবস্থা যায় যায়। কোন দিন ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যেতে হয় কে জানে? করোনার জন্য তার সব আয় বন্ধ। একটা স্কুলে টিচার ছিল। তাকে ছাটাই করে দিয়েছে। রোজা পর্যন্ত হাফ বেতন পেলেও ঈদের পর পর চাকরি থেকে বের করে দেয়। আপাতত সংসার দুইটা টিউশনির উপর দিয়ে চলছে। কত দিন তাদের এই ছোট্ট নীড় টিকে থাকে তা দেখা বাকি। বাসা ভাড়া তিন মাসের পাওনা আছে। বাড়িওয়ালা ভাল মানুষ দেখে এখনো এই বাসায় থাকতে দিচ্ছে।অন্য দিকে ইভানারা এপার্টমেন্টে থাকে।আবাসিক এলাকা। ওইদিকের প্রতিটা বাসার ভাড়াই ত্রশ হাজারের উপরের। শৌখিনের মনে হয় ওইটা ইভানাদের নিজের বাসাই।
শৌখিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারা আয়োজন করে টিভি দেখছে। কারন কালকে টিভি টা বেচে দেওয়া হবে সাড়ে পাচ হাজার টাকায়।
শৌখিন উদাস চোখে রং-বেরঙের টিভির পর্দায় চোখ দিল। বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখা ঘোর অপরাধ। এই সাত দিনে অনেক বার ইভানা তাকে কল করেছে কিন্তু সে ধরে নি। আর ধরবেও না কোন দিন। ভালোবাসা বুকে চেপে এক জীবন পাড় করা যায় কিন্তু অভাব বুকে চেপে জীবন অতিবাহিত করা খুব কঠিন। তার কষ্টের ভাগ সে ইভানাকে দিতে চায় না। যদি কোন দিন সম্ভব হয়, তাহলে সে অবশ্য ই আল্লাহর কাছে চাবে তার ভাগ্যে যতোটুকু ই সুখ লেখা আছে সেটা যেন ইভানাই পায় আর ইভানার কষ্ট গুলো তাকে দিয়ে দেয়। শৌখিনের কষ্ট সহ্য করার অভ্যাস আছে সেই ছোট কাল থেকেই। সে ইভানাকে ভালোবাসে না মনে মনে এটা বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তার চোখ ভরে উঠল। সে দ্রুত অশ্রু মুছে নিল।
একটা মেয়ে ভালোবাসার জন্য সব সেক্রিফাইজ করতে পারে এই কথা শৌখিন মানে না। ভালোবাসা থাকলেই বাবা-মায়ের রাজকন্যা কোন কুড়ে ঘরে গিয়ে উঠে আজীবন কষ্ট পাক এটা শৌখিন কোন দিন সমর্থন করবে না। যে মেয়ে কোন দিন গ্যাসের চুলাতেই রান্না করে নি তাকে আমরা যদি খড়ির চুলায় রান্না করতে দিই, তাহলে কেউ কি একবারো ভেবেছে সেই মেয়েটার কতো কষ্ট হবে? যে মেয়ে গাড়ি ছাড়া যাতায়াত করে নি সে কোন দিন লোকাল বাসের ঠেলাঠেলি সহ্য করতে পারবেনা। যতোই ভালোবাসা থাকুক তার কষ্ট হবেই। যার অভ্যাস এসি রুমে ঘুমানোর তার ফ্যানের হাওয়ায় ঘুম হবে না যতোই পাশে ভালোবাসার মানুষ থাকুক। শৌখিন এটাও বলছে না যে মেয়েরা তাহলে টাকা দেখেই বিয়ে করুক। না এটা সে মোটেও মিন করছে না। তার ছোট মাথা এটাই বুঝে, সবার উচিত নিজে যেরকম পরিবেশে বড় হয়েছে ঠিক সেরকম আর ওই লেভেলের কাউকে বিয়ে করুক। এতে এডজাস্ট করতে সুবিধা হবে। বেচে থাকার জন্য ভালোবাসা হলো একটা অন্যতম উপাদান। সবকিছু না।
শায়েরী প্লেটে করে নিয়ে এলো মুড়ি। একে মুড়িমাখা বলে।,যেখানে মুড়ি চানাচুর সঙ্গে পেয়াজ-কাচামরিচ আর সরিষার তেল নিয়ে মাখানো থাকে। শৌখিন মৃদ্যু হেসে প্লেট থেকে মুড়ি মাখা নিয়ে টিভির দিকে তাকালো। ফুটবল খেলা চলছে। হয়তো আর কোন দিন এভাবে বসে টিভি দেখা হবে না যতোদিন না ঘরে নতুন টিভি আসছে।
★★★
মেঘ আবেগদের বাসায় ফিরে এল। গ্যারেজ থেকেই মুখ ধুয়ে নিল সে। তারপর সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে পড়ল। বেল বাজাতেই ইভানা গেট খুলে দিল।
মেঘ দুইদিন ধরে ইভানাকে খেয়াল করছে। মেয়েটা মনমরা হয়ে আছে। মেঘ ইভানাকে এক কাপ চা দিতে বলল। এবং নিজে সোফায় বসে পড়ে।
ইভানা কিছুক্ষন পর চা আনল। মেঘ চুমুক দিয়ে বলে, কি রে তোর কি হইসে?
ইভানা ফোন চেক করে নিয়ে বলে, কি হবে আবার?
–মন খারাপ?
–নট এট ওল।
–ডোন্ট লাই।
ইভানা মেঘের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে সেদিন তার সাথে হওয়া সব কিছু বলে দিল।
মেঘ প্রথমে ভড়কে গেলেও পরে বলে, তোর কোন দোষ নাই। যা হওয়ার ছিল হয়েছে। তবে তোর উচিত ছিল আগেই জানানো। চুপ থাকা উচিত হয় নি।
ইভানা ভারাক্রান্ত গলায় বলে, সর্যি।
মেঘ বলল, ছেলেটা কে রে?
ইভানা ভ্রু কুচকে বলে, কোন ছেলে?
মেঘ বলল, ঢং কম কর। যেই ছেলেটা ঢিষুম ঢিষুম করে গুন্ডাটাকে মেরে তোকে বাচালো।
–ও। আমার।ফ্রেন্ডের ভাই। ও না আমার ফোন ই রিসিভ করছে না আর সেদিনের ঘটনার পর থেকে কেন যেন।
মেঘ মজা করে বলে, ভয় পাইছে। প্রথম ডেটেই এমন মাইর খাওয়াইচ্ছোস ওরে। ছেলে ভয় পেয়ে পালাইছে।
–মোটেও না। ও অনেক ব্রেভ।
মেঘ ভ্রু নাচিয়ে বলে, তোর ভাই জানে তুই ওই ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস?
–উহু। ভাবী জানে।
–ভালো। ছেলেটা কি কোন বিপদে পড়েছে?
–জানি না।
–কালকে ওর বাসায় যাস।
ইভানা খুশি হয়ে গেল এবং বলল, সত্যি?
–ইয়াপ। আচ্ছা ছেলে কি করে? ডাক্তার নাকি ইঞ্জিনিয়ার?
ইভানা হালকা করে বলে, টিচার।
–ও।
★★★
আবেগ ছাদ থেকে নেম রুমে এসে দেখে রোদেলা সমুদ্র কে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। দুই মা-ছেলে ঘুম।
আবেগ রোদেলার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। তারপর কিছুক্ষন পর রোদেলার চুলে বুলি কেটে দিতে লাগলো। সে নিজেও রোদেলার পাশে শুয়ে পড়ে এবং খুব শক্ত করে রোদেলা কে জড়িয়ে নেয়। রোদেলা প্রথমে একটু ঘুমের মধ্যে ই বিরক্তি প্রকাশ করে। তাও আবেগ তাকে ছাড়ে না। বাধন কিছুটা আলগা করে রেখে জড়িয়ে ধরে পরম আবেশে চোখ বুজে। কি যে প্রশান্তি কাজ করছে তার মনের মধ্যে তা বলে বোঝাতে পারবে না আবেগ। রোদেলা নড়াচড়া করতে করতে আবেগের বুকে এসে মাথা রাখল। আবেগ মৃদ্যু হেসে একটু শক্ত করে জড়িয়ে নেয় রোদেলা কে।
তারপর রোদেলার কপালে একটা চুমু দেয়। হুট করে একটা মশা এসে রোদেলার গালে এসে বসে। আবেগ দ্রুত মশাটা তাড়িয়ে দেয়৷ রোদেলাকে মশা কামড় দিবে এটা তো মানা যায় না। ঢাকা শহরে শীত কালে মশার উপদ্রব দেখা দেয়। হুট করে গেটে কেউ নক করে। আবেগ আস্তে করে রোদেলা কে বুক থেকে সরিয়ে বালিশে আস্তে করে মাথা পরম যত্নে রেখে, রোদেলাকে শুইয়ে দেয়। এরপর গেট খুলতে যায়।
গেটে মেঘ দাড়ানো। মেঘকে দেখে আবেগ বলে, তুই এসেছিস। আমি আরো ভাবলাম এখনো বাইরে তুই।
মেঘ ব্যতব্যস্ত হয়ে বলে, নেহার ব্যাপারে কিছু বলব।
–বল।
— প্রাচুর্যের মতো ক্রিমিনালের সাথে ওর বিয়ে হোক সেটা আমি চাই না।
–আমিও না। নেহা বেটার কাউকে ডিসার্ভ করে।
–হুম। কিন্তু ওর বিয়ে তো কালকে।
আবেগ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, নেহাকে কল দিয়ে সব জানা।
মেঘ দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ওর ফোন অফ। সোস্যাল মিডিয়ায় একটিভ ও নেই। ওর বাসা যেতে হবে। আমি চাই তুই ও আমার সাথে চল।
–আচ্ছা যাব।
–এখনি যাব আমরা৷
–এখন কেন?
–ওর বাবা বাসায় নাই। ইনফরমেশন পাইসি।
আবেগ বিরক্ত হয়ে বলে, তুই সব আজাইরা ইনফরমেশন পাস।
মেঘ খানিকটা চটে গেল এবং বলে কোনটা আজাইরা রে?
আবেগ বলে, প্রথমে বলছিলি রিশাদের সাথে মন্ত্রী-মিনিস্টারের হাত আছে৷ এখন জানালি প্রাচুর্য হেল্প করছে। আর রিশাদের খবর ও জানিস না। রিশাদের ইনফরমেশন বের না করে নেহার বাবা বাসার বাইরে গেছে এটা জানলি।
মেঘ বলে, প্রথমে আমি আন্দাযে বলছি যে রিশাদের নেতার হাত আছে। আর রিশাদের ইনফো পাচ্ছি না কস ও আত্মগোপন করে আছে। মেঘ কোন কাজ আজাইরা করে না। বাইরে আয়। আমি নিচে দাড়ালাম।
–আচ্ছা।
মেঘ গেলে আবেগ সবার আগে রেডি হলো তারপর মশারি টাঙিয়ে নিল। রোদেলা আর সমুদ্র দুজনকেই চুমু দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
★★★
নেহার বাসায় ঢুকে পড়ে তারা ছদ্মবেশ ধরে। মেঘ আবেগ কে বলে,সে যেন নেহাকে সব সত্য জানায়। আবেগ অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেহার রুমে ঢুকে পড়ে৷ এভাবে এর আগে কোন দিন কোন মেয়ের রুমে ঢুকে নি। ইভানার রুমে ঢুকেছে কিন্তু ইভানা তার আপন বোন হয়। আবেগ অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। নেহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ আবেগকে বাইরে থেকে পাহাড়া দিচ্ছে। নেহাকে দেখা যাচ্ছে রুম থেকেই। চুল খুলে রেখেছে সে। মৃদ্যু হাওয়ায় চুল গুলো নড়ছে। রুমের ঝাড়বাতির আলোয় চুল গুলো জ্বলজ্বল করছে।
আবেগ ধীর পায়ে বারান্দায় গিয়ে একটা শুকনো কাশি কাশল। নেহা কারো শব্দ শুনে পিছনে তাকালো। আবেগকে দেখে চমকে উঠে নেহা। বিষ্ফরিত চোখে তার দিকে তাকায়। আবেগের অস্থির লাগতে শুরু করে৷ নেহা এতোক্ষণ যাবত আবেগের কথাই ভাবছিল আর সে স্বয়ং তার সামনে দাড়িয়ে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। নেহার চোখ ছলছল করে উঠে৷ আজকে নেহা শাড়ি পড়েছে। সত্যি বলতে এই প্রথমবার আবেগ নেহাকে শাড়িতে দেখছে। তাই নেহাকে দেখে একটা ধাক্কার মতো খেল
শাড়ি পড়ায় নেহার মুখে-চোখে অদ্ভুত মায়া বিরাজ করছে।
নেহা আবেগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলে, তুমি?
–কেমন আছো?
নেহা আহত গলায় বলে , তুমি যেভাবে রেখে গিয়েছিলে সেভাবেই আছি।
আবেগ মাথা নিচু করে বলে, প্রাচুর্যকে বিয়ে করো না।
নেহা খুশি হয়ে বলে৷ কেন? তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
–নেহা! (জোড়ে ধমক দিয়ে)
নেহা কাদো কাদো হয়ে বলে, তাহলে কেন মানা করলে? বিয়ে না করতে বললে কেন? হু? উত্তর দাও?
আবেগ যা যা জানত সব বলে দিল। সব শুনে নেহা হতভম্ব হয়ে যায়। প্রাচুর্য এতো নিচ কিভাবে হলো?
আবেগ বলল, আমি যাই। বাকিটা তোমার ইচ্ছা।
নেহা ছলছল চোখে আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে,আবেগ, আই লাভ ইউ জান!
–সাট আপ নেহা। (চোখ বড় করে ধমকের সুরে)
নেহা আবেগের হাত ধরে বলে, প্লিজ আমাকে বিয়ে কর। আমি তোমার দ্বিতীয় বউ হয়ে থাকতে ও রাজী। আমার কোন সমস্যা নেই
রোদেলাকে নিজের সতীন বানাতে। আমি আর রোদেলা আলাদা আলাদা বাসায় থাকব। প্লিজ ম্যারি মি আবেগ। আই লাভ ইউ এ লট।
আবেগ রেগে গিয়ে বলে, ফর গড সেক সাট আপ ইউর মাউথ। তোমার ভালোর জন্য এসেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়ে গেছে আসাটাই আমার। আমাকে ভুলে যাও নেহা। আই ডোন্ট লাভ ইউ এনিমোর।
বলে আবেগ গটগট করে নেহার রুম ছেড়ে চলে আসে। নেহা বারান্দায় হাটু গেড়ে বসে কান্না জুড়ে দেয়। কেন . আবেগ এসে তাকে ভেতরে ভেতরে গুরগুর করে ভেঙে দিল?
★★★
প্রাচুর্য সিগারেট খাচ্ছে। পাশেই রিশাদ নুডুলস খাচ্ছে। প্রাচুর্যের গা জ্বলে যাচ্ছে রিশাদকে দেখে। প্রাচুর্য সিগারেট টা ফেলে দিয়ে বলে,কালকে আমার বিয়ে। যদি আমার বিয়েতে কোন সমস্যা হয় তাহলে কিন্তু আমি আপনাকে খুন করে দিব।
রিশাদ খেতে খেতে বলে, আরে, চিল। আপনার বিয়ে তে কোন ঝামেলা করব না। কিন্তু আপনি চালাকি করবেন না। তাহলেই কোন প্রব হবে না।
প্রাচুর্য রক্তবর্ণ চোখ তাকিয়ে আছে। ছয় দিন ধরে রিশাদ আর সে সাভারে তার ই একটা ফার্ম হাউসে আছে। ছয় দিন ধরে কারো সাথে তার যোগাযোগ নেই।প্রাচুর্য মায়ের সাথেও কথা বলতে পারে নি। সবাই জানে সে বিসনেস মিটিং য়ে আছে। কালকে ফিরবে। রিশাদ তাকে এমন ভাবে ফাসিয়ে দিয়েছে যে সে না পারছে রিশাদকে মেরে ফেলতে আর না পারছে সহ্য করতে। তবে রিশাদকে সে নিজ হাতে মারবেই ডিসিশন ফাইনাল। তার গায়ের মুক্তিযোদ্ধার রক্ত বইছে সে ভীতু না।
চলবে৷
[আজকেই ইচ্ছা ছিল রিশাদের শাস্তিটা দেখানোর কিন্তু গতানুগতিক ভাবে আগানোর জন্য আজকের পর্বে সম্ভব হলো না। গল্প নিয়ে কোন ধরনের অভিযোগ বা প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন আমি গল্পের মাধ্যমেই উত্তর দিয়ে দিব।ভালোবাসা অবিরাম ]
part–42
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
আবেগ রুমে ফিরতেই দেখে রোদেলা মাত্র ঘুম উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে। চোখে ঘুমের ভাব লেগে আছে এখনো।যার কারনে রোদেলাকে আরো বেশি রূপবতী লাগছে। চুল গুলো একটু অগোছালো হয়ে আছে।আবেগের চোখ রোদেলাতে আটকে গেল।
রোদেলা আবেগকে দেখে একটু ভ্রু কুচকে বলে, তুমি আবার কই গিয়েছিলে?
আবেগ কিছুটা চমকে উঠে। সে রোদেলাকে জানাতে চায় না যে নেহায় বাসায় গিয়েছিল। তাই আবেগ বলল, কোথাও না তো। মেঘের সাথে ছাদের ছিলাম।
রোদেলা হাই তুলতে তুলতে বলে, ও।
–হুম। ঘুম হলো নাকি আরোও ঘুমাবে?
রোদেলা চোখ কচলে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলে, অনেকক্ষন ধরে ঘুমিয়ে ফেলেছি তাই না?
–ছয়টা টু দশটা। বেশি কিনা কম জানি না।
ফোনটা টেবিলে রাখতে রাখতে জবাবে বলে আবেগ।
রোদেলা চোখ বড়বড় করে বলে, এখন দশটা বাজে?
–জি। রাত দশটা এগারো মিনিট।
রোদেলা তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। আবেগ তাকে আটকে দিয়ে বলে, কি হয়েছে সুনামির মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে কেন?
রোদেলা বলল, আল্লাহ, এতোক্ষন ধরে ঘুমিয়েছি বাড়ির সবাই কি ভাববে বল? বাড়ির বউ কি কখনো এতোক্ষন ধরে ঘুমায়?
আবেগ নিশ্চিত গলায় বলে , অন্য কারো বউ না ঘুমাতে পারলে ও, আমার বউ ঘুমাবে তার যতোক্ষণ ঘুম পূরণ হয়!
রোদেলার ঠোঁটের কোনে তার অজান্তেই হাসির রেখা গুটে উঠে। আবেগ মুচকি হাসল। রোদেলা র কি যে খুশি লাগলো এই কথা শুনে সত্যি বলে বুঝানো সম্ভব না।
আবেগ বলে, চোখে-মুখে পানি দিয়ে আসো। আজকে বাইরে থেকে খাবার আনা হয়েছে।
রোদেলা মুখ কালো করে বলে, আমি ঘুমাচ্ছিলাম বলে রান্না হয় নি জন্য বাইরে থেকে আনিয়েছো?
–না রে পাগলি। মেঘ আর ইভু চাইনিজ খাইতে চাচ্ছিল তাই কিনে আনা হয়েছে।
রোদেলা একবার আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে, বাইরে গিয়েছিলে কি?
আবেগ ইতস্তত করে বলে, না তো। কেন এমন মনে হলো?
রোদেলা শান্তসুরে বলে, এই শার্টটা তো বাইরে গেলে পড়। তাই জিজ্ঞেস করলাম কোথাও গিয়েছিলে কিনা।
–বাসায় পড়া শার্ট টা খুজে পাচ্ছিলাম না তাই এটা পড়েছি।
রোদেলা কিছু একটা ভেবে বলে, ওহ হ্যা। আলমারির বাম সাইডে সব শার্ট গুছিয়ে রেখেছি। তাই হয়তো খুজে পাও নি।
–সমস্যা নাই। একেবারে রাতে চেঞ্জ করে গেঞ্জি পড়ব৷।চল খেতে আসো।
–ফ্রেস হয়ে আসি।
–যাও।
রোদেলা ফ্রেস আসলে আবেগ প্রশ্ন করে, সমুদ্র কি উঠে যাবে এখন?
রোদেলা উত্তর দিল, না। ও আর উঠবে না। একেবারে সকাল পাচটায় উঠে খেলবে। রাতে দুই-তিন বার ঘুমের মধ্যেই খাইয়ে দিলে আর উঠবে না রাতে সমুদ্র।
–ওকে।
ডাইনিং রুমে গিয়ে সবাই একসাথে চাইনিজ খেল। খাওয়া-দাওয়ার পর যে যার রুমে চলে আসে। আবেগ-রোদেলা রুমে এসে আবারো বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল। আজকে খুব শীত পড়েছে। ঢাকায় এতো দ্রুত শীত পড়ে যাবে তা ভাবে নি কেউই। আবেগ কম্বলের ভেতরে ঢুকে পড়ে রোদেলা চুলে বেনী করছিল তখন।
আবেগ অপলক নয়নে তার বউকে দেখছিল। সে তো চোখের পলক ফেলার কথাও ভুলে গেছে। যদি চোখের পলক ফেলে তবে এই সুন্দরতর দৃশ্য থেকে সে পয়েন্ট জিরো জিরো ওয়ান সেকেন্ড বঞ্জিত হবে যেটা আবেগ মিস করতে চায় না।
রোদেলার চুল বেশ বড় জন্য কাধ বেয়ে বাম সাইডে এনে তারপর আগার চুলগুলোতে বেনী করতে হয় তার। রোদেলার চোখ আবেগের উপর পড়ল। আবেগ তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। রোদেলা ইশারায় জিজ্ঞেস করে আবেগ কিছু বলবে কিনা?
আবেগ মাথা নাড়িয়ে না-বোধক অর্থ প্রকাশ করে।
আবেগ হুট করে রোদেলার গা ঘেষে বসে পড়ে। রোদেলা মৃদ্যু কেপে উঠল। অদ্ভুত ভালো লাগা বয়ে গেল তার শরীর জুড়ে!
আবেগ রোদেলার কোমড় চেপে ধরে বলে ফিসফিস করে বলে, এতো দিন শুনে আসলাম আকাশে চাঁদ উঠে, আজকে দেখি আমার ঘরে পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে।
রোদেলা আবেগে আটখানা হয়ে গেল এবং চোখ-মুখে লাল আভা ছেয়ে গেল তার। সে আদুরে গলায়, কি যে বল না তুমি!
–সত্য বলছি!
রোদেলা আবেগে আপ্লূত হয়েই বলে, কোথায় চাঁদ আর কোথায় আমি?
আবেগ রোদেলার গালে হাত রেখে বলে, তুমি আমার চাঁদ! আকাশের চাদটা আর চোখে পড়ে না আমার।
রোদেলা মাথা নিচু করে ফেলে। তার মনে একটা শঙ্কা, এতো সুখ টিকবে কি তার কপালে? সে তো পোড়াকপালি। সেই পোড়াকপালির ভাগ্য এতো ভালো হলো কি করে?
আবেগ ব্যতিব্যস্ততা দেখিয়ে বলে, কি হলো রোদেলা?
রোদেলা চোখ নিচে রেখেই বলে, আবেগ, এতো এতো সুখ-শান্তি কি আমি সইতে পারব?
আবগ রোদেলার মুখ টা উচু করতেই দেখে, সে কাদছে। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে৷ আবেগ রোদেলার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, এমনি কি তোমার নাম অশ্রুমাল রাখসি? এতো কান্দুরা স্বভাবের কেন তুমি? আর কোন দিন কাদবে না। ওকে?
–হু।
–তুমি বললে না সুখ সইয়ে কিনা এটার উত্তর আমি জানি না। তবে কোন দিন আল্লাহর অকৃতজ্ঞ হবে না। আর আল্লাহ পাক নারাজ হয় এমন কাজ করবে না। আল্লাহর ইবাদত করবে,নামাজ-রোযা পড়বে আর সবসময় যিকিরের ভেতর থাকবে দেখবে আল্লাহ তোমার উপর সবসময়ই এভাবেই রহমত দিতে থাকবে। বুঝলে?
–হুম!
আবেগ রোদেলাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে। আজকেও রোদেলা মাঝখানে শুয়েছে । আবগ রোদেলাকে টপকে সমুদ্র কে আদর করে দিল। তারপর শুয়ে পড়ে সে।
★★★
নেহা সারারাত বারান্দাতেই কান্না করে কাটিয়ে দিয়েছে। ভোরের দিকে সে বারান্দা থেকে রুমে ঢুকল। আজকে তার বিয়ে। প্রাচুর্যের সাথে। তার হ্যাসবেন্ড হিসেবে সে কোন দিন আবেগ ছাড়া কাউকে মানতেই পারে নি। নেহা এই শীতের মধ্যেই ঠান্ডা পানি দিয়ে এতো সকালে গোসল করে একটা সালোয়ার কামিজ পড়ল। সাদা রঙের কামিজে নিজের কাছেই নিজেকে স্নিগ্ধ লাগছে।
কেউ মারা গেলে সাধারণত সবাই সাদা জামা পড়ে শোক প্রকাশ করে। আয়নায় দাঁড়িয়ে নেহা ভাবছে তাহলে সে কেন সাদা পড়ল? কেউ কি মারা গেছে?
প্রশ্নটা মাথায় আসতেই নেহা নিজেই আয়নার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, মারা গেছে কেউ একজন। সেই কেউ একজন হলো আমার আত্মা! ইনার মি! ইনসাইড মি ইস ডেডথ ফ্রম টুডে।
প্রমথ চৌধুরি একটা কথা বলেছেন তাহলোঃ “দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার না।” কথাটা তার ক্ষেত্রে ওয়ান হান্ড্রেন্ট পারসেন্ট কারেক্ট। আজকে তার ও আত্মার অপমৃত্যু ঘটলো কিন্তু হায় আফসোস দেখার কেউ নেই, ডেডথ সার্টিফিকেট লিখে দেওয়ার কেউ নেই। সত্যি কেউ নেই! বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে আজ!
মন ভাঙ্গা যদি অপরাধ হত তবে সে খুব বড় একটা শাস্তি দিত তার আবেগকে। সেই শাস্তিটা হতো আজীবন তার সাথে থাকতে হবে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়! তার ই তো আবেগ! আবেগ নেহাকে নিজের না মানলেও নেহা ঠিকই আবেগকে ভালোবেসে যাবে আজীবন।
ভালোবাসা এতো সস্তা না। যে চলে গেলেই সেই ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা উড়ে যাবে। বরং ভালোবাসা হচ্ছে সেই অনুভূতি যেই অনুভূতিটা “সে” চলে গেলেও চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যেতে থাকে! গুনোত্তর ধারার মতো দ্বিগুন, চারগুন, আটগুন, ষোল গুণ বত্রিশ গুন হারে, পূর্ববতী মূহুর্তের অনুভূতির চেয়ে পরবর্তী মূহুর্তের অনুভূতিটা ক্রম্ব ক্রমে বাড়তে থাকে!!
নেহা হুহু করে কেদে দিল। কেন আবেগ তার কপালে জুটলো না? কি কমতি আছে তার? নেহা খুব করে চায় পৃথিবীতে যদি আরেকবার জীবনটা পাওয়া যেত তবে যেন সেই নতুন জনমে সে-ই আবেগের মনের অধিকারিণী হয়!!!
এইবার সে ব্যর্থ প্রেমিকা। পরের জনমে যেন রোদেলা ব্যর্থ প্রেমিকা হয়! নেহা একটা ব্যাগে করে কিছু জিনিস আর পাসপোর্ট ঢুকিয়ে কেচি গেট দিয়ে বের হয়ে গেল। বের হয়ে গেল বললে ভুল হবে পালিয়ে যাচ্ছে। তাকে সাহায্য করছে তারই বাবার খাস কর্মচারী আরিফ আংকেল। ছোটবেলা থেকেই আংকেল তাকে খুব আদর করে। নেহা শেখ –শেখ সাহেবের একমাত্র কন্যা। নেহার মা ডেলিভারির সময় মারা গেছেন। ডেলিভারির ঠিক ছয় ঘন্টা পর মারা গিয়েছিলেন নেহার মা। তাই মাকে দেখা ভাগ্যে জুটে নি নেহার।
নেহা বাইরে আসতেই আরিফ ছুটে এসে বলল, মামনি, ওই কালো গাড়িতে করে চলে যাও। থাইল্যান্ড যাবা। এই যে টিকিট আর কিছু টাকা। ইনশাআল্লাহ তিন মাস ইউরোপ কান্ট্রিতে লাক্সারি ভাবে ঘুরতে পারবে। তাও লাগলে আমাকে বললেই হবে। কারো সাথে যোগাযোগ না রাখলেও আমাকে মাঝেমধ্যে কল দিও মামনি। আমি কোন দিন সিম বদলাব না। তোমার কলের অপেক্ষা করব আজীবন।
নেহা হুম বলল তারপর জিজ্ঞেস করে, বাপি যদি বুঝে যায় এতো গুলো টাকা মিসিং তখন তো আপনি ধরা খাবেন।
আরিফ সাহেব হোহো করে হেসে বলে, সাগর থেকে এক ফোটা জল নিলে যেমন কেউ টেরই পায় না তেমনি আপনার বাবার কাছেও এটা এক ফোটা পানির সমান। তার কাছে পুরো সমুদ্রটাই পড়ে আছে যে!
নেহা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বাবা টাকা নিয়েই পড়ে থাকুক। টাকার সমুদ্র বানাতে গিয়ে কোন দিন যে সাগরে ডুবে মরে আল্লাহ জানে!
নেহা বাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল গাড়ির কাছে। গাড়িতে উঠে বসতেই শো শো করে গাড়ি চলা আরম্ভ করে।
আজকে থেকে তার নতুন জীবন শুরু। এ নিউ জার্নি স্টার্ট ফ্রম টুডে।
নেহা নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, নেহা আশা রাখি তোমার আগামী দিন গুলো খুব খুব সুন্দর হবে। তোমার জন্য রইল অঢেল শুভকামনা!
★★★
বেলা বারোটায় বিয়ের বর বাড়ি ফিরল। প্রাচুর্য সোজা নেহার বাসায় চলে এসেছে। তার সাথে সর্বোক্ষনের জন্য রিশাদের চ্যালারা ছিল এবং এখনো আছে। প্রাচুর্য কোন একশন নিতে পারেনি কারন তার মা একা থাকেন বাসায়। যদি মায়ের কিছু হয়ে যেত? এখন আর সেই ভয় নেই। চাচ্চুর বাসায় মা চলে এসেছে। প্রাচুর্য নেহার বাসায় ঢুকতেই প্রাচুর্যের সাথে আসা রিশাদের লোকদের কে প্রাচুর্যের লোকরা এসে আটক করে ফেলে। প্রাচুর্য বাসার সামনে দাড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তার লোকদের ইশারায় বলল, ওদের মারধোর করতে।
রিশাদের লোকদের মাইর খাওয়াতে দেখে প্রাচুর্য খুশি হয়ে বাসায় ঢুকেই এক দফা চমক খেল। বাসায় আনন্দের ছিটেফোঁটা ও নেই। হয়েছেটা কি? প্রাচুর্য তার মাকে দেখে নিল। মা ঠিক আছে। এই ছয়দিন যখন সে মা ছাড়া ছিল তখন খুব চিন্তা লাগত। নিজের জন্য না। মায়ের জন্য। যদি রিশাদের লোকরা মায়ের উপর আক্রমণ করে বসে?
এই কারনেই পুলিশকে জানাতে পারেনি। এখন সব ঠিক আছে। তার ফার্ম হাউসে সে রিশাদকে আটকে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে।এরমধ্যেই পুলিশ কল করে ফেলেছে সে। রিশাদ তার বাসা থেকে পালানোর আগেই পুলিশ চলে যাবে তাকে ধরতে।
প্রাচুর্য তার মায়ের কাছে বসে বলে।, কি হয়েছে আম্মু?
প্রাচুর্যের মা বলে, নেহা আজকে সকালে পালিয়ে গেছে। বাসায় নেই ও।
প্রাচুর্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মা কি যা-তা বলছে! নেহা চলে গেছে? নেহা পারল তার মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে? নেহা কি তবে বুঝল না প্রাচুর্য তাকে কতোটা চায়। প্রাচুর্যের জীবনে নেহা কতোটা মূল্যবান?
প্রাচুর্যের চোখ লাল হয়ে গেল।
তার মা বলল, তোর চাচা অসুস্থ হয়ে গেছে।প্রেসার হাই হইসে। খুব টেনশন হচ্ছে রে।
প্রাচুর্য প্রায় দুপুর পর্যন্ত মাথা নিচু করে সোফায় বসে থাকলে। পড়নে তার গোল্ডেন কালারের সুতার কাজ করা পাঞ্জাবি। আজকে তো তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কোথায় চলে গেল নেহা তাকে ছেড়ে?
প্রাচুর্য কাউকে কিছু না বলে আরিফের কাছ গেল। তাকে জেরা করেও কোন লাভ হয় না। পরে অনুরোধ করলে উনি বলেন, সে নেহাকে পালাতে সাহায্য করেছে। তারপর যা বলল সেটা শোনার জন্য প্রাচুর্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না৷ কালকে রাতে নাকি নেহা সুসাইড করতে চেয়েছিল। আরিফ সাহেব ভাগ্যক্রে নেহাকে দেখে ফেলে । এবং আত্যহত্যা করা থেকে আটকে দেন আর আজকে পালিয়ে যেতে এজন্যই সাহায্য করলেন।
সব শুনে বাকরুদ্ধ প্রাচুর্য। চোখের কোনের পানি মুছে নিয়ে প্রাচুর্য মনে মনে বলে, এতো কষ্ট দিয়েছি তোকে নেহা? যে সুসাইড করতে চাইলি আবারো? আচ্ছা ঠিক আছে। তুই যা চাবি তাই হবে। করব তোকে বিয়ে। খুজব না তোকে আর!
তারপর নেহার বাসা থেকে বেরিয়ে যায় প্রাচুর্য। সোজা পুলিশ স্টেশন। রিশাদকে পুলিশ ধরে এনেছে৷ সেখানেই যাচ্ছে প্রাচুর্য। রিশাদকে টুকরা টুকরা করে কেটে গায়ে নুন ছিটাবে।।
★★★
আবেগ হাসপাতালে ছিল। মেঘ তার কেবিনে হুট করে ঢুকে পড়ে। তারপর আবেগকে সঙ্গে নিয়ে এক প্রকার টানতে টানতে হাসপাতালের বাইরে এনে দাড় করায়৷
আবেগ বিচলিত হয়ে গেল এবং মেঘকে প্রশ্ন করে, হয়েছেটা কি তোর?এনি প্রবলেম?
–দোস, অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। প্রাচুর্য নির্দোষ।
–মানে?
মেঘ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে, রিশাদ হারামজাদা ওরে ব্লাকমেইল করে ফাসায় দিসে রে। ছেলেটা ইনোসেন্ট।আজকে প্রাচুর্য নিজে রিশাদকে ধরিয়ে দিয়েছে পুলিশের কাছে৷
— আলহামদুলিল্লাহ! প্রাচুর্য কি তোকে ফোন করেছিল?
–ধুর না।আমাকে কল দেয় নি। ও হচ্ছে শেখ প্রাচুর্য। আইজি স্যারকে কল করছে। আইজি স্যার হ্যান্ডেল করছে কেস।
–ও।
–চল। পুলিশ স্টেশন যাই।
–হ্যা। চল।
মেঘ আর আবেগ স্টেশন যায়। তাদের সাথেই প্রাচুর্য ঢুকে। তারা তিনজন রিম্যান্ডে রুমে যায়৷
প্রাচুর্য গিয়েই রিশাদের কলার ধরে ফেলে আর নাক বরাবর একটা ঘুষি দেয়৷
তা দেখে মেঘ আবেগকে বলে, তামিল মুভির একশন চলে দেখি! প্রাচুর্যের মতো একশন আমার মধ্যে নাই কেন?
আবেগ প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রাচুর্য ইচ্ছামতো মারল রিশাদকে। মেঘ এবার গিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, দেখেন। রিশাদের রিমান্ডে নেওয়া হবে। ছাড়ুন ওনাকে।
প্রাচুর্য ছেড়ে দেয় রিশাদকে। আবেগ প্রাচুর্যের কাছে গিয়ে বলে, আপনার সাথে কথা ছিল। একটু যদি বাইরে আসতেন?
প্রাচুর্য আর আবেগকে একসাথে যেতে দেখে মেঘও পেছন পেছন গেল।
আবেগ বাইরে গিয়ে প্রাচুর্য কে বলল, প্রাচুর্য আই এম সর্যি।
প্রাচুর্য ভ্রু কুচকে বলে, ফর হুয়াট?
–আমি আমার ভুল বোঝার জন্য অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছি। নেহাকে আপনার ব্যাপারে ভুলভাল বলেছি৷ তারপর কালকের ঘটনার কথা জানালো আবেগ।
–ও। আপনি কি জানেন নেহা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে৷
মেঘ পেছনে থেকে চিৎকার দিয়ে বলে, হুয়াট?
–জি৷
আবেগ অনেক অনুতপ্ত বোধ করে পুনরায় প্রাচুর্যের কাছে ক্ষমা চায়৷
প্রাচুর্য একটা বেদনামূলক হাসি হেসে বলে, আপনি সম্পর্কে নেহার কাছ থেকে শুনেছি। আপনার ব্যক্তিত্ব দেখে আমি মুগ্ধ। আপনার কোন দোষ নাই। নেহা আমার কপালে ছিল না তাই জোটে নি। এসব বাদ৷ দেন। ভুলে যান এসব ঘটনা ।
বলে প্রাচুর্য সামনে পা বাড়ালো। সেও সব ভুলে যাবে। নেহাকে ভুলবে না। মনে মনে ভালোবেসে যাবে।
আবেগ মেঘকে বলে, ছেলেটা খুব ভালো রে।
মেঘ বলে, তোর চেয়ে কম।
আবেগ বিরক্তি নিয়ে বলে, আমার সাথে তুলনা করিস ক্যান? তুই ও খুব ভালো। রিকশাওয়ালার মেয়েটার কি হলো?
–ওই ব্যাটা রে ক্যালানি দেওয়াইছি আর মেয়েটাকে ওয়াল্টনের স্মার্টফোন কিনে দিসি৷
–প্রাউড অফ ইউ৷
মেঘ মুচকি হেসে বলে, আজকে থেকে আর কোন চিন্তা নাই৷ এখন আপনি আপনার ম্যারিড লাইফে ফোকাস করেন ডাক্তার সাহেব। একটু রোম্যান্টিক হন প্লিজ!
আবেগ মাথা নিচু করে হাসল।
★★★
বিকেলের দিকে রোদেলা ছাদে বসে ছিল। আকাশ দেখছিল। আবেগ এখনো ফেরে নি। সন্ধ্যায় আসবে।
তার আকাশ দেখতে খুব ভালো লাগে। সমুদ্র নিচেই আছে মামার কাছে। রোদেলা ছাদ থেকে নেমে তালা দিয়ে বাসার গেল। বাসায় ঢুকতেই বুঝল কারেন্ট নাই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রোদেলা ইভুকে ডাকতে লাগে। কিন্তু কারো কোন সাড়া মিলল না। সে চিন্তিত হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। বাসায় গা ছমছমে ভাব। রোদেলার মনের মধ্যে একটা চাপা ভয় দেখা দিচ্ছে। সে একটা ঢোক চিপে সামনে পা বাড়ালো। ডাইনিং রুমে ঢুকতেই কেউ তার দুটো হাত একত্রে নিয়ে সামনে এনে ধরে ফেলে এবং মুখে হাত দেয়। যেন আওয়াজ না করতে পারে। এর আগেও এই পরিস্থিতি তে পড়েছে সে। তাই ভীষণ ভয়ে পেয়ে যায় রোদেলা। গা ঘামতে লাগল। সে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। তাকে ধরে রাখা ব্যক্তিটা রোদেলার হাত দুটি আরো চেপে ধরে। রোদেলা চোখের পানি ছেড়ে দিল। সে কি আবারো বিপদে পড়েছে? আবেগ কোথায়?
চলবে।