আগুন ঝরার দিনে পর্ব -০৮

#আগুন_ঝরার_দিনে

#পর্ব_৮

আশফাক একটু আগে সিগারেট কিনতে বাইরে গেল। আশফাক বাইরে যেতেই দীপার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল। রাত দশটা বাজে। এত রাতে একজন স্বাভাবিক মানুষের সিগারেট কিনতে যাবার কথা নয়। তাছাড়া আশফাক তো আর কলেজ, ভার্সিটি পড়ুয়া কোনো ছাত্র নয় যে যখন ইচ্ছে হলো তখন কোনো অজুহাত দেখিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল!

দীপা অস্থির ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। তাদের শোবার ঘরের লাগোয়া বারান্দা থেকে বাড়ির সামনের রাস্তা অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। কথাটা মনে হতেই দীপা বারান্দায় চলে এলো। রাস্তার যতটুকু অংশ দীপার চোখে পড়লো সেখানে কোথাও আশফাককে দেখা গেল না। দীপা বারান্দায় একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। আশফাক কি আদৌ সিগারেট কিনতে গেছে নাকি অন্য কোথাও গেছে এটা ঠিকঠাক না জানা পর্যন্ত তার মনে শান্তি মিলবে না। এদিকে দীপাকে দেখতে না পেয়ে ছেলেটা তারস্বরে কেঁদে চলেছে। দীপার ইচ্ছে করছে ছেলেটার গালে কষে একটা চড় মারতে। কিন্তু সে নিরুপায়। নিতান্ত বাধ্য হয়ে সে শোবার ঘরে চলে এলো। ছেলেটাকে খানিকটা আদর করে ঠান্ডা করতে করতেই মিনিট দশেক পেরিয়ে গেল। দীপা আবার তড়িঘড়ি করে বারান্দায় এলো। এবার আর তার পরিশ্রম বৃথা গেল না। সে আশফাককে দেখতে পেল। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আশফাক ভীষণ মনোযোগ দিয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। আশফাক যতক্ষন ফোনে কথা বলল দীপা ঠিক ততক্ষন আশফাকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখের পলক পর্যন্ত পড়ল না। দীপা অবাক হয়ে দেখল, ফোনটা রাখার পরেও আশফাকের মধ্যে বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরালো।

বারান্দায় প্রচন্ড গরম। এর মধ্যেই দীপা ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেছে। নিরুপায় হয়ে সে ঘরে এসে ফ্যানের নীচে দাঁড়াল। দীপা ঘরে এসে দাঁড়ানোর মিনিট পাঁচেক পর আশফাকও ফিরে এলো। দীপা ভেবেছিল, সিগারেট কেনার অজুহাত দেখিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া নিয়ে আশফাককে আপাতত সে কিছু বলবে না। এই ব্যাপারগুলোতে আশফাক ভীষণ বিরক্ত হয়। অযথা সব বিষয় নিয়ে নজরদারী করা তার পছন্দ নয়। এর আগেও এসব নিয়ে তাদের মাঝে অসংখ্য বার ঝগড়া হয়েছে। তবুও দীপা নিজেকে সামলাতে পারলো না। আশফাক ঘরে ঢুকতেই সে আশফাকের দিকে প্রায় তেড়ে এলো। ইতিমধ্যে রাগে তার ফর্সা মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেছে। তীব্র ক্রোধে তার নাকের পাটা দুটো ফুলছে।

আশফাক অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে দীপা? তোমার চোখ মুখের অবস্থা এমন কেন?

দীপা যেন আশফাকের কোনো কথা শুনতে পেল না। সে রাগে লাল হয়ে বলল, এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

– কোথায় আর যাবো। তোমাকে তো বলেই গেলাম নীচে সিগারেট কিনতে যাচ্ছি।

– সিগারেট কিনতে এত সময় লাগে তোমার?

– কী আশ্চর্য দীপা! এমন করছো কেন? আমার প্রতি মিনিটের হিসেব তোমাকে দিতে হবে নাকি?

– তুমি না বললেও আমি জানিনা ভেবেছ তুমি নীচে কেন গিয়েছিলে?

– কেন গিয়েছিলাম?

– তুমি নীচে গিয়েছিলে তোমার গোপন প্রেমিকার সাথে ফোনে কথা বলতে। আমাকে এত বোকা ভেব না আশফাক। আমি সব জানি।

দীপাকে কড়া একটা জবাব দিতে যেয়ে আশফাক থেমে গেল। একটু ভেবে নেয়ার পর তার মনে হলো, কড়া কোনো জবাব দেয়ার পর দীপার কাছ থেকে এত সহজে পার পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আজ দীপা যা বলছে তা ভুল কিছু নয়। জীবনে এই প্রথম বারের মত আশফাক দীপার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে কথা বলল। নরম গলায় বলল, নীচে দাঁড়িয়ে আমি ফোনে কথা বলেছি ঠিকই তবে আমার কোনো গোপন প্রেমিকার সাথে নয়। আমার একজন কলিগের সাথে। বিশ্বাস করো দীপা, তুমি অযথা আমাকে সন্দেহ করছ।

দীপা একদৃষ্টিতে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে তার চোখ দিয়ে আশফাকের মনের ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করছে।

দীপাকে স্বাভাবিক করার জন্য আশফাক বলল, খাবে না দীপা? আমার খুব খিদে পেয়েছে। চলো খেয়ে নিই।

দীপা আর কথা বাড়ালো না। শান্ত মুখে টেবিলে খাবার গোছানো শুরু করল। দীপাকে স্বাভাবিক দেখে আশফাক একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

সেই রাতে ছেলের জায়গা আবারো বিছানার একপাশে হলো। আশফাক দীপার মনোকামনা বুঝতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। ঠোঁটের কোনে একটা হাসি এঁকে সে দীপার দিকে এগুলো। এই প্রথমবারের মত তার মনে হলো, মাঝে মাঝে নিজেকে আড়াল করার জন্য একটি লুকোনোর জায়গা তার খুব প্রয়োজন, বড় বেশী প্রয়োজন!

………………..

আশফাক স্যারের মুখের উপর ফোনটা রেখে দেয়ার পর রুহী অনেকক্ষন কাঁদলো। এই কান্নার সঠিক কারনটা সে জানে না। কান্নার উৎস সম্পর্কেও তার কোনো ধারনা নেই। আশফাক স্যার ফোনে তাকে যে কথাগুলো বললেন, তাতে বিন্দুমাত্র ভুল কিছু ছিল না। বরং তিনি খুব সহজভাবে সঠিক কথাগুলো তাকে বলেছেন। তবুও রুহীর কষ্টে বুক ভেঙে যাচ্ছে। নিজেকে সামলানোর রুহী প্রাণপন চেষ্টা করল। যে সম্পর্কের কোনো পরিণতি নেই শুধু শুধু সেই সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না। রুহীর কান্নার মাঝে সজল আবার ফোন করল। রুহী এবার সজলের ফোনটা ধরলো। সজলের সাথে দুই তিন মিনিট স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলল। সজল বোধহয় তাকে কিছু বলার জন্য ফোন করেছিল। তবে রুহী সেগুলোর ধার দিয়ে গেল না। নিতান্তই সাধারন কিছু কথা বলে রুহী ফোনটা রেখে দিল। সজলও রুহীর মন খারাপ বুঝতে পেরে তাকে আর ঘাটালো না। ফোনটা রেখে দেয়ার পরেও অদ্ভুৎ ভাবে আজ তাকে মোবাইলটা টানছে। রুহী মোবাইলের ডাটা অন করতেই দেখল আশফাক স্যার অনলাইনে রয়েছেন। তার নামের পাশে টিমটিম করে ছোট্ট একটা সবুজ আলো জ্বলছে। রুহী অনেকক্ষন সেই সবুজ আলোর দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পর যেন রুহী নয় রুহীকে দিয়ে কোনো অদৃশ্য শক্তি লেখালো, কী করছেন?

অনেকক্ষন কোনো উত্তর নেই। রুহী উত্তরের আশায় মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। দুই এক মিনিট যেতেই রুহীর চোখ ভরে জল এলো। আশফাক স্যার তার মেসেজটা সিন করেছেন ঠিকই অথচ এখনো কোনো উত্তর দেননি। রুহীর মনে হলো, তিনি বোধহয় ইচ্ছে করে তার মেসেজের উত্তর দিচ্ছেন না। তিনি বোধহয় রুহীকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন। রুহী তীব্র অভিমানে একটু আগে আশফাক স্যারকে লেখা তার মেসেজটা ডিলিট করতে যাবে ঠিক তখন উত্তর এলো, আমাদের জীবনটা এমন কেন রুহী? যা করতে ইচ্ছে হয় না তাই আমাদের বার বার করতে হয়…যা নিয়ে আমাদের ভাবতে ইচ্ছে হয় না তা নিয়েই আমাদের ভাবতে হয়…

রুহী একটু ভেবে নিয়ে লিখলো, কেন? তা কেন? আমরা যা করি তার উপর অনেক সময় আমাদের নিয়ন্ত্রন না থাকলেও আমাদের ভাবনার উপর তো কারো নিয়ন্ত্রন নেই, তাই না? ভাবুন না আপনি, যা ইচ্ছে করে তাই নিয়ে ভাবুন, যাকে নিয়ে ইচ্ছে করে তাকে নিয়ে ভাবুন, কে আপনাকে বারণ করেছে?

আশফাক লিখল, বেশ, তবে তাই হোক…আমি ভাবছি রুহী…আমার যাকে সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে আমি তাকে নিয়ে ভাবছি… আমি তোমাকে নিয়ে ভাবছি রুহী…তোমাকে নিয়ে ভাবছি….

“চলবে”

“আমার লেখা পড়তে ভালো লাগলে ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আমার থ্রিলার উপন্যাস “ত্ন” বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি, বুকমার্ক, প্রজ্ঞা, ধী ছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। ধন্যবাদ সবাইকে। “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here