“আকাশী”
পর্ব ১৯.
দিনের বেলায় যানের চলাচল মানুষের আওয়াজ-চিৎকার সব মিশিয়ে রেডিওর শনশন আওয়াজের মতো শোনায়। তখন বোধ হয়, মাথায় যদি কোনো তার থেকে থাকে, সবই ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড় হবে। কিন্তু অপরপক্ষে রাতের বেলার পরিবেশটাই ভিন্ন। দিনের বেলার বিকট সেই শব্দ রাতের বেলায় যেন অজানা এক সুর তোলে। শান্তির সুর। রাজিব আর নিশান একেকটা কৌতুক করে হাসাহাসি করছে। রাজিবের সবসময় একটাই উদ্দেশ্য থাকে, আকাশীকে রাগানো। এমন কথা সে তোলে, আকাশী চটে না গিয়ে পারে না। একটু আগেই রাজিব ফিসফিস করে বলল, ‘আকাশী আকাশী পেছনে ছেলে একটা দেখ, তোর দিকে কী করে তাকিয়ে আছে।’
আকাশী চিন্তিত হয়ে সত্যিই পেছনে ফিরল। ফিরে সে সন্দেহজনক কাউকেই পেল না। তাকে বোকা বানিয়ে রাজিব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে হেসে উঠল। নিশানও তার সাথে যোগ দেয়। আকাশীর সাথে এসব কাজ সে প্রায়ই করে, যা তাকে বিরক্ত করে তোলে। এবার করেনি। এবারের মতো সে কখনও রাতের বেলায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমিয়ে সময় কাটায়নি। রাতের এই মাতাল করা পরিবেশ আকাশীকে কেন এতো টানে তা তার জানা নেই। ব্যস, ইচ্ছে হয়, এভাবেই এই মুহূর্তগুলোর জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। আকাশী কথা বলতে বলতে হঠাৎই রেস্টুরেন্টের গ্লাসের বাইরে অনিককে দেখতে পেল। অনিকেরও তার সাথে চোখাচোখি হতে সে ভেতরে ঢুকে যায়।
‘কী আকাশী? কী হচ্ছে এখানে?’
‘বন্ধুদের সাথে টাইম স্পেন্ড করছি। একচুয়ালি টাইম স্পেন্ড না। আমার এই বন্ধুগুলো ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনালে টেনেটুনে পাস করে ফেলার জন্য ট্রিট দিয়েছে।’
অনিক হাসল, ‘কি! টেনেটুনেতে ট্রিট?’
রাজিব বলল, ‘ভাই, আপনি এর মর্ম বুঝবেন না। আমরা যারা সারাবছর পড়াশোনা করি না, তারা কোনোভাবে পাস করে ফেলতে পারলে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা হয়। সে উপলক্ষে ট্রিট। আপনি এই আকাশীর কথা বইলেন না, সে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে আমাদের চেয়েও ডাবল মার্ক নিয়ে এসেছে। মন চায়, ওরে হাতের মুঠে নিয়ে মুচড়ে ফেলি।’
অনিক রাজিবের কথার ধরন দেখে হাসল। আকাশী তাকে বলল, ‘ও এভাবেই কথা বলে। হিংসায় কী করবে বুঝতে পারছে না। আজ আমি ফেল হলে উল্টো কান্না করে ভাসিয়ে দিত। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বোস।’
চেয়ার টেনে আকাশীর পাশে অনিক বসে পড়ল। বাকিরা নীরবে তাদের দিকে চেয়ে রইল। তারা এই যাবৎ মনে করত, আকাশীর মনে কেউ নেই। এমনকি সে কখনও নিজের মনের কথাও বলে না। সহজেই বুঝা যায় না, সে কাউকে ভালোবাসে কিনা। যদি ছেলেটা তার বয়ফ্রেন্ড হয়, তবে অনেক লম্বা একটা কৈফিয়ত আকাশীকে তাদের কাছে দিতে হবে। আকাশী বলল, ‘তোরা হঠাৎ চুপ হয়ে গেলি কেন? আচ্ছা শোন, ও হচ্ছে অনিক। আমরা ছোটবেলায় একসাথে লেখাপড়া করেছিলাম।’
আকাশী সামনের টেবিলে বসা ছেলেদের দেখিয়ে বলল, ‘অনিক, ও রাজিব। আর ওই চাশমিশটা নিশান। আমার পাশের ঝুমুরের কথা তো বলেছিলাম। ওর পাশেরটা আমাদের নতুন ফ্রেন্ড, আতিকা।’
অনিক সবার সাথে পরিচিত হলো। তার আসার পর থেকে সবাই একরকম চুপ হয়ে গেল। আকাশী তা ধরতে পেরে বলল, ‘অনিক আমার সাথে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। এরপর থেকে সে বিদেশে ছিল। আমাদের মাঝে তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। তোরা যা ভাবছিস, ওরকম কিছু না। ও এই একমাস আগে দেশে এসেছে। আমি আমার বাড়ির যে চেয়ারম্যান চাচার কথা বলি, ও তাঁর ছেলে। তিনি এখন অসুস্থ। সে কারণেই চলে এসেছে। একটা বছর সে এখানেই থাকবে।’
অনিক ম্লান হাসে। সে কিছুটা আহত হয়েছে। যদিও সত্যিই আকাশীর সাথে তার বন্ধুত্বের ব্যতীত আর কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু তা স্বীকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সবগুলো ক্লেশ দূর হতেই আবার আড্ডা জমে উঠল। অনিক সহজ হওয়ার চেষ্টা করল। দোকানে দোকানে একা ঘুরার চেয়ে ঢের ভালো, কারো বন্ধুর সাথে আড্ডা দেওয়া। অনিক তাই করল, আকাশীও তা পছন্দ করেছে। আড্ডা শেষে যে যার বাড়ি চলে যায়।
অনিক আর আকাশী একসাথে বেরুয়। অনিক নতুন বাইক কিনেছে। তা ইন্টারসেকশনের আগের রোডের পাশের একটি গ্যারেজে থাকার সত্ত্বেও সে আকাশীকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়িতে লোক উঠায় আকাশীকে তার পাশেই বসতে হয়েছে। আকাশী বাল্যবন্ধুর পাশে কিঞ্চিতও সঙ্কোচ করছে না। কিন্তু এই বিষয় নিয়ে সঙ্কোচ লাগছে যে, ওঠার পর থেকে অনিক একটি কথাও বলেনি। বাইরের দিকে মুখ করে বসে আছে। যথারীতিতে তারা দু’জন বাড়ির রাস্তায় গাড়ি থেকে নামল। এরপরের পথটা হেঁটে যেতে হয়। কিছুদূরে স্কুল প্রাঙ্গণ। গাড়ি এরচেয়ে বেশি যায় না। আকাশীরা হাঁটাই ধরল। অনিক তখনও কিছু বলছিল না। স্কুল প্রাঙ্গণ ছেড়ে খামারের পাশের রাস্তায় এলে নীরবতা ভেঙে আকাশী চলতে চলতেই বলল, ‘কী হয়েছে অনিক? কথা বলছিস না কেন?’
আকাশী তখন লক্ষ করল, সে কিছুদূর হেঁটে এসেছে। অনিক একটু পেছনেই রয়ে গেছে। সে পেছনে ফেরার আগেই অনিক তার হাত ধরে ফেলল। এই হালকা অন্ধকারের নির্জন রাতে চাঁদের ম্লান আলোয় অনিককে অন্যরকম দেখাচ্ছে। তার চোখগুলো যেন মায়া জাগানোর মতো ভোলা দেখাচ্ছে।
অনিক গলা খাঁকার দিয়ে বলল, ‘আমাদের মাঝের সম্পর্কটা অন্য ধরনের হলে ভালো হয় না আকাশী?’
‘যেমন?’
‘তুই বড় হয়েছিস। এই সময় মেয়েদের কাছে কাছের মানুষ বলতে কেউ না কেউ থাকেই। যে মেয়ের নেই, তার জন্য অনেক ছেলের মনে ভাবনা জাগে। আমারও সেই অবস্থা। তুই এখন যাই ইচ্ছা তাই করতে পারিস। তোকে ধরেবেঁধে রাখার কেউ নেই। আর আমি বড় তেমন একটা না হলেও তোর আমার জুটিকে সকলেই অনেক পছন্দ করবে। সবচেয়ে বেশি খুশি হবে বাবা। তিনি তো তোকে খুব পছন্দ করেন।’
‘কিছু ভাবনাকে প্রশ্রয় না দেওয়া ভালো, বিশেষ করে সেগুলোকে, যেগুলো ক্ষণিকের জন্য মনে জাগে। আমরা সমবয়সী, ছোটবেলা থেকেই একে-অপরকে চিনি। তোর আর আমার চিন্তাভাবনার মধ্যেও বিস্তর ফারাক আছে। আর তুই তেমন একটা বদলাসনি যে, তোকে নতুন করে জানার মতো কিছু অবশিষ্ট আছে। তাই তোর আমার জুটি মনের দিকে থেকে মানাবে না। আর আমার মনের কথা তেমন কাউকে বলতে যাই না। একসময় তোকে বলতাম বিধায়, এখন সেই মিতাইয়ের কারণে বলি, প্রেম-ভালোবাসা এসব আমার মতে শুরু করতে হয় না, একসময় হয়ে যায়। এটা কোনো মেশিন না যে, চালু করতে বললে চালু হয়ে যাবে। এই ধরনের যান্ত্রিক সম্পর্ক উচ্চ পদস্থ কিছুই লোকই স্থায়ী রাখে, যাদের কাছে জীবন মানে বিজনেস, গার্লফ্রেন্ড রাখা স্মার্টনেস। তাদের মনে ভালোবাসার আসল একটা দানাও নেই। এই ধরনের যান্ত্রিক সম্পর্ক বেশ কিছুদিন টেকেও না।’
‘তাহলে তুই কী বলতে চাস? আমার জায়গায় অজানা একটি ছেলে হলেও কি তুই তাকে এসব কথা বলতি? সোজাভাবেই বল না, আমার মাঝেই কোনো কমতি দেখেছিস।’
আকাশী বুঝানোর চেষ্টা করল, ‘এইতো বোঝালাম, যান্ত্রিক ভালোবাসায় আমি ইন্টারেস্টেড নই। তোর স্থলে অন্য যেকোনো ছেলে হলেও আমি একই জবাব দিতাম।’
‘তাহলে তুই কি কারো সাথে কখনও সম্পর্ক করবি না?’
‘এটা সময়ের ওপর ডিপেন্ড করে। আমি যদি কখনও কোনো ছেলের জন্য অন্য কিছু অনুভব করতে থাকি, তবে আমি তাকে আপন করতে সঙ্কোচ করব না। বরং ওকে পেতে আমার সাধ্যের সবকিছুই করব। কারণ আমার জীবনে এমন লোক অনেক কম ছিল, যাদেরকে মনের গহীন থেকে ভালোবাসা দিতে পেরেছি। বাবা যাওয়ার পর থেকে আমার কাছে কেউই নেই। মাকে যে ভালোবাসাটা দিতে চাই, তিনি তা নেন না। নির্দিষ্টতই আমি একদম একা। আমার মনের ভালোবাসাগুলো জমছে। যেদিন তারা কারো সান্নিধ্যে আসবে সেদিন জান দিয়ে তাকে ভালোবাসব। যে ভালোবাসা কাউকে দিইনি, সবই সে পাবে। সেদিনটার অপেক্ষা আমি করতে চাই না। সেদিনটা এলে আমি পুরোপুরিই নিশ্চল হয়ে পড়ব। এখন আমার মন-মস্তিষ্ক সবই জীবনের ওপর। জীবনকে কোন আকার দেবো, তাতেই দুটোকে কাজে লাগাচ্ছি। এই সময় যদি আমি আমার মনের মানুষটাকে খুঁজতে যাই, আমার ক্যারিয়ার বরবাদ হয়ে যাবে। কারণ আমার মন-মস্তিষ্ক তার ওপরই কাজ করতে শুরু করবে। যদি সে একদিন আমাকে ছেড়ে দেয়, তবে আমি একা কী নিয়ে বাঁচব? ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না বলতে বলতে তাকে নিয়েই ভেবে ফেলি। ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আমি বর্তমানটাকে ভালোভাবে চলানোর চেষ্টা করছি। আমি ইচ্ছা করেই আমার মনটাতে লাগাম দিয়েছি। কারণ আমি মনে করি, আমি তৈরি হয়েছি আজীবন সংগ্রাম করার জন্য, শুধু কারো ভালোবাসার মানুষ হয়ে থাকার জন্য নয়। আমি কষ্ট পছন্দ করি। এটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সুখের দেখা পেলেও আমার লাগছে, আমি মানিয়ে নিতে পারব না। তাই সুখের দেখা পাওয়ার ইচ্ছেও নেই অনিক। যেমন চলছি তেমনই চলতে চাই।’
অনিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আকাশীর জমানো আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসাটা যে পাবে সে সত্যিই ভাগ্যবান কেউ হবে। দুঃখ হলো, সে ওই ভালোবাসাটা পেল না। পেয়ে যাবে অন্য কেউ। আকাশী খামারের দিকে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অনিক নিজেকে সহজ করে হেসে বলল, ‘অনেক গম্ভীর কথা আজ আমাদের মাঝে হয়ে গেল। আমি চাই, এই অধ্যায়টা মুছে যাক। আমরা আগের মতোই ফ্রেন্ড হয়ে থাকি। পরশু তো বাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। আজকের দিনের কারণে আবার আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিস না।’
‘তুই পাগল নাকি?’
‘শোন, দিনটা বাবার জন্য খুব বড়। তাঁর চেয়ারম্যানের পদটা কোনো না কোনোভাবে তুই-ই অর্থবহ করেছিস। বাবার টাকা কম, উন্নয়ন করতেও জানতেন না। তবে ইচ্ছা রাখতেন। সেই ইচ্ছাকে তুই বাস্তবায়িত করেছিস। মানুষ তাকে ভালো মানুষ হিসেবে মান্য করতই। তোর কারণেই তাঁর সম্মান আরও বেড়েছে। সেই মদ বিক্রয়কারীকে তাড়ানো, মেয়েদের বাল্যবিবাহ কমানো, শিক্ষা বাড়ানো, আবার এই যে ঘাটের নির্মাণ সবকিছুর মাধ্যমে বাবা যে শ্রদ্ধাটা পেয়েছে, তা তোর বদৌলতেই। বাবা তো শুধু রূপ দিয়েছিলেন। ঘাটের নতুন মেরামত তো চারিদিকে ধ্বনি তুলেছে। জানিস, অন্যান্য গ্রামেও এই পদ্ধতিতে ঘাট মেরামত করার কথা উঠছে। এতে করে আমাদের মেয়েমানুষেরা নির্দ্বিধায় আর পর্দায় পুকুর ব্যবহার করতে পারবে। আর আগে যেসব মানুষ তোকে অপছন্দ করত, তারাও এখন তোকে নিয়ে কটু কথা পছন্দ করে না।’
‘তা আমি ইদানীং বুঝতে পারছি। আমি তো শাড়ি পরা খুব কমিয়ে দিয়েছি। এখন বড়ও হয়েছি। তবু মাঝে মাঝে পরলেও এখন একদম কেউই খারাপ চোখে দেখে না। ঠিক এই দিনটার অপেক্ষাই আমি করেছিলাম। পরশু তো চেয়ারম্যানের বদল হবে। বড় অনুষ্ঠানও হবে। আমি অনেক এক্সাইটেড। মাহমুদ আঙ্কেলের তো অনেক টাকা। এই রাস্তাঘাট তিনি চেয়ারম্যানের পদে এলে সবই নতুন হয়ে যাবে। গ্রামটা আর গ্রামের মতো থাকবে না।’
‘হুঁ। আমার লাগছে দিনটা কয়েকজনের জন্য আরও বিশেষ হবে।’
আকাশী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল, ‘কেন? কেন?’
অনিক রহস্যময় হাসি হাসে, যার উত্তর সে আর তার বাবা ছাড়া কেউ জানে না।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার