#আগুন_ঝরার_দিনে
#পর্ব_৯
দিনগুলো যেন সোনালি ডানায় ভর করে চলছিল। জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত কিংবা সময় আসে যখন ন্যায় কিংবা অন্যায় অথবা ভালো কিংবা মন্দ এর বাছ বিচার করার চেয়ে নিজের জীবনের চাওয়াগুলো বেশী মুখ্য হয়ে ওঠে। রুহী এবং আশফাকের জীবনে এমনই এক অধ্যায় চলছিল। দুজনেই ভুলে গিয়েছিল, যে মিথ্যে মরীচিকার পেছনে তারা ছুটে চলেছে তা শুধু দুজনের জীবনে কালো অন্ধকার নামিয়ে আসবে, মৃদু আলোর সোনালি রেখা কখনোয় দুজনের সর্ম্পককে ছুঁয়ে যাবে না। তবুও দুজনেই যেন সব কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করছিল। দুজনেই প্রাণপণে অপেক্ষা করতে শুরু করেছিল ক্যাম্পাস ছুটি হবার মুহূর্তটুকুর, দুজনের দেখা হবার মুহূর্তটুকুর। অদ্ভুত ভাবে তাদের সম্পর্কটুকু সবার কাছে লুকোনো ছিল। দীপা কিংবা সজল নিজেদের সম্পর্ক গুলোর মাঝে কোনো অস্বাভাবিকতা যে টের পাচ্ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে বলার মত উপযুক্ত কোনো প্রমাণ কিংবা কারন তারা খুঁজে পাচ্ছিল না। সজল ছাড়াও আরেকজন মানুষ ছিল যে রুহীর মধ্যে অস্বাভাবিকতা টের পাচ্ছিল আর সে মানুষটা হলো সুমি। রুহীর সাথে সুমির বন্ধুত্ব সেই ছোট্ট বেলার। এক যুগেরও বেশী চেনা এই মানুষটির হঠাৎ অচেনা হওয়াটা সুমিকে ঠিকই নাড়া দিল। সময় সুযোগ মত সে একদিন রুহীকে ধরল।
চোখে একগাদা সন্দেহ নিয়ে সে রুহীকে জিজ্ঞেস করল, তোর কী হয়েছে রে ?
রুহী ঠোঁট উল্টে বলল, কী হবে আমার?
– ক‘দিন থেকে খেয়াল করছি তুই যেন বেশ অন্যমনস্ক। কোনো কাজে মন নেই। ক্লাস গুলোও ঠিক মত করিস না। সব সময় উড়ুউড়ু ভাব।
– কী যা তা বলছিস। ক্লাস ঠিক মত করি না কখন? প্রতিদিনই তো ক্লাস করছি।
– তা করছিস হয়ত। তবে তোর মন কিন্তু অন্য জায়গায়।
– তাই নাকি? তো কোথায় আমার মন?
সুমি ভ্রুঁ নাচিয়ে বলেছিল, আমি খুব ভালো মত জানি রুহী কোথায় তোর মন। আমি তোকে এক যুগেরও বেশী সময় ধরে চিনি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুই নিজেকে যতটুকু চিনিস তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী আমি তোকে চিনি। তাই আমার ভয় করছে রুহী। আমি চাই না তোর কোনো ক্ষতি হোক। কিংবা কোনো কারনে তুই কষ্ট পাস। তাছাড়া আমরা যে সমাজে বাস করি সেই সমাজের কথাও তোর ভাবতে হবে।
রুহী চোখ বড় বড় করে বলেছিল, তুই কী বলছিস সুমি আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না।
– তুই সব বুঝছিস রুহী। কিংবা এখন হয়ত বুঝছিস না, তবে একদিন ঠিকই বুঝবি। এখনো সব কিছু তোর পক্ষে রয়েছে। তবে যখন সবাই জানবে তখন কিছুই আর তোর কন্ট্রোলে থাকবে না। তখন কী হবে একবার ভেবে দেখেছিস?
রুহী অবাক হয়ে সুমির দিকে তাকিয়েছিল।
সুমি রুহীর অবাক হওয়া দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলেছিল, ভয় পাস না রুহী। ওই যে বললাম, আমি তোকে খুব ভালো মত চিনি। তাই ব্যাপারটা এত দ্রুত আমি বুঝতে পেরেছি। এখনো কেউ কিছু জানে না। তবে সব কিছু জানতে খুব বেশী দেরী হবে না। এসব ব্যাপার চাপা থাকে না রুহী। তাই সময় থাকতেই প্লিজ বের হয়ে আয়। তাছাড়া তোর বিয়ের তো বেশী দেরী নেই। আর মাত্র মাসখানেক পর তোর বিয়ে, তাই না?
রুহী মিনমিন করে বলেছিল, হুম।
– তাহলে কেন সব কিছু ধ্বংস করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিস, বল তো? বাবা মার সম্মানের কথাও তো তোর একবার ভেবে দেখা উচিৎ, তাই না? রুহী তুই প্লিজ পাগলামী করিস না। এই সম্পর্ক থেকে তুই বেরিয়ে আয় প্লিজ।
সেদিন বিকেলেই রুহী থমথমে মুখে আশফাকের সামনে দাঁড়িয়েছিল। আশফাক চোখে একটু কৌতুহল ফুটিয়ে বলেছিল, কী হয়েছে? মন খারাপ?
– না মন খারাপ নয়।
– তবে? চাঁদের মত এমন মুখখানায় আঁধারের ছাঁয়া কেন?
রুহী গোমড়া মুখে বলেছিল, আমার মনে হয় আমাদের বিষয়টা সুমি কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছে।
– সুমি কে?
– ও আমার খুব কাছের বান্ধবী। আমরা দুজন ক্লাস ওয়ান থেকে এক সাথে পড়ছি। আজ সুমি আপনার কথা আমার সামনে বলছিল।
আশফাক অবাক হয়ে বলেছিল, আমার কথা?
– ঠিক আপনার কথা নয়। আমাদের দুজনের সম্পর্কের কথা।
– সুমি যেহেতু সরাসরি আমার নাম তোমার সামনে বলেনি তাই আমার ধারনা তুমি অযথা টেনশন করছ। এমন তো হতেই পারে, সে তোমার আর সজলের ব্যাপারে কিছু বলছে। আর তুমি ভাবছ সুমি আমার কথা বলেছে।
– না তা নয়। অযথা টেনশন দেয়ার মানুষ সুমি নয়। আমি একশ ভাগ নিশ্চিত সুমি কিছু জানে। সে আমাকে আজ বারবার সাবধান করলো।
আশফাক চোখে কৌতুক নিয়ে বলল, কী বলে সাবধান করল তোমাকে? বারবার করে বলল, আশফাক স্যার খুব খারাপ মানুষ। ওর কাছ থেকে তুই একশ হাত দূরে থাকবি। উনি তাকে সুযোগ পেলেই কপ করে খেয়ে ফেলবে।
রুহী ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, সব সময় আপনার মজা। আপনি সিরিয়াস কখন হবেন বলুন তো?
আশফাক একটু গম্ভীর হয়ে বলল, কী নিয়ে সিরিয়ার হবো রুহী? তোমার আমার সম্পর্ক নিয়ে? নাকি আমার আর দীপার সম্পর্ক নিয়ে?
রুহী মুখ নামিয়ে বলল, আমার মনে হয় সুমি যা বলেছিল সেটা হয়ত ঠিক।
– কী বলেছিল সুমি?
– আমার এই সর্ম্পক থেকে বের হয়ে আসা উচিৎ।
আশফাক তেতো গলায় বলল, তোমার আর আমার সম্পর্কের ব্যাপারে সে কথা বলার কে? আর তোমার যদি মনে হয় সুমির কথা ঠিক তবে তোমার এই সময় আমার পাশে বসে থাকার কথা নয় রুহী। তোমার এই সময় সজলের পাশে থাকার কথা। তাই না?
রুহী মুখ শক্ত করে বলল, সজলকে আমি বিয়ে করব না। কিছুতেই না।
আশফাক রুহী কে বোঝাতে যেয়ে থেমে গেল। এই মেয়েকে বোঝানোর সাধ্য তার নেই। তাছাড়া কী-ই বা সে বোঝাবে। আগুন নিয়ে খেলতে শুধু রুহী নামেনি, রুহীর সাথে সে নিজেও নেমেছে। যে খেলাটা শুরু হয়েছিল না জানা কিছু প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে সেই খেলাটা আজ প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় সরব হয়েছে। আশফাকের কখনো মনে হচ্ছে, প্রশ্নের উত্তরটা তবে দিয়েই ফেলা যাক কিন্তু পরমুহূর্তেই কয়েকটা মুখ চোখের সামনে বড় বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আশফাক দু এক দণ্ড ভেবে নিয়ে রুহীর হাতের উপর একটা হাত রাখলো।
রুহী অবাক হয়ে আশফাকের দিকে তাকালো। মানুষটা সহজে তার শরীর স্পর্শ করে না। আশফাকের মুখটা এই মুহূর্তে খুব মলিন দেখাচ্ছে। প্রিয় মানুষটির হাত ছোঁয়ার কোমল আনন্দটুকু তার চোখের মাঝে নেই। বরং সেখানে যেন এক রাশ বিষাদ খেলা করছে। রুহী তার হাতটুকু আশফাকের হাতের মধ্যে থেকে সরিয়ে নিলো।
আশফাক রুহীর দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বলল, আমাকে ভুল বোঝা খুব সহজ রুহী। আমার জায়গায় নিজেকে একবার দাঁড় করিয়ে দেখো তখন বুঝবে আমার জায়গাটা কতখানি কঠিন।
একটু ভেবে নিয়ে রুহী নরম গলায় বলল, কে বলেছে আপনার জায়গাটা বোঝা আমার পক্ষে কঠিন? এই যে চেয়ে দেখুন, আমি আপনার পাশেই রয়েছি। যদি সুমির কথাগুলোই মেনে নিতাম তাহলে তো এই মুহূর্তে আপনার পাশে আমি থাকতাম না, তাই না ?
“চলবে”
“আমার লেখা পড়তে ভালো লাগলে ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আমার থ্রিলার উপন্যাস “ত্ন” বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি, বুকমার্ক, প্রজ্ঞা, ধী ছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। ধন্যবাদ সবাইকে। “