অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ১৪.

0
320

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৪.

ফাতিহ নিজের বিস্ময় আড়াল করে আবার সামনের দিকে তাকায়। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

” কিভাবে জানলে আমার পরিচয়? ”

ল্যায়লা তার হাতের ডায়েরি কলম নামিয়ে পাশে রেখে দেয়। উত্তরে জানায়,

” বৌজনিকা বীচে আসার পথে বিলবোর্ডে তোমার ছবি দেখতে পাই। কোনো কমার্শিয়ালের ছিলো হয়তো। আমি ভেবেছিলাম হয়তো তুমি কোনো চিত্রনায়ক। কিন্তু গুগল করে জানতে পারলাম তুমি আর ইসাম মরক্কান ন্যাশনাল ফুটবল টিমের প্লেয়ার। ”

সাথে সাথে ল্যায়লা আবার বলে উঠে,

” আমি কখনো স্পোর্টস দেখি না। তাই চিনতে পারি নি তোমাকে। সরি ফর দ্যাট। ”

ফাতিহ বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,

” আমি এখনো এমন কিছু করি নি যে সবাই আমাকে চিনবে। ”

ল্যায়লা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

” মানে? ”

” মানে আমার ক্যারিয়ারে তেমন কোনো অর্জনই নেই। ”

ল্যায়লার স্পোর্টস সম্পর্কে ধারণা খুবই সামান্য। কখনো সে খেলার প্রতি আগ্রহই অনুভব করে নি। তাই বুঝতে পারছে না তার এই মুহুর্তে কি বলা উচিত হবে। ফাতিহ ল্যায়লার দিকে তাকায়। তাকে এরকম দ্বিধায় দেখে হেসে বলে,

” ডোন্ট ফিল ওকার্ড। সবার সব কিছু জানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তোমার যেমন স্পোর্টস সম্পর্কে ধারণা নেই তেমন আমারও ফোটোগ্রাফি সম্পর্কে ধারণা নেই। ”

ফাতিহর কথা শুনে ল্যায়লা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তখনই ফাতিহ হেসে বলে,

” কিন্তু তুমি চাইলে আমি তোমাকে স্পোর্টস আর তুমি আমাকে ফোটোগ্রাফি সম্পর্কে ধারণা দিতে পারো। ”

ল্যায়লার চোখমুখ সাথে সাথে জ্বলজ্বল করে উঠে। কেন যেন হঠাৎ করে তার স্পোর্টস বিশেষ করে ফুটবল সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে উচ্ছ্বসিত স্বরে প্রশ্ন করে,

” সত্যি? ”

ফাতিহ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। ল্যায়লার চোখে মুখে আগ্রহ এবং কৌতূহল দেখে সে বেশ উপভোগ করছে। তার মনে পড়ে যায় তাদের প্রথম দিনের সাক্ষাৎ। যখন ল্যায়লার মুখশ্রীতে কেবল নির্জীবতা পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু গত দু’দিনে ল্যায়লার চোখের সেই নিষ্প্রাণতা সরে গিয়ে সেখানে আরো অনেক অনুভূতির সমারোহ ঘটেছে। খুশি, আনন্দ, উল্লাস, কৌতূহল।

__________

এতক্ষণ মনযোগ দিয়ে ফাতিহর কথা শুনে ল্যায়লা মাথা নেড়ে বলে,

” তার মানে তুমি এই পর্যন্ত তিনবার বিশ্বকাপ খেলেছো? ”

” হু। ”

” কিন্তু একবারও তোমাদের টিম রাউন্ড অফ ১৬ এও পৌঁছাতে পারে নি? ”

ফাতিহ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ল্যায়লা মাথা ঝাকিয়ে বলে,

” কি কঠিন খেলা বাপরে! তোমরা তো তা-ও ওয়ার্ল্ড কাপ খেলার জন্য কোয়ালিফাই হতে পেরেছো। আমি ফুটবল খেলতে গেলে বলের আগে নিজে উল্টিয়ে গোলপোস্টে চলে যেতাম। ”

ল্যায়লার কথার ভঙ্গিমা দেখে ফাতিহ গা কাপিয়ে হেসে উঠে। ল্যায়লা ভ্রু কুচকে তাকায়। সে কি এমন হাসির কথা বললো যে এভাবে হাসতে হবে?

” ভ্যানিলা ওর চকলেট? ”

ইসাম ল্যায়লার দিকে তিনটা আইস্ক্রিম এগিয়ে ধরে প্রশ্ন করে। ল্যায়লা উত্তর দেওয়ার আগেই ফাতিহ পাশ থেকে ওর হাত হতে দুটো আইস্ক্রিম নিয়ে বলে উঠে,

” কোনটাই না। ”

ইসাম রেগে বলে উঠে,

” আমি তোকে না ল্যায়লা কে প্রশ্ন করছিলাম। ”

ফাতিহ ততক্ষণে দুটো আইস্ক্রিমই খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। সে খেতে খেতে উত্তর দেয়,

” ওর এখনো ঠান্ডার মেডিসিন চলছে। তাই ও খেতে পারবে না। ”

ইসাম ভুলে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠে,

” শিট। খেয়াল ছিলো না। সরি ল্যায়লা। ”

ল্যায়লা হেসে বলে,

” সমস্যা নেই। আমি এভাবেও বাটারস্কোচ বাদে অন্য কোনো ফ্লেভার পছন্দ করি না। ”

ইসাম ল্যায়লার পাশে বসে আইস্ক্রিম মুখে দিয়ে প্রশ্ন করে,

” কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো? ”

ল্যায়লা উত্তর দেয়,

” তোমাদের ওয়ার্ল্ড কাপ ম্যাচ নিয়ে। ”

ল্যায়লার কথা শুনে ইসাম বিষম খায়। সে কাশতে কাশতে অবাক চোখে ফাতিহর দিকে তাকায়। ল্যায়লা বলে উঠে,

” ডোন্ট ওয়ারি। আমি জানি তোমাদের পরিচয়। ”

ইসাম নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে,

” কিভাবে? ”

” রাস্তার পাশে বিলবোর্ডে আমি ছবি দেখেছি। ”

ইসাম মাথা নেড়ে বলে উঠে,

” এদের নিয়ে আর পারি না। আমি জানি আমার ফেস ভ্যালু অনেক। পুরো দেশের সব মেয়েরা আমার জন্য পাগল। তাই বলে প্রতি রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিলবোর্ডে আমার ছবি টাঙিয়ে রাখতে হবে? কি যে করি! ”

ল্যায়লা চোখ বড় বড় করে ইসামের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে উঠে,

” আমি তোমার না ফাতিহর ছবি দেখেছিলাম। ”

সাথে সাথে ইসামের মুখটা একটুখানি হয়ে যায়। সে তাকিয়ে দেখে ফাতিহ মিটিমিটি হাসছে পিছনে। ল্যায়লা আর তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে নিজের ক্যামেরা হাতে নিয়ে একটা ছবি বের করে তাদেরকে দেখিয়ে বলে,

” ইট ওয়াজ মাই ফার্স্ট ক্লিক ইন দিজ ক্যামেরা। ”

ফাতিহ আর ইসাম চোখ বড় করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আবার ল্যায়লার দিকে তাকায়। ফাতিহ মুখ হা করে বলে উঠে,

” ড্যাম! আর ইউ এ ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার? ”

ল্যায়লা মাথা নেড়ে বলে,

” আম নট শিওর ইফ আই ক্যান কল মাইসেল্ফ দ্যাট। ”

ইসাম খুটিয়ে খুটিয়ে ছবিটা দেখছে। ঘন সবুজ অরণ্যের একটি গাছে সবুজ রঙের একটি সাপ ফোনা তুলে গাছের ডাল পেচিয়ে ঝুলে আছে। ইসাম বলে,

” ওয়াও! সাপটা অনেক কিউট। এই সুইটহার্টের নাম কি? ”

ল্যায়লা নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

” ট্রিমারিসুরুস আলবোলাব্রিস। একে সাদা ঠোঁটযুক্ত পিট ভাইপারও বলা হয়। এর বিষদাঁত রয়েছে। এক কামড়েই মৃত্যু ঘটতে পারে। ”

ইসাম ল্যায়লার কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। ফাতিহ প্রশ্ন করে,

” এটা কোথায়? ”

” বাংলাদেশের বান্দরবানে। ”

ইসাম ভাঙা গলায় উচ্চারণ করে,

” বান-দার-বান? এটা আবার কেমন নাম? এই জায়গার নাম এটা কেন রাখা হয়েছে? ”

ল্যায়লা এবার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বাংলায় বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

” কারণ ওখানে তোমার মতো অনেক বান্দর আছে। ”

__________

নিঝুম রাত। ফাতিহ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে অনেকক্ষণ ধরে। যখন তার ধীরে ধীরে চোখ লেগে আসে তখনই দরজায় নকের শব্দ পায়। ফাতিহ বিরক্ত হয়। তার কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে। এই মাঝরাতে কে আসবে তার রুমে? তখনই ফাতিহর মনে পড়ে ল্যায়লা নয়তো?

তৎক্ষণাৎ সে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে ইসাম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফাতিহ বিরক্তির সুরে প্রশ্ন করে,

” তুই এতো রাতে কি করছিস? ”

ইসাম সোজা রুমের ভেতরে প্রবেশ করে সোফাতে বসে। তারপর বলে উঠে,

” আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস জানতে পেরেছি। ”

ফাতিহ দরজা লাগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে,

” কি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস? ”

ইসাম চোখমুখ সিরিয়াস করে সোজা হয়ে বসে বলে,

” আমি জানি ল্যায়লা কেন সুইসাইড এটেম্পট করতে এসেছে। ”

ইসামের কথা শুনে ফাতিহর চোখের ঘুম উবে যায়। সে প্রশ্ন করে,

” আর ইউ সিরিয়াস? কিভাবে জানলি? কি কারণ? ”

ইসামের চেহারা এখন আগের তুলনায় আরো বেশি সিরিয়াস হয়ে যায়। সে বলে,

” ল্যায়লার একচুয়্যালি একজন বয়ফ্রেন্ড ছিলো। কিন্তু ল্যায়লার এই পশু-প্রাণী আর নাগ-নাগীনদের ছবি তোলার প্রতি অবসেশন দেখে বেচারা মজনু হয়তো ভয়ে ওর সাথে ব্রেকাপ করে ফেলে এবং ওকে সিস্টার জোনে ফেলে দেয়। এজন্যই হয়তো ওদিন ল্যায়লা ভাইয়ের কথা শুনে এতো রেগে গিয়েছিল। আর এই প্রেম বিচ্ছেদ মেনে নিতে না পেরে ও হয়তো বড় বড় কিংবদন্তী প্রেমিক প্রেমিকাদের মতো নিজের জীবন দিতে এসেছে। ”

ইসামের কথা শুনে রাগে ফাতিহর মাথার রগ দপদপ করতে শুরু করে। সে কোনো মতে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে,

” এসব তোকে ল্যায়লা বলেছে? ”

ইসাম সোফায় হেলান দিয়ে বলে উঠে,

” না। আমার ঘুম আসছিলো না। তাই শুয়ে শুয়ে এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে এই রহস্য উদঘাটন করি। ”

ফাতিহ রাগে এইবার উঠে ইসামকে ধরে দরজার বাইরে নিয়ে বলে,

” ব্রো প্লিজ। নিজেও ঘুমা আর আমাকেও ঘুমাতে দে। আর দয়া করে তোর ব্রেইনের উপর আর প্রেশার দিস না। ”

কথাটা বলেই ফাতিহ দরজা লাগিয়ে দেয়। বিছানায় গিয়ে আবার ঘুমানোর জন্য শুয়ে থেকে কিছুক্ষণ পর উঠে বসে। আর ঘুম আসছে না। তারা এই মুহুর্তে মোহাম্মেদিয়া শহরের আভান্তিয়া বীচ হোটেলে অবস্থান করছে। সমুদ্রের তীরবর্তী এই হোটেলের রুমের বারান্দা থেকেই সি ভিউ পাওয়া যায়। ফাতিহ উঠে বারান্দায় যায়৷ সাথে সাথে বাতাসে তার আত্মা শীতল হয়ে যায়। তার একপাশের রুমে ইসাম এবং অন্য পাশের রুমে ল্যায়লা আছে।

ফাতিহ ঘাড় ঘুরিয়ে ল্যায়লার বারান্দার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় ল্যায়লা বারান্দায় একটি কাউচে বসে ঘুমোচ্ছে। ফাতিহর ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। এখানে বসে ঘুমোচ্ছে কেন? কি ফিনফিনে শীতল বাতাস! এই মেয়ের তো আবার ঠান্ডা লেগে যাবে। ফাতিহ একবার ভাবে ডেকে বলবে ভেতরে যেতে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে শুধু শুধু ঘুম ভাঙিয়ে লাভ নেই কোনো।

ফাতিহ দূর থেকে ল্যায়লার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ল্যায়লার স্নিগ্ধ ঘুমন্ত চেহারা দেখে আচমকা তার বুকের ভেতর ধক করে উঠে। গাঢ় স্বরে বলে,

” দূরে থাক ফাতিহ। পুড়তে না চাইলে দূরে থাক। ”

কথাটা বলেই সে বড় বড় কদম ফেলে নিজের রুমে চলে যায়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here