#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ২৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৮০,
“আসলে কি বল তো! গতকাল যে আমায় ইফরাদ তার মায়ের কথায় আমায় তাদের বাসায় নিয়ে গেলো! সেখানে কথাবার্তার এক পর্যায়ে ইফরাদ আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে জিগাসা করে, আমার এতো ন্যাকামি আসে কোথা থেকে! ব্যস কথাটা সোজা মনে গিয়ে লেগেছে রাই৷”
শার্লিনের উত্তরে রাইমা চিন্তিত হয়ে পরে। ইফরাদ সহজে এমন ভাবে বলার মানুষ না। রাইমা চিন্তিত স্বরে শার্লিনকে জিগ্যেস করলো,
“তুই কি এমন করেছিলি? যে ইফরাদ ভাই এমন বললো?”
“তেমন কিছু নয়, মাহিশাকে দেখার জন্য পিক চেয়েছিলাম। দিচ্ছিলো না, তাই জেদ করায় তা ইফরাদের কাছে বাচ্চামি লেগেছে। বাদ দে সেসব। তোর বিয়ের আর বাকি তো আছে ৪দিন। গ্রামে যাবি কবে?”
রাইমা শার্লিনকে ঘাটালো না। আপাতত চুপ থাকলো, পরে ইফরাদের সাথে কথা বলে বিষয়টা দেখা যাবে। শার্লিনের কথার উত্তরে রাইমা বললো,
“আজই দুপুরের পরপর বেরুনো হবে। মা সব গুছিয়ে নিয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে মাহাদ ভাইদের বাসায় গিয়ে সবাইকে নিয়ে এক সাথেই যাওয়া হবে।”
“দিগন্ত ভাইয়ের পরিবার বলতে তো শুধু স্নেহা ভাবী। ভাবীও কি তোদের সাথেই যাবে?”
“না, ভাবী আর মাহাদ ভাই দিগন্ত সাহেবের সাথেই থাকবে। ওরাও নিজেদের গ্রামেই যাবে। ওখানে তো উনার ফুফি, চাচা সবাই আছে। বেশি আয়োজন না হলেও মাঝামাঝি পর্যায়ের ধুমধাম হবেই।”
“বাহ রাই, দিগন্ত সাহেব!! ভালোই তো সম্মোধন টা! এতোদিন তো আমি খেয়াল করিনি। করবোই বা কি করে? আমার সামনে তো তোরা কথাও বলিস না৷ দারুণ দারুণ।”
শার্লিন রাইমার মাথার চুল এলেমেলো করে দিয়ে হেসে কথাটা বললো। রাইমা শার্লিনের মুখে হাসি দেখে যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো। এই মেয়েকে চুপচাপ, হাসিখুশি বিহীন একদম মানায় না। একে হাসিতেই সুন্দর লাগে। শার্লিন এরমাঝেই হাসি থামিয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে কিছু একটা ভাবতে শুরু করেছে। রাইমা তা দেখে জিগাস্যা করে,
“কি ভাবছিস?”
“ভাবছি, তুই এখনও দিগন্ত ভাইকে আপনি ডাকিস, এটা নরমালই লাগে। বাট দিগন্ত ভাই তোকে আপনি বলেই সম্মোধন করে যতোদূর খেয়াল করেছি। দিগন্ত ভাইয়ের তো উচিত তোকে তুমি বলা। যেহেতু তুই উনার ছোটো+বউও হয়ে যাচ্ছিস।”
“কিছু সম্পর্ক আপনি ডাকেই সুন্দর। তার যেটায় কমফোর্ট ফিল হয় বলুক। আমি অযথা কিছু বলে উনাকে অসস্তিতে ফেলতে চাই না।”
“বাহ, প্রেম জমে ক্ষীর তবে। দুই ঝগরুটে, পাড়ার কিছু কিছু টক্সিক কাকিমাদের মতো ছিলো! তাদের মাঝে ভালোবাসা জন্ম নিচ্ছে। বিষয়টা দারুণ।”
শার্লিন মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে কথাটা বললো। রাইমা বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে শার্লিনের পিঠে হালকা চাপড় মে”রে বললো,
“ধ্যাত, একদম আজেবাজে কথা বলবিনা।”
“তোমরা প্রেমে পরছো, তাতে কিছু না৷ আমি বললেই যতো দোষ। ব্যাপারটা হলো, যতো দোষ, শার্লিন ঘোষ।”
৮১,
শার্লিনের কথা ফুরোতেই রাইমা শব্দ করেই হেসে উঠলো। শার্লিন রাইমার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। এরপর ব
আনমনা হয়ে বললো,
“তোর বিয়ে হওয়ার পর আমাদের জীবন টা কেমন পাল্টে যায় তাই না রাই? দিনের ১৪ঘন্টা যার সাথে হাহা হিহি করছি, মন খারাপ হলে ছুটে আসছি, বকবক করতে করতে মন খারাবি উধাও করে দিচ্ছি, কিছু হলে ফোন দিয়ে মাথা ন”ষ্ট করে দিচ্ছি, যখন ইচ্ছে, তখনই একে অপরের বাসায় এসে দুজনে আড্ডা দিচ্ছি, একটু মনে হলো বাইরে যাবো, ছুটে যাচ্ছি। একটা সময় আসবে, এসব বন্ধ হয়ে যাবে। মন খারাপ হবে! এসব তখন স্মৃতি হয়ে মন পাড়ায় একাদোক্কা খেলবে। চাইলে আর তোরে জড়িয়ে ধরে কাঁদা যাবেনা, ফোন দিয়ে একটু মন হালকা করতে চাইবো, পারবোনা। হয়তো তুই সংসার জীবনে ব্যস্ত থাকবি! নয়তো আমি৷ ইশশ কি নিদারুণ যন্ত্রণা৷ আমরা আর এক রকম শাড়ি পরে চাইলেই পারবোনা ঘুরতে, পারবোনা বিকেল হলে রাস্তার পাশ ঘেটে হেটে বেড়াতে। পাড়ার শেষের মাঠটায় গিয়ে ঘাসের উপর বসে বাচ্চাদের লাফালাফি দেখতে। চাইলেও পারবোনা তোর উপর অধিকার দেখিয়ে আমার কাছে রাখতে। তোকে আমি চাইলেও আর তখন ছুতে পারবোনা, হাসতে হাসতে তোর উপর গড়িয়ে পরবোনা, কথার ছলে কি”লও মারতেও পারবোনা। পারবোনা বুদ্ধি করে ক্লাসের শেষ বেঞ্চটায় বসে গল্প করতে ক্লাসে মনোযোগ না দিয়ে। আমাদের হুট করে একদিন দেখা হবে, দুজনের সংসারের গল্প হবে। হবে নিজেদের ব্যস্ততার গল্প। হবেনা শুধু এই সুন্দর সময়গুলো ফিরে পাওয়া। এই এতো এতো না পাওয়ার ভীড়ে আমাদের পাওয়া এই সুন্দর সময় গুলো হারিয়ে যাবে। জীবন টা অদ্ভুত না রাই? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রাই। আমার ভীষণ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই তো এখনই তোকে জড়িয়ে আমি কাঁদতে পারবো। ক’দিন পর আর তোকে জড়িয়ে কাঁদাও যাবেনা। জীবন এতো বিভীষিকা কেনো রাই? আমরা যেটায় খুশি থাকি! তা দীর্ঘস্থায়ী কেনো হয়না বলতো?”
শার্লিন একদমে কথাগুলো বলে থামলো। রাইমা এতোক্ষণে ফুফিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। শার্লিন তাকে ধরে কান্না জুড়ে দেওয়ার আগেই সে শার্লিনের মাথা ধরে বুকের মাঝে বাচ্চাদের মতো আগলে ধরে কান্না শুরু করেছে। সত্যিই তো জীবন এতো বিভীষিকাময় কেনো? কেনো সারাজীবন সুখের ছোয়া যেসব মানুষে, তারা স্থায়ী হয়না! রাইমার কাছে এসবের উত্তর নেই। শার্লিন তো বাচ্চাদের মতোই রাইমা জড়িয়ে ধরায় জোড়ে শব্দ করে কান্না করে দিয়েছে। আরফান আর শাহনাজ বেগম এবং আজাদ সাহেব এসেছিলো রাইমার কাছে । কিন্তু শার্লিন তখন কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় ওনারা আর রুমে ঢুকেননি। দরজায় দাড়িয়ে ছিলেন। আরফানও মায়ের হাত আকড়ে ধরে দাড়িয়েছিলো মায়ের সাথে। তারা এসেছিলেন মেয়ের সাথে একটু একান্ত সময় কাটিয়ে হাতে হাতে রাইমার সব জিনিস গুছিয়ে নিতে। এরপর তো বিয়ের ব্যস্ততায় রাইমার সাথে সময় টুকুও ঠিকমতো কাটানো হবে না। শার্লিনের কথা শুনে উনারাও কেঁদে ফেলেছেন৷ দুজনের কান্না থামাতে উনারাও চোখ মুছে রুমে ঢুকলেন। শাহনাজ বেগম শার্লিন আর রাইমার মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নাভেজা গলায় বললেন,
“কষ্ট তোমার একার হচ্ছে মা! আমাদের হচ্ছে না? এভাবে কেঁদো না মা। আমরা নিজেদের শক্ত রাখবো কি করে বলো তো?”
বাবা-মা, ভাইকে দেখে রাইমা আরও ভেঙে পরে শার্লিনকে ছেড়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। আজাদ সাহেব আড়ালে চোখ মুছলেন। বাবা তো! উনাকে শক্ত থাকতেই হবে। নিজের মায়ের আসনে বসানো মেয়েটাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে! এরপরও কান্না করা যাবেনা। উনি যে বাবা! বাবাদের কাঁদতে হয় আদৌও? কাঁদলেই তো সন্তানকে নিজের কাছে বেঁধে রাখা যাবেনা। আরফান বাচ্চা মানুষ, এতোটাও সম্পর্কের অনুভূতি গুলো বুঝে উঠেনি। তবুও সে কান্না থামাতে পারছেনা। বোনকে আর কাছে পাবেনা কিছুদিন পর থেকে! এই কঠিন বাস্তবটা সেও বুঝে গিয়েছে। কান্নারত না আর বোনকে সেও দুহাতে যতোটা পারছে জাপ্টে জড়িয়ে ধরেছে। রাইমা কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করে,
৮২,
“শক্ত থাকতে পারছিনা মা! কি করে শক্ত থাকি বলোতো? তোমার আঁচলের তলায় বড়ো হয়ে, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে তোমার হাতে হাতে কাজ শেখা, একসাথে সময় কাটানো, সকালে উঠে তোমার হাতে হাতে নাস্তা বানানো, কতো শখ আহ্লাদ তোমায় বলা। অসুস্থ হলে তোমার একেকটা নির্ঘুম রাত। তোমার আমার বন্ডিং টাই তো এক্সপ্লেইন করা পসিবল না মা। বাবার সাথে এতো শতো খুনশুটি, আরফানের সাথে ঝগড়া। আমি এসব না করে থাকবো কি করে? ও মা, আমায় বিয়ে দিও না মা। আমায় তোমাদের সাথে রেখে দাও। আমার বুকের ভিতর জ্ব”লছে মা। আমার তোমাদের ছেড়ে থাকতে হবে ভাবতেই তো কলিকাটা ছিড়ে যাচ্ছে মা। কয়দিন ওর রমজান আসবে! আমায় তো কেউ ধাক্কিয়ে সাহরীতে তুলবে না মা। ঈদের দিন তোমার হাতের সেমাইটা খাওয়া হবে না। এতো যন্ত্র”ণা নিয়ে বাঁচা যায় মা?”
“ধুর পাগলি মেয়ে! আমিও তো আমার মা বা পরিবার ছেড়ে তোর বাবার হাত ধরে এই সংসার সাজিয়েছি। আমি জানি আমার মেয়ে হয়ে তুইও পারবি সংসার সাজাতে। মেয়েরা বিয়ের আগে তোর মতোই বলে কিভাবে থাকবো! বিয়ের পর এমনিই নিজেদের মায়ের কথা ভেবে ধৈর্য এসে যায়৷ আমাদের কি কষ্ট হয় না? হয় তো! কিছু ভালোমন্দ রান্না করলে, মেয়ের প্রিয় খাবারটা রান্না করলে আমাদের গলা দিয়ে নামতে চায়না, কিছু করতে গেলে তাতে মেয়ের স্মৃতি থাকলে আমাদের হাত নড়ে না৷ কিন্তু দিব্যি জীবন টা কেটে যায়। এটাই বাস্তবতা, আমাদের নিয়তি। আর বাস্তবতা জিনিসটা বড্ড তিক্ত হয় রে মা।”
শাহনাজ বেগম নিজেকে সামলে মেয়ের কথার উত্তর দেন। আজাদ সাহেব পরিবেশ টা স্বাভাবিক করতে হইচই করে৷ শার্লিনের উদ্দেশ্যে বলেন,
“শার্লিন মা, তুমি তো সবাইকে চুটকিতে হাসাও। তুমিই কাঁদছো! এটা মানা যায় না মা। নেও সবাইকে নরমাল করোতো। এরপর তোমার এই ইমোশনাল বান্ধবীকে থামিয়ে, তার যা যা প্রয়োজন গুছিয়ে নিতে বলো। গাড়ি আসছে,রাস্তায় আছে। এসে পরবে শিগগিরই। তুমিও বাসায় গিয়ে ব রেডি করে নাও। তুমি আর মিসবাহ আজই যাবে। ভাই আর ভাবীর সাথে আমার কথা হয়েছে। উনারা গায়ে হলুদের দিন যাবেন। তোমার বাবার অফিসের ছুটি কম। পাবেনই না, তবুও রিকুয়েষ্ট করে ছুটি নিয়েছেন, আমার কথা রাখতে। কিন্তু তোমাদের তো আর অফিস নেই। যাও ঝটপট রেডি হয়ে এসো।”
“জি আংকেল যাচ্ছি।”
শার্লিন নিজের চোখ মুছে বসা থেকে উঠে দাড়ায়। রাইমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আর কাঁদিস না। তোর বিয়ে নিয়ে আমার সব আনন্দ করার প্ল্যান মন খারাপের কান্নার জলে ভেসে যাবে। আমি রেডি হই, তুইও রেডি হ। মাফ চাই বইন ইমোশনাল করার জন্য। এবার কান্না থামা।”
শার্লিনের কথায় নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে রাইমা। মা’কে ছেড়ে হাসার চেষ্টা করে। শার্লিন রাইমার গাল টেনে দিয়ে বলে,
“এই তো আমার গুড ফ্রেন্ড। এবার রেডি হ, বিয়েতে দুলাভাইয়ের পকেট ফাঁকা করবো গেইট ধরে, জুতা চুরি করে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।”
শার্লিন রাইমার গাল ছেড়ে লাফাতে লাফাতে চলে যায়৷ এই মেয়ে যে কি! এই কাঁদে তো এই হাসে। ওর কান্ড দেখে রাইমা হাসে, তার সাথে বাকিরা। এরপর ব্যস্ত হয়ে পরে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিতে। প্রায় দুপুর আড়াইটা বেজে যায় তারা সব রেডি করে বের হতে হতে। শার্লিন আর রাইমা পাশাপাশি বসে নিজেদের সীটে গা এলিয়ে দিয়ে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। এরমাঝেই রাইমার হাতে থাকা ফোন টা বেজে উঠে। স্নেহার ফোন এসেছে।
#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ২৭
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৮৩,
গ্রামের মাটিতে পা রেখেই চোখ বন্ধ করে হাত মেলে লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিলো রাইমা। ওর দেখাদেখি শার্লিনও তেমন করলো। আরফান তো গাড়ি থেকে নেমেই পায়ের জুতো খুলে গ্রামের মাটিতে ছুটোছুটি শুরু করেছে। গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে পরদিন এগারোটার সময় পৌছালো তারা। গ্রামের মাটিতে, তার প্রকৃতিতে বাতাসের গন্ধ টাই অন্য রকম। একপ্রকার প্রশান্তি ছেয়ে থাকে প্রকৃতির নির্মল বাতাসে। হাসান সাহেব এবং আজাদ সাহেব সম্মিলিত ভাবে গাড়ি থেকে সব ব্যাগ, লাগেজ নামাচ্ছেন। শাহনাজ বেগম আর সাহিরা বেগম বাড়ির বাইরের উঠোনে পা ফেলতেই বাড়ির সব বউঝিরা এসে উনাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন। বাড়ির কর্তারা হাসান সাহেব এবং আজাদ সাহেবের হাত থেকে সব ব্যাগ লাগেজ নিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে যেতে ব্যস্ত। রাইমা আর শার্লিন একত্রে পা ফেলে সবার দিকে আগাচ্ছে। বড়ো হওয়ার পর রাইমার তেমন ভাব গ্রামে আসা হয়নি। বাবা মা এসে ঘুরে গেলেও সে আসেনি। ৩-৪বছর পর একবার এসে ঘুরে গেছে। এবারও এইচএসসি পরিক্ষা শেষে এসে যে ঘুরে গিয়েছিলো! এরপর আর আসা হয়নি। ঘুরকুনো স্বভাবের মানুষগুলো নিজের ঘরেই আর গুটি কতক মানুষের মাঝে সস্তি পায়। রাইমার স্বভাবেও সেই ধাচ আছে। সে নিজের ঘরেই শান্তি পায়, অন্য কোথাও গেলে তার শান্তি লাগে না। রাইমাকে দেখেই তার দাদী হামিদা বেগম এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে একপ্রকার কেঁদে দিয়েই বললেন,
“গ্রামে আসার কথা মনে পরলো বু! আসলা তুমি! আমরাও শহরে যাইতে পারিনা, আর তুমি আমগো দেখতে আসো না। এইটা কি ঠিক বু?”
রাইমা আচমকা জড়িয়ে ধরায় একটু হকচকিয়ে যায়। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরে সে বললো,
“এই যে দাদী আসলাম। আপনি কাঁদছেন কেনো? কান্না থামান, আসছি তো আমি।”
“কতোগুলা বছর পর আসলা বু। আমার একমাত্র বড়ো নাতনী তুমি। অথচ তোমারেই মন চাইলে দেখতে পারিনা। এমন সময় আসলা, যখন বিদেয় দেওয়া লাগবো। এমনেই আসতা না, পরের ঘরে যাবা, আরও আসবা না। ম’রলে শেষবার দেখতে আসতে পারবা কিনা! এটাও সন্দেহের বিষয় হয়ে গেছে।”
“আহ মা! রাইমা মা আসতে না আসতেই তোমার কান্না শুরু। সবাইরে ঘরে যেতে তো দাও। আসলো সবে! একটু দম নিতে দাও।”
হামিদা বেগমের কান্না থামাতে কথাটা বললেন রাইমার চাচা মজিদ সাহেব। তখনই রাইমার চাচাতো বোন শিখা আর রেখা বাড়ির ভেতর থেকে দৌড়ে এসে রাইমাকে জড়িয়ে ধরে। রাইমা দুজনকে দেখে হেসে দুহাতে জড়িয়ে নেয়। শাহনাজ বেগম নিজের জা সাফিয়া বেগমের সাথে কলাকুশলী আদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন। শিখা আর রেখা রাইমাকে জড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বুবু, কত্তোদিন পরে আসলে। জানো তোমায় কত্তো মিস করেছি!”
“আমিও তোমাদের মিস করেছি পিচ্চিগুলো।”
৮৪,
শিখা আর রেখা পিঠাপিঠি হওয়ায় একই সমান প্রায়। একজন ইন্টার প্রথম বর্ষে অন্যজন ২য় বর্ষে পরে৷ সবার সাথে ভালোমন্দ কথাবার্তা হওয়ার পর মজিদ সাহেব শিখা আর রেখাকে সবার জন্য ঠিক করা ঘর দেখিয়ে দিতে বলে। শার্লিন এতোক্ষণ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিলো। সবাই ব্যস্ত নিজেদের আলাপচারিতা নিয়ে। তার দিকে তো কারোর খেয়ালই নেই৷ রাইমা এসে শার্লিনের পাশে এসে দাড়িয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে জিগাসা করে,
“আমার গোল আলু এখানে এমন কারেন্টের খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছে যে!”
“কি আর করবে সে! তাকে কি কেউ চিনে? যে সে অন্য কারোর মতো জড়িয়ে ধরে গল্প জুড়ে দিয়ে একটা মানুষকেই ভুলে যাবে!”
শার্লিন গাল ফুলিয়ে উত্তর দেয়। রাইমা মুচকি হেসে শার্লিনের গাল টেনে বলে,
“হয়েছে হয়েছে, অনেক রাগ করেছেন। এবার চলেন, ঘরে গিয়ে একটু রেস্ট করবেন। এরপর মন ভরে শান্তিমতো অভিমান করিয়েন।”
“আজকাল অভিমানের আর পাত্তা পাই না। অভিমান করেও আর লাভ নেই।”
শার্লিন আনমনে রাইমার কথার জবাবে কথাটা বলে। রাইমা কারণ টা বুঝতে পারে। সে জবাব দেয়না শার্লিনের কথার। যা করার সে ইফরাদ আসলেই করবে। কিন্তু তাদের আসতে আসতে শনিবার। মাঝখানে আরও দুদিন। ইফরাদের সাথে ফোনে কথার বলার চেষ্টা করেছে রাইমা। কিন্তু সুইচ ওফ দেখালো ইফরাদের ফোন। এসব যে কি হচ্ছে বুঝে আসছেনা রাইমার। স্নেহার সাথে কথা হলো, আমিরা শেখ স্নেহাদের সাথে গ্রামে যাবেন, সেই বিষয়ে যেনো সে দিগন্তকে একটু বোঝায়, সেই কথা বলে রেখেছে স্নেহা। আর দিগন্তের কাছে উনার কথা বললে ঠিক কি রিয়েকশন হবে দিগন্তের! এটা নিয়েই সন্দিহান রাইমা৷ ভালোই লাগছেনা কিছু।
“কি হলো রাইমা, ওখানেই দাড়িয়ে থাকবে? ঘরে আসো।”
সবাই প্রায় নিজেদের ঘরে চলে গেছে। শিখা আর রেখা সবার জন্য ঠিক করা ঘরগুলো দেখিয়ে দিয়েছে। বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা চাচীর ডাক শুনে নিজের চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রাইমা। শার্লিনের হাত আকড়ে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে। মেসবাহ আসতে চেয়েও আসতে পারেনি। তার অফিসের কাজে আটকে পরেছে। সেও বাবা মায়ের সাথেই আসবে। রাইমার মামা-মামীরা, কাজিন’স রাও সব শনিবারেই আসবে। আপাতত বাড়ি একটু ফাঁকাই আছে। রাইমা আর শার্লিনের জন্য ঠিক করে দেওয়া ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে রাইমা। শার্লিন টইটই করে পুরো বাড়ি ঘুরতে শুরু করেছে। রাইমার দাদার বাড়িটা একটু বেশিই সুন্দর লাগে রাইমার কাছে। ইট পাথরের বাড়ির বদলে এক সারিতে ৪টা ঘর, চার ঘরের সাথে বাকা করে উত্তর আর দক্ষিণ দুয়ারী করে একপাশে দুটো অন্য পাশে দুটো করে চারটে ঘর। মাঝখানে হেশেলপার, কলপার, টয়লেট, আর একপাশে খোলা জায়গায় টুকিটাকি সবজির মাচা দেওয়া, আর বাগান করা। হেশেলপারে সবার জন্য খাবার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন সাফিয়া বেগম এবং হামিদা বেগম। নানা রকমের পিঠাপুলি, নাস্তা, সেমাই, দুপুরের খাবারের জন্য আলাদা করে খাবার বানানো সবকিছুই বাড়ির ভেতরের বারান্দায় একপাশে খাবার টেবিল রাখা, সেখানে সাজিয়ে রাখছেন উনারা। শাহনাজ বেগম আরফানকে ফ্রেশ করিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে বের হলেন৷ শার্লিনকে বাড়িতে ঘুরঘুর করে দেখে উনি বললেন,
“টইটই পরে করিয়ো আম্মু, ফ্রেশ হয়েছো? ফ্রেশ হতে হবেনা?”
“রাইমা এসেই আগে ধপা”স করে শুয়ে পরলো আন্টি। আমি কি করবো! তাই ঘুরে ঘুরে দেখছি। জন্মের পর তো গ্রাম চোখে দেখছি কিনা সন্দেহ! বড়ো হয়েও দেখেছি বলে মনে পরে না। শহরের ইট পাথর দেখতে দেখতে কা”না হয়ে গেলাম। বাপ দাদার ঠিকুজি গোষ্ঠী সব ঢাকা। প্রথমবার গ্রামের বাড়িঘর এতো কাছ থেকে দেখা তো, দেখে মন জুড়োচ্ছে না আন্টি৷”
৮৫,
শার্লিন কপাল চাপড়ে উত্তর দেয় শাহনাজ বেগমের কথার। ওর কথার ভঙ্গিতে উপস্থিত সকলেই হেসে ফেলে। হামিদা বেগম শার্লিনকে লক্ষ্য করে শাহনাজ বেগমকে বললেন,
“বড়ো বউমা! এ ছেড়িরে তো চিনলাম না। দেখতেছি তোমরা আসার পর থাইকা। কিন্তু চিনি নাই।”
“তা কেন চিনবা বুড়ি, তুমি তো তোমার নাতনীরে নিয়াই ব্যস্ত ছিলা। আমারে তো কেউ চিনোও না ভালোও বাসো না। অবশ্য বাসবা কেন? সতীন লাগি তো তোমার। তা আমার বর টা কই গো বুড়ি?”
হামিদা বেগমের প্রশ্ন শুনে শার্লিন হামিদা বেগম পিড়িতে বসে তরকারি খুন্তি দিয়ে নেড়ে দিচ্ছিলেন, সেই বসা অবস্থাতেই উনার গলা জড়িয়ে কথাগুলো বললো শার্লিন৷ হামিদা বেগম খুন্তি টা রেখে তরকারিতে ঢাকনা দিয়ে শার্লিনের হাত ধরে গলা ছাড়িয়ে ঘুরে বসে ওর গালে হাত দিয়ে বললেন,
“তোরেই আমার নাতনী নাতনী লাগতেছে রে ছেড়ি। আমার নাতনী তো শান্ত মেয়ে, দাদীর সাথে যে একটু রসিকতার একটা সম্পর্ক, তা ওর মাঝে খুজেই পাওয়া যায় না।”
“এখন কও তো আমার বুড়ো বর টা কই! সবাইরে দেখি, তারে দেখিনা যে?”
“তোর বুড়ো বরটা কামলা হইছে, ভু্ট্টা তুলতেছে ক্ষেতে। তোরে আসার পর থেকে খেয়াল করতেছি, তুই কেডা এইডা আগে ক তো ছেড়ি!”
“ও আপনার নাতনীর সবথেকে কাছের বান্ধবী আম্মা। ওর বিয়ের জন্য আসছে আগেই৷”
শাহনাজ বেগম শার্লিনের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর শার্লিনকে ফ্রেশ হতে বলে আরফানের হাত ধরে ঘরে চলে গেলেন। শিখা আর রেখা তখুনি বাড়ির ভেতর উঠানে ঢোকার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে হাত ভর্তি কাঁচা তেতুল নিয়ে। শার্লিন কলপারে ঢুকতে গিয়ে কাচা তেতুল দেখে থেমে যায়। ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এগুলো কোথায় পেলে তোমরা?”
শার্লিনকে আগেই নিজের আত্মীয় স্বজন সবার ছবি দেখিয়ে নাম পরিচয় বলে দিয়েছে রাইমা। এজন্য শার্লিনের সাথে মন সংকোচ হচ্ছে না সবার সাথে মিশতে। শিখা আর রেখার হাতে কাঁচা তেঁতুল দেখে সাফিয়া বেগম ধমকে বললেন,
“রাইমা আসতে না আসতেই তোদের বাঁদরামি করে তেতুল আনা শুরু!”
“ইশ রে আন্টি ওদের ধমক কেনো দিচ্ছেন? কাঁচা তেঁতুল রাইমার মতো আমারও পছন্দ। এই এগুলো ধুয়ে লবণ মরিচ সহ একটা প্লেটে সাজিয়ে আমাদের জন্য ঠিক করা ঘরে নিয়ে চলো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
শার্লিনের কথা শুনে সাফিয়া বেগম আর কিছু বললেন না। শিখা আর রেখা শার্লিনের কথামতো কাজে লেগে পরে। বাকিরা ব্যস্ত হয়ে পরে নিজেদের কাজ শেষ করে৷
রাইমা ফোন হাতে বসে আছে। দিগন্তের কাছে কল দিবে কি দিবে না সংকোচে একবার নাম্বার ডায়াল করছে তো রিং হওয়ার আগেই কেটে দিচ্ছে৷ ওদের যা কথা হয়েছে, সবই তো সরাসরি। ফোনে কথা বলা হয়ে উঠেনি এখনও। আবার প্রথম বার ফোন দিয়েই আমিরা শেখের কথা বলবে! ভয়ই লাগছে তার৷ একটু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে সাহস নিয়ে দিগন্তের নাম্বারে ডায়াল করেই ফেলে রাইমা। মাহাদের থেকে দিগন্তের নাম্বার টা নিয়েছে সে। এদিক থেকে একটু চিন্তাতেও ছিলো রাইমার নাম্বার না চিনে যদি রিসিভ না করে! কিন্তু রাইমার চিন্তা ভুল প্রমাণ করে দিগন্ত ফোন টা রিসিভ করলো৷ রাইমা ফোন টা কানে ধরে কিছু বলার আগেই শুনতে পায়,
“এই যে মিস রাইমা খন্দকার, অস”ভ্য মেয়ে! আমায় মিস করছিলেন বুঝি?”
দিগন্তের শীতল কণ্ঠে মিস করার কথা টা শুনে রাইমার মনের মাঝে এক প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়। উত্তর দিতে যেনো ভুলে যায়। সেকেন্ড গড়িয়ে সময় মিনিটে পরিণত হলে দিগন্ত আবারও শীতল কণ্ঠে বলে,
“নিশ্বাস গুণতে ফোন দিয়েছেন বুঝি? কথা বলছেন না যে!”
“আপনি আমার নাম্বার কি করে চিনলেন? কথা না বলতেই আমি ফোন দিয়েছি, ধরে ফেললেন যে!”
রাইমা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে। দিগন্ত স্মিত হাসে। রাইমার কথার উত্তরে বলে,
“নাম্বার চেনা কি খুব কঠিন বিষয় ম্যাম?”
চলবে?
।