আমড়া কাঠের ঢেঁকি পর্ব -০১

#আমড়া_কাঠের_ঢেঁকি
#কুরআতুল_আয়েন

১.
‘শোনো নিরু,,কান্না করা ভালো।কারণ কান্না করলে হার্ট ভালো থাকে।’
নিরু রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সামনে বসা আফজাল এর দিকে।অথচ আফজালের কোনো হেলদোল নেই।এই কড়া রোদের মধ্যে কি সুন্দর করে মাঠের মধ্যিখানটায় বসে বসে বাদাম খাচ্ছে।সূর্য একদম মাথার উপর।কিন্তু এদিক দিয়ে নিরুর গরমে যা-তা অবস্থা।ঘেমে একাকার।শ্যামলা বর্ণের মুখটা এখন বিচ্ছিরি দেখতে লাগছে।
আফজাল নিরুর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
নিরু হতাশ হলো।আফজালের এমন উদাসীন ভাব তাকে খুব কষ্ট দেয়।ছেলেটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে।আগের মানুষটার সাথে এখনের মানুষ টার আকাশ-পাতাল তফাৎ।নিরু কোনোরকম কান্নাটাকে দমিয়ে রেখেছে।মনে মনে পণ করে নিয়েছে যতই হোক আফজালের সামনে আর কান্না করবে না।নিজেকে যতটা কঠিন করে রাখা যায় ঠিক ততটাই কঠিন করে রাখবে।এর বেশি কঠিন করার চেষ্টা করলেও করতে পারবে কিন্তু হিতে যদি বিপরীত হয় তাহলে বিপদ।দেখা গেলো নিজেকে এতো কঠিন করতে গিয়ে নিজেই না ভেঙে গুড়মিশ্রিত হয়ে গেলো।তারচেয়ে যতটুকু লোড নেওয়া যায় ততটুকু নেওয়াই ভালো।কথায় আছে অতিরিক্ত কিছুই ভালো না।

আফজাল নিরুর দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
‘পানির বোতল টা দাও তো নিরু।মনে হচ্ছে গলায় বাদাম আঁটকে আছে।শুধু তায় নয়,দাঁতের চিপাচাপাতেও আঁটকে আছে।কি একটা অবস্থা দেখেছো,,বাদাম জিনিস টা কে এখন চীজ না বলে আর পারছি না।’

নিরু কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো,
‘পানি খাওয়ার দরকার নেই,মরতে পারো না।গলায় বাদাম আঁটকে মরে যাও।’

একমুহূর্তের জন্য নিরু আর সেখানে বসলো না।ধপাধপ্ পায়ে জায়গা প্রস্থান করার জন্য হাঁটা ধরলো।কার্জন হলের গেইট পার হতে না হতেই কান্না আর দমিয়ে রাখতে পারলো না।নাক টেনে টেনে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা ধরলো।বিরবির করে বলতে লাগলো,
‘হা*রা*ম*জা*দা*র কাছে আমার কোনো মূল্য নেই।তাকে যদি বলি ডান সে বলে বাম।বামেই যাক সে,,গিয়ে দেখুক সেখানে কি মধুর জিনিস টা আছে।ডানে আর আসতে হবে না তার।’

কার্জন হল থেকে বের হয়ে হেটে হেটেই দোয়েল চত্বরের দিকটায় আসলো নিরু।ঠিক করে রেখেছিলো মাটির কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যাবে।গত সপ্তাহে বাসায় নিরুর মুমু আপা একটা কর্ণার পাঠিয়েছে।সেটাকে সাজাতেই এখানে আসা।কর্ণার টা পাওয়ার সাথে সাথেই নিরু ভেবে নিয়েছে এটা তার পার্সোনাল বারান্দায় সেট করার মতো মোক্ষম একটা জিনিস।আফজালের কথা ভুলে গিয়ে নিরু জিনিসপত্র খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখায় মনোযোগ দিলো।আপাতত আফজাল লিস্টের বাহিরে।
—–
শান্তিনিবাসের সামনে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিরু।দোয়েল চত্বর থেকে সোজা এখানে এসেছে।হাতে মাটির বিশাল বড় একটা ফুলদানি।কারুকাজে অপূর্ব লাগছে।বিকাল প্রায় পাঁচটা বাজতে চললো।এখানে আসার কথা ছিলো চারটায়।এসেছে একঘন্টা লেইট করে।তার এই বা কি করার ছিলো,জ্যামে পড়ে এক ঘন্টা লেইট হয়েছে।বেশি তো আর হয় নি,মাত্রই তো একঘন্টা।
আবার কলিং বেলে চাপ দিয়ে উঠলো।কলিং বেলের মিষ্টি আওয়াজ টা পুনরায় বাজতে শুরু করে দিলো।নিরুর মুখে এবার বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে।আরো মিনিট পাঁচেক পর দরজা টা খুলতেই নিরু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।

‘এতো দেরি হয় তোমার দরজা খুলতে আপা।কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছি এইসব জিনিসপত্র নিয়ে।এইজন্য তোমার এই শান্তিনিবাসে আসতে আমার ইচ্ছে করে না।’

মুমু দরজা লাগিয়ে লম্বা একটা হাই তুললো।খোলা চুলগুলো কে হাতখোঁপা করে নিয়ে নিরুর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘নিরু তোকে দেখতে কি বিচ্ছিরি লাগছে রে।চুলগুলো কাকেরঠ্যাং হয়ে আছে।’

‘তোমার দেওয়া কর্ণার সাজাতেই আমার এতো কষ্ট করতে হয়েছে।দেখো না এই জিনিস গুলো নিয়ে এসেছি।’

‘দেখি তো কি কি কিনেছিস।’

‘তুমি দেখতে থাকো,,আমি ততক্ষণে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি।তোমার বাথরুম টা ফাঁকা আছে তো।’

‘না রে নিরু,তোর দুলাভাই মুনমুনকে হাগাচ্ছে।মুনমুনের সকাল থেকে হাগা হচ্ছে না।তাই তোর দুলাভাইও উঠেপড়ে লেগেছে মুনমুনের হাগার পিছনে।’

‘উফফ!কি কথার ছিরি তোমার আপা।ছোট একটা বাচ্চাকেও ছাড় দিচ্ছো না।সে তার মতো করে সব করবে।যখন তার প্রকৃতির ডাক আসবে তখন তোমার আর দুলাভাই এর এতো উঠেপড়ে লাগতে হবে না,সে এমনেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিবে।এবার বলো কোন বাথরুম টা ফাঁকা আছে।’

‘ডাইনিং রুমের টায় যা।এটা আপাতত ফাঁকা আছে।’

নিরু এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেলো।ধুলোবালি তে তার শরীর কেমন চটচটে হয়ে আছে।
—–
এশার আজানের শব্দে নিরুর ঘুম ভেঙে যায়।ফ্রেশ হয়ে একটু শুয়েছিলো।সারাদিনের ক্লান্তিতে বেচারি যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তা তার খেয়াল এই নেই।ঘুম হয়ে মাথাটা একদম ক্লিয়ার লাগছে।পিরিয়ড রানিং বলে নামাজ আর পড়া হলো না।ওড়না টা ঠিক করে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।ফোন টা হাতে নিয়ে একবার দেখে নিলো আফজাল কোনো কল বা মেসেজ করেছে কিনা।ফলাফল শূন্য দেখে নিরুর খুব অভিমান জাগলো।ভারী গলায় বিরবির করে বলে উঠলো,
‘মানুষ টা এতো পাষাণ কেন।আচ্ছা কেউ তাকে কালো জাদু করে নি তো।যদিও করে থাকে তাহলে বুঝার উপায়ই বা কি।মুমু আপার সাথে একবার কথা বলে দেখতে হবে।উঁহুহু মুমু আপা না,দুলাভাই এর সাথে কথা বললে স্পেসিফিক একটা উত্তর পাবো।’

নিরু চা নিয়ে বসেছে।মাথায় তার হাজারো চিন্তা এসে ভীড় করছে।মুমু রান্নাঘরে আছে।হয়তো পেঁয়াজ কাটছে।পেঁয়াজের ঝাঁজের গন্ধটা আসছে।নিরু আজকে এখানেই থেকে যাবে।কাল ভার্সিটির ক্লাস কমপ্লিট করে বাসায় ফিরবে।রাতেই ফিরে যেতো কিন্তু মুমু যেতে দেয় নি।কি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলে নিরুকে রেখে দিয়েছে।মুনমুন সামনে বসে ঘ্যানঘ্যান করছে।নিরুর মাথা যেনো আরো ধরে গিয়েছে।রান্নাঘর থেকে মুমু চিল্লিয়ে বললো,

‘নিরু ওকে একটু হাইকমোড এর উপর বসিয়ে দিয়ে আসবি।হাগার বেগ এসেছে বলেই এভাবে ঘ্যানঘ্যান করছে।’

নিরু চোখ মুখ খিঁচিয়ে তাকালো মুমুর দিকে।মুমু আবারো তাড়া দিয়ে বলে উঠলো যা না নিরু।মেয়েটা ছোটা মানুষ,আঁটকে রাখতে পারবে না তো।নিরু এমতাবস্থায় বললো,

‘চা খাচ্ছি আপা।এখন কীভাবে যাবো বলো।’

‘চা এই তো খাচ্ছিস,,ভাত তো আর খাচ্ছিস না।ভাত খাওয়া থেকে উঠে গিয়ে মুনমুনকে হাগিয়েছি।তারপর আবার ভাত খেতে বসেছি।নিজের যখন সন্তান হবে তখন বুঝবি দেখিস।’

‘আপা তোমার কথার ব্যাখ্যার সাথে পারা মুশকিল।মা’র বংশের মেয়েদের মধ্যেই তুমিই অন্যরকম হয়েছো।’

বন্যা মাথায় কোনোমতে ওড়না পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।একটু পর পর সরু চোক্ষু দিয়ে হাত ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে।নিরুর জন্য অপেক্ষা করছে।এখনই আসার কথা।অথচ নিরুর কোনো দেখা নেই।পায়চারী করতে লাগলো।এই সময় এই জায়গা টা একদম নিস্তব্ধ হয়ে থাকে।নিরুকে যে ফোনও করবে তার কোনো স্কোপ নেই।ফোনের ব্যালেন্স একদম শূন্যে নেমে এসেছে।নিরু আসলে সামনের দোকান টা থেকে টাকা ভরে নিবে।কিন্তু এখনো নিরুর দেখা পেলো না বন্যা।বিরক্তিতে তার কপাল কুঁচকে আছে।মনে মনে আওড়াতে লাগলো,
‘যেদিন বলি নিরু তুই তাড়াতাড়ি আসবি ওইদিনই লেইট করে আসে।এক দুদিন মানা যায় তাই বলে কি সবসময়।’
🍁🍁
এই যে আপু এই সময়ে এইখানে কি করছেন আপনি?
বন্যা চট করে পিছন ফিরে তাকালো।হাঁটুর বয়সি এক ছেলে ঠিক তার পিছন টায় দাঁড়িয়ে আছে।বন্যা গলা কেশে বললো,
‘নাম কি তোমার?’

‘নাম দিয়ে কাম কি?’

বন্যা অবাক হয়ে গেলো।বাপরে কি ছেলে রে।মুখের উপর কথা বলার তারিফ না করে পারছে না।ছেলেটা একটা চোখ টিপ দিয়ে বললো,

‘বললেন না তো কি করছেন এখানে একা একা।’

বন্যা থতমত খেয়ে গেলো।এই ছেলে যে চালু তা বুঝাই যাচ্ছে।বন্যা কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,

‘তাতে তোমার কি।একটা বাচ্চা ছেলে হয়ে ভাব নিচ্ছো বড়দের মতো।’

‘দেখতে বাচ্চা হলেও কাজেকর্মে কিন্তু ঠিক বড়দের মতোই।বিশ্বাস না হলে কাজ করে দেখিয়ে দিবো নাকি।’

বন্যা এবার নিজের পা থেকে জুতাটা খুলে ছেলেটার দিকে তেড়ে আসতে নিলেই ছেলেটা এক দৌড়ে অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েছে।পিছন ফিরে আর তাকানোর সাহস করে নি।বন্যা রাগে থুতু ফেলে কটমট করে বললো,

‘শালা,,এখনো নাক টিপলে দুধ বের হবে আর এসেছে আমাকে তার কাজকর্ম দেখাতে।আরেকদিন সামনে পেলে খবর করে ছাড়বো।এই রাস্তাতেই তো আসা-যাওয়া হবে,এই ছেলেকে চিনে রাখলাম।’

নিরু দৌড়ে এসে বন্যার সামনে থামলো।বন্যা জুতা দিয়ে মারতে গিয়ে দেখলো নিরু।নিরু কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।শুকনো ঢোক গিলে বললো,,
‘কিরে বন্যা জুতা তোর হাতে কি করছে রে।জুতা তো পায়ে থাকার জিনিস।শোন পায়ের জিনিস কখনো মাথায় তুলবি না।দেখবি লায় পেয়ে তোরই যা তা অবস্থা হবে।’

‘মাঝেমধ্যে জুতাকে মাথায় তুলতে হয়।কারণ এটার উপকার অন্য লেভেলের।এই যে এখন এক আশিক কে পিটানোর জন্য আমার এই জুতাটাই যথেষ্ট ছিলো।’

‘তোর আবার কোন আশিক রে?রাজু ভাইয়ার দিন তাহলে শেষ।’

‘রাজু এক বুইড়া হা*রা*ম*জা*দা।কবরে এক পা রেখে এখনো তার টাংকি মারা গেলো না।আরেকবার কিছু বলতে আসতেই এই জুতা টাকেই কাজে লাগাবো।’

নিরু আর বন্যা রিকশার ভাড়া মিটিয়ে টিএসসির দিকে রওনা দিলো।দূর থেকে নিরু আফজাল কে দেখতে পেলো।সাদা পাঞ্জাবী পড়ে একটা মেয়ের সাথে কি মিষ্টি করে হেসে হেসে কথা বলছে।নিরুর অভিমান যেনো আরেক কদম বাড়লো।তবে মনে মনে আফজালের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়লো।বন্যা একবার নিরু আর আফজাল এর দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।এদের লায়লী মজনুর প্রেম কাহিনী দেখতে গিয়ে কাজের কাজ টাই না মিস হয়ে যায়।

চলবে..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here