#আবর্তন
#তাজরীন_খন্দকার
#পর্বঃ০৬
যার সাথে ফ্রী হিসেবে থাকতে পারে এক দুইটা বাচ্চা!
বলেই অরুণ হেসে উঠলো।আর চন্দ্রা মুখে হাত দিয়ে দু পা পিছিয়ে গেলো। না না এসব কি বলছে অরুণ! এটা হতে পারেনা, কখনোই হতে পারেনা। অরুণকে নিয়ে তার মধ্যে ভালো একটা ধারণার উদয় হয়েছিল। কীভাবে সেটা মিথ্যা হতে পারে?
আর অরুণ নিজের প্রতিশোধের জন্য এতো নির্দয় চিন্তা ভাবনা কিভাবে করতে পারে?
চন্দ্রা কতো ভালো ভেবেছিল অরুণকে। এদিকে গোপনে তার মধ্যেও কিনা এতো নিচ পরিকল্পনা!
তখনি তার মনে হলো রনি, হ্যাঁ রনি! রনিকে সব জানাতে হবে। চন্দ্রার বিশ্বাস রনি কিছু একটা করবেই। রনিকে তার ভাবী ও অরুণ অযথা বাজে অপবাদ দিচ্ছে। রনি তো তাকে খুব ভালোবাসে। আজকে তাদের দেখা করার কথা ছিল, হয়তো রনি এখনো জানেনা তার চন্দ্রার বিয়ে হয়ে গেছে।
খুব শীগ্রই কিছু একটা করতে হবে, তার এসব ভাবনার মধ্যে অরুণ আবার বলে উঠলো,
___কাপড়গুলো ধুয়েছিলে?
চন্দ্রা মাথা নেড়ে বারান্দায় ইশারা করে ভেজা কাপড় দেখিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অরুণ ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে গেলো এবং ফিরে এসে দেখলো টেবিলের উপর গরম ধোঁয়া উড়ানো চা রাখা আছে। চায়ের কাপে ধরতে গিয়েই দেখলো পাশে অনেকগুলো কাপড় ইস্ত্রি করে রাখা। তার মানে কালকে সে যা যা বলেছিল সবকিছুই চন্দ্রা পালন করতেছে। অরুণ কিছুক্ষণ নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। ওহ আজকের চা-টাও দারুণ হয়েছে, সে কাপের দিকে তাকিয়ে ভাবলো,, এটা নিশ্চয়ই চন্দ্রার নিজের হাতে বানানো। তার রান্নার হাত ভীষণই ভালো। প্রশংসার যোগ্য হলেও সেটা তাকে করা যাবেনা। কিন্তু এতো তারাতাড়ি কীভাবে বানালো? এই মেয়ে তো কাজকর্মে ভীষণ ফার্স্ট ফার্স্ট। ভালোই হলো অন্তত কয়েকদিন কাজের মেয়ের আউলানো কাজে বিরক্ত প্রকাশ করতে হবেনা।
চা খাওয়া শেষ করে অরুণ বিছানায় বসে ল্যাপটপে নিজের কাজ করতেছিল, বেশ খানিক সময় পরে
চন্দ্রা রুমে আসলো, আর এসেই বললো,
___ আপনার নাস্তা রেডি, খেতে যান।
চন্দ্রার কথা শুনে অরুণ উঠে দাঁড়ালো, আর তার দিকে বাঁকা হয়ে একটু তাকালো, কিছু বলতে গিয়েও না বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলো।
অরুণের এই হাসিটা যেন বুকে ছুড়ি বসানোর জন্য যথেষ্ট, এর আগে অরুণের দিকে সে কখনোই খেয়াল করে তাকায়নি । কিন্তু এই মূহুর্তে প্রথম সে খেয়াল করলো অরুণের মুখে শুধু উপচে পড়া মায়ার আবরণ আর তার দুচোখে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ। সেখান থেকে কেমন যেন চোখ সরানো দায়। নাহ এই চোখে কোনো প্রতারণার চাপ নেই, এটা বিশুদ্ধ এক চাহনি।
আনমনে হাসি চন্দ্রার ঠোঁটেও একটা হাসি ভীড় করেছে, হঠাৎ আয়নার সামনে গিয়ে চমকে উঠলো, আরে তার গালে এগুলো কি? চন্দ্রা হাত দিয়ে মুছতে লাগলো, নিশ্চয়ই রুটি বানানোর সময় ভুলক্রমে গালে আটা এসে লেগেছে। এখন সে বুঝতে পারলো অরুণ তার দিকে কেন এমন হাসি দিয়েছিল।
চন্দ্রা এখান থেকে সরে বিছানার এদিকে গিয়ে দেখলো অরুণ তার ফোনটা বালিশের উপর রেখে গেছে। প্রথমে ভাবলো এটাই সুযোগ, কিন্তু পরক্ষণে সে আর মোবাইলে স্পর্শ করলোনা। কেন জানি মনে হচ্ছে ভদ্র পরিবারের মেয়েদেরকে অন্তত বিয়ের পরে সবকিছু মানিয়ে নিতে হয়। অরুণ চাইলে ডিভোর্স দিয়ে দিক, আর তার বিয়ে হয়েছিল কিংবা শশুড়বাড়িতে থেকেছে এমনটা শোনার পর রনিও যে তাকে মেনে নিবে সেটা তার মন সায় দিচ্ছেনা। তবে তার মন সায় দিচ্ছে অরুণ তাকে ডিভোর্স দিবেনা।
মাত্র একদিনেই অরুণের উপর কি কঠিন বিশ্বাস জন্ম নিলো তার।
চন্দ্রা এসব ভাবনা রেখে একটা ন্যাকড়া হাতে নিয়ে ফার্নিচারের এদিক ওদিক মুছতে লাগলো। অরুণের কথামতো কয়েকদিন কাজের মেয়ের মতো কাটাতে বিরক্ত লাগবেনা। কারণ এটা তার প্রাপ্য ছিল।
এদিকে অরুণ খাবার টেবিলে যাওয়ার সাথে সাথে তার মা বললো,
___ এতো লক্ষি একটা বউ পেয়েছিস। প্রথমদিনেই কিছু চিনেনা অথচ নিজে থেকে চিনে নিয়ে সকালে চা বানানো, সবার জন্য নাস্তা বানানো একা করলো। তা বউমা কোথায়, ওকে নিয়ে আসলিনা কেন? সে তো খায়নি এখনো।
অরুণ মায়ের কথায় চন্দ্রাকে ডাকতে গেলো। রুমে গিয়েই দেখলো চন্দ্রা শাড়ীর আঁচল পেঁচিয়ে, সেটাকে কোমরে গুঁজে একদম গ্রামের বঁধুদের মতো এদিক ওদিক মুছতেছে। আলমারির উপরের দিকটা তার নাগালের বাইরে তাই টুলের উপর উঠে হাত উঁচিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে।আর পেছনের সেই তিলটা এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অরুণ আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে বললো,
___ কেন যে এতো টাকা দিয়ে ঘরের আকাইম্মা কাজের বুয়া টুয়া রাখি। আগে জানলে কবেই বিয়ে করতাম।
অরুণের কথা শুনে চন্দ্রা লাফিয়ে উঠলো, হুড়মুড় নিচে নেমে নিজের কাপড় ঠিক করতে করতে বললো,
___প্লিজ বিশ্বাস করুন আমি জানতাম না আপনি এসময় আসবেন। ভেবেছি আপনার খাবার খেতে যতটা সময় লাগবে আমি ততক্ষণে সেরে ফেলবো।
অরুণ আরেকটু এগিয়ে আসলো আর বললো,
___একটু পেছনে ফিরো তো।
চন্দ্রা আমতাআমতা করে বললো,
___ কেএএনো?
অরুণ রাগী সুরে বললো,
___পেছন ফিরতে বলছি ফিরবে। প্রশ্ন করো কেন?
চন্দ্রা পেছন ফিরলো। অরুণ টেবিল থেকে একটা আঠালো স্টিকারের টুকরো চন্দ্রার পিঠের মধ্যকার তিলটার উপর লাগিয়ে বললো,
___ এটা সবসময় ঢেকে রাখবে, মনে থাকে যেন। কারণ এটা যে কাউকে মেরে ফেলতে পারে।
আর এখন আমার সাথে আসো, আম্মু ডাকছে।
চন্দ্রা অরুণের পেছনে যেতে যেতে নিজের পিঠে হাত দিয়ে দেখলো এটা একটা স্টিকার, কিন্তু কেন লাগালো কে জানে। মেরে ফেলতে পারে এটাই বা কেন বললো অরুণই জানে।।
ডাইনিংয়ে যাওয়ার পরেই অরুণের মা ফোন হাতে চন্দ্রার দিকে এগিয়ে এসে বললো, তোমার বাবা তোমার সাথে কথা বলতে চায়।
চন্দ্রা হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো। অরুণ বুঝতে পারলো সে আজকে যে যাবেনা সেই বিষয়ে তার আব্বুর সাথে কথা হয়েছে তাই তিনি নিজের মেয়ের মতামত জানতে চান৷ অরুণ জানে চন্দ্রা এখন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে বলবে,,বাবা আমাকে নিয়ে যাও আমার এখানে ভালো লাগছেনা।
কিন্তু চন্দ্রার কথা শুনে অরুণ আকাশ থেকে পড়লো।
চন্দ্রা ফোন নিয়ে নিজে বাবাকে বলছে,
___ বাবা আমার এখানে থাকতে কোনো সমস্যা হচ্ছনা৷ উনারা সবাই খুব ভালো । আমি তারাতাড়ি যেতে চাইনা। তুমি নিজের খেয়াল রেখো কিন্তু।
অরুণ গলা ঝেড়ে চোখ মুখ বাঁকিয়ে খাওয়া শুরু করলো। চন্দ্রাও খাচ্ছে৷ এখনকার বলা চন্দ্রার এসব কথা তার ভাবনার বাইরে ছিল। কে জানে চন্দ্রাকে কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স দিয়ে দিবে সেটা জেনেও এখন বাংলা সিনেমার আদর্শ নায়িকাদের মতো এমন ভাব দেখাচ্ছে কেন/? যদিও সে পাক্কা অভিনেত্রী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ যাক সে যে ধরনের অভিনয়ই করুক, সেটা যতদিন এই বাড়িতে আছে অন্তত ফ্রীতে দেখা যাবে।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে অরুণ আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যদিও অরুণ এখন ছুটিতে তারপরও তার কাজ ছাড়া এখন কিছু ভালো লাগে না। অন্যদিকে চন্দ্রাও ভীষণ ব্যস্ত। সারাবাড়ি চকচকে ঝকঝকে এবং একদম তকতকে বানানোর চেষ্টা তার। তার শশুড় শাশুড়ী সবাই কতো প্রশংসা করছে, সবাই মানা করা সত্ত্বেও সে খুশিমনে শুধু কাজ করে যাচ্ছে। কাজের একেক ফাঁকে তার মায়ের একটা কথা খুব মনে পড়ছে,,
বাড়িতে মায়ের কাজে সাহায্য করতোনা বলে তার মা মাঝে মাঝে বলতো, আমাকে তো কোনো কাজে সাহায্য করো না, এক বেলা রান্না করেও খাওয়াওনা। পরের বাড়িতে গিয়ে ঠিকি সব করবে৷ কিন্তু আমি সেটা পাবোনা আর কি।
চন্দ্রা হাসছে আর ভাবছে সত্যিই তো তার মা কোনো সহজ কাজের কথা বললেও সেটা কমপক্ষে ১০০ বার না বললে করতে যেতোনা। আর তার স্বামী একবার বলাতে অনায়াসেই সব কাজ করছে,, সেটাও ভালোভাবে বলা ছিল না৷ জায়গা ভেদে মানুষ কতোই না পরিবর্তনশীল!
এভাবে ৪ দিন কেটে গেলো। চন্দ্রা নিয়ম করে সবগুলো কাজই সুন্দর করে আগে আগে গুছিয়ে করে ফেলে। কয়েকদিনে বাড়ির সবাই-ই কেমন জানি তার উপর নির্ভর হয়ে গেছে, তার শাশুড়ীর পান সাজিয়ে দেওয়ার কাজটাও উনাকে করতে দিতোনা।
কিন্তু ৪ দিনের মাথায় হঠাৎই তার বাবা তার শশুড়বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন,,তিনি তার মেয়েকে না নিয়ে যাবেন না। চন্দ্রাও তার বাবার খুব আদরের একটা মাত্র মেয়ে। এতদিন না দেখে চন্দ্রা বাবা মা যেন অস্থির প্রায় হয়ে যাচ্ছিলো, মেয়ের জন্য চন্দ্রার মায়ের কান্নাকাটিতে তিনি আজকে তাকে নিয়ে যেতে বাধ্য।
এদিকে চন্দ্রার শশুড় শাশুড়ীও তাকে যেতে দিচ্ছেনা।
আবার অরুণও তখন তার অফিসে, তাদের কথা হচ্ছে অরুণ আসলে তারপর নিয়ে যেতে। কিন্তু চন্দ্রার বাবা নাছোড়বান্দা, আজকে এবং এখনি মেয়েকে নিয়ে যাবেন। কারণ নতুন বিয়ে হওয়ার পরে কোনো মেয়েই একনাগাড়ে এতদিন শশুড়বাড়ি থাকেনা।
চন্দ্রারও নিজের মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কেন জানি অরুণের জন্য খারাপ লাগছে। মানুষটাকে এক নজর দেখলে দিনটাই তার ভালো কাটে। বিয়ের পরে আজকেই প্রথম সে অফিসে গেছে, এমনিতেই চন্দ্রা ছটপট করছিল অরুণকে কখন দেখবে। কিন্তু সেটা আজকে আর হলোনা।
‘
‘
এদিকে অরুণ বাড়িতে এসেই দেখল সবাই মন খারাপ করে বসে আছে। অরুণ তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
___কেউ কি মারা গেছে?
অরুণের মা বললো,
___ চন্দ্রাকে তার বাবা এসে নিয়ে গেছে।
অরুণ হাসতে হাসতে বলল,
___গেছে ভালো ভালো হয়েছে, এতে মন খারাপের কি আছে আজব!
বলেই সে কিছু শোনার অপেক্ষা না করে এখান থেকে রুমে চলে গেলো।
কিন্তু এটা শুনে অজানা এক মন খারাপের ভীড় তার মধ্যেও। শুধু ঘরটা না, বুকের ভেতর কেমন জানি হাহাকার করছে তার। রুমে গিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকাতেই অরুণের মনে হলো, কাল রাতে চন্দ্রা বলছিল তার এখানে থাকতে কষ্ট হয়।
অথচ অরুণ তার কথাকে পরোয়া করেনি। নিজের সাথে তাকে জায়গা দিতে সে নারাজ।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তার সাথে জায়গা না দিলেও গোপনে চন্দ্রা তার খুব গভীরে জায়গা নিয়ে নিয়েছে!
চলবে…..