অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৮.
সকালের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে এসে লাগতেই ল্যায়লা নড়েচড়ে উঠে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সে। চারিদিকে তাকাতেই সে অবাক হয়। জায়গাটা তার অপরিচিত। গতরাতের চিত্র মনে করতেই তার মনে পড়ে সে গাড়িতে ছিলো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে টের পায় নি। এটাই কি তবে ইসামের দাদার বাসা? ল্যায়লা বিছানা ছেড়ে নামতেই দেখে তার পায়ের কাছে এক জোড়া বাসায় পড়ার জুতা। ল্যায়লা জুতা জোড়া পড়ে রুম থেকে বের হয়।
রুম থেকে বের হতেই সে দেখতে পায় বাড়িটা সম্পূর্ণ একটি ট্র্যাডিশনাল মরক্কোর বাসার ন্যায়। বাসার দোতলায় তিনদিক দিয়ে খোলা করিডোরের ন্যায় বারান্দা। প্রতি পাশে দুটি করে মোট ছ’টি রুম এই তালায়। সম্পূর্ণ বাসাটা সাদা রঙের হলেও, দরজা, জানালা, বারান্দার রেলিং এবং সিঁড়ি সব কাঠ দ্বারা নির্মিত। সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় আসতেই ল্যায়লা দেখে এখানেও একই রকমভাবে তিনপাশে করিডোরের ন্যায় বারান্দা। তার মাঝে বিশাল উঠোন। পুরোটাই সাদা এবং সবুজ টাইলস দ্বারা সজ্জিত। উঠোনের চারদিকে চারটি টবে মনস্টেরা গাছ। মাথার উপর খোলা আকাশ।
” ল্যায়লা? উঠে গিয়েছো? ”
ল্যায়লা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে ইসাম দাঁড়িয়ে আছে। ল্যায়লা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। ইসাম এগিয়ে এসে হেসে চারিদিকে তাকিয়ে বলে,
” বাড়ি সুন্দর লেগেছে তোমার? ”
ল্যায়লা মলিন মুখে বলে,
” সুন্দর। ”
ইসাম হাত ঘড়ি দেখে বলে,
” চলো নাস্তা করবে। ফাতিহ আর ফিরুজে খালাও ভিতরে। ”
ল্যায়লা ইসামকে অনুসরণ করে মাঝখানের করিডর দিয়ে একটি দরজার ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় বিশাল ডাইনিং রুম। যার মাঝখানে রয়েছে গোলাকৃতির টেবিল। রুমের চারিদিকে বিভিন্ন কেবিনেট, শোপিস দ্বারা সাজানো। ল্যায়লাকে দেখতেই ফিরুজে এরাবিকে বলে উঠে,
” শাবাহ আল খায়ের৷ ”
কথাটুকু বলেই তিনি জিভ কেটে বলে,
” ভুলেই গিয়েছিলাম ল্যায়লা এরাবিক পারে না। ”
তিনি আবার বলে,
” গুড মর্নিং। ”
ল্যায়লা ফিরুজে খালার পাশে দাঁড়িয়ে জবাব দেয়,
” গুড মর্নিং। ”
ফাতিহ টেবিলে বসে নাস্তায় ব্যস্ত ছিলো। সে আড়চোখে একবার ল্যায়লাকে দেখে নিয়ে আবার খাওয়ায় মন দেয়। ফিরুজে ল্যায়লাকে টেবিলে বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। ল্যায়লা শান্ত ভঙ্গিতে একবার টেবিল দেখে নেয়। বাংলাদেশের তুলনায় এদেশের খাদ্যাভ্যাসও অনেকটা আলাদা। মরক্কানরা সাধারণত নাস্তায় অলিভ, জ্যাম, আমলউ, মধু, গ্রীক ইউগার্ট, ডিম, ব্রেড এবং হারিরা নামক এক ধরনের স্যুপ খেয়ে থাকে। এই সকল খাবার গুলোই টেবিলে উপস্থিত আছে। ল্যায়লা চোখ বড় বড় করে তার সামনে বসা ইসাম এবং ফাতিহর দিকে তাকায়। তারা চোখের পলকেই সব কিছুই একটু একটু করে খেয়ে ফেলছে।
ল্যায়লাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফাতিহ প্রশ্ন করে,
” কি? ”
ল্যায়লা মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বলে,
” তোমরা এতো খাচ্ছো মোটা হয়ে যাবে না? ”
ল্যায়লার এধরণের প্রশ্ন শুনে ফাতিহ আর ইসাম দুজনই তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। পরপরই তারা হো হো করে হেসে উঠে। তার হাসির শব্দে ফিরুজে খালাও এসে উপস্থিত হন। ল্যায়লা বোকার ন্যায় তাকিয়ে থেকে ভাবে, সে কি ভুল প্রশ্ন করলো?
ইসাম হাসতে হাসতে বলে উঠে,
” এটাকে তুমি এতো খাবার বলছো? ”
ল্যায়লা একই স্বরে বলে,
” আমি কখনো এতো খাবার খাই না। ”
ফাতিহ হেসে বলে,
” এই কারণেই তো শরীরের এই অবস্থা। ”
এই কথায় ল্যায়লা রাগ অনুভব করে। এই লোকটা সবসময় এমন কথা কি তাকে রাগানোর উদ্দেশ্যেই বলে? ইসাম বলে,
” এসব তো কিছুই না। আমরা লাঞ্চ এবং ডিনারে এর তুলনায় আরো বেশি খাই। কিন্তু ওয়ার্ক আউট করি দেখে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। ”
ল্যায়লা খেতে খেতে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
” কি এমন বয়স হয়েছে এদের যে ওয়ার্ক আউটও করে! ”
কথাটা ল্যায়লা বিড়বিড়িয়ে বললেও তা সকলেই স্পষ্ট শুনতে পায়। আরেক দফা সবাই একসাথে হেসে উঠে। ল্যায়লা কেবল মুখে একটা অলিভ পুরেছে। সকলের হাসি শুনে সে চোখ বড় করে তাকায় সামনের দিকে। মুখের ভেতর খাবার থাকায় তার গাল ফুলে আছে। দেখতে অনেকটা আদুরে লাগছে। ফাতিহর মায়া হয় দেখে। এই মেয়েকে সারাক্ষণ সে হয় বিষন্ন কিংবা রাগী হয়ে থাকতেই দেখেছে। ল্যায়লার মুখশ্রীতে এমন আদুরে ভঙ্গি দেখে তার হঠাৎ মন চাইলো এই দৃশ্য সে ক্যামেরাবন্দী করতে পারলে মন্দ হতো না। কারণ এরকম দৃশ্য হ্যালির ধুমকেতুর মতো হয়তো জীবনে একবার দেখার সুযোগ হলো তার। কিন্তু মনের ইচ্ছা মনে দাফন করে ফাতিহ বলে উঠে,
” তোমার কি আমাদের দেখে নিজের সমবয়সী মনে হয়েছে? ”
” তা নয়তো কি? তোমাদের হাইট দেখেছো? আমি প্রায় তোমাদের সমান। ”
ল্যায়লা যেন আজ বোকা বোকা কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে। ফিরুজে খালা হাসতে হাসতে রান্না ঘরে চলে যায়। ইসামও বেশ মজা পাচ্ছে ল্যায়লার কথায়।
এটা সত্য যে ল্যায়লা হাইটের দিক দিয়ে মোটামুটি ভালোই লম্বা। কিন্তু তবুও বুটস হিল পড়েও সে ফাতিহ এবং ইসামের কাধ সমান কেবল। আর এটা দিয়েই সে তাদের নিজের সমবয়সী ভেবে নিয়েছে?
ফাতিহ হেসে বলে,
” আমরা গুনে গুনে তোমার থেকে নয় বছরের বড়ো। ধরে নাও, তোমার বাবা যদি ঠিক বয়সে বিয়ে করতো তাহলে আমাদের বয়সী তোমার বড়ো ভাইও থাকতো। নাকি আছে? তোমার পরিবারে কে কে আছে আমার জানা নেই আসলে। ”
মুহুর্তেই ল্যায়লার মুখ পাষণ্ড রূপ ধারণ করে। সে কঠিন স্বরে বলে উঠে,
” আমার কোনো ভাইয়ের প্রয়োজন নেই। ভাইদের আমি ঘৃণা করি। আর যেই সম্পর্কে তুমি জানো না সেই সম্পর্কে কথা বলবে না কখনো। ”
কথাটা বলেই ল্যায়লা টেবিল ছেড়ে উঠে তড়িৎ গতিতে হেঁটে উপরে চলে যায়। ফাতিহ এবং ইসাম দুজনই বোকা বনে যায়। হঠাৎ করে কি হলো? ইসাম প্রশ্ন করে,
” রেগে গেলো কেন? ”
” হয়তো সঠিক জায়গায় টোপ ফেলেছি তাই। ”
ল্যায়লার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে ফাতিহ কথাটা বলে।
__________
সারাদিন আর ল্যায়লা রুম থেকে বের হয়নি। দুপুরের খাবারটাও ফিরুজে খালা তার জন্য রুমে নিয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন অলস ভঙ্গিতে রুমে পার করার পর সন্ধ্যার দিকে ল্যায়লা ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন রাত ১১ টার উপর বাজে।
ল্যায়লা চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। এতো রাত হয়ে গেলো অথচ কেউ তাকে ডাকে নি? ল্যায়লা উঠে রুমের বাইরে যায়। সাথে সাথে সে চমকে যায়। চারিদিকে কোনো আলো নেই কেন? সে আবার ফিরে এসে রুম থেকে নিজের ফোন নিয়ে ফ্ল্যাশ লাইট অন করে বের হয়। করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভীত স্বরে ডাকে,
” ফিরুজে খালা? ”
” ইসাম? ”
কেউ তার কথার জবাব দিচ্ছে না। ল্যায়লা দোতলা থেকে উঁকি দিয়ে নিচে তাকায়। নিচেও সব লাইট নিভানো। তারমানে সেখানেও কেউ নেই। আচমকা ল্যায়লার মনে ভয় গ্রাস করে। এতো বড় বাসায় নিজেকে বেশ একা মনে করে। সকালে তার ওরকম ব্যবহারের জন্য কি সবাই রাগ করে তাকে একা ফেলে চলে গিয়েছে?
ভয়ে ল্যায়লা হাতের মুষ্টিবদ্ধ করে, নখ দিয়ে হাতের তালু চেপে ধরে। তখনই আচমকা এক চিলতে আলো জ্বলে উঠে কোথাও। মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখতে পায় ছাদে আলো জ্বলছে। ল্যায়লার মনে পড়ে সে ছাদে উঠার সিঁড়িও দেখেছিলো কিন্তু আর যাওয়া হয় নি তার। সাহস করে সে দ্রুত পা বাড়িয়ে ছাদে যায়৷
ছাদে যেতেই সে আরেক দফা অবাক হয়। ছাদের মাঝখান দিয়ে ফাঁকা শূন্যস্থান। চারিদিক দিয়ে রেলিং দিয়ে ছাদের জায়গা। ছাদের একপাশে দুটো বেশ বড়সড় চৌকি। তার উপর গদি বিছানো। তার সামনেই একটি বারবিকিউর চুলা। যার পাশে একটি লম্বা টেবিলের উপর বেশ কিছু রান্নার সরঞ্জাম এবং খাবার। সেখানে দাঁড়িয়ে ফাতিহ দক্ষ হাতে কিছু কাবাব বারবিকিউ করছে এবং ইসাম একটি পাখা দিয়ে বাতাস করে আগুনের তাপ নিয়ন্ত্রণ করছে।
” দাঁড়িয়ে না থেকে এসে বসো। ”
ফাতিহর কণ্ঠ শুনে ল্যায়লা চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে একটি চৌকিতে বসে। প্রশ্ন করে,
” ফিরুজে খালা কোথায়? ”
ইসাম উত্তর দেয়,
” উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। একচুয়্যালি খালার ডায়াবেটিস আছে। তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। আমরা তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। তোমার গলা শুনতে পেয়েই ওপাশের আলো জ্বেলে দিয়েছি। ”
ল্যায়লা চুপচাপ বসে থাকে। ফাতিহ আর ইসাম মিলে তিনটা প্লেট প্রস্তুত করে। সুজির তৈরী কুসকুস, লুবিয়া, সাথে কাবাব। ইসাম একটা চৌকিতে নিজের প্লেট নিয়ে বসে। ফাতিহ ল্যায়লার সামনে তার প্লেট দিয়ে বলে,
” আমি গিয়ে সোডা ওয়াটার নিয়ে আসছি। ”
ফাতিহ নিচে গেলেই ইসাম হেসে বলে উঠে,
” খেয়ে বলো কাবাব কেমন হয়েছে? ”
ল্যায়লা চামচ দিয়ে কিছুটা মুখে দেয়। অনেক সুস্বাদু। কিন্তু মুখে বলে,
” খারাপ না। ”
ইসাম হতাশ হয় ল্যায়লার কথায়। বলে,
” ফাতিহ এতো সুন্দর করে কাবাব বানিয়েছে। আমি চুলোয় কয়লা জ্বালিয়ে রান্নার সময় এতক্ষণ পাখাও নাড়লাম। তবুও তুমি বলছো খারাপ হয়নি! আমি কষ্ট পেলাম। ”
ইসামের কথা বলার ভঙ্গি দেখে আচমকা ল্যায়লা হেসে উঠে। ইসাম এতে চমকে যায়। তার চোখে বিশ্বাস হচ্ছে না এতোদিন চেষ্টার পর অবশেষে সে ল্যায়লাকে হাসাতে পেরেছে। সে আরেকটু ঢং করে বলে উঠে,
” বিশ্বাস করো ল্যায়লা এই কয়লা জ্বালানো কাবাব বানানোর থেকেও বেশি কষ্টসাধ্য কাজ। কয়লা ঠিকঠাক না জ্বালাতে পারলে কাবাব একদম পুড়ে ছারখার হয়ে যেতো। ”
ল্যায়লা আবারও স্ব শব্দে হেসে উঠে। দূর থেকে আড়ালে এই দৃশ্য নিজের ফোনের ক্যামেরা বন্দী করে নেয় ফাতিহ। এরকম দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য তার রোজ রোজ তো হবে না। ফোনটা পকেটে গুজে ছাদের দরজা থেকে আবার ল্যায়লার দিকে তাকায় ফাতিহ। ছাদের ল্যাম্পের হলুদ আলোয় এই হাসিমাখা মুখশ্রী দেখতে মনমোহনীয় লাগছে। ফাতিহ মনে মনে বলে উঠে,
” এই মুখশ্রীতে বিষন্নতা না কেবল হাসি মানায়। এতো চমৎকার হাসতে জানা মানুষের জীবনে কেবল একটি হাসির কারণের অভাব। আল্লাহ যেন সেই অভাব ঘুচিয়ে দেয়। ”
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]