আগন্তুকের আসক্তি পর্ব -০২+৩

#আগন্তুকের_অসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২]

দুপুরের রোদ জানালার কাঁচ ভেদ করে তীর্যক ভাবে ইনানের চোখে লাগে।সহসা চোখ মুখ কুচকে আড়মোড়া কাটিয়ে উঠে বসে সে।দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সকাল সাড়ে বারোটা বাজতে দেখে আবার ধপাশ করে বিছানায় শুয়ে যায়।পাশে ফিরে তাকাতেই গুটিয়ে শুয়ে থাকা লাল শাড়ি পড়া একটি মেয়েকে দেখে ভরকে যায়।সহসা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়।বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে-নিতে রুমের পরিবেশটা পরখ করে বুঝতে পারে, আরে মেয়েটা তার বিবাহিত স্ত্রী।গতকাল মেয়েটার সাথে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে যায়।তারপর আর মনে নেই।হয়তো ক্লান্ত শরীরে মেয়েটি দুরুক্তি না করে গুটিয়ে শুয়ে যায় ইনানের পাশে।

আয়নায় নিজেকে ভালোভাবে দেখে নেয় ইনান।গতকালের সাজ পোশাক এখনো আগের মতো আছে।রুম থেকে বের হয়ে সোজা লিভিং রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। অলীদ আর সুফিয়া সেখানেই বসে আছে।ইনানকে আসতে দেখে অলীদ ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।তার সন্দেহভাজন দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুচকায় ইনান।

– তোর সমস্যা কি, এইভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?
– তোর সাজপোশাক এখনো আগের মতো মানে রাতে কিছু হয়নি?
– কি হবে?
– ইয়ে আই মিন…

অলীদ কথা শেষ করার আগেই তার পিঠে কিল বসায় ইনান।
– আমাকে কি তোর পাগল মনে হয়?ভুলে যাবি না মেয়েটার আঠারো হয়নি তাছাড়া মেয়েটার ভালো মন্দ সব দায়িত্ব আমার।তাই সব দিক বিবেচনা করা একান্ত জরুরি।

ইনানের কথায় তাল মিলায় সুফিয়া।
– ঠিক বলেছিস তবে তোর পাঞ্জাবি পুড়লো কি করে?
– তেমন কিছু না।দুপুর হয়ে এসেছে তোরা তোদের পছন্দ মতো খাবার অর্ডার দে ডেলিভারি ম্যান খাওয়ার দিয়ে যাবে।
– ওকে তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।

ইনান উপরে উঠে আবারো নিজের রুমে চলে যায়।ইতিকা এখনো ঘুমিয়ে আছে আগের মতো।ইনান আগে ফ্রেশ হয়ে এসে ইতিকার পাশে বসে।,

– এই যে শুনছেন।এই মেয়ে,এই যে।

ইতিকার হুশ নেই।সে এখনো গভীর ঘুমে মগ্ন।সূর্যের আলো তার মুখের সৌন্দর্য যেন বাড়িয়ে দিয়েছে।চেহারার মাঝে সরলতা গ্রাম্য ভাব তার মাঝে বৃদ্ধমান। কিন্তু কে বলবে এই মেয়ের ঘুম ভাঙ্গলে বাঘিনী রূপ ধারন করবে।
ইনান মেয়েটির হাত আলতো ছুয়ে দেয়।নরম তুলতুলে হাতটা নিজেও ইনানের হাত আঁকড়ে ধরে।ইনান দোটানায় পড়ে যায়।নিজের মাঝে তৈরি হয় ইতস্ত বোধ।সঙ্গে সঙ্গে সে চিটকে সরিয়ে দেয় ইতিকার হাত।আকস্মিক ঝাকরায় ঘুম ভেঙ্গে যায় ইতকার।তার সামনে ইনানকে দেখে লাফিয়ে উঠে বসে।

– আপনি?
– আমার রুমে আমি ছাড়া, এই রুমে কাউকে দেখবেন না।যাই হোক ফ্রেশ হয়ে আসুন।ব্যাগে আপনার জামা কাপড় রাখা আছে আর বিকেলের মধ্যে আপনার প্রয়োজনীয় সব চলে আসবে।

ইনান চলে যায়।ইতিকা তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকায় মনের ঘোর কাটলে আবার চোখ সরিয়ে নেয়।

বেশ কিছুক্ষণ পর ইতিকা ডাইনিং টেবিলের সামনে আসে।তার জন্য এতক্ষণ খাওয়ার টেবিলে অপেক্ষা করছিল সবাই।সুফিয়া ইতিকাকে টেনে ইনানের পাশে বসায়।ইনান আড় চোখে একবার মেয়েটিকে পরখ করে নেয়।আসমানি আর নীল রঙের মিশ্রণে শাড়িটিতে মেয়েটিকে অন্যরকম সৌন্দর্যে আবৃত করে রেখেছে।কোমরের নিচে চুলগুলো চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে।
সুফিয়া সবার খাবার সার্ভ করে নিজেও বসে যায়।ইতিকার দিকে তাকিয়ে তার ভ্রু-যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে যায়।সবাই হাতে চামচ নিয়ে সহজে খাবার খাচ্ছে কিন্তু ইতিকা এইসবে অভ্যস্ত নয় তাই সবার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আবার নিজের প্লেটের দিকে একবার তাকাচ্ছে তার অবস্থা বুঝতে পেরে সুফিয়া স্মিথ হেসে বলে,

– ইতিকা তুমি হাত দিয়ে খাও আমিও হাত দিয়েই খাবো।
– ঠিক আছে আপু।

মেয়েটির চোখে ভয়ের ছাপ কেটে গেছে।মুচকি হেসে নিজেও খাওয়া শুরু করে।অপর দিকে অলীদ একবার ইনান আরেকবার ইতিকার দিকে তাকাচ্ছে।তার সবকিছু গোজামিল লাগছে।ইনান বরাবরি স্টাইল,ফ্যাশন সচেতন ছেলে।তার সঙ্গে সব ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়া মেয়েদের চলাফেরা তার মাঝে এই গ্রাম্য মেয়েকে বিয়ে করার কারন সে খুঁজে পেলনা।

__
দুপুরের পর সুফিয়া তার নিজের বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়।সুফিয়া,অলীদ এবং ইনান তিনজনের বন্ধুত্ব একটু বেশি গভীর।অলীদের বাড়ি ঢাকার বাইরে হওয়ায় ভার্সিটিতে আসা যাওয়ার সমস্যা হওয়ায় মেসে থাকতে শুরু করে কিন্তু গত একবছর ইনান তার বাবা-মাকে ছেড়ে এই ফ্লাটে উঠেছে তারপর থেকে ইনানের সঙ্গে এই ফ্লাটে আছে আলীদ।

বসার রুমে অলীদ এবং ইনান একসঙ্গে বসে আছে তখনি নিরিবিলি পরিবেশটার ছেদ ঘটায় ইনানের ফোনের ভাইব্রেটর। বাড়ির দারোয়ানের নাম্বার দেখে তার মনে সন্দেহের বাতি জ্বলে উঠে।

– আসসালামু আলাইকুম চাচা বলুন।

– তুমি নাকি বিয়া করছো?তোমার আব্বা আম্মা আসছে।গেটের সামমে দাঁড়াইয়া আমারে জিগাইলো ইফতিহার ইনান থাহে কোন হানে আমিও দেখাই দিলাম।গত এক বছরে তাদের দেহা পাইলাম না আর আইজগা আইসা পড়ছে তোমার বিয়ার খবর পাইলো কেমনে?
– তারা এখন কোথায় চাচা?
– বাগান সাইড পার হইয়া গেসে লিফটে উঠে যাবে যেকোন সময়।

ইনান আর দেরি করলো না দ্রুত মোবাইলটা ছুড়ে মারে সোফার উপর।অলীদকে বুঝিয়ে দেয় কেউ আসলে দরজা যেন দেরিতে খোলে।
ইনান ঝটপট নিজের রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়।এদিকে বিছানায় উপড় হয়ে কাঁদছে ইতিকা।লেখনীতে পলি আনান
হুট করেই তাকে টেনে দাঁড় করায় ছেলেটি।তার শাড়ির ঠিক নেই এদিক সেদিক হয়ে আছে।দ্রুত দুহাতে শাড়ি ঠিক করে ইনানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে।কিন্তু ফালাফল ব্যার্থ।

কান্নার ফলে রক্তিম ডালিমের মতো চোখ দুটো দেখে বেশ রেগে যায় ইনান কিন্তু তা প্রকাশ করলো না।দ্রুত ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে পাউডার নিয়ে ইতিকার মুখে লাগাতে থাকে।লিপস্টিক দিয়ে রাঙাতে থাকে মেয়েটির ঠোঁট যুগল।
– এই যে কি করছেন আপনি?পাগল হয়ে গেছেন নাকি?

ইতিকার ধমক ইনান শুনলো না বরং বডি স্প্রে নিয়ে তার সারা শরীরে স্প্রে করলো।হাতে মোটা মোটা বালাগুলো পড়িয়ে, গলায় চোকার সঙ্গে লম্বা মোটা চেইন পড়িয়ে ক্ষান্ত হলো সে।

ইতিকা ইনানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ায়।কিন্তু ইনান তাকে তার কাছে টেনে এনে ভেজা চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলে,

– শুনছেন, আমার মা-বাবা আসবে মানে আপনার শশুড়-শাশুড়ী।নিশ্চিই তাদের দেখে আমার নামে নালিশ দেওয়া শুরু করবেন?

– অবশ্যই আপনি যে আমায় জোর করে বিয়ে করেছেন তা তাদের জানানো একান্ত জরুরি।

– এমনটা আপনি ভুলেও করবেন না ফলাফল বেশি ভালো হবে না বলে দিলাম।

ইনানের ধমকে ইতিকা ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আরো ক্ষিপ্ত হলো,
– আমাকে আপনি চিনতে পারেননি,কলিজা টেনে ছিড়ে ফেলবো আপনার।আমাকে বিয়ে করার স্বাদ মিটিতে তবেই আমি ক্ষান্ত হবো।

ইনান মাথায় হাত দিয়ে পাইচারি করছে।কিছুক্ষণ আগে অলীদের কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে।অলীদ বলেছিল, গ্রামের মেয়েরা দেখতে সহজ সরল হলেও মোটেও তারা সহজ সরল নয় বরং তাদের মাঝে আলাদা একটি ভাব ধারা আছে।তারা ঝগড়া করতে পটু ইনানের জীবন যে এই মেয়েটা অতিষ্ঠ করে তুলবে তার আগাম বার্তা অলীদ তাকে কয়েক মিনিট আগে দিয়েছে।কিন্তু তার ফলাফল যেন খুব শীঘ্রই পেতে চলেছে ইনান।

যখন কোন ভাবে ইতিকাকে কবজা করতে পারলো না তখন মিথ্যার আশ্রয়টা নিলো ইনান।

– একটা কথা বলবো আপনাকে?আমার বাবার হাটে একটা ফুটো আছে।তিনি যদি জানেন তার ছেলে এইভাবে বিয়ে করেছে তবে তার হার্টের অসুখ বাড়বে যদি তিনি এট্রাক করে বসেন আমার বাবার অসুস্থতার দায় কিন্তু আপনাকে নিতে হবে।”

ইনানের আফসোস ভঙ্গিমার কথায় দমে গেলো ইতিকা।তীর্যক ভাবে তাকিয়ে ইনানকে বলে,

– তবে কি করতে হবে আমায়?”

-বেশি কিছু না শুধু বলবেন আমার আর আপনার রিলেশনের বিয়ে ছিল ব্যস এইটুকুই।

– রিলেশনে করবো আমি তাও আপনার সাথে?

ইতিকার ব্যঙ্গ সুরের কথায় হাত মুঠিবদ্ধ করে নিলো ইনান।দাঁতে দাঁত চেপে আরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো ইতিকার উদ্দেশ্য,
– এর আগে বুঝি প্রেম করেন নি?

প্রশ্নটা যেন একপ্রকার খোঁচা দেওয়া হলো ইতিকাকে।বুকের বাম পাশটায় আবারো অসহ্য ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।

ইতিকাকে অন্যমনষ্ক দেখে তার দু’গাল আলতো ভাবে ছুঁয়ে দেয় ইনান।

– একটা চুমু খেলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?

ইনানের প্রশ্নে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে ইতিকার কপালে।রাগান্বিত স্বরে কিছু বলার আগেই ইনান তার গালে অধর ছোঁয়ায়।হঠাৎ স্পর্শে অন্যরকম শিহরণ বয়ে যায় ইতিকার মাঝে।

ইনান সরে আসে তার সামনে থেকে আবার কি মনে করে এগিয়ে যায়।মেয়েটিকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে আয়নার দিকে ইশারা করে,

– ডানে বামে অতিতে কি হয়েছে ভুলে যান ইতিকা।আর সামনে কি হবে তাও ভাবতে হবে না আপনার।আপনি আজকের পর থেকে মাথায় এটাই ঢুকিয়ে নিন আপনি আমার ‘ইতি বউ’।’
ইতিকা’ নামটায় ডাকতে পারবো না।তার থেকে ভালো আমি আপনাকে ছোট নামে ডাকি ‘ইতি’ আর আপনি আমার একমাত্র বউ তাই আপনি আমার ‘ইতি বউ’।

ইতিকা শিউরে উঠলো আয়নার দিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে একবার দেখে নিলো কপালের দিকটায় কাটা দাগ, গালের বাম পাশেও কিছু কাটা দাগের চিহ্ন।অদ্ভুত একটা মানুষের বিক্ষিপ্ত এতটা কাটা দাগ কি করে?আর জখম পেলো কি করে সে? ইতিকার ভাবনার ছেদ ঘটে ইনানের আবেগী সুরে কন্ঠের।

– ইতিবউ আপনি কি আমার বাবা’মাকে নিজের বাবা’মায়ের আসনে বসাতে পারবেন?
#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩]

কলিং বেলের শব্দে বার বার কেঁপে উঠছে অলীদ তার মাঝে তৈরি হয়েছে ভয়ের সঞ্চার।যতদিন,যতবার ইনানের বাবার সাথে তার দেখা হয়েছে প্রতিবার তাকে বকা শুনতে হয়েছে কখনো কখনো তাকে মারার জন্য তেড়ে এসেছে।তার একমাত্র কারন ইনান কেন তার মামার সঙ্গে রাজনীতিতে মেতে আছে?বন্ধু হিসেবে তারাও তো বোঝাতে পারে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ইনান এভাবে নিজের জীবনটা হেলদোল হীন ভাবে কাটানো উচিত নয়।
একে একে টানা আঠারো বার কলিংবেল বাজার পর নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে ইনান।

– সমস্যা কি আলীদ,দরজা খুলছিল না কেন?

– আব…আমার ভয় লাগছে।

– দ্রুত দরজা খোল কিচ্ছু হবে না আমি বলছি।

অলীদ আমতা আমতা করে দরজা খুলতে গেলো।দরজা খুলে দেখে ইনানের বাবা ‘ইব্রাহিম’ আগুনের চুল্লি মুখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

– আস…আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।

ইব্রাহিম এবং ইনানের মা ‘নাসরিন’ সালামের জবাব নিলেন না বরং পাশ কাটিয়ে তারা ঘরে ডুকলেন।ইনানের বাবা ডানে বামে না তাকিয়ে ইনানকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সশব্দে চড় লাগায় তার গালে।

চড়টা এতটাই জোরে লেগেছে ইনানের কান,গাল রক্তিমভাব ছড়িয়ে গেছে।চড়ের শব্দে রুম থেকে ছুটে আসে ইতিকা।মাঝ বয়সী একজোড়া দম্পত্তিকে দেখে তার বুঝতে বাকি নেই এরাই ইনানের বাবা-মা।ইতিকা ভ্রু কুচকে অলীদের দিকে তাকায় অলীদ তাকে ইশারা করছে সালাম করার জন্য।ইতিকা ঝটপট দুজনের পা ছুঁয়ে সালাম করে দাঁড়িয়ে যায়।তার মুখটা হাসি হাসি রেখে বলে,

– আম্মা-আব্বা আপনারা বসুন।আপনাদের বেশ ক্লান্ত লাগছে।

ইতিকার দিকে তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারলেন না ইব্রাহিম।নাসরিন মুখে আচঁল গুজে এবার কেঁদেই দিলেন

– আমার ছেলের মাথায় ব্যামো হয়েছে গো ব্যামো।এই বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়ে করে কি বোঝাতে চাইছে সে?

ইব্রাহিম এবার ইনানের কলার টেনে আরেকটি চড় বসিয়ে দিলো।পর পর দুটো চড়ে এবার অলীদের মুখের ভাব পালটে এসেছে।ইতিকা কি করবে বুঝতে পারছেনা।ইনানের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।ইব্রাহিম ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসে যান।তার প্রেসার বেড়ে গেছে।এসির মাঝেও সে ঘামছে।

ডায়নিং টেবিল থেকে পানির গ্লাস এনে ইব্রাহিমের দিকে বাড়িয়ে দিলো ইতিকা।কিন্তু ইব্রাহিম হাতে তুলে নিলেন না।বরং ইতিকাকে আপাদমস্তক একবার দেখে ইনানের উদ্দেশ্য বলে,

– এই মেয়েকে ছেড়ে দেবে তুমি আর তোমার বিয়ে করার শখ হয়েছে?বেশ আমরা মেয়ে খুঁজে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবো।

– সরি, বিয়ে যখন একবার করেছি তখন ছেড়ে দেওয়ার জন্য করিনি ;সংসার করবো বলেই করেছি।
– এই বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে সংসার করবে তুমি?মাই গুড নেস।

– সে বাচ্চা নয় তোমাদের থেকেও সেয়ানা।

ইনানের কথার উলটা পিঠে আর কথা বললেন না ইব্রাহিম।রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে কিছুক্ষণ পর বলেন,

– কার অনুমতিতে বিয়ে করেছো তুমি?কে দিয়েছে বিয়ে করার অনুমতি।

– আমি মামুকে বলেই বিয়ে করেছি।আপনাদের আপত্তি থাকলে আমার বাসা থেকে চলে যান।

ইনানের কথায় স্পষ্ট রাগ ।ছেলের এমন অপমান সূচক ব্যবহারে চমকে যায় ইব্রাহিম এবং নাসরিন।নিশ্চুপ দু’চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে নাসরিন।তখনি ইনানের বুকে কেউ ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।টাল সামলাতে না পেরে ইনান ছিটকে দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খায়।ইতিকা কোমড়ে হাত গুজে রাগি সুরে তাকিয়ে আছে ইনানের দিকে।

– খবরদার বলে দিচ্ছি বাবা মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন না।দাঁত থাকতে আপনি দাঁতের মর্ম বুঝতে পারছেন না।

ইতিকার শাসানো কথায় উপস্থিত সবাই নিশ্চুপ অবাক।ইনান কিছু বলার জন্য এগিয়ে আসলে আবারো ইনানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ইতিকা।

– আম্মা-আব্বাকে সরি বলুন।আমার মতো যদি এতিম হতেন তবে বুঝতে পারতেন দুনিয়া কোন নিয়মে চলে এখন তো বাবা মায়ের হোটেলে চলে তেল মাখাচ্ছেন শরীরে।

ইনান কি বলবে বুঝতে পারছেনা।তবে ইব্রাহিম এবং নাসরিন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।ইনান নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আদেশ সুরে বলে,

– রুমে যাও ইতিকা।
– যাবো না।
– যেতে বলেছি আমি।
– তো?

ইতিকার আচরণে রাগ সামলানো দায় হয়ে পড়েছে ইনানের।তাই তাকে টেনে হিচড়ে রুমে বন্দি করে দেয়।আজকের পরিস্থিতিতে তাজ্জব বনে গেছেন ইনানের বাবা মা দুজনেই।তাই দু’বাক্য না করে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

__
গায়ের শার্টটা এক টানে ছিড়ে ফেলে ইনান শরীর জুড়ে ভয়ংকর রাগের সঞ্চার হয়েছে।কাকে রেখে কাকে মারবে সে বুঝতে পারছেনা।ইচ্ছে করছে ইতিকাকে দু’চড়ে অচেতন করে দিতে।অলীদ তার দিকে তাকিয়ে আছে চঞ্চল দৃষ্টিতে।

– অলীদ সিগারেট দে।
– এ..এখন?
– দিতে বলেছি দিবি ডোন্ট টক।

অলীদ সিগারেটটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে।সিগারেট ছুঁয়ে দেওয়ার আগেই ফোনের স্কিনে তার মামুর নাম্বার দেখে ভ্রু কুচকে গেলো।বিনা বাক্যে ফোন রিসিভ করে জানতে পারে তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছেন।

.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশটার দিকে বিষন্নতার চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে ইতিকা।নিস্তব্ধত মূহুর্তে হুট করেই সে অনুভব করে তার উন্মুক্ত পেটে কারো নখের আঘাত বেশ তীব্র ভাবে লাগছে।ধীরে ধীরে নখ দেবে যাচ্ছে তার মাংসপিন্ডে।ইতিকা স্থির থাকলো না তড়িৎ গতিতে পেছনে ঘুরে তাকাতেই তার মুখটা কেউ হাতের তালুতে চেপে ধরে।

– খবরদার চিৎকার করবে না ইতিবউ।

ইনানের আদেশ বাক্য ইতিকা মান্য করলো না বরং ছুটাছুটি দ্বিগুণ বাড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।তীব্র ব্যাথায় পেটের অংশটা যেন অবশ হয়ে আসছে তার।শ্বাস নেওয়া ধীরে ধীরে কমে আসতেই ইনান একটানে তাকে বক্ষঃস্থল ঝাপটে ধরে।

– কেমন দিলাম?একটু ছোঁয়ায় কুপকাত।আমার সাথে লাগতে এসো না ইতিবউ, পরিণাম খুব ভয়ংকর হবে।

– আপনার ছোঁয়া বড্ড বাজে,বিশ্রী,একদম জঘন্য।
– তবে কি ওয়াসিমের ছোঁয়া সুমিষ্ট ছিল ইতিবউ?

ইনানের প্রশ্নে বিষ্ফরিত নয়নে তাকায় ইতিকা।বুকের ভেতর ধরাস ধরাস শব্দ আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।শ্বাস উঠা নামার ছন্দটা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।ইনানের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে প্রশ্ন ছোড়ার আগেই কানে আসে ইনানের আদেশ বাক্য।

– কোন কথা নয়।মুখটা কন্ট্রোল করো।মামু আসছে তোমার দুরুক্তি কথা বার্তা কিঞ্চিৎ পরিমানে তার কানে পৌঁছালেও বিপদ তোমার জীবনে ঘনিয়ে আসবে।তাই বার বার সাবধান করছি নতুন বউয়ের মতো ব্যবহার করো।লজ্জায় নুইয়ে থাকো সাহসিকতার পরিচয় আমি তোমার কাছ থেকে আপদত চাইছি না।দ্রুত শাড়ি ঠিক করে বাইরে এসো।

ইতিকা তাজ্জব বনে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইনানের দিকে। ওয়াসিম’কে কি করে চেনে এই লোকটা?আর জানেই বা কি ভাবে ওয়াসিমের সাথে ইতিকার সম্পর্ক আছে?
.
ইনানের মামা বাহরুল ইসলাম বেশ কিছুক্ষণ পরেই ফ্লাটে উপস্থিত হয়।তিনি ইতিকার আচরণে ভালো ভাবেই বুঝে নিয়েছেন মেয়েটি বিয়েতে এখনো রাজি নয়।ইতিকার ত্যাড়ামো স্বভাবটা বেশ ভালো ভাবেই লক্ষ্য করেছেন তিনি।লেখনীতে পলি আনান। এদিকে বাহরুল ইসলামের সামনে ইতিকার এমন দুরক্তি ব্যবহারে লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয় ইনান।ইতিকার হাতে উপহার হিসেবে ভারী গহনার বাক্সটা হাতে তুলে দিতেই তা গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানায় সে।

এতে বেশ অপ্রতিভ অবস্থায় পড়ে ইনান এবং বাহরুল ইসলাম।যাওয়ার আগে ইনানের মামু তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– মেয়েটা সুবিধার নয় ইনান।সাবধানে থাকিস গ্রামের মেয়ে তোকে মারতেও দু-বার ভাববে না।আজকের ব্যবহারটা তার কাছে আশা করিনি।

– তুমি কিছু মনে নিও জা মামু সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি সব ঠিকঠাক ভাবে সামলে নেবো।

– হুম।
.

গয়নার বাক্স গুলো বিছানায় ছুড়ে ফেলে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে কাদঁছে ইতিকা।ইনানের মুখে তার প্রেমিক ওয়াসিমের কথা শুনে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তার।দুঃখের জীবনে তার একমাত্র সঙ্গী ওয়াসিম বেশ কয়েকবছর থেকেই তাকে চেনে জানে তবে প্রেমিক হিসেবে সম্পর্কটা মাত্র সাড়ে সাত মাসের।এই সাতমাসে যেন ইতিকার জীবনে নেমে এসেছে স্বর্গীয় সুখ।সেই সুখের ভাটা হয়ে তার জীবনে নতুন করে আগমন ঘটলো “ইফতিহার ইনান” নামক ব্যাক্তিটির।

সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত ইনান।ইতিকাকে শায়েস্তা করার কোন কলাকৌশল খুঁজে পাচ্ছে না সে।তার অবস্থা বুঝতে পেরে অলীদ ক্ষীণ স্বরে বলে,

– ইতিকাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করিস না দোস্ত।ছোট মেয়ে হয়তো এইভাবে বিয়েটা মেনে নিতে পারছেন না।

– ছোট মাই ফুট!কিসের ছোট মেয়ে?এই টুকুনি মেয়ে সাত মাস ধরে প্রেম লীলায় জড়িত আর তোর কাছে তাকে ছোট লাগছে?সে বয়সে ছোট বুদ্ধিতে নয়।

ইনানের গমগমে কথায় বাকরুদ্ধ অলীদ।সোফায় বসে দু’হাত দিয়ে মুখ ঠেকে কিছুক্ষণ মেঝেতে তাকিয়ে রইলো।তার অবস্থা যে এখন শকে আছে তা বুঝতে পেরে বাঁকা হাসে ইনান।অলীদ স্থির কন্ঠে ইনানের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

– তুই জানিস সে প্রেম করে তবুও মেয়েটাকে বিয়ে করলি কেন?

– কার সাথে প্রেম করছে আগে সেটা তো শুনবি।

অলীদ বা’ভ্রুটা কুচকে বলে,

– কার সাথে?

– আমাদের পরিচিত মুখ “ওয়াসিম হাসনাত” তার সঙ্গে।

ইনান হাসতে থাকে।কিন্তু মূহুর্তেই মাথায় রাগের সঞ্চার হয়েছে অলীদের।

– হোয়াট?তুই পাগল হয়ে গেছিস?নাকি ওয়াসিম পাগল হয়েছে?ক্লাস নাইনে পড়ুয়া একটি মেয়ের সাথে প্রেমে মশগুল ওয়াসিম কুত্তা*টা আর তুই ডাইরেক জোরজবরদস্তির করে বিয়ে করেনিলি।

– এতকথা তোকে বুঝতে হবে না আগে মেয়েটাকে শায়েস্তা করে আসি।

– কি করবি তুই?খবরদার বাড়াবাড়ি করবি না বলে
দিলাম।

– অলীদ তুই ভালো করেই জানিস আমি অবাধ্য ছেলে নিজের মর্জি মত চলাফেরা করি সেখানে তুই বারন করলেও আমি তোর কথা শুনবো না।সো গুড বায়।

– ইনান….

ইনান একছুটে নিজের বেডরুমে প্রবেশ করে, সেখানে স্থির হয়ে মেঝেতে বসে কাদঁছে ইতিকা।ঢেউখেলানো চুলগুলো একপাশটায় দলাপাকিয়ে আছে যার ফলে তার উন্মুক্ত পিঠ সহজে ইনানের চোখে পড়ে আর তা দেখে স্থির চিত্তে তাকিয়ে রইলো সে।হুট করেই অবাধ্য মন তাকে জানান দিচ্ছে এই মেয়েটি তার বিবাহিত স্ত্রী,তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার অধীকার ইনানের আছে।আর সেই অধীকার প্রশ্রয় দিয়ে ইতিকার কাছে এগিয়ে যায় সে।তখনি তার কানে আসে তার ইতিবউ ফ্যাচফ্যাচ করে কাদঁছে।

ইনান রাগ জেদ ভুলে ইতিকার সামনে হাটু মুড়ে বসে,
– কাদঁছো কেন?

ইনানের প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায় সে।

– আপনি এটা কেন করলেন?আমি ওয়াসিমকে ভালোবাসি অথচ আপনি সবটা জেনে আমাকে বিয়ে করেছেন?ওয়াসিমের চেয়ে আমাকে কেউ ভালোবাসতেও পারবে না আর কেউ ভালো রাখতেও পারবেনা।

নিভন্ত রাগটা চড়া দিয়ে উঠেছে ইনানের মাথায়।কোন স্বামী কখনোই চাইবে না তার স্ত্রী অন্য পুরুষের জন্য তার সামনে চোখের জল বিসর্জন দেবে।

– আমি তোমার বিবাহিত স্বামী অথচ আমার সামনে তুমি অন্য পুরুষের জন্য চোখের জল ফেলছো?আর এদিকে আমায় ছুড়ে দিচ্ছো অবহেলা।

– আমি তো এই বিয়ে মানি না সরে যান আমার সামনে থেকে।

ইতিকা ইনানের বুকে ধাক্কা দিতেই সে কিছুটা দূরে পিছিয়ে যায়।তার আচরণে ইনানের মাঝে অপমান বোধের সৃষ্টি হয়।ইনান একটানে দাঁড় করায় ইতিকাকে।

– আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

– আমার সাথে সংসার করার পূর্ব শর্ত হলো তোমার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।

– আমি আপনার সঙ্গে সংসার করতে চাই না।

ইনান ইতিকার হাত টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।নব ঘুরাতেই ঝরণার পানি ভিজিয়ে দিতে থাকে তাকে।বেশ কিছুক্ষণ পর ইনান ইতিকাকে বাইরে এনে ফ্লোরে ছুড়ে মারে।

– আজ আমি বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত পুরো ঘর অন্ধকার থাকবে আর জানলা খুলেও লাভ নেই এত উপরে তোমার ল্যাম্পপোস্টের আলো পৌছাবে না।

বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায় ইনান।এদিকে নিশ্চুপ চোখ বন্ধ করে রাগ সামলাতে ব্যস্ত ইতিকা।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here