আমড়া কাঠের ঢেঁকি পর্ব -৩ ও শেষ

#আমড়া_কাঠের_ঢেঁকি
#কুরআতুল_আয়েন

৩.(শেষ পর্ব)
নিরু হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো।বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো মুমু মুখে ফেইসপ্যাক মেখে চোখে দুটো শসা দিয়ে আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে।অন্যদিকে মুনমুন সারা ফ্লোর লিপস্টিক দিয়ে মাখিয়ে একদম মাখামাখি অবস্থা করে ফেলেছে।নিরু হতাশা চোখে কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো মুনমুনের দিকে।মুনমুনও নিরুর উপস্থিতি উপলব্ধি করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।নিরু বেচারি আর কোনোদিকে লক্ষ্য না করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।লম্বা সময় নিয়ে গোসল করা উচিত।আজকে তার সাথে শুধু অবিশ্বাস্য কাহিনী ঘটেছে।প্রথমত,রিকশায় বসা সুদর্শন ব্যক্তি টি আর কেউ না বন্যার বাগদত্তা।না জেনে কতো কথাই না শুনিয়েছে নিরু সেই ব্যক্তি টিকে।অথচ যখন জানতে পেরেছে বন্যার বাগদত্তা তখন কথা শোনানোর থেকে মনে হয় বেশিই লজ্জা পেয়েছে।কিন্তু নিরুর রাগ হচ্ছে অন্য জায়গায়,বন্যার যে এমন একজন স্পেশাল মানুষ আছে তা নিরু ঘুণাক্ষরেও জানতো না।এমনকি বন্যার বাগদত্তা ফরহাদের সাথে কথা বলার পর বুঝতে পেরেছে বন্যা তার ব্যাপারেও গল্প করেছে ফরহাদের কাছে অথচ,ফরহাদ কে সে চিনেই না।ব্যাপার টা টোটালি হাস্যকর আর অবিশ্বাস্য।পরিচিত হওয়ার পর নিরুও বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে এসেছে বন্যা আর ফরহাদের সাথে।ফরহাদের সামনে বন্যাকে কিছু বলতে না পারলেও অবশ্য চোখ দিয়ে গিলে খেয়েছে নিরু।যার অর্থ,আপাতত তোকে ছাড় দিলাম কিন্তু ছেড়ে দেয় নি।
—–
‘আপা!যেভাবেই হোক শুক্রবারে বিয়ে করতে হবে।’

মুমু হকচকিয়ে উঠলো।তীক্ষ্ণ চোখে নিরুর দিকে তাকিয়ে বললো,

‘মানে কি নিরু!তোর কথায় মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই তোর মাথায় সমস্যা হয়েছে।’

‘মা’কে গিয়ে বলো নিরু বিয়ে করতে চায়।তাও শুক্রবারেই।’

মুমুর এবার রাগ হলো।তাও ভীষণ রকমের।নিরুকে তার এখন বিতৃষ্ণা লাগছে।সবকথাতেই কেমন একটা ধোঁয়াশা রেখে দিয়েছে।বিয়ে কি বললেই হয়ে যায় নাকি!আর পাত্রও কি হাতের মোয়া যে বলা মাত্রই হাজির।মুমুর মতে বাংলাদেশে ভালো পাত্র পাওয়াই টাফ।নিজের বিয়ের সময় কিছুটা আন্দাজ হয়ে গিয়েছে।কতো সময় নিয়ে তার জন্য জামাই খোঁজা হয়েছিলো আর শুক্রবার তো আসতে মাত্র কয়েকদিন!এই কয়েকদিনে জামাই কোথা থেকে আমদানি করবে মুমু তা ভেবে পায় না।আর নিরুর এমন খাপছাড়া কথা গুলাতে তার এখন রাগ হচ্ছে।রাগ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক!মুমু এবার গম্ভীর কন্ঠে নিরুকে বললো,

‘দেখ!নিরু,ফাইজলামির একটা সীমা থাকে।তুই সকাল থেকেই কেমন একটা লাগামহীন কথা বলে চলেছিস।হুট করেই বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠলি।কেনো রে খালা যখন কয়েকদিন আগেই বিয়ে করার কথা বলেছিলো তখন কেনো করলি না,জামাই তো ভালোই ছিলো।এক কথায় যাকে সুপাত্র।’

‘আপা!আমার সুপাত্রের দরকার নেই,আমার আগুন ছেলে হলেই হলো।’

মুমু রাগে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।কটমট চোখে নিরুর দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তোর জামাই তুই খোঁজ!’
মুমু দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই নিরু কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।তবে,বেশিক্ষণের জন্য শুতে পারলো না।পরমুহূর্তেই মুমু এসে টেনে তুললো নিরুকে।চোখমুখ সিরিয়াস ভঙিমা করে বললো,

‘নিরু!সব কথা খোলসা করে বল আমাকে।তোর মতিগতি ভালো ঠেকছে না।তুই কখনোই এমন ছিলি না।বিয়ে করার চিন্তা তো তোর থেকে একশো হাত দূরে ছিলো।তাহলে দু’দিন ধরে কি এমন হলো যার জন্য তুই একদম বিয়ে পাগলী হয়ে গেলি।’

নিরু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মুমুর দিকে তাকালো।মুমুকে তার এখন ভয়ংকর রাগী লাগছে।মুমুকে এমন রাগী সচরাচর দেখে নি নিরু।আমতাআমতা করে বললো,

‘কিছু না আপা!পরে বলবো,এখন আমি একটু ঘুমাবো।’

‘নিরু আমার হাতে থা’প্প’ড় খেতে না চাইলে সব এখনি বল।না হলে কিন্তু পরে বলতে আসলে আমি শুনবোই না।’

মুমুর রাগের কাছে নিরু যেনো চুপসে গেলো।অগ্যাতা!সবকিছুই খোলসা করে বলতে হলো নিরুকে।সব শুনে মুমু কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো।রাগে,জেদে যে এমন একটা কাহিনী করে বসবে তা বলার বাহিরে।মুমু কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠান্ডা মাথায় নিরুকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘পাগলামি বাদ দিয়ে,তোর প্রেমিকের সাথে কথা বলে সব ঠিক করে নে।আর এইসব বিয়ের ভূত মাথা থেকে আপাতত ঝেড়ে ফেল,তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কোনো ভুল হোক তা আমি চাই না নিরু।এর বিপরীতে যাতে কোনো কথা না হয়।’

নিরু কিছু বলতে গিয়েও পারলো না।অসহায় চাহনি নিয়ে মুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
—–
ভার্সিটি তে গিয়ে আফজাল এর কোনো খোঁজ পেলো না নিরু।একরাশ মন খারাপ নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালো।পাশে বন্যা নিজের মতো করে বকবক করেই যাচ্ছে।সেদিকে নিরুর কোনো পাত্তা নেই।মন যেনো আফজাল কে খুঁজতে ব্যস্ত।বন্যা নিরুর দিকে পরোক্ষ করতেই আসল কারণ টা ধরে ফেললো।ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হেসে মনে মনে আওড়াতে লাগলো,

‘ভালোবাসা খুবই অদ্ভুত।এই যে দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু ভুল বুঝাবুঝির জন্য কতটা দূরে চলে যাচ্ছে।’

নিরু ব্যাগ টা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে নির্বিঘ্নে বসে পড়লো।পাশে বন্যাও বসেছে।নিরু ফোন টা হাতে নিয়ে এপাশ-ওপাশ করছে।ফোনটা জ্বলে উঠতেই নিরু শান্ত চোখের চাহনি নিয়ে সেদিকে তাকালো।ফোনের স্ক্রিনের জ্বলজ্বল করছে আফজালের মেসেজ।ঠোঁট দুটো নেড়ে নিরু বিরবির করে পড়তে লাগলো,

‘বিয়ে কি শুধু তুমিই করতে পারো নিরু!আমাকে কি তোমার ঠ্যাঙা মনে হয়।শুক্রবারে আমিও বিয়ে করছি।হ্যাঁ!যেই শুক্রবারে তুমি বিয়ে করছো ঠিক সেই শুক্রবারেই!শুধু তাই নয়,তোমার থেকে হাজার গুনে ভালো মনের মেয়েকে,যে আমাকে বিশ্বাস করবে।মানুষের মুখের কথা শুনে আমাকে অবিশ্বাস করবে না।ভালোবাসায় বিশ্বাস টা খুব জরুরি।বিশ্বাস থাকলে যত্নটাও আপনা-আপনি চলে আসে।তোমার তো আমার প্রতি কোনো বিশ্বাস এই ছিলো না।ছিলো শুধু অবিশ্বাস!’

আফজালের এই কয়েক লাইনের মেসেজের বার্তাটায় সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পেয়েছে অভিযোগ আর অভিমান।তাকে অবিশ্বাস করার কারণ গুলো এই কয়েকলাইনেই বুঝিয়ে দিয়েছে আফজাল।আর,এদিকে নিরুর যা-তা অবস্থা।কপাল বেয়ে ঘামের চিকন স্রোত ভেসে যাচ্ছে।বুকের ভিতর অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছে।নিরুর মনে এক বিশাল অভিযোগ এসে হানা করলো।তার এখন অভিযোগ একটাই,সে না হয় ভুল বুঝে,অবিশ্বাস করে অনেক বড় পাপ করেছে।আফজালের তো উচিত ছিলো নিরুকে সামনে বসিয়ে সবকিছুর ধোঁয়াশা মুক্ত করে দিতে।কিন্তু,আফজাল তা করে নি,উলটো নিজেও নিরুকে কি না বিয়ের দেমাগ দেখিয়ে দিয়ে গেলো।নিরুর এখন আরেকটা মানুষের উপর রাগ হচ্ছে।মানুষ টা তার মুমু আপা ছাড়া আর কেউ না।মুমুর কথামতো সে আফজালের সাথে কথা বলতে এসেছিলো আর আফজাল এই কি না তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একদম বিয়ের খবর দিয়ে গেলো।নিরুর ভিতর থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো।ব্যাগ টা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।বন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আমি গেলাম।’

বন্যা এতোক্ষণ ধরে ফেইসবুক স্ক্রোল করছি।নিরুর কথা শোনে মাথা উঁচু করে নিরুর দিকে তাকালো।এমতাবস্থায় বললো,

‘কোথায় যাবি!বসবি না এখানে?কিছুই তো খেলাম না,মাত্রই তো এলাম।’

নিরু কড়া চাহনি নিয়ে বন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তুই বেশি করে খা।খেয়ে খেয়ে শরীরের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা কর।কারণ,সামনের শুক্রবার তোর দুটো বিয়ে খেতে হবে।একটা আমার আর একটা আফজালের।একদিনে দুই জায়গায় বিয়ে খেতে হলেও শরীরের এনার্জি অনেক দরকার।’

নিরু আর একমুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না।ঝড়ের বেগে সেখান থেকে প্রস্থান নিলো।ভেবেছিলো সব ঠিক করে নিবে।কিন্তু,এখন আর কারোর কথা শুনবে না,না মুমু আপা না বন্যা।বিয়ে সে করেই ছাড়বে।
🍁🍂
চারপাশ নিস্তব্ধতায় ভরপুর।থেমেথেমে বাহির থেকে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ ভেসে আসছে।বিছানার সাইড ট্যাবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেট আর লাইটটার টা নিয়ে নিলো আফজাল।ঠোঁটের দু’পাশে চেপে ধরে নিরুর কথা ভাবতে লাগলো।নিরুর কথা ভাবতে গেলে আফজালের এখন রাগ,অভিমান,জেদ ছাড়া মাথায় কিছুই আসে না।আফজালের কষ্ট একটা জায়গায়,নিরু তাকে অবিশ্বাস করেছে।মানুষের মুখের কথাকে প্রায়োরিটি দিয়েছে।মানুষ তো অনেক কিছুই বলবে,রটাবে!এই যে,ভার্সিটির চিনা পরিচিত মানুষ এখন জানে আফজাল নতুন প্রেম করছে,অথচ নিরুকে বাদ দিয়ে আর একটা প্রেমের ছিটেফোঁটাও আফজালের মনে ছিলো না।ভার্সিটির বড় ভাই হওয়ার সুবাদে তার সাথে অনেক জুনিয়র মেয়েরাই কথা বলতে আসে তাই বলে কি সে সবার সাথে প্রেম করে বসেছে নাকি।মানুষের কাজ এই তো এটা,সমালোচনা ছাড়া কোনো মানুষই চলতে পারে না।হোক সেটা ভালো কাজের সমালোচনা বা মন্দ কাজের সমালোচনা।কিন্তু নিরুর তাকে বিশ্বাস করার প্রয়োজন ছিলো।আফজালের এক বড় ভাইয়ের কথা এখন ভীষণ মনে পড়ছে।বেচারা প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে আফজাল এর সাথে প্রায় দু’ঘন্টার গপ্পো জুটিয়েছিলো।সেই গপ্পের আসল থিম ছিলো ভালোবাসার মূল অস্ত্র হচ্ছে বিশ্বাস।বিশ্বাসে কমতি ছিলো বলেই সেই বড় ভাইয়ের প্রেম ভেঙে গুড়মিশ্রিত হয়ে গিয়েছিলো।আজও সেই বড় ভাই বিরহে দিন কাটায়।তবে আফজাল মোটেও এমন করবে না।নিরুকে সে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিবে তাকে অবিশ্বাস করার ফল।ছেলেটার মন নরম হলেও রাগ যেনো তার দ্বিগুণ।

কেটে গেলো একদিন।মুমু পড়েছে বিপাকে।নিরুর সাথে কথা বলতে গিয়ে মন-মেজাজের আর বারোটা বাজাতে চায় না।আর এদিকে মুনমুনও তাকে জ্বালিয়ে মারছে।মেয়েটা যেনো দিনদিন দুষ্টুর শিরোমণি হয়ে উঠছে।এই যে এখন মুনমুন না ঘুমিয়ে চোখ দুটো গোল গোল করে তাকিয়ে আছে।মুমু মুনমুনের দিকে অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করলো।বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে,
‘ঘুমিয়ে যা না মা।দুপুর পার হয়ে বিকেল হতে চললো।’
কে শোনে কার কথা,মুনমুন কোনো পাত্তাই দিলো না।সে তার মতো গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলো মুমুর দিকে।মুমু পুনরায় চেষ্টা লাগালো মুনমুন কে ঘুম পাড়ানোর জন্য,কিন্তু হিতে-বিপরীতই হচ্ছে।রাগ লাগছে তার এখন।অবশেষে,মুনমুনের উপর রাগ দেখাতে না পেরে সেই রাগ ঝাড়লো মুনমুনের বাবার উপর।মুমু ফোন কানে চেপে ধরে দাঁত কটমট করে বললো,’অফিস বাদ দিয়ে তোমার মেয়েকে এসে তুমি ঘুম পাড়িয়ে যাও।তোমার মেয়েও হয়েছে তোমার মতো।আমাকে একদম নাচিয়ে ছাড়ছে।’যেমন ভাবে ফোন দিয়েছিলো ঠিক তেমন ভাবেই ফোন কেটেও দিলো।ফোনের বিপরীত প্রান্তে থাকা মানুষ টার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না।মিনিট বিশেক পর মুমু দেখলো মুনমুন ঘুমিয়ে গিয়েছে।এই সুযোগে তার পরিচিত এক বন্ধুকে ফোন করে দেখা করতে চাইলো।

বিয়ের তোড়জোড় চলছে নিরুদের বাসায়।প্রতিবেশীরা যে যেমন পারছে তেমন ভাবে সাহায্য করছে।হাতেগোনা মাত্র তিনটি দিন আছে।এর মধ্যে পারভীন আরা সবাইকে দাওয়াত দিয়ে দিয়েছেন।নিরুর দাদা বাড়িতে লোকজন নেই বললেই চলে তাও,পাশের বাড়িতে নিরুর এক চাচা আছেন।উনাকেও পারভীন আরা দু’দিন আগে চলে আসতে বলেছেন।সবার সাথে হাসি-মুখে কথা বললেও পারভীন আরা নিরুর উপর ভীষণ রকমের ক্ষেপে আছেন।এইতো সেদিনের কথা,নিরুর হুট করেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত টা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না।এই নিয়ে নিরুর সাথে কথা বলতে গেলেই নিরুর উপর রাগ আর বিরক্ত হয়েই নিরুর রুম থেকে ফিরেছেন।মেয়ের মুখে এক বুলি সে বিয়ে করতে চায়,হোক সেটা বুড়ো জামাই।তাও সে বিয়ে করতে চায় মানে চায়!পারভীন আরা মেয়ের জেদের কাছে হেরে একরাশ হতাশায় ডুবেছিলেন।আর তখনি মুমু একটা প্রস্তাব নিয়ে আসলো।ছেলে হচ্ছে মুমুর বন্ধুর এক ছোট ভাই।এই অল্প সময়ে মুমুর হাতে একটা ভালো ছেলের সন্ধান পাওয়ার খবর যেনো নিরুর মা পারভীন আরার কাছে এক বিশাল আনন্দের খবর ছিলো।কিন্তু এখানেও যেনো বিপত্তি বাজলো,ছেলে বেকার শুনে পারভীন আরার মুখটা নিমিষেই বেলুনের মতো ফুঁস হয়ে গেলো।মুমুর মুখে যখন শুনলো ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট।পড়াশোনা শেষের দিকে।এখনো চাকরি-বাকরি কিছু করছে না।তবে,ছেলের বাপের বিশাল বড় ব্যবসা আছে।বাসা-বাড়ি আপাতত করে নি তবে ঢাকায় তাদের জায়গা কিনে রাখা আছে।সামনেই বাসার কাজ ধরবে।

নিরুর মা পারভীন আরা দোটানায় পড়ে গেলেন।কি করবেন বুঝতেন পারছিলেন না।অন্যদিকে,নিরুর বাবা আকবর সাহেব তো বেঁকেই বসেছেন।তাঁদের এক কথা,বেকার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবেন না।ছেলের বাপের যা কিছুই থাকুক না কেনো আসল কথা হচ্ছে ছেলে বেকার।আর,ছেলের যে পরে চাকরি হবে তারই বা কিসের নিশ্চয়তা আছে।এই দেশে চাকরির বাজারের যা অবস্থা।এর থেকে বয়স্ক ব্যবসা ওয়ালা জামাই অনেক ভালো।অত্যন্ত একটা গতি আছে।মুমু যেনো পড়লো আরো বিপাকে।তারপরও অনেক ধৈর্য নিয়ে নিরুর মা বাবাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে।নিরুর জন্য চাইলেই এখন ভালো জামাই পাওয়া যাবে না,আর সময়ও নেই বলতে গেলে।ছেলে চাকরি না পেলেও বাপের ব্যবসায় তো বসতে পারবে।আর সবথেকে বড় কথা ছেলে বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান।কোনো ভাই বোন নেই।বাপের স্বয়-সম্পত্তি ছেলেই পাবে।কাজেই নিরুর কোনো কষ্টই হবে না।এমনকি,দু’পরিবারের গার্জিয়ান রা একসাথে বসে অনেকটা সময় নিয়ে কথা বলে বিয়ের সবকিছু পাকাপোক্ত করে ফেলেছিলো।

কেটে গেলো আরো একটা দিন।নিরুর বিয়ে উপলক্ষে মুমু এখন নিরুদের বাসাতেই আছে।বাসা থেকে বিয়েতে পড়ার জন্য কাপড়চোপড়ও আনিয়ে নিয়েছে।সেগুলোই নিরুর রুমে বসে দেখছিলো মুমু।আর,অন্যদিকে নিরু মুখটা গোমড়া করে বসে আছে।মুমু সেদিকে একবার তাকালো পুনরায় কাপড়চোপড় দেখায় মনোযোগ দিলো।গলা পরিষ্কার করে বললো,
‘ছেলেটাকে তোর একবার দেখা উচিত ছিলো নিরু।ছেলের বায়োডাটা ছবিও তোর কাছে দিয়েছিলাম।দেখলি না।একদম মাথায় জেদ নিয়ে বসেছিস।না দেখেই বিয়ে করবি।ছেলে যেমনই হোক না কেনো।অত্যন্ত নামটাও শুনতে চাস নি।বিয়েটা তোর কাছে কি পুতুল খেলা মনে হচ্ছে?এমন যদি মনে হয় তাহলে এইসব ভুলে যা নিরু।বিয়ে হলো দুটি মানুষের সারাজীবনের বন্ধন হওয়ার রাস্তা।নিজের একটা মানুষ হওয়া।সেই মানুষ টার উপর একমাত্র তারই অধিকার থাকবে অন্যকারোর না।কিন্তু তোকে দেখে মনে হচ্ছে অন্যকিছু।আচ্ছা!সেসব কথা বাদ দিলাম,একটু দেখা করবি ছেলের সাথে?ছেলের চাচতো ভাইয়ের বউয়ের সাথে আমার কথা হয়েছিলো ছেলেও নাকি রাজি হয়েছিলো দেখা করার জন্য।আমার মনে হয় কি একবার দেখে আসা উচিত তোর।একটু সময়ও কাটানো হবে তোদের।’

নিরু ফোঁস করে উঠলো।গম্ভীর গলায় বললো,

‘আপা!আমার কিছুই ভালো লাগছে না।পারলে ছেলে কে আমার একটা ছবি পাঠিয়ে দাও।আর ছেলের মা বাবা তো আমাকে দেখেছেই।তাদের তো পছন্দই হয়েছে।’

‘সব তো আর তোর কথা মতো হবে না নিরু।তবে এতো জেদ মোটেও ভালো না।’

মুমু রাগ নিয়েই নিরুর রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।আশপাশ থেকে হাউকাউ এর আওয়াজ আসছে।এতে যেনো মুমুর মাথা আরো ধরেছে।

অন্যদিকে,
ভাবিদের জোরাজুরিতে পাত্রীর সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছিলো আফজাল।কিন্তু একটু আগে যখন শুনলো পাত্রী কিছু সমস্যার জন্য দেখা করতে পারবে না।এতে অবশ্য আফজালের কোনো ভাবান্তর নেই।এই বেকার ছেলের কাছে যে,কোনো মেয়ের পরিবার মেয়ে দিতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক।আর মা-বাবার তো মেয়ে পছন্দই হয়েছে।অনেক প্রশংসাও করেছে বটে।একটু আগে ভাবিদের মুখে মেয়ের ছবি নিয়েও কথা শুনেছে,সেদিকেও কোনো পাত্তা দেয় নি আফজাল।সে শুধু বিয়ে করে দেখিয়ে দিতে চায় নিরুকে।নিরুর কথা মনে পড়তেই ভিতর থেকে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
🍁🍂
দুপুর বারোটা বাজতে আর বেশিক্ষণ সময় নেই।সোফার রুম থেকে অনেক আওয়াজ ভেসে আসছে।নিরুর কাজিন রা সাউন্ড বক্সে গান ছেড়েছে তাও আবার অনেক আগের একগান।নিরুর রাগে,দুঃখে এবার কান্না আসার উপক্রম।বন্যা আর মুমু মিলে নিরুকে সাজাচ্ছে।শাড়ির আঁচল ঠিক করছে মুমু।আর বন্যা কুচিগুলো এক এক করে ধরে ভাঁজ করে ঠিক করে দিচ্ছে।খয়েরী কাতান শাড়িতে নিরুকে বেশ মানিয়েছে।নিরুর চোখের পানি দেখে মুমু অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
‘কিরে কাঁদছিস কেনো নিরু।বিয়ে নিয়ে তো তুই অনেক এক্সাইটেড ছিলি,এমনকি তোর জেদের জন্যই তো এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে,আর এখন তুই কান্না করছিস।’

নিরু নাক টেনে টেনে বললো,
‘বিয়ে হওয়ার জন্য কান্না করছি না আপা,দেখো কি আগের পুরোনো এক গান ছেড়ে দিয়েছে আমার বিয়েতে।রাস্তা দিয়ে মানুষ গেলেও তো বলবে এখনকার বিয়েতে বুঝি এইসব গান বাজায়।’

মুমু কপাল চাপড়ে বন্যার উদ্দেশ্য বললো,
‘বন্যা বাকিটা তুই রেডি করে দে।এখানে থাকলে আমার মাথা গরম হয়ে যাবে।নিরুর এতো অধঃপতন হবে তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি।’

মুমু চলে যেতেই নিরু অসহায় চোখে তাকালো বন্যার দিকে।বন্যা নিরুকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করেই শাড়ি টা ঠিক করে দিতে লাগলো।

অন্যমনষ্ক হয়েই পাত্রীর বাড়িতে বর সেজে উপস্থিত হলো আফজাল।শেষমুহুর্তে এসে মনে হচ্ছে জেদ করে বিয়ে করতে আসাটা একদম ঠিক হয় নি।একটু পর পর নিরুর কথা মনে পড়ছে।একটা ভুল বুঝাবুঝি ধরে রেখে আজকে কই এসে দাঁড়ালো তারা।আফজাল ক্ষণে ক্ষণে শুধু বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে।একটু পরেই কাজী আসবেন।আর মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই আফজাল অন্য কারোর হয়ে যাবে,নিরুকে যে জায়গায় টাতে কল্পনা করতো আজকে সে জায়গায় অন্যকাউকে দেখবে।ভাবতেই আফজালের বুকটা হু হু করে উঠলো।

বর আসার খবর শুনতেই নিরুর বুকটা অজান্তেই কেঁপে উঠলো।এখন মনে হচ্ছে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আফজালের কাছে ছুটে যেতে।কিন্তু এখন এইসব ভাবা মানে অন্যায়।দু’পরিবারের অসম্মান সে হতে দিতে চায় না।ঠোঁট কামড়ে শুধু নিজের কান্নাটাকে দমিয়ে রেখেছে।
————–
পাত্রের নামের জায়গায় আফজাল নামটি শুনে নিরু আর বন্যা একবার চোখাচোখি করে নিলো।নিরুকে এবার পায় কে,কান্না যেনো দমকা হাওয়ার মতো ছুটে বেরিয়ে আসলো।মনে মনে আওড়াতে লাগলো,
‘এক আফজাল কে শাস্তি দিতে গিয়ে আরেক আফজাল এই আমার কপালে জুটলো।’
কিন্তু বোকা নিরু,এটাই বুঝলো না এই আফজাল সেই আফজাল এই।আর অন্যকেউ না।
নিরুর কান্না দেখে মুমুরও কান্না পেলো।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘বলে দে নিরু কবুল।আর কান্না করিস না।’
নিরু অনেকক্ষণ সময় নিয়ে তিন কবুল বলে দিলো।কিন্তু কান্না যেনো থামলোই না বরং গতি যেনো আরো একটু বেড়ে গেলো।

একপর্যায়ে বর-কনে কে একসাথে বসানো হলো।নিরুর মাথায় বড় করেই ঘোমটা দেওয়া।আর আফজাল মাথা নিচু করে রেখেছে।তার কিছুই ভালো লাগছে না।মুমু মিষ্টি হেসে আফজাল কে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘আফজাল খারাপ লাগছে তোমার।তোমাকে কি রুম দেখিয়ে দিবো একটু বিশ্রামের জন্য।’

আফজাল মাথা নিচু করেই বললো,
‘না না আমি ঠিক আছি।আমার খারাপ লাগছে না।’

নিরু এবার চট করে ঘোমটা তোলে তাকালো আফজালের দিকে।এতোক্ষণ খারাপ লাগাটা থাকলেও নিরু এবার অবাক হয়ে তাকালো পাশে বসা আফজালের দিকে।আফজাল কে দেখে একপ্রকার চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
‘তুমি এখানে?’

আফজাল নিরুকে দেখে হকচকিয়ে উঠলো।বউয়ের জায়গায় নিরুকে দেখে সেও অবাক হলো।অবাক হয়েই নিরুর দিকে তাকিয়ে রইলো।আর এদিকে মুমু নিরুর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এসব কি বলছিস নিরু।চুপ করে বস।নতুন বউ হয়ে এভাবে চিল্লাপাল্লা করছিস কেনো?’

‘আপা আমি এই বিয়ে মানি না।এই অ’প’দা’র্থ কে আমি কিছুতেই জামাই হিসেবে মানতে পারবো না।’

নিরুর কথা শোনে উপস্থিত সবাই অবাক হলো।মুমু নিরুর হাত টা চেপে ধরে বললো,
‘নিরু মাথাটা আসলেই গেছে তোর।বিয়ে করে এখন বলছিস এই বিয়ে মানিস না।’

নিরু মুমুর কথা অগ্রাহ্য করে সেখান থেকে উঠে চলে আসলো।আফজাল এতোক্ষণ চুপ করে বসে থেকে সবকিছু মিলিয়ে নিলো।মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি।দু’জনের জেদ আজকে দু’জনকে কাছে নিয়ে এসেছে।আফজাল বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।মুমুর দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে আস্বস্ত করে বললো,’আমি দেখছি।’আফজাল আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না।নিরুর পিছু পিছু সেও পা চালালো।আর এদিকে মুমুর কিছুই বোধগম্য হলো না!

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here