#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ২৩
গুনে গুনে ক’বছর পর নিজের দেশে পা ফেলেছেন তা নিজেরও হিসেব নেই আরহান সাহেবের।শিল্পপতি আরহান যার কাছে সাফল্য হলো টাকার সংখ্যা বাড়ানো।তাইতো নিজের স্ত্রীর মৃত্যুতেও দেশে ফিরেছিলেন না তিনি।ফিরলে ব্যবসায় বড্ড ক্ষতি হয়ে যেতো যে তার!
হয়তো দশ থেকে পনেরো বছর পর ফিরেছেন তিনি নিজের মাতৃভূমিতে।যে দেশে বসবাস তার সকল আপন মানুষগুলোর।ফিরেছেন তিনি নিজের প্রিয় মানুষগুলোর কাছে,ফিরেছেন নিজের সন্তানের মায়ার টানে।বহু বছর পর আজ এতোটা প্রশান্তি অনুভব করছেন আরহান সাহেব।নিজের ছেলেকে এক নজর কাছ থেকে দেখার তৃষ্ণা প্রখর হয়ে আছে তার।এয়ারপোর্টে নেমে সবে মাত্র গাড়িতে উঠেছেন তিনি।বারংবার তাকাচ্ছেন নিজের হাত ঘড়ির দিকে।প্রতিটি মুহূর্ত অধীর আগ্রহে নিয়ে অপেক্ষা করে চলছেন তিনি।এই অপেক্ষা সেই মুহূর্তের যখন নিজের সন্তানকে কাছ থেকে দেখতে পারবেন তিনি।পারবেন একটুখানি জড়িয়ে ধরতে।
!!
ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানোর মতো প্রথম অভিজ্ঞতা টা মুগ্ধ করলো নাফিয়াকে।বাচ্চা তিনজনই ভীষণ দুষ্টু কিন্তু সেই সাথে ভদ্র ও।পড়ার মাঝে দুষ্টুমি,হাসাহাসি কোনোটিই বাদ যাচ্ছিলো না তবে নাফিয়ার চোখ গরমেই চুপসে গিয়ে পড়ায় মনোযোগী হচ্ছিল তারা।বাচ্চাদের মায়েদের সাথেও কথা হয়েছে নাফিয়ার।সবাই ভীষণ মিষ্টভাষী এবং মিশুক।এতো কম বয়সে স্টুডেন্ট পড়িয়ে নিজের হাতখরচ চালানোর উদ্যোগে অনেকেই বাহবা দিলো তাকে।মোটমাট,প্রথম দিন ভালোই কাটলো নাফিয়ার।খুশি মনে পড়িয়ে রিয়াদের গাড়িতে সবে এসে বসলো সে।ঠোঁটে হাসি লেগে আছে তার।
নাফিয়ার ঠোঁটের হাসি দেখে রিয়াদও ঠোঁটে আলতো হাসি টেনে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-খুশি খুশি মনে হচ্ছে!এতো খুশির কারণ কি ভাবী?
রিয়াদের মুখে ‘ভাবী’ ডাক শুনতেই চমকে তার দিকে তাকায় নাফিয়া।রিয়াদও ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।মুখ ফসকে ভুল মানুষের সামনে ভুল শব্দটি উচ্চারণ করে বসেছে সে।নিজের ভুল শুধরানোর উদ্দেশ্যে সে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে ওঠে,
-এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
-আপনি ‘ভাবী’ ডেকেছেন আমাকে?
-পাগল নাকি?আমি বলেছি যে, “তোমার এতো খুশির কারণ কি ভাবতেছি”।
এবার স্বাভাবিক হয় নাফিয়া।ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে সে বলে ওঠে,
-প্রথম দিন টা ভালোই কেটেছে তাই খুশি।
নাফিয়ার উত্তরে রিয়াদও আলতো হাসে।মনে মনে যেনো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে সে।
এদিকে বুকের মাঝে অদ্ভুত ভালো লাগা অনুভব করেছিলো নাফিয়া।এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে আফিমের বউ বলে মনে হয়েছিলো তার।অদ্ভুত সুন্দর এক অনুভূতি ছুঁয়ে দিয়েছিলো তার হৃদয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই রিয়াদের উত্তর সব ভালোলাগার ইতি টেনে দিলো।
!!
কাজে মন বসছে না আফিমের।কেমন অস্থির অস্থির লাগছে তার।বুকের বাম পাশ টায় কেমন যেনো শূন্য শূন্য অনুভব করছে সে।মাত্র ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট হলো মেয়ে টা তার দৃষ্টি সম্মুখে নেই।অথচ সে অনুভব করছে না জানি কতটা সময় পাড় হয়ে গিয়েছে!অনুভূতি এমন যেনো ১ বর্ষ নিজের প্রেয়সীহীনা পাড় করে দিয়েছে সে।মেয়েটার জন্য চিন্তেও কম হচ্ছে না আফিমের।রিয়াদের উপর পূর্ণ ভরসা আছে তার তবুও অবাধ্য মন শান্ত থাকছে না।এই ২ ঘন্টা ৩০ মিনিটে গুনে গুনে ১০-১২ বার রিয়াদকে কল দিয়ে খবরা-খবর জেনে নিয়েছে সে।তার মতো গম্ভীর পুরুষকে এমন বাচ্চামিতে মানায় না।বিষয়টা সমন্ধে অবগত আফিম।নিজেকে নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ চেষ্টা করে চলছে সে।তবুও বেসামাল সে।নিজের মনের মাঝে চলা অশান্তি সহ্য করার ক্ষমতা হারাতেই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ছেলেটা।উদ্দেশ্য নিজেই গিয়ে নিয়ে আসবে তার হৃদহরণী,তার মায়াবীনি কন্যাকে।নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে নিজের ক্যাবিনের দরজার দিকে অগ্রসর হয় আফিম।সে কয়েক কদম এগোতেই হুট করে ক্যাবিনে প্রবেশ করে এক নারী।ক্যাবিনে প্রবেশকৃত এই মানবীর দিকে আফিমের চোখ পড়তেই থেমে যায় সে।তার অস্থির নেত্র যুগল স্থির হয় সেই মানবীর দিকে।নিজের প্রেয়শীর দেখা মিলতেই তার হৃদয় জুড়ে ছেয়ে যায় প্রশান্তির ছোঁয়া।সে স্থির দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রয় তার প্রেয়সীর দিকে।
ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই নাফিয়ার চোখ যায় আফিমের দিকে।ছেলেটার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু ব্রু কুঁচকায় সে।
“একটু সময়ে কি হলো ছেলেটার?দেখতে এমন অস্বাভাবিক লাগছে কেন?”
প্রশ্নদ্বয় মনে উদয় হতেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় নাফিয়া আফিমের দিকে।ছেলেটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,
-ঠিক আছেন,আফিম?
প্রশ্ন খানা করতেই বিনা বাক্যে এক হেঁচকা টানে নাফিয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয় আফিম।অশান্ত হৃদয় যেনো খুঁজে পেয়েছে তার প্রশান্তির মহাসাগরের ছোঁয়া।আফিম শক্তপোক্তভাবে জড়িয়ে ধরে নাফিয়াকে।গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
-কাল থেকে তুমি আমার সাথে যাবা আর আমিই সাথে করে নিয়ে আসবো তোমায়।
আফিমের কথাগুলো কানে আসতেই মুগ্ধতার হাসি ফুটলো নাফিয়ার ঠোঁটে।সে জানে না আফিমের এসব অদ্ভুত আচরণের পেছনের কারণ কি!তবে সে প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করে এই মানুষটা সীমার বাইরে ভালোবাসে তাকে।ফিজিক্সে বলা হয়,”সীমা বা ক্ষেত্রের বাইরে মানেই অসীম”।ঠিক তেমনই আফিমের অনুভূতি তার জন্য সীমার অতিরিক্ত অর্থাৎ অসীম।এই সীমাহীন ভালোবাসা সংজ্ঞায়িত করার সামর্থ্য নাফিয়ার নেই।
!!
“স্যার,আরহার স্যার দেশে ফিরেছেন”
ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করছিলো আফিম।এমন সময় রিয়াদের উচ্চারিত বাক্যটি কানে আসতেই ল্যাপটপ হতে চোখ উঠায় সে।শান্ত দৃষ্টিতে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কি বললে?বুঝিনি।
-আরহার স্যার দেশে ফিরেছেন।তিনি একটু আগে আমাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন আপনি কোথায় আছেন।মানে বাসায় নাকি অফিসে।আমি বলেছি আপনি অফিসে আছেন।শুনে তিনি বলেছেন তিনি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা অফিসেই আসবেন।
রিয়াদের কথাগুলো আফিমের কান অব্দি পৌঁছালেও তাতে তার মস্তিষ্ক সাড়া দিলো না ঠিক মতো।কথা গুলো শুধু নিরবে শুনলো আফিম।তার নিরব চাহনি স্থির করে রাখলো রিয়াদের দিকে।একটু সময় নিয়ে শান্ত কন্ঠেই সে বলে উঠলো,
-ভুল শুনেছো হয়তো,রিয়াদ।তিনি কেনো দেশে ফিরবেন?
রিয়াদ জিহবা দ্বারা নিজের ওষ্ঠ মৃদু ভিজিয়ে নিলো।উত্তরে কি বলবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
আফিমের মনের হাল বুঝতে বিন্দু মাত্র কষ্ট হচ্ছে না রিয়াদের।সে জানে তার বলা কথাগুলো শুনবার পর আফিমের চোখ যতটা শান্ত ছেলেটার মনের ভেতরে উৎপন্ন হওয়া ঝড় ততটাই প্রবল।রিয়াদ জানে আফিম ভেতরে ভেতরে ঠিক নেই।তাই কথা খানা বলতে গিয়েও গলা শুকিয়ে আসছিলো তার।আর এখন কণ্ঠনালী হতে শব্দ উৎপন্ন হওয়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।এতো বছর পর পিতা-পুত্রের মিলন হয়তো এক আবেগঘন মুহুর্ত হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু রিয়াদ জানে আফিমের ভেতরে উৎপন্ন হওয়া ঝড় তার পিতাকে দেখার সাথে সাথে আরো প্রবল হবে।ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইবে।ধ্বংস হবে এক মমতার সম্পর্ক।
আর ভাবতে পারলো না রিয়াদ।মনে সাহস সঞ্চয় করে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-ঠিক শুনেছি,স্যার।আরহান স্যার এসেছেন দেশে এবং হয়তো ৩০ মিনিটের মধ্যে তিনি অফিসে পৌঁছে যাবেন।
রিয়াদের কথাগুলো কর্ণ কুহোর অব্দি এসে পৌঁছাতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আফিমের।হাতদ্বয় মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুজে নিলো সে।কঠিন কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলো,
-কেনো এসেছেন তিনি?যে নিজের স্ত্রীর মৃত্যুতে আসতে পারেনি সে কেনো এখন এসেছে?
আফিমের প্রশ্নের উত্তর নেই রিয়াদের কাছে।সে মাথা নিচু করে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নিলো।
এদিকে নাফিয়া চুপচাপ তাকিয়ে আছে আফিম ও রিয়াদের দিকে।কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার।তবে ধীরে ধীরে আফিমের চোখের লালাভ বর্ণ ধারণ করাটা মনে ভয় সৃষ্টি করছে নাফিয়ার।আফিমের সাথে পরিচয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত শুধু একবারই আফিমকে ভীষণ রাগতে দেখেছিলো সে।আজকেও আফিমের ক্রোধ যেনো মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।আফিমের চোখজোড়াতে যেনো অগ্নি ধাও ধাও করে জ্বলছে।এ ক্রোধ বড্ড ধ্বংসাত্মক ঠেকছে নাফিয়ার কাছে।
রিয়াদের নিরবতা ক্রোধ বাড়ায় আফিমের।চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজের মায়ের মৃত চেহারা খানা।সহ্যের সীমা অতিক্রম হওয়ায় সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো আফিম।কোনো বাক্য ব্যয় করলো না আর না কোনো টু শব্দ করলো।নিজের মনের মাঝে চলা তুফানের তীব্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো নিজের সামনে থাকা টেবিল খানা উল্টিয়ে ফেলে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে।হটাৎ আফিমের কান্ডে ভয় পেয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো রিয়াদ,চিৎকার করে উঠলো নাফিয়া।নাফিয়ার চিৎকারে তার দিকে তাকালো আফিম।ছেলেটার রক্ত বর্ণ চোখ দেখে ভয় বাড়লো নাফিয়ার।এক কদম পিছিয়ে গেলো সে।
টেবিলের কাঁচ ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো কক্ষজুড়ে।নাফিয়ার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই সেই কাঁচের উপর পা ফেলে দ্রুত পদে মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসে আফিম।শক্ত করে মেয়েটার হাতের কব্জি চেপে ধরে সে।অতঃপর কিছু না বলেই নাফিয়াকে নিয়ে নিজের ক্যাবিন হতে বেরিয়ে যায় ছেলেটা।
চলবে।
[