আকাশেও অল্প নীল পর্ব -০৮+৯

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৮
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

২১,
“মাহিশা আর আমার বন্ধুত্বের শুরুটা আমি যখন ক্লাস সিক্সে, তখন থেকে। ওরা এই মহল্লায় নতুন ভাড়াটিয়া হিসেবে তোরা যেই বাসায়, যেই ফ্লোরে আছিস, এখানেই আসে। আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানেই ভর্তি হয়। সেখান থেকেই পরিচয়, বন্ধুত্ব। আমাদের সম্পর্ক এতোটা গভীর হয় যে আমাদের দুইজনের পরিবারের মাঝেও একটা গাড় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। ওর বাসায় আমরা যেতাম, ওরা আমাদের বাসায় আসতো। ভালো মন্দ কিছু হলে দুই পরিবার দুই পরিবারকে সাপোর্ট দিতো, দেখতো। এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো মাহিশার সাথে আমি দিনে দুদণ্ড কথা না হলে চলতো না। কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। সময়টা যখন ইন্টার ১ম বর্ষে উঠলাম। মাহিশার বাবা ওর বিয়ের কথা তুললেন। ওর বাবার অফিস কলিগের ছেলে। যেহেতু ওর পড়াশোনা চলছিলো, আংটি বদল করে রাখতে চেয়েছিলো সবাই। কিন্তু সবার অজান্তেই মাহিশা সম্পর্কে জড়িয়েছিলো কলেজের ওয়ান ইয়ার সিনিয়র একজন ভাইয়ের সাথে। আমি সবই জানতাম, বুঝিয়েছিলাম। ও সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বিয়ের কথা উঠতেই ও কেমন একটা পাগলামি শুরু করলো। রিলেশনের কথা বাসায় জানালো। সেইম এজ ছিলো প্রায়। ২বছরের ছোটো বড়ো। সবাই মানতে নারাজ। রিলেশনের কথা আসতেই আংকেল আন্টি ভুল বুঝলেন আমায়। আমি জেনেশুনে ওকে আটকাইনি কেনো? ওতো রিলেশনে জড়িয়ে আমায় জানিয়েছিলো। আমি আমার মতো বুঝিয়েছিলাম, ও শোনেনি। প্রেম ভালোবাসা তো মনের ব্যাপার শুনতাম। কারের মনের উপর কি জোড় চলে! আমি জোড় করে তো ওকে আটকাতে পারিনি। তবুও ওর পরিবার ওকে শাসন করে কলেজে যাওয়ায় বাধা দিলো। আংটিবদল হয়েওছিলো। এরপর কি হলো! নরমালই সবাইকে বিশ্বাস করালো ও রিলেশন ভেঙে দিয়েছে। কলেজে যাওয়া শুরু হলো। ২য় বর্ষে উঠলাম দুজনেই। একদিন সকালে ওকে ডাকতে গিয়ে শুনি ও নেই, কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকাল করে আমাদের নতুন কোচিং শুরু হয়েছে, এই কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলো। আংকেল-আন্টি, ইফরাদ ভাই ধারণা করেন, আমি সব জানতাম কিন্তু উনাদের বলিনি। পুরো ঢাকা শহর একমাসের মতো তন্নতন্ন করে খুজেও মাহিশার খোজ পাওয়া যায়নি। আসলে যে লুকিয়ে থাকে, তাকে পাওয়া মুশকিল। হারালে তো ইজিলিই পাওয়া যেতো। মাহিশা আড়ালে রেখেছে নিজেকে। যার ফলাফল আজও ওকে পাইনি। তখন এক বিপদের মাঝে আরেক বিপদ৷ মাহাদ ভাই বাইক এক্সিডেন্ট করে ছোটো খাটো। মাহাদ ভাই খালামনির একমাত্র ছেলে জানিসই। আর কোনো সন্তান খালামনির হয়নি। একমাত্র ছেলের বিপ’দে খালামনি ভে’ঙে পরলে ওখানে যাওয়া টাও জরুরী ছিলো। গেলাম ওখানে আম্মুর সাথে। দুদিন পর এসে ইফরাদ ভাইয়ের কাছে ছুটে আসছিলাম সেদিন যে মাহিশার খোজ পাওয়া গেলো কিনা! ওরে ছাড়া যে আমার একটা সেকেন্ডও শান্তিতে যাচ্ছিলো না। অথচ দেখ, চার চারটা বছর পেরিয়ে দুমাস চলছে, তার চেহারাও আমি দেখছিনা। আমার যে ভেতরে ভেতরে কি অবস্থা আমি জানি আর আমার উপরওয়ালা জানেন। কান্না এমনি এমনি আসে না। ওর স্মৃতি আমায় তাড়া করে বেড়ায়। সবাই বলে শূণ্য জায়গা শূন্য থাকেনা। বালুকণা এসে হলেও পূর্ণ করে। রোজ আল্লাহর কাছে বলতাম, আমার একটু শান্তি চাই। শান্তি দাও। তুই আসলি, তোকে পেলাম। মাহিশার জায়গায় তোকে না বসাতে পারলেও তুই তোর মতো করে জায়গা তৈরি করে নিয়েছিস। ওরা বাসা ছেড়ে গেলে তোরা আসলি। ইফরাদ ভাইকে ডাকতে এসে দরজা খুললি তুই। তাদের না পেয়ে কান্নায় ভে’ঙে পরলাম আমি। সামলানোর চেষ্টা করলি তুই, যেভাবে মাহিশা করতো আমার কিছু হলেই। এরপর টুকটাক তোর সাথে কথাবার্তা দেখা হলে। এক ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া। এরপর তো চলছে দিন, যেভাবে চলার। আর দিনদিন তোর জায়গা আমার জীবনে শক্ত একটা খুঁটির মতো হয়ে বসলো। জীবনটা যে শুধু ভালোবাসলেই, সেই সম্পর্কে কিছু হলেই কান্না পায়না! মাঝে মাঝে আত্মায় মিশে থাকা মানুষগুলোর অভাবেও কান্না পায়। সেই ঘটনার পর ইফরাদ ভাই আর আংকেল আন্টির খোজ পাইনি। আমায় ভুল বুঝে আর যোগাযোগও করেননি। তোর উছিলায় ইফরাদ ভাইকে দেখলাম এতগুলো দিন, মাস, বছর পর৷ মানুষ টা তোর জন্য ভুল নয়, ঠিকই আছে। শুধু যা করার পরিবারকে মানিয়ে করিস প্লিজ। মাহিশার মতো তুইও হারাস না। আমি শান্তিতে বাচতে পারবোনা।”

২১,
বেশ কয়েকবার দম নিয়ে ধীরেসুস্থে কথাগুলো বললো রাইমা। সবকিছু শুনে তো শার্লিন নিস্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। এই মেয়েটা ভেতরে ভেতরে না পাওয়ার যন্ত’ণা আর মিথ্যা অপবাদের বোঝা বয়ে হাসিখুশি ভাবে সবার মাঝে চলাফেরা করছে। অথচ কেউ টেরও পাচ্ছেনা তার ভেতরে ভেতরে কি হয়ে যাচ্ছে। শার্লিন চট করে রাইমাকে জড়িয়ে ধরে। কান্না কান্না স্বরে বলে,

“এসব হয়েছে তোর জীবনে, আগে একবারও আমায় বলিসনি। এই আমি তোর আত্মার মানুষ!”

“কিছু নতুনত্বে পুরোনো সম্পর্কের প্রভাব ফেলতে হয়না। যা হচ্ছে হতে দে। আজও তোর জানা হতো না। যদি না ইফরাদ ভাইকে দেখতাম।”

“আমি ইফরাদকে বোঝানোর চেষ্টা করি? যেটা হয়েছে, তাতে তো তোর হাত নেই।”

“এসব নিয়ে আর কিছু বলার দরকার নেই। আমি মাহিশাকে যেদিন পাবো খুজে, সেদিনই সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।”

শার্লিন রাইমাকে ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ায়। কফির মগ নিয়ে যাওয়ার আগে বলে,

“ঐ ছেলের বাসায় কি খোজ নেওয়া হয়নি? যার সাথে মাহিশার সম্পর্ক ছিলো।”

“হয়েছিলো খোজ নেওয়া। মাহিশা ঐ ছেলের সাথেও পালায়নি। পুলিশ কেস অব্দি হয়েছিলো, কিন্তু সব তদন্তের পর কোনো কূল কিনারা বের হয়নি। পরে পুলিশ এই কেস ক্লোজ করে দিয়েছিলো বোধ হয়। আমি সেদিন খুব বেশি ভুল না হলে মাফিনকেই দেখেছি৷ এতোদিন পর যখন ওর ছায়া দেখেছি, আশা করা যায় খুব শিগগিরই আমি ওকে পেয়ে যাবো।”

রাইমা উত্তর দেয়। শার্লিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে যায় রুম থেকে। সেদিন আর দুজনের কেউই রাতের খাবার খায়নি। রাত জেগে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। পরদিন সকালবেলায় রাইমা নিজের বাসায় চলে আসে।

২২,
বিকেলবেলায়, দিগন্তদের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছে, মাহাদ, মাহাদের মা সাহিরা বেগম, শাহনাজ বেগম আর রাইমা। এতো বড়ো একটা বাসা, অথচ মানুষজনের বালাই নেই। শুধু দিগন্তকে একবার দেখেছে রাইমা। দিগন্ত বাসার মেইডদের সাহায্যে নাস্তা পানি দিয়ে বোনকে ডাকতে সেই যে গিয়েছে, দুই ভাইবোনের কারোর আসার খবর নেই। রাইমা কয়েক পিস আপেল নিয়ে চিবুতে চিবুতে বিরক্ত হয়ে ফোন দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরে। মাহাদ অধীর আগ্রহে বসে আছে স্নেহাকে দেখাটর আশায়। মিসেস সাহিরা মেয়ের তাদের সামনে আসতে দেরি হচ্ছে দেখে মাহাদের হাটুতে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে জিগাসা করলেন,

“আমার হবু ছেলের বউটা কোথায় রে? এতো সময় কেনো নিচ্ছে সামনে আসতে? আধঘন্টা হয়ে গেলো।”

“মা একটু ধৈর্য ধরো। জানোই তো সব, ওর মা বা বাসায় হেল্পিং হ্যান্ড কেউ নেই। ওর একাই সব গোছাতে হয়েছে। সেজন্য রেডি হতে হয়তো সময় নিচ্ছে।”

মাহাদ আর সাহিরা বেগমের কথার মাঝেই স্নেহার রুম থেকে স্নেহা আর দিগন্ত বের হয়৷ দিগন্ত বোনের পাশাপাশি দাড়িয়ে সযত্নে বোনকে ধরে ধরে আনছে। যেনো কাচের পুতুল, টোকা লাগলেই ভেঙে যাবে। স্নেহা আসছে দেখে শাহনাজ বেগম মেয়েকে আস্তে করে বললেন,

“এবার অন্তত ফোন টা রাখো। তোমার হবু ভাবী এসেছে পরেছে।”

রাইমা ফোন রেখে চোখ তুলে তাকায়। স্নেহা ধীরেসুস্থে এসে সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিলো। রাইমা তাকাতেই দিগন্তের সাথে বেশ ভালো ভাবেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। অসস্থিতে হিজাবের মাঝে চোখের চশমাটা ভালো করে নেওয়ার ছুতোয় চোখ নামিয়ে নেয়৷ স্নেহাকে দেখে মাহাদ মুগ্ধতায় বুদ হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। দিগন্ত মাহাদের শাহনী দেখে বড়োদের মাঝেই বলে,

“ব্রো, আমার বোন হারিয়ে যাচ্ছে না। একটু তো চারদিকে তাকিয়ে এরপর আমার বোনের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকো।”

মাহাদ বিষম খেয়ে যায় দিগন্তের কথায়। রাইমা ভ্রু কুচকে তাকায়। শার্লিনের হাওয়া লেগেছে নাকি এই লোকের গায়ে? শার্লিনের মতো যেখানে সেখানে ভুলভাল কথা বলে বসছে দেখছি! রাইমা আনমনে এটাই ভাবে। সাহিরা এবং শাহনাজ বেগম মিটমিটিয়ে হাসলেন। মাহাদ আর স্নেহা দুজনই লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়েছে। দিগন্ত দাঁত বের করেই হাসছে। রাইমা কটমটিয়ে দিগন্তকে দেখে। কি রকম নির্লজ্জের মতো হাসছে দেখো! সাহিরা বেগম পরিস্থিতি সামলাতে বলেন,

“দাড়িয়ে আছো কেনো মা! এসো আমার পাশে এসে বসো।”

স্নেহা উনার কথায় পাশে বসে। হালকা কলাপতা রঙের শাড়ি পরেছে সে। সাথে হালকা সাজগোজ। এজন্য একটু সময় লাগলো স্নেহার। আগে কখনও সালোয়ার সুটের বদলে শাড়ি পরে দেখেনি সে। প্রথম শাড়ি পড়ার ঝামেলাই অন্য রকম, সাথে অনুভূতিও। আর সেই শাড়ি পড়াটা যদি হয় প্রিয় মানুষের জন্য! তাহলে তো তার চোখে মুগ্ধতা আশা করা যেতেই পারে। আর আশা অনুযায়ীই মাহাদ স্নেহাকে মুগ্ধতার সহিত দেখলো। ভাবতেই কেমন লজ্জা লজ্জা অনুভব হচ্ছিলো স্নেহার। সাহিরা বেগম হবু পুত্রবধূর থুতুনিতে হাত দিয়ে মুখটা উচু করে ধরে বলেন,

“মাশাল্লাহ, আমার ছেলের পছন্দ আছে তবে। শুনেছিলাম ওর কাছে তোমার গল্প। আজ সত্যি হওয়াতে এসেছি সেই গল্পটাকে। আমার ছেলে রোজ দুবেলা বায়না করে আমার কাছে তোমায় মেনে নেওয়ার আবদার করতো। তোমায় এনে দেওয়ার আবদার করে রোজ বাচ্চাদের মতো কেদেও দিয়েছে মাঝে মাঝে, যখন তোমাদের ঝগড়া হতো। শেষে এসে শুনেছিলাম, তুমিই নাকি ওকে বিয়ে করতে রাজী হচ্ছো না। সে যাই হোক, এখন তোমার আপত্তি নেই তো মা?”

স্নেহা সাহিরা বেগমের কথা শুনে জল ভরা দৃষ্টিতে একবার মাহাদের দিকে তাকায়। একটা ছেলে জতোটা ভালোবাসলে মায়ের কাছে তার জন্য এরকম বাচ্চাদের মতো বায়না ধরতে পারে? স্নেহা দুদিকে মাথা এলিয়ে বোঝায় তার আপত্তি নেই। দিগন্ত খুশিমনে বোনের সুখে দেখছে। কতোটা যে শান্তি লাগছে তার, বলে বোঝানের মতো নয়। রাইমাও নিরবে সবার আড়ালে চোখের জল মুছে নিলো। অবশেষে, তার বড়ো ভাইয়ের ছায়া দেওয়ার মানুষটা তার মানুষকে আপন করে পাচ্ছে। ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে রাইমার। সাহিরা বেগম এবং শাহনাজ বেগম হাসিখুশি ভাবেই স্নেহাকে দুয়া করে আংটি পরিয়ে দিলেন। দিগন্তকে সাহিরা বেগম বললেন,

“সামনের শুক্রবারেই বিয়েটা হোক?”

দিগন্ত বললো,

“আন্টি তার পরের শুক্রবারে বিয়েটা হলে ভালো হতো না?”

“এতো লেইট কেনো?”

রাইমা মাঝখানে ফোড়ন কেটে প্রশ্ন টা করে। দিগন্ত রাইমার দিকে একবার তাকিয়ে তার প্রশ্ন এড়িয়ে সাহিরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমার কিছু স্বপ্ন আছে আন্টি, আপার বিয়েকে ঘিরে। সেগুলো যদি পূরণ করার একটা সুযোগ দিতেন! তার জন্য আমার একটু সময় প্রয়োজন সব গুছিয়ে নেওয়ার৷”

মাহাদ বললো,

“কি স্বপ্ন শুনি? আমাদেরও বলো। আমরাও চেষ্টা করবো সহোযোগিতা করার।”
#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৯
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

২৩,
“দেখুন মাহাদ ভাই আমার বোনের সাথে যেহেতু বিয়ে টা হবে, সো আই থিংক আপনাদের আমাদের পরিবারের সব খুঁটিনাটি জানা উচিত। বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধন, কারোর ঠুনকো কথায় যেনো আপনাদের মাঝে কোনো দূরত্ব সৃষ্টি না করতে পারে, আমি সবকিছু আগে ভাগেই বলে এরপর বিয়ের দিনতারিখ নিয়ে নিশ্চয়তা দিতে চাচ্ছি। কারণ একটা সম্পর্ক গড়তে যতোটা সময় নেয়, কারোর ঠুনকো কথায় ২সেকেন্ড সময় লাগবেনা ভাঙতে। একটা সম্পর্ক গড়াও যেমন সহজ, ভাঙাও তেমন সহজ। কঠিন শুধু আগলে রাখা, আকড়ে ধরে বাঁচা। তাই জানানোটা জরুরী মনে করছি।”

মাহাদের কথার উত্তরে দিগন্ত উত্তর দেয়। মাহাদের সাথে সাথে সাহিরা বেগম, শাহনাজ বেগম সহ রাইমাও একটু অবাক হয়। দিগন্তের গম্ভীর কথার মানে বুঝতে না পেরে মাহাদ বললো,

“তোমার বোনকে যখন গত ৮বছরেও ছাড়িনি, ভরসা করতে পারো আগীম সময়গুলোতেও যতোই কঠিন সময় আসুক, আমি ছাড়বোনা। আমি অতীতের কিছু জানতে চাইনা, ইচ্ছেও নেই। তবুও যদি তুমি বলে শান্তি বোধ করো। বলতে পারো, আমরা শুনছি।”

“হ্যাঁ বাবা, তোমার যদি মনে হয় বলা জরুরী, তবে বলো।”

শাহনাজ বেগম মাহাদের কথার পরপরই কথাটা বললেন। রাইমা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এই লোক আবার উল্টোপাল্টা কিছু জানিয়ে বিয়েটা না ভেঙে বসে। কেমন একটা ভয় লাগতে শুরু করেছে রাইমা। সে স্নেহার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। স্নেহা মাথা নিচু করে বসে আছে। দিগন্ত হালকা হেসে বলতে শুরু করে,

“আপনাদের মানসিকতা অনেক উন্নত আন্টি। আমার বোন ভালো থাকবে আমি বুঝে গিয়েছি। তবুও বলার প্রয়োজন মনে করছি, কারণ মানুষের ভালো মানুষ আর সহ্য করতে পারেনা। আর সেখানে স্বার্থে আ”ঘাত লাগলে তো আরও পারেনা। আমাদের মা আমার পাঁচ বছর বয়স বছর হবে হয়তো,আপুর তখন ৭বছর চলছে, তখনই আমাদের বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যান৷ কারণ ছিলো আমার বাবার গুরুতর অসুখ হয়েছিলো। পুরো বেড রেস্টে পরে গিয়েছিলেন উনি। জীবনের ভরসা ছিলো না৷ বাবা নিজের সবকিছু আমাদের দুই ভাইবোনের মাঝে আর আমার ফুফু আছেন একজন, উনার যা হক তা দিয়ে দেন। মায়ের নামে বাবা আর মায়ের বিয়ের সময়ই বাবা একখণ্ড জমি লিখে দিয়েছিলেন। যার উপর একটা এতিমখানা তৈরি করেছিলেন আমার বাবা। দেখাশোনাও করতেন উনি আর্থিক সবদিক৷ মাকে নতুন করে আর কিছু দেননি বাবা৷ আমার নানী আমার মা-কে নিয়ে চলে যান বাবার গুরুতর অবস্থা দেখে। চাচ্চু আর ফুফু মিলে না আগলিয়ে রাখলে হয়তো আমরা আজ এই জায়গায় থাকতাম না। শেয়াল কুকুরে রাস্তায় ছিড়ে খেয়ে ফেলতো। সেসব দিকে না যাই। তো আমার মায়ের সাথে বাবার ডিভোর্স হলে মা চলে যান। বাবা যদি মা”রা যায়! এই সম্পর্কে মায়ের ফিউচার কি! বাবাও মা’কে কিছু দেননি, আমরা দু ভাইবোন যদি বড়ো হয়ে মা’কে না দেখি! বাবা হীন আমরা যদি বিগড়ে যাই। এটাই ছিলো চিন্তা আমার নানীর। নানী উনার মেয়ের কথা ভেবেছেন, মা-ও তার মায়ের কথা শুনে ভেবে সম্পর্ক ছেদ করে চলে গিয়েছিলেন৷ নানী দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিলেন, উনিই ডিভোর্স করিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। একজন মা চাইলেই পারেন সব গড়তে, আবার চাইলেই পারেন ভাঙ’তে। নানীও সেটাই করেছেন, যেটা উনি উনার মেয়ের জন্য ভালো বুঝেছেন। বাবা সময়ের সাথে একটু দেরি হোক, কিন্তু সুস্থ হোন চলাফেরা করার মতো। এরপর ফুফু, চাচা গ্রামে চলে যান। বাবা আর বিয়ে করেননি, আমাদের দু ভাইবোনকে মানুষের মতো মানুষ করার পাল্লায় নামলেন। মানুষ হলাম, কিন্তু বাবাকে আগলে রাখতে পারলাম না৷ উনার হায়াত শেষ, উনি রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছেন৷
২৪,
আমার মা ২য় বিয়ে করেছিলেন। সেখানে উনি সন্তান নিতে পারেননি, কারণ উনার ২য় স্বামীরও ১ম ঘরে সন্তান ছিলো। যদি মায়ের সন্তান হয়, আগের সন্তানগুলোকে তো উনি হয়তো অবহেলা করবেন। এই কারণে মায়ের সন্তান নেওয়া হয়নি। আমার মা ফিরে আসতে চাইলে বাবা আর ফিরিয়ে নেননি। মা আমার আপাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। আপাও যায়নি, বাবাও দেননি। বাবা মা’রা যাবার পর থেকে মা আমাদের কাছে আসতে চান, কারণ বাবা থাকতে আমাদের দুজনের সামনে উনিই ঢাল ছিলেন। আমি আর মা’কে মানতে পারিনি, হয়তো পারবোও না। কারণ আমার যখন মা’কে প্রয়োজন ছিলো, আপার যখন প্রয়োজন ছিলো! উনি অন্যরে সন্তানকে আগলে গেছেন তখন৷ এখন মা যখন বাবা মা’রা যাবার পরও আমাদের কাছে ফিরতে পারলেন না, তখন ঐ এতিমখানার এতিম বাচ্চাদের থাকার জায়গাটুকু উচ্ছেদ করার ভয় দেখালেন। আপার বিয়েটা আমাদের মামাতো ভাই আছে, তার সাথে দিতে চেষ্টা করলেন। যেনো আপাকে একটু যখন ইচ্ছে গিয়ে দেখতে পারেন। এখানে তো আসতে পারেন না। আমি মা’কে সহ্য করতে পারিনা এজন্য। মাহাদ ভাইকে বিয়ে না করতে চাওয়ার এগুলোই কারণ ছিলো। আমি জানি আমার মা বিয়ে ভাঙার চেষ্টা অবশ্যই করবেন। তাই এতো ইতিহাস জানানো। আমি এগুলো বড় হওয়ার পরপর আপা, বাবা দুজনের থেকে জেনেছি৷ আর মায়ের অন্য সংসারের অশান্তিগুলো যখন বাবার কাছে ফিরতে চেষ্টা করতেন মা, কান্না করে বলতেন৷ তাই বলতে পারলাম৷ আমাদের পরিবার টা এমনই। এখন যদি মনে হয় এমন পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করা উচিত, তাহলে আগামী শুক্রবারের পর শুক্রবারে বিয়েটা হোক৷ কারণ সেদিনই নতুন একটা এতিমখানা তৈরি করেছি বাচ্চাদের জন্য। ওখানে তাদের পার করে দিবো। কারণ আমি এটাও আন্দাজ করতে পারি মা বিয়েটা না ভাঙতে পারলে বাচ্চাদের থাকার জায়গা উচ্ছেদ করার ভয় দেখাবেন৷ আমি চাচ্ছি সেদিনই বাচ্চাদের নিয়ে এসে আপার বিয়ের অনুষ্ঠানে তারাও অংশ গ্রহণ করুক।”

দিগন্ত দীর্ঘ সময় নিয়ে কথাগুলো বললো। এরপর থামে সে। রাইমা এক ধ্যানে তাকিয়ে দিগন্তের কথাগুলো শুনলো। এই লোকটা ভেতরে ভেতরে মা হারানোর শোক জমিয়ে রেখেছে, দেখলে বোঝা যায় না তো! রাইমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মাহাদ স্নেহাকে দেখছে, এই মেয়েটা এতো কষ্ট জমিয়ে রেখেছে ভেতরে, কখনও তাকে টের পেতেও দেয়নি! সে শুধু জানতো, স্নেহার বাবা মা নেই, একটা ভাই আছে শুধু । ভাইয়ের খেয়াল রাখতে সে বিয়ে টা করতে চায়না৷ কিন্তু এতো কথা তো কখনও জানায়নি! সে কি এতোটাই পর ছিলো স্নেহার! নাকি সে আপন হতে পারেনি! মাহাদ একটু অভিমান করে স্নেহার উপর।

২৫,
সব শুনে শাহনাজ বেগম বলেন,

“আজ থেকে তোমাদের মা বাবা নেই, এই কথা ভাবার দরকার নেই। আমি তোমার আংকেল যতোটা পারবো বাবা মা তো হতে পারবোনা, কিন্তু তাদের মতো আদর দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। তোমার কথাই রইলো, সেই দিনই বিয়েটা হবে।”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

দিগন্ত মুচকি হেসে বললো। রাইমাও খুশি হয়, স্নেহার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

“যাক একজোড়া ভালোবাসার কপোত-কপোতী অবশেষে এক হবে। আলহামদুলিল্লাহ।”

রাইমা স্নেহা ছেড়ে দিয়ে বসলো ঠিকঠাক হয়ে। দিগন্ত আড়চোখে দেখছিলো তাকে৷ সেজন্য ছেড়ে দিয়ে বসলো। নয়তো আরও কিছু সময় জড়িয়ে ধরে বসে থাকতো।

“আজ তবে উঠি আমরা। অনেক সময় পেরিয়ে গেলো আসার৷”

শাহনাজ বেগম বললেন কথাটা। সাহিরা বেগম তাল মিলিয় বললেন,

“হ্যাঁ কথাবার্তা যখন মিটলো, এবার যাওয়া দরকার আমাদের।”

“আন্টি একটা রিকুয়েষ্ট আছে।”

স্নেহা নিচু স্বরে কথাটা বললো। সাহিরা বেগম হবু পুত্রবধুর থুতুনিতে ফের হাত রাখলেন। মুখটা উচু করে ধরে বললেন,

“অনেক তো আন্টি বললে! এবার একটু মা ডাকা প্রাক্টিস করো। আমার সন্তান একটাই, একজনের মুখে তো মা ডাক শুনে আত্মা শান্তি হয়না। তোমারও বলতে হবে।”

“আচ্ছা চেষ্টা করবো, আমি আপনাদের জন্য ছোট্টখাটো কিছু আয়োজন করেছি। সেগুলো খেয়ে এরপর বাসায় ফিরবেন আজ। প্লিজ না করবেন না।”

স্নেহা আদুরে গলায় অনুরোধ করে বললো কথাটা। শাহনাজ বেগম বললেন,

“আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার অনুরোধ আমরা রাখবো।”

স্নেহা খুশি হলো। দিগন্ত বললো,

“আপনারা এখানে আড্ডা দিন, আমি টেবিল সাজিয়ে ডাকবো।”

শাহনাজ বেগম ব্যস্ত হয়ে দিগন্তের কথার উত্তরে বললেন,

“আমরা আমরাই তো! সবাই একসাথে গুছিয়ে নিয়ে খেতে বসি!”

“আপনারা আজ আমাদের বাসায় প্রথম আসছেন, আজকের দিনটা আমি করি! এরপর না হয় মায়ের হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে করলে আমি গিয়ে আপনাদের জ্বা”লাতন করবো!”

“আচ্ছা বাবা আচ্ছা। মেনে নিলাম তোমার কথা।”

দিগন্ত মুচকি হাসলো শাহনাজ বেগমের কথায়। উঠে চলে গেলো ডাইনিং টেবিলের দিকে। রাইমা কিছু একটা ভেবে উঠে দাড়ালো। মাহাদ তা দেখে বললো,

“কোথায় যাবে? উঠলে যে!”

“আমি একটু উনাকে হেল্প করি ভাইয়া। একা একা কাজ করতে গিয়ে কিছু ভেঙে বসলে! ছেলে মানুষ তো! কি করতে কি করে বসে! আর ফলমূল এসব তো আর কেউ খাবেনা এখানে। নিয়ে যাই আমি।”

রাইমা কথাটা বলেই দ্রুত গতিতে সব গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলো। কাউকে কিছু বলার সুযোগও দিলো না৷ স্নেহা একবার বারণ করতে চাইলো। পরে সেও কিছু কথা ভেবে বাধা দিলো না৷ রাইমা চলে যেতেই স্নেহা শাহনাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে ভীতু গলায় বললো,

“আন্টি একটা অনুরোধ করবো? রাখবেন? যদিও জানিনা আমি, আমার কথাটা কিভাবে নিবেন! তবুও কেনো জানি মনে হলো আমার এই বিষয়টা হতেই পারে৷ দারুণ হবে।”

মাহাদ ভ্রু কুচকে তাকালো স্নেহার দিকে। কি ভাবলে আবার স্নেহা! শাহনাজ বেগম একবার বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে স্নেহার দিকে তাকালেন। এরপর স্নেহার হাত ধরে বললেন,

“কি অনুরোধ মা?”

“আমি তো আপনার বোনের ঘরে চলে যাবো বউ হয়ে। আমার ভাই একলা পরে রবে এই এতো বড়ো বাসায়। তার দেখাশোনা আমি করি, আমি চলে গেলে কে করবে? বলছি আন্টি, আমায় আপনাদের ছেলের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন, আমার ভাইটার জন্য আপনাদের মেয়েকে দিবেন? আমিও ওয়াদা করছি, আপনাদের মেয়ে আল্লাহ সহায় থাকলে ভালো থাকবে, খারাপ নয়।”

উপস্থিত তিনজনই পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেলো স্নেহার কথায়। স্নেহা যে এমন কথা বলবে! কেউ কল্পনাই করেনি৷ স্নেহা সবার হতবাক চাহনী দেখে কাঁপা গলায় বলে,

“আমি কি অন্যায় আবদার করলাম আন্টি?”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here