#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি
১১+১২
–’হাসান ভাইয়ের বউকে দেখেছিস?’
নদীর পাড়ের কচি ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই বলল তমা। কন্ঠটা কেমন শোনালো। হয়তো কান্নাটা চেপে রেখে স্বাভাবিক থাকার প্রচেষ্টা করছে মেয়েটা। ইচ্ছের পা থেমে গেলো। অবাক হয়ে জানতে চাইলো-
–’হাসান ভাই বিয়ে করেছে?’
তমা যেন একটু হাসলো। সে হাসিতে রয়েছে না পাওয়ার চাপা আর্তনাদ। মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল,
–’না করার কোনো কারণ আছে বুঝি?’
ইচ্ছে কি উত্তর দিবে খুঁজে পেল না। তমা আবার বলে উঠলো,
–’জানিস হাসান ভাইয়ের বউটা ভারী মিষ্টি দেখতে। খুব মানায় দুজনকে। মেইড ফর ইচ আদার টাইপের।’
ইচ্ছে প্রশ্ন করলো-
–’তুই দেখেছিস?’
–’হ্যা। দূর থেকে দেখেছিলাম। কাছে যেয়ে উপহাসের শিকার হওয়ার সাহস ছিলনা। হাসান ভাইকে বেশ খুশি লাগছিল। মানুষটা তবে নিজের হ্যাপিনেস খুঁজে নিয়েছে।’
ইচ্ছ দেখলো তমার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। কিন্তু মুখে তার হাসি। নিজে কষ্ট পেলেও ভালোবাসার মানুষটা সুখে আছে ভেবেই খুশি মেয়েটা। ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়? ইচ্ছের মনে হলো পৃথিবীতে পুরুষ জাতিটা কেবল তাদের মতো মেয়েদের ভেঙে চুরমার করে দিতেই এসেছে। ইহান আর হাসান তার জলন্ত প্রমাণ। ইহানের কথা মনে হতেই বুক ভারী হয়ে এলো। কিভাবে পারলো মানুষটা তার অনুভূতির সাথে এমন নোংরা খেলা খেলতে?
______________
সকাল দশটা। বেলা উঠেছে। সূর্য তার রঙিন শিখায় তপ্ত করে তুলেছে প্রকৃতিকে। ইচ্ছে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ী পড়ে লাগেজ হাতে নিচে নেমে এলো। নাহার বেল খুশি। মেয়ের তবে সুমতি হলো। এভাবে বাপের বাড়িতে পড়ে থাকলে গ্রামের মানুষ ছেড়ে কথা বলতো না। হয়তো চরিত্র নিয়েও কথা তুলতো। শশুর বাড়ি ছেড়ে মেয়ে দিনের-পর-দিন বাপের বাড়িতে পড়ে আছে ব্যাপারটা গ্রামের কেউই সহজ ভাবে নিত না। ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিতেও বেশ বেগ পেতে হতো। এছাড়া পুরুষ মানুষ দুইটা বিয়ে করতেই পারে। তাই বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে কেন আসতে হবে? অবশেষে মেয়েটা ফিরে যেতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক।
নাহার বেগম খুশি খুশি দুটো কাঁথা ইচ্ছের হাতে দিয়ে বললেন,
–’এ দুটো তোর শাশুড়িকে দিস খনে। শহরের দিকে তো এমন হাতে করা কাঁথা পাওয়া যায় না। খুশি হবে।’
ইচ্ছেও অল্প হেসে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। মোশতাক মোড়ল মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছেন। আজ সে মেয়ের চোখে চোখ রাখতে পারছেন না। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগলো। বাবা হয়ে মেয়ের মাথার আশ্রয় খুঁজে দিতে ব্যার্থ তিনি। আজ শেষ আশ্রয় হিসেবে মেয়েটা তার কাছে এসেছিল কিন্তু সে সেটাও দিতে পারলো না। ফিরে যেতে হচ্ছে মেয়েটাকে। সে চাইলেও আটকাতে পারছে না। ছোট আরো একটা মেয়ে আছে যে! এক মেয়ের জন্য অন্য এক মেয়ের ভবিষ্যত তিনি কিভাবে নষ্ট করবেন?
ইচ্ছে এগোলো। বাবখর দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ হেসে বললো,
–’আসছি। নিজের খেয়াল রেখো।’
আর কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে গেল ইচ্ছে। গলা থেকে কথা বের হতে চাইছে না যেন। কান্না গুলোকে দমিয়ে রেখে শেষ বারের মতো বাড়িটার দিকে তাকালো। এখানে হয়তো আর কখনোই ফিরে আসা হবে না। এখানে আসার কোনো কারণ তার কাছে আর নেই। সময়ের সাথে সাথে সব বিলিন হয়ে গেছে। নয়তো তার বাবা কি আজ এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো? বিয়ের সাথে সাথে এ পরিবার থেকে তার অধিকারটাও বোধহয় দমকা হাওয়ায় বিলিন হয়ে গেছে। কি কঠিন নারীর জীবন!
মোশতাক মোড়ল শক্ত হয়ে একইভাবে সোফায় বসে আছেন। চোখে মুখে তীব্র অনুতাপবোধ। মেয়েটা যাওয়ার সময় তাকে বাবা বলে সম্বোধন করলোনা যে! সে কি তবে এই শেষ বয়সে সন্তানের কাছে ঘৃণার পাত্র হলো! মেয়েটা তাকে বাবা বলে ডাকতে চায়না তবে! আর ভাবতে পারলো না তিনি। বুকের বাঁ পাশটায় কেমন যন্ত্রণা অনুভব করলো। এক হাত বুকে চেপে ধীর পায়ে নিজ রুমের দিকে চলল। মেয়ের প্রতি করা এই অন্যায় বুঝি সৃষ্টিকর্তা ও মানতে নারাজ।
________________
একসময় এক চঞ্চল কিশোরীর খিলখিল হাসির শব্দে যে বাড়িটি মেতে থাকতো আজ সে বাড়ি শ্মশানপুড়িতে পরিণত হয়েছে। নিস্তব্ধ নিশ্চুপ এক ছাড়াবাড়ি। এখানে থাকা মানুষগুলোও যেন কোনো যন্ত্র চালিতো রোবট। এখানে যে যার মতো চলছে খাচ্ছে প্রয়োজন না হলে কেউ কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলেনা। বাড়িটা যেন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। যেখানে পূর্ণতার আলো পৌছাতে পারেনা।
সদর গেট পেরিয়ে একবার বাড়িটার দিকে পিছু ফিরে তাকালো ইরা। কোনো কারণ ছাড়াই হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। এইতো গতকাল সে এসেছিল কিছুদিন থাকবে বলে কিন্তু সকাল হতেই সব জিনিস পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পরেছে। এ বাড়িতে তার দম বন্ধ লাগছে্য। এ বাড়ির বিষাক্ত বাতাসে সে শ্বাস নিতে পারে না। এছাড়াও মা আর ভাইয়ের যুদ্ধে সে থাকতে চায়নি। চট্টগ্রামে থেকে নাইমা বেগমের কল এসেছিল। সে তার ছেলে নুহাশের জন্য ইরার হাত আবদার করেছেন। ননদের সাথে শারমিন বেগমের খুব ভালো সম্পর্ক। তাছাড়া নুহাশ ও দেখতে শুনতে ভালো। ভালো চাকরি করে সব মিলিয়ে না করার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া মেয়ের ও বিয়ের বয়স হয়েছে। তাই সে নাজমুল সাহেবর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন ইরার মত থাকলে তারা আর আপত্তি করবেনা। কিন্তু এ কথাটা ইহানের কানে যেতেই শুরু হলো তুফান। সে কিছুতেই তার বোনকে নুহাশের সাথে বিয়ে দিবে না। কারণ জানতে চাইলেও সে এড়িয়ে গেছে বারবার। একসময় পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ভাসটা তুলে সজোরে ছুড়ে মারে। তীব্র শব্দ তুলে কয়েকখন্ড হয়ে যায় ভাসটি। ছেলেকে এতটা রাগতে আগে কখনো দেখিনি শারমিন বেগম। কিন্তু পরক্ষনেই তিনিও জেদ ধরেছেন। তিনি তার মেয়েকে নুহাশের কাছেই বিয়ে দিবেন। নুহাশ নিঃসন্দেহে একজন সুপুরুষ। এতকিছুর মাঝে নাজমুল সাহেব নিরবতা পালন করেছেন। একমনে পেপারে চোখ বুলিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু পড়ছেন যেন। তার পাশে চলা ঝড় যেন তাকে ছুঁতে পারলো না। ইহান রাগ করে সরাসরি ইরার ঘরে পৌঁছালো। ইরা তখন দরজা বন্ধ করে বিছানায় এক কোণে চুপটি করে বসে বাহিরের সকল কথা শুনছিল। চোখ দুটো তার অশ্রুতে পরিপূর্ণ। পরিবারের এমন বেহাল অবস্থা তাকে ভেতর থেকে পিষে ফেলছে যেন। আগের কাটানো দিনগুলো কতইনা রঙিন ছিল! সুন্দর হাসিখুশি একটা পারফেক্ট পরিবার।
হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত হতেই ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে ইরা। দু হাতে চোখের পানি মুছে একটু স্বভাবিক হয়ে দরজা খুলে দিল। ইহান দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলা মাত্র হুরমুরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
–’তোর কোনো পছন্দের ছেলে আছে?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নে বিস্ময় নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো ইরা। ইহান নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার প্রশ্নের অপেক্ষা করছে। কৌতূহল থাকলেও সেটা দমিয়ে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইঙ্গিত বুঝালো। ইহান যেন এবার একটু নরম হলো। কোমল কন্ঠে বলল,
–’কোনো পছন্দ থাকলে বলতে পারিস। আমি তোকে তোর পছন্দের ছেলের হাতেই তুলে দিব।’
ইরা আরষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো। এই টপিকটা তার ভালো লাগছে না। কোনো রকম মিথ্যা হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলল,
–’তেমন কিছু না ভাইয়া। আমি তোমাদের পছন্দতেই বিয়ে করবো।’
ইহানকে চিন্তিত দেখালো। কিছু একটা ভেবে বলল,
–’নুহাশ ভালো ছেলে না। ওর সাথে কখনো সুখী হতে পারবি না। আমি ওর মতো ছেলের হাতে কিছুতেই তোকে তুলে দিতে পারবো না। এই বিয়েতে কিছুতেই তুই মত দিবিনা। তোর জন্য রাজকুমার খুঁজে আনবো আমি। প্রমিস!’
ইরার চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। বা হাতে চোখের পানিটুকু মুছে মিষ্টি হেসে ভাইয়ের পানে তাকালো।
–’আজ যদি ইচ্ছের কোনো ভাই থাকতো তবে সেও হয়তো কখনোই তোমার সাথে ওর বিয়ে হতে দিত না। মেয়েটার দুর্ভাগ্য যে সে আমার ভাইয়ের মতো কোনো ভাই পায়নি।’
বোনের বলা কথার ইঙ্গিত বুঝতে কষ্ট হলোনা ইহানের। কথাগুলো তীরের ন্যায় বুকে বিঁধেছে। জখম হয়েছে কতটা তা কি কেউ জানে? হয়তো রক্তও ঝড়ছে কিন্তু সেটা দেখার ক্ষমতা কজন রাখে? যে এই জখমে মলম লাগাতে পাড়তো তাকেই তো সে হারিয়ে বসে আছে। হঠাৎ করেই তার মনে একটা প্রশ্নের উদয় হলো। তার নেয়া পদক্ষেপটা কি তবে ভুল ছিল??
চলবে……….
#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি
১২.
বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা করে চৌধুরী বাড়ির সামনে নামলো ইচ্ছে। হাতব্যাগ থেকে ভাড়ার টাকা বের করতে যেয়ে খেয়াল হলো তার কাছে খুচরা টাকা নেই। এখানে ভাড়া বিশ টাকা। রিকশাওয়ালা একশত টাকা খুচরা দিতে পারবেন না। অগত্যা পুরো টাকাটাই দিয়ে দিল সে। এমাসের হাতখরচের আর কয়েকটা টাকাই অবশিষ্ট আছে মাত্র। তপ্ত শ্বাস ফেলে ছোট্ট ট্রলিটা টেনে বাড়ির ভেতরে পা রাখলো। দারোয়ানকে দেখতে পেল না কোথাও। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে গেলো বাড়ির দরজার সামনে। বেল চাপতে যেয়ে কেমন অস্বস্তি বোধ হলো। কেমন একটা আড়ষ্ঠ ভাব তাকে জেকে ধরেছে। এ বাড়িতে দ্বিতীয়বার পা রাখার ইচ্ছা তার ছিলনা। কিন্তু তাকে কিছুদিন এখানে থেকেই নিজের পরবর্তি পরিকল্পনা গুছিয়ে নিতে হবে। এসব নানাবিধ ভাবতে ভাবতেই সে ডোরবেল চাপলো। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও যখন কেউ দরজা খুলল না তখন আবার ডোরবেল চাপতে যেতেই কেউ দরজা খুলে দিল। হঠাৎ এভাবে দরজা খুলে যাওয়ায় ইচ্ছে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে নিজেকে সামলে সামনে তাকাতেই দেখলো রুশা দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছেকে দেখে সে খুশি বা রাগ করলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে ইচ্ছে খুশি হতে পারলো না রুশাকে দেখে। এমন একটা মানুষ যে তার থেকে তার প্রাণটাই কেড়ে নিয়েছে তাকে দেখলে খুশি কিভাবে হতে পারে? ইচ্ছে কোন প্রকার কথা ছাড়াই পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
________________
ইচ্ছে ফিরে আসায় শারমিন বেগম বেশ খুশি হয়। এতদিন বাদে নাজমুল সাহেব ও হাসি মুখে কারো সাথে কথা বললেন। শারমিন বেগম রান্নার জন্য তরকারি কাটছিলেন তখনই রুশার বাচ্চা কেঁদে উঠে। তা শুনে শারমিন বেগম ইচ্ছেকে তরকারি কাটতে বলে নিজে এগিয়ে যান বাচ্চাকে সামলাতে। তা দেখে ইচ্ছে কষ্ট লুকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। রুশাকে পছন্দ না করলেও বাচ্চার প্রতি যে শারমিন বেগম বেশ পজেসিভ তা বুঝতে বাকি রইল না। অবশ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার একমাত্র ছেলের একমাত্র সন্তান বলে কথা!
এরপরের দিনগুলো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার জন্য। কারণ অবশ্যই ইহান। ইহান বারবার তার সাথে কথা বলার জন্য আগে পিছে লেগে ছিল। ইচ্ছেও খুব কৌশলে তাকে এড়িয়ে গেছে। যদিও এক বাড়িতে থেকে ইহানের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখাটা সহজ ছিল না। ইহান অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে সেই সুযোগে ইচ্ছে তার প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র রেডি করার জন্য বেরিয়ে পড়তো। ইহানকে এ ব্যাপারে কিছু বুঝতে দিলে চলতো না। ইচ্ছের এটা ভাবতেই হাসি পায় যে একসময় যে মানুষটার সাথে থাকার জন্য হাজার বায়না বানাতো আজ তার থেকে নিজেকে লুকাতে হাজার প্রচেষ্টা!
ইচ্ছে রোজ সকালে বারান্দায় লুকিয়ে ইহানকে দেখে। ইহান যখন পাঞ্জাবি গায়ে মাথায় টুপি পড়ে মসজিদ থেকে ফেরে তখন তাকে ভিষণ পবিত্র লাগে। মুখের দাড়ি গুলো একটু বড় হওয়ায় চেহারায় অন্যরকম জৌলুস এসেছে। অল্পদিনেই বয়সটা কেমন বেড়ে গেছে বোধহয়। কিন্তু তবুও সৌন্দর্যে বিন্দুমাত্র কমতি নেই। বরং আগের থেকেও বেশ আকর্ষণীয় লাগে। ইচ্ছের খুব ইচ্ছা হয় আলতো হাতে মুখ ভরা দাড়ি গুলো একটু ছুঁয়ে আদর করে দিতে। বুকে মাথা রেখে রাত জেগে নিকষ কালো আঁধারে ঘেরা আকাশের বুকে জ্বলতে থাকা তারা দেখতে। হাজার রঙিন স্বপ্ন দেখতে। কিন্তু এগুলো কেবল ইচ্ছা পর্যন্তই সিমাবদ্ধ। বাস্তবায়ন যে আর সম্ভব নয়।
_______________
ঘড়িতে সময় রাত দুইটা। নিশ্চুপ পরিবেশকে এক গুনগুন শব্দ ভারী করে তুলছে। চাপা কান্নায় বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে ইচ্ছের শরীর। কান্নাগুলো শব্দ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। নিজেকে আটকে রাখতে চাইলেও পরমুহূর্তেই ভেঙে পড়লো ইচ্ছে। শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে। এতদিন জমিয়ে রাখা কষ্ট গুলো অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়তে লাগলো। সেও তো রক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষ। কিভাবে সহ্য করবে এত আঘাত? কষ্ট তো তারও হয়। সে যত ই নিজেকে শক্ত করে রাখতে চায় ততটাই ভেঙে পড়ে। রাতের এই অন্ধকার তার শক্ত ব্যক্তিত্বের মাঝে লুকিয়ে থাকা এই কোমল ইচ্ছেকে বের করে আনে। হাতের কাঁটা স্থান থেকে এখনো রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় বেরিয়ে আসছে। এর থেকেও অনেক বড়ো আঘাত সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার আছে। তবে আজ এই অল্প আঘাতে কেন এত কান্না? ইচ্ছে নিজেও বুঝলো এই হাত কাঁটাতো কেবল অজুহাত মাত্র কান্নার কারণতো অন্যকিছু।
দরজার বাইরে থেকে তার এই কান্নার শব্দ অন্য একজন নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছিলো। তার কি করা উচিত এই মুহূর্তে সেটা সে জানে না। ভেতরে যেতে চেয়েও পারলোনা সে। কোন একটা অদৃশ্য দেয়াল বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের মাঝে। রমনীর এত দুঃখের কারণ তো সে নিজেই। এক সময় নিজের জন্য যার মুখে আনন্দের জোয়ার ছিল আজ তারই জন্যে সেই মানুষটার চোখে অশ্রু ঝরে। দগ্ধ হৃদয় নিয়ে রুমে ফিরে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল ইহান। যেন তার সকল রাগ দরজার ওপর থেকেই কাটাতে চাইছে। হতাশ হয়ে বারান্দায় ফ্লোরে বসে দূর আকাশ পানে তাকালো। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো,”আমি কি ক্ষমার যোগ্য?”
________________
বিগত এক সপ্তাহ ধরে ইচ্ছের একটা চুলের দেখাও মিলছে না ইহানের। তার অনেক কিছুই বলার আছে মেয়েটাকে কিন্তু মেয়েটা যে তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা বারের জন্যও কি মেয়েটা তার উপর করুণা করতে পারেনা? সে যতটা অনুতপ্ত হয়ে আকুতি করছে ইচ্ছের কাছে এই আকুতিটা কোনো পাহাড়ের সামনে বসে করলে হয়তো পাহার গলে নদীতে পরিণত হতো। ইহানের আজকাল কিছুই ভালো লাগেনা। মেজাজ আগের তুলনায় অধিক খিটখিটে হয়ে গেছে। ইচ্ছের প্রতি অভিমান গুলো রাগে পরিণত হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেয়েটাকে সামনে পেলে কষিয়ে একটা থাপ্পর দিবে এমন অভদ্রতার জন্য। শাসনের অভাবে এমন অবাধ্য হয়ে উঠেছে।
রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিয়ে শান্তিতে চোখ বুজে শ্বাস নিলো ইচ্ছে। আজ সকল কিছু থেকে মুক্তি নেওয়ার দিন। সকল খারাপ স্মৃতি থেকে মুক্তি নিয়ে এক নতুন অধ্যায় শুরু করার সময় চলে এসেছে। বারান্দায় থাকা লাল গোলাপের গাছটায় আলতো করে হাত ছোয়ালো ইচ্ছে। কাঁটা বিধলো। সামান্য রক্ত ও বের হলো। ইচ্ছে সেদিকে নজর দিল না। তার মনে পড়লো এই গোলাপ গাছটা ইহান তাকে বার্থদে গিফট দিয়েছিল। তখন গাছটা বেশ ছোট ছিল। কোনো ফুল ছিল না তাতে। ইচ্ছে ইহানের এমন গিফ্টে খুশি হলো না। সে ইহানের থেকে একতোড়া গোলাপ আশা করেছিল রোমান্টিক কাপলদের মতো। ইহান বুঝতে পেরে ইচ্ছেকে একটা সফট হাগ করে বলেছিল,
–’একতোড়া গোলাপ তো আজ বাদে কাল ই নষ্ট হতে শুরু করবে কিন্তু এই গাছটার যত্ন নিলে সে বছর পর বছর তোমায় ফুল দিবে। আমি তোমায় এক তোড়া না এক জীবন পরিমাণ গোলাপ উপহার দিলাম। খুশি নও তুমি?’
ইচ্ছের মোন খারাপ তখনই শেষ। এরপর থেকে বিশেষ যত্ন নিয়ে আগলে রেখেছে এই গাছটা ইচ্ছে। যখন ফুল ফোটে তখন একরাশ ভালোলাগা তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু তার সাথে সাথে এখন এ গাছটাও মরে গেছে। ভালোবাসা নেই বলেই হয়তো!
চলবে…..
(