আকাশেও অল্প নীল পর্ব -২৮

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ২৮
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৮৬,
দিগন্তের প্রশ্নে রাইমা হকচকিয়ে যায়। তোতলানো স্বরে বলে,

“না, কঠিন বিষয় কেনো হবে? আগে কখনও ফোনে কথা হয়নি তো! এজন্য প্রশ্নটা করা।”

“আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আপনাকে জানানোর আছে রাই। এজন্য আপুর থেকে নাম্বারটা নিয়ে কল করতেই উদ্দ্যত হয়েছি। আর আপনি ফোন দিয়েছেন। তো এবার কথাগুলো বলা যাক! আপনি ফ্রি তো?”

দিগন্ত কিছু টা থমথমে কণ্ঠেই কথাগুলো বললো। রাইমা দিগন্তের কথায় একটু চিন্তিত হয়ে পরলো। কি এমন কথা যা দিগন্ত বলতে এতোটা তৎপর! রাইমা দিগন্তের প্রশ্নের উত্তরে বলে,

“হ্যাঁ, ফ্রি-ই আছি আপাতত।”

“তো মনোযোগ দিয়ে শুনুন।”

“বলুন, আমি শুনছি।”

“আপা আপনার কাছে ফোন দিয়েছিলো?”

“জ্বি!”

“ফোন দিয়ে কি বলেছে?”

রাইমা এবার ঘাবড়ে যায়। এমনিই সে ইতস্তত হয়ে বসে আছে স্নেহার বলা কথাগুলো দিগন্তকে কিভাবে বলে! সেখানে দিগন্তের এই সোজাসাপ্টা প্রশ্নের উত্তরে সত্য টা বলার সাহস টা সে পাবে কোথায়? রাইমা বার কয়েক ফাঁকা ঢোক গিললো। দিগন্তকে বলার সাথেই যদি সে রে”গে যায়! তখন সে কি করবে? এখন তো এক শহরেও নেই যে! দেখা করে সব মিটমাট করে নেবে। রাইমা যখন এসব বিষয় নিয়ে চিন্তিত তখনই দিগন্ত সাবলীল গলায় রাইমাকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, বলে,

“কি হলো বলছেন না যে? কোনো সিরিয়াস ইস্যু?”

দিগন্ত রাগ করে করুক, এবার দরকার। এই ভেবে রাইমা মুখ খুললো, বললো,

“আপনার মায়ের বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলেছে ভাবী।”

রাইমা শেষের দিকে এসে একটু তুতলিয়েই কথাটা বললো। দিগন্ত এপাশ হতে স্মিত হাসলো। বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে চুলগুলোয় হাত চালিয়ে বললো,

“আমি কিছু বিষয় আপনাকে এবার এক্সপ্লেইন করি রাই। আপনি কিন্তু পুরোপুরি আমার কথার দিকে মনোযোগ দিবেন। ওকে?”

রাইমা নিজের স্বভাবসুলভ ভীতু কণ্ঠে আস্তে করে বললো,

“হু বলুন, আমি মনোযোগ আপনার কথার দিকেই দিলাম।”

“আচ্ছা রাই! আপনার বয়স টা যখন চার কি পাঁচ! এই সময় যদি আন্টি আই মিন আপনার মা, আপনাকে ছেড়ে, আপনার বড়ো বোনকে ছেড়ে, সবথেকে বড়ো কথা আপনার অসুস্থ বাবাকে ছেড়ে চলে যেতো! আপনি কি তাকে ক্ষমা করতেন?”

রাইমা দিগন্তের সরাসরি প্রশ্নে বুঝতে পারে স্নেহার বলা সব কথায় হয়তো সে শুনেছে। রাইমা দিগন্তের প্রশ্নের কি উত্তর দিবে! চিন্তা করেও খুজে পেলো না। সে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,

“স্নেহা ভাবীর বলা কথাগুলো আপনি শুনে ফেলেছেন?”

“শুনতে চাইনি, কিন্তু আপুকে ডাকতে গিয়ে কানে এসে পরেছিলো। আমার আবার অন্যের কথা আড়ি পেতে শোনার অভ্যেস নেই রাই।”

“এখন আপনি কি আমার উপর রাগ করবেন দিগন্ত সাহেব?”

“আমি সহজে রাগ করিনা রাই। কিন্তু যখন রাগ করি, তখন সহজে নিজেকে সামলাতে পারিনা। এজন্য আমার জীবনে কাছের মানুষের সংখ্যা খুবই স্বল্প। তেমন কাছের মানুষ নেই বললেই চলে। তাই চাচ্ছি না রাগ করে আপনাকে না পেতেই হারিয়ে ফেলি।”

রাইমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বুঝলো মানুষ টাকে রাগানো বা কষ্ট দেওয়া কোনো টাই ঠিক হবে না। দিগন্ত এপাশ হতে রাইমার নিঃশ্বাসের শব্দটা ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারলো। ফোনের দুপাশে চলছে পিনপিন নিরবতা। দিগন্ত এবার লম্বা কয়েক টা নিঃশ্বাস ফেলে শোয়া থেকে উঠে বসলো। পায়ে স্যান্ডেল চালিয়ে টাউজারের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে রুমের মাঝেই ছোটো-ছোটো কদমে হাঁটতে হাঁটতে বলতে শুরু করে,

৮৭,
“আপনাকে একটা স্টোরি বলি রাই! শুনবেন কিন্তু। ফোন কাটবেন না। গল্পটা একটা ছেলের জানেন তো। ছেলেটা কে আশা করি বুঝতে বাকি রাখবেন না। আমি জানি আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। পাঁচ বছরের একটা ছোট্ট ছেলে যে সম্পর্কের টান কি! সবে বুঝতে শুরু করেছে। কিন্তু বাবা মা ভাইবোন তাদের প্রতি তো বোঝার বয়স না হতেই তো টান থাকে। তখনই দেখা গেলো তার বাবা অসুস্থ, এতোটা অসুস্থ যে জীবনের ভরসা নেই। তার বড়ো বোনও জীবন কি বুঝে উঠেনি। ঠিক তখুনি তারা দুজনই দেখলো তাদের মা তাদের উপর ছায়া দেওয়ার বদলে সরে গেলো। মাথার উপর কড়া রোদ্দুরে দুজনই যখন ছায়া খুজে বেড়াতো, মা বলে মানবীকে তারা পেতো না। তাদের চাচা, ফুফু তো তাদের বাবাকে সুস্থ করতেই ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করতো, ছেলেমেয়ে দুটো বাসায় কি খায়! তারা কি অবস্থায় আছে? তারা ঠিকমতোন খায় কিনা! ঘুমোয় কিনা? খোজ নেওয়ার জন্যও তাদের মা আসতো না৷ তাদের দুই ভাইবোনের ছেলে টা ক্ষুধার তাড়নায় কান্না করতো। বোনটা তো বাবার রাজকন্যা! সে কি করে তার ছোট্ট ভাইটার জন্য কি করবে? তবুও সে হাত পু”ড়িয়ে খাবার বানিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টায় থাকতো। বোনের পো”ড়া হাতটায় জ্ব”লতো। দেখার জন্য কেউ ছিলো না রাই। ক্যান ইউ ইমাজিন দ্যাট রাই! তাদের মা আছে, অথচ তারা ক্ষুধার তাড়নায় সাফার করছে। ঘুমানোর সময় মাথার উপর কারোর হাত বুলিয়ে দিতে আসতো না। অথচ ছেলেটা মায়ের আঁচলে মাথা না রেখে ঘুমাতোই না৷ তার বোনটা ঐ ছোট্টো অবস্থায় ছোট্ট ভাইটার মাথা তার নিজের কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতো। ছেলেটার বাবা মায়ের অভাবে জ্বর এসে পরতো। যেই সেই জ্বর না। গা কাপিয়ে জ্বর আসতো৷ জ্বরের ঘোরে সে মা মা করে কাঁদতো রাই। কিন্তু তার মা আসতো না। ছেলে টা তখন সদ্য মায়ের হাতের আঙুল পেচিয়ে স্কুলে যেতে শুরু করেছিলো। কিছুদিন পর তার বাবা সুস্থ হলে সে স্কুলে যাওয়ার সময় মা’কে খুঁজতো। পেতো না জানেন! মায়ের অভাবে বোনকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতো। অতঃপর একসময় সে মা আসবেনা সেই তিক্ত বাস্তবতা মেনে নিয়ে চুপ হয়ে গেলো৷ একটা চঞ্চল ছেলে দিনদিন চুপ থেকে থেকে এতোটাই গম্ভীর হয়ে গেলো যে, বাচ্চাদের তার শৈশবের আনন্দ বলে যে একটা বিষয় থাকে! তার জীবনে সেই জিনিসটা ছিলো না। তার বোন বারবার বলতো ভাই আমার সাথে এসে খেলা কর, বাবা আর বোন ছেলেটার মুখে হাসি দেখতে এতোটা তৎপর ছিলো যে ছেলেটা না চাইতেও অনেক কিছু পেয়ে যেতো। কিন্তু তার ঠোঁটে না হাসি আসতো না৷ সে প্রতিটা সিঙ্গেল সেকেন্ড তার মা’কে খুজে যেতো। স্কুলে গিয়ে দেখতো তার সব ক্লাসমেইটদের মা আছে। অথচ তার নেই৷ স্কুলের প্যারেন্ট’স টিচার’স মিটিং এ তার প্রতিটা ক্লাসমেইট দুহাতে বাবা মায়ের আঙুল আঁকড়ে আসতো, সে একা বাবার হাত ধরে যেতো। বড়ো হওয়ার সাথে সাথে দেখতো তার বাবাও জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে নেমে কতোটা কষ্ট করে যাচ্ছিলো। এরমাঝেই তার মা তারা বড়ো হওয়ার পরপর এসে বাচ্চাদের উপর হক দাবী করে কম ঝ”গড়া করতো না রাই। দিনশেষে ক্লান্ত বাবা যখন বাসায় ফিরতো! ঐ মহিলা এসে নিজের সুবিধা করতে না পেরে ঝগড়া করে চলে যেতো। ছেলেটা তার বাবাকে তাদের দু ভাইবোনকে আঁকড়ে চিৎকার করে কাঁদতে দেখেছে রাই৷ মানুষ সুখের স্মৃতি কমই মনে রাখে রাই, কষ্টগুলো চাইতেও ভুলতে পারেনা। আমিও পারিনি ভুলতে। আপনি কি চান যে মানুষ টার জন্য তিন তিনটা মানুষ জীবনের ২২-২৩টা বছর ধরে কেঁদে গেছে সে ফিরে আসুস তাদের জীবনে? বাবা নামক মানুষ টা তো আল্লাহর বান্দা, আল্লাহ নিয়ে নেওয়ায় দুনিয়াবী কষ্ট থেকে মুক্তি পেলো। আমরা তো সেই কষ্ট মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে হজম করে চলেছি। সেই কষ্টের কারণকে কি করে লাইফে এক্সেপ্ট করবো রাই?”

৮৮,
দিগন্তের বলা প্রতিটা কথা শুনে রাইমা এপাশ হতে নিঃশব্দে কেঁদে দিয়েছে। একটা মানুষ নিজের মনের মাঝে এতো কষ্ট চেপে রেখেছে। আর সে কিনা সেই কষ্টের কারণ টাকেই দিগন্তের জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে চাইছে। কিন্তু স্নেহার কথাও বা কিভাবে ফেলে দেয়! রাইমা দোটানায় পরে গেলো। সে একহাতে নিজের চোখ মুছে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,

“কিন্তু স্নেহা ভাবী যে বললো! আজ একবার নয়, মাহাদ ভাইয়ের বিয়ে সময়ও আপনার মা আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। আমি না বুঝতে পারছিনা আমি কি করবো!”

দিগন্ত বুঝতে পারি রাইমার বিভ্রান্তির কারণ। সে রুমে থাকা সিঙ্গেল সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বললো,

“এই যে আপনি যেমন এক নারী হয়ে অন্য নারীর কথা ফেলতে পারছেন না, আমার বোন টাও পারছে না আমিরা শেখের কথা ফেলতে৷ সেখানে তো আমিরা শেখ আমাদের মা। শুধু নামেই মা, মায়ের দায়িত্ব পালনে মা নয়। জন্ম দেওয়ার যে কষ্ট! সেই কষ্ট সহ্য করলেই সব নারী মা হতে পারে না রাই। জন্ম দেওয়ার কষ্ট আর সারাজীবন মানুষ করার মতো কষ্ট হয়তো দুনিয়ায় ২য়টি হয় না। কিন্তু মা তো সব কষ্ট হজম করে নেয়। আমার মা তো তা করেনি রাই৷ আমি আশা রাখবো, আপনি আমার ভেতরে জমানো কষ্টগুলো বুঝবেন। আপনি আমার জীবনে ২য় নারী, যাকে আমার বোনের পর আমার ভেতরের কথাগুলো কোনো দ্বিধা ছাড়াই জানাতে পারলাম৷ আপনিও আপনার স্থান টা সম্মানের সহিত আমার জীবনে ধরে রাখার চেষ্টা করবেন না রাই। ইনশা আল্লাহ আমি আপনার কাছে কখনও কিছু লুকাবো না তবে৷ আর আপনার ভাবীকে আমি সামলে নিবো। আপনার দোটানায় ভাসতে হবেনা৷”

রাইমা সস্তির নিশ্বাস ফেলে। আলতো স্বরে বলে,

“ধন্যবাদ না রেগে আমায় সব টা বোঝানোর জন্য।”

“আমি এমন মানুষ রাই, যে কিনা যেটা অপছন্দ, তার কাছের মানুষই করতে চেষ্টা করলে, তা বুঝতে পারলে একবার বুঝাই। সে বুঝে বিষয়টা থেকে পিছু হটলে ভালো। বুঝেও না বোঝার ভান ধরে সেই অপছন্দের কাজে পা বাড়ালে তার দিকে ২য় বার ফিরে তাকাই না। তাই আশা রাখবো, আপনি বিষয়গুলো মনে রাখবেন।”

“যার মন যেমন, সে তেমনই মানুষই পায় দিগন্ত আহসান। এটাই তো বড়োরা বলে। আপনি যেমন, আমিও ঠিক অনেকাংশেই তেমন। তাই আপনিও এই কথাগুলো মেনে চলবেন। সম্পর্ক তো আমি একা জুড়ছিনা, আপনিও জুড়বেন।”

দিগন্ত মৃদু হাসলো। হেসে বললো,

“জি ম্যাম মনে রাখবো। আপাতত রাখি। আমরা আজ গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো।”

“পৌছে কল দিয়েন।”

“যথাআজ্ঞা মহারাণী।”

দিগন্ত কল কেটে দেয়। রাইমা ফোন টা বুকে জড়িয়ে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পরে। যাক সব চিন্তার ভার তার মাথা থেকে নামলো। এবার শান্তি।

৮৯,
শনিবার সকাল। ঝকমকে রোদের সকালে বাড়ির বারান্দায় রাখা বড়ো টুলে বসে আছে রাইমা, শার্লিন, শিখা, রেখা। বাড়ির বড়োরা কাজে ব্যস্ত। ওরা চারজন বসে বসে বড়ইয়ের আচার খাচ্ছে। বাড়ির সামনের পুকুরপারে মস্তো দুটো বড়ইয়ের গাছ মাথা উচিয়ে দাড়িয়ে আছে। সেই গাছেরই বড়ইয়ের আচার করে রেখেছেন হামিদা বেগম। যা এখন রাইমা-রা বোসে বোসে খাচ্ছে। হাসান সাহেব এবং আজাদ সাহেব গেছেন গ্রামের বাজারে। ওখানে ডেকোরেটরের লোকদের সাথে কথা বলতেই মূলত উনাদের বাজারে যাওয়া। মজিদ সাহেব গরুর খোয়ারে গরুদের পানি খাওয়াতে ব্যস্ত। তাদের বাবা বয়স্ক মানুষ, কাজ করে কোমড়ের ব্যথায় ঘরে শুয়ে আছেন। শাহনাজ বেগম জা-য়ের হাতে হাতে রান্নায় ব্যস্ত। সাহিরা বেগম আর হামিদা বেগম লাউয়ের মাচা থেকে শাক তুলতে ব্যস্ত। লাউয়ের গাছে আর লাউ ধরেনা, সিজন শেষ। এবার গাছ কেটে দেওয়ার পালা। তবুও লাউয়ের গাছের কচি লতাপাতা বেরোয় বলে টুকটাক শাক খাওয়া চলছে। শার্লিন শাক দেখেই বলেছে শাক খাবে। এজন্য উনারা শাক তুলতে ব্যস্ত। বিকেল থেকে বিয়ের ধুম লাগবে। আগামীকাল হলুদ, সেসবেরই আয়োজন শুরু হবে বিকেল থেকে। গতকাল সারাদিন লাগিয়ে আজাদ সাহেব মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে এসেছেন পুরো গোষ্ঠী ধরে। আত্মীয় স্বজন তো আছেই। একমাত্র মেয়ের বিয়ে যেনোতেনো ভাবে দিতে রাজী নন আজাদ সাহেব। গ্রামে একটাই এতিমখানা, সেখানকার বাচ্চাদের জন্যও খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও আজাদ সাহেব করেছেন। এখন বিয়ের ধুমধাম শুরু হবার অপেক্ষা। রাইমার ফুফু এখনও শ্বশুর বাড়ি সামলে ভাতিজীর বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে এসে সারতে পারেননি৷ রাইমা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নিজের ফুফুর জন্য। মায়ের পর ফুফুর আদরটাই বেশি পেয়েছে সে। কথায় আছে না, ফুফু ভাতিজী একজাত, সেজন্য ফুফুর প্রতি তার টান টা বরাবরই বেশি। তার ফুফু বেশ কয়েকবারও ঢাকায় গিয়ে তাদের দেখে এসেছে। এজন্য একটু হলেও ফুফুর আদরটা ফিল করতে পেরেছে রাইমা। এজন্য ফুফুর আগমনের অপেক্ষায় রাইমার মন টা একটু বেশিই ছটফট করছে। রাইমার এই ছটফটানির মাঝেই বাড়ির বড়ো উঠোনে ভ্যান এসে থামলো। ভ্যান থেকে রাইমার ফুফু ডালিয়া বেগম নামতেই রাইমা উল্লাসে খালি পায়েই ফুফি বলে চিৎকার দিয়ে ছুট লাগায়। শার্লিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে রাইমার দিকে। সে তো রাইমাকে শান্ত স্বভাবেই দেখে অভ্যস্ত। আচমকা চিল্লাতে দেখে শিখার হাতে চিমটি কেটে জিগাসা করে,

“এটা কি হলো শিখা?”

“ফুফি এসেছে শার্লিন আপু। আর রাই আপু ফুফিকপ একটু বেশিই পছন্দ করে।”

“ওহ।”

শার্লিনের মন টা চুপসে যায়। ফুফু কি জিনিস সে কমই বোঝে। অন্যের ফুফুদের দেখে কতো আদর করতে। তার ফুফু বলেও যে কারোর অস্তিত্ব এই দুনিয়ায় আছে কমই দেখেছে সে। তার চাচা ফুফুরা তো সবাই নিজেদের মাঝে তার দাদা দাদীদের নিয়ে দ্বন্দ্বই করে চলেছে। তারা মা”রা যাবার পর তো তারা যে আপন, এটাই ভুলে বসেছে। কোন পরিবারে কোন গল্প লুকিয়ে আছে বোঝা দায়। অন্যের টা দেখে শুধু আফসোসই হয়। শার্লিন নিজের ইমোশন সামলে রাইমার পিছু ধরে। বোনের মতো বান্ধবীর দৌলতে দাদা-দাদী, চাচা-চাচীর আদর ফিল করতে পারলে ফুফুর আদরও পাবে। না পেলে আদায় করে ছাড়বে। আপাতত এটাই তার উদ্দেশ্য।

৯০,
ইফরাদ, মেসবাহ, শাহীন সাহেব, শিরিনা বেগম এক বাসে রওনা দিয়েছে রাইমাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে। মেসবাহর বাবা মা সামনের সীটে একসাথে বসেছেন। মেসবাহ আর ইফরাদ পেছনের সীটে। ইফরাদের বাবা মা, মাহিশার শ্বশুরবাড়িতে বলে মাহিশাকে নিয়ে আলাদা ভাবে রওনা দেবে বলে ইফরাদ মেসবাহদের সাথেই যাচ্ছে। এছাড়া সে মাহিশার মুখোমুখিও হতে চায় না বলে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। একই দুনিয়ায় প্রতিটা মানুষের জীবনে প্রতিটা সম্পর্কের চিত্র আলাদা। ভাইবোন, বোনে বোনে, ভাই ভাইয়ে সম্পর্ক তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক। দিগন্ত আর স্নেহার বন্ডিং দেখলেই তা বোঝা যায়। অথচ তার বোন! এমন একটা মানুষ, তাদের মাঝের সম্পর্ক টাকে এতোটা তিক্ততায় পৌছে দিয়েছে যে মিলে থাকার বদলে এড়িয়ে চলার রাস্তা খুজতে হয়। তার বোনের জন্য একটা মেয়েকে, যে মেয়েটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বান্ধবী বলে পরিচয় করাতো! সেই মেয়েকে সমাজের মানুষের কাছে কম নিচু হতে হয়নি! ভাবতেই ইফরাদের মনে অপরাধ বোধে হু হু করে উঠে। মাহিশার কথা বলায় শার্লিনকপও সে কষ্ট দিতে ছাড়েনি। না জানি পাগলিটা কি অবস্থায় আছে! তার উপর কতোটা অভিমানের পাহাড় যে জমিয়ে রেখেছে! সে শুধু উপরওয়ালা আর শার্লিন ভালো জানে। শার্লিনকে কষ্ট দেওয়ার পর রাগে নিজের ফোন টাও ভেঙেছে ইফরাদ। হাতে টাকাও শর্ট বলে ফোন কেনা হয়ে উঠেনি। রাইমার বিয়ে শেষে কিনবে বলে ঠিক করেছে। ফোনটার এমন দশা, ঠিকও করা যাবেনা। যার ফলে শার্লিনের সাথে কথাও হয়ে উঠেনি। মায়ের ফোন দিয়ে একবার কথা বলবে ভেবেছিলো! পরে ভাবলো দূরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়! গানের লাইনটার একটা ছোট্ট পরিক্ষাও করা যাক। শার্লিনের প্রতি ইফরাদের ভালোবাসা বেড়েছে কিনা ইফরাদ জানেনা, তবে বুঝেছে পাগলিটাকে ছাড়া সে অসম্পূর্ণ এবং তার পাগলামি না দেখে, ফানি কথাবার্তা না শুনলে সে নিজেই পাগোল হয়ে যাবে। পথ যতো ফুরিয়ে রাইমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে অগ্রসর হচ্ছে, ইফরাদের দুশ্চিন্তা ততো বাড়ছে। শার্লিন তাকে দেখে ঠিক কি রিয়েক্ট করবে? এই চিন্তায় আপাতত তার কিছু ভালো লাগছেনা। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে ইফরাদ। সেই অস্থিরতার কিছু মাত্রা হয়তো ইফরাদের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। মেসবাহ ইফরাদের কাছে তার বোনের সাথে ইফরাদের ঝগড়ার বিষয়ে সবই শুনেছে। ইফরাদ শেয়ার করেছে। মেসবাহ ইফরাদের কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বললো,

“এতো অস্থির হইয়ো না। আমার বোন ভালোবাসার কাঙাল। একটু ভালোবেসে আগলে ধরো, ও গলে যাবে। ভাই হয়ে লজ্জাও করে বোনের ভালোবাসার বিষয়ে কথা বলতে। কিন্তু তোমার অবস্থা দেখে না বলে থাকতে পারলাম না।”

ইফরাদ মেসবাহর ভরসা পেয়ে একটু শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে। মেসবহার কথার উত্তরে মুচকি হাসে। সীটে গা এলিয়ে দিয়ে ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“আপনার কথা যেনো সত্যি হয়।”

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়। ২১৮০+ ওয়ার্ড, এতো বড়ো পর্ব রিচেইকের মতো ধৈর্য হয়নি। মানিয়ে নেবেন ভুলগুলো। আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here