আমার গল্পে আমি খলনায়িকা পর্ব -০৮

#আমার_গল্পে_আমি_খলনায়িকা
পর্ব—০৮

আমার কাছে এবার সবটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যেতে লাগলো,এই মেয়েটা আমার থেকেও বড়ো খেলোয়াড়!আর প্রত্যয়ও কম যায় না।এরা দুজন মিলে এতোদিন আমার সাথে কি ড্রামাটাই না করেছে,অথচ আমি কিচ্ছু বুঝতে পারিনি।তার মানে প্রত্যয়ের সমস্ত কুকর্মর সাথে রোদেলা জড়িত,কিন্তু ওর এসবের পেছনে উদ্দেশ্যটা কি?
আমি চুপ করে থাকাতে রোদেলা কলটা কেটে দিলো।ও বোধহয় কিছু একটা সন্দেহ করেছে।এদিকে প্রত্যয়েরও আসার সময় হয়ে গিয়েছে।প্রত্যয় যখন রোদেলার থেকে জানতে পারবে কেউ ফোন রিসিভ করেছিলো তখন আমাকেই সন্দেহ করবে।কিন্তু আমি যে কিছুতেই সেটা হতে দিতে পারি না।বুদ্ধি করে ফোনে অটো রিসিভ অপশনটা চালু করে দিলাম।প্রত্যয় গোসল সেরে রুমে ঢুকতেই আমি ওকে ডেকে বললাম।

—কেউ হয়তো কল দিয়েছিলো তোমায়,আমি এসে দেখি রিসিভ হয়ে আছে।

—রিসিভ হয়ে আছে মানে,কে রিসিভ করলো?

—আমি কি জানি,যা দেখলাম তাই বলছি তোমায়।আমি ফোনটা তুলতে তাবো অমনি কেটে গেলো।

—কিন্তু আমি তো রুমে ছিলাম না,কলটা রিসিভ করলো কে?

—দেখো তো,অটো রিসিভ অপশন চালু হয়ে যায়নি তো আবার,আবার ফোনেও হয়েছিলো সেদিন।

—হ্যাঁ,সেটা হতে পারে।

প্রত্যয় ফোন চেক করে দেখলো আমি যা বলেছি তাই সত্যি।ও আর সন্দেহ করলো না আমায়,আমি আগেই ফোনকলের বিষয়টা জানিয়ে রাখলাম,কারন আমি চাই না ও এক মূহুর্তের জন্য হলেও সন্দেহ করুক আমায়।

—কি হলো,পেলে কিছু?

—তুমিই ঠিক বলেছো,অটো রিসিভ অপশন চালু হয়ে আছে।

—জানতাম।

—শোনো,আমার খাবার দাও।একটু বেরোতে হবে।

আমি প্রত্যয়ের জন্য খাবার রেডি করতে গেলাম।যাওয়ার আগে একবার পিছু ফিরে তাকালাম প্রত্যয়ের দিকে,দেখলাম ও মোবাইলের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে।আমার দিকে তাকাতেই আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।এখন কেবল একটাই কাজ আমার এই রোদেলাকে এক্সপোস করা।ও ভেবেছে আমার সাথে দিনের পর দিন মিথ্যে নাটক করে যাবে,আর আমি কিছু বুঝতেই পারবো না।এবার যেকরেই হোক ওকে নিজের জালে ফাঁসাতে হবে,এরপর এমন ব্যবস্থা করবো সবটা গড়গড় করে বলে দিতে বাধ্য হবে।একবার হাতের নাগালে পাই ওকে,জাস্ট সেই সময়টুকুর অপেক্ষা।তবে এর থেকেও কঠিনতর প্রশ্ন আমার সামনে,আর সেটা হলো নকল প্রত্যয়ের আসল পরিচয়।ও আসলে কে?প্রত্যয়কে কেনো খু ন করে নিজে সেই জায়গাটা নিলো?কি চায় ও?প্রত্যয়ের সাথে যদি ওর কোনো সম্পর্ক নাই থেকে থাকে তবে দুজনের চেহারা কথাবার্তায় এতো মিল হয় কিকরে?প্রত্যয়ের কোনো জমজ ভাই ছিলো বলে তো জানা নেই আমার,এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মা’ই দিতে পারে আমায়।আমি আর সময় নষ্ট না করে তার কাছে গেলাম।





মা আর আমি ঘরের বেলকনিতে বসে আছি।আমি আমার হাতটা মায়ের হাতের ওপরে রাখলাম।

—আজ আপনায় আরেকটু বিব্রত করবো মা,জানি সেদিন আপনাকে প্রশ্নগুলো করাতে আপনি ভীষণ অবাক হয়েছেন।আজ হয়তো আরোও বেশী অবাক হবেন,

—আচ্ছা বৌমা তুমি লুকিয়ে গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করছো না তো,আজকাল তোমায় বাড়ির বৌ কম পুলিশ বেশী মনে হয়।
(মা হেসে বললেন,আমি বুঝতে পারি সে ভালো মুডেই আছে।আজ হয়তো বিরক্ত হবে না)

—ঠিক আছে,কিছুসময়ের জন্য হলেও মনে করুন আপনি একজন ডিটেকটিভের সাথে কথা বলছেন।

—কি বলবে বলো?

—প্লিজ রাগ করবেন না,এই প্রশ্নটা হয়তো একটু বেশীই প্রাইভেট এবং সেনসিটিভ।তারপরেও আমার জানা খুব জরুরী?

—আচ্ছা বলো,সমস্যা নেই।

—আপনার কোনো জমজ সন্তান ছিলো নাকি মা,মানে প্রত্যয়ের কোনো জমজ ভাই?

আমার কথা শুনে মা বিরক্ত হবার পরিবর্তে হেসে উঠলো।তারপর বললেন

—মানেটা কি,আমার জমজ ছেলে আসবে কোথা থেকে?বৌমা তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে যায়নি তো,মানসিক ভাবে সুস্থ আছো তো?

—আমি সুস্থই আছি,তার মানে প্রত্যয়ের কোনো জমজ ছিলো না।

মায়ের হাসি দেখে বুঝতে পারছি আমার প্রশ্নটা কতোটা হাস্যকর লেগেছে তার কাছে।তার মানে সত্যিই প্রত্যয়ের কোনো জমজ নেই,একজন মা আর যাই হোক নিজের সন্তানকে নিয়ে এইভাবে মিথ্যে বলতে পারে না।মা মিথ্যে বললে আমি তার চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারতাম।তাছাড়া, যদি সত্যিই কোনো জমজ থাকতো প্রত্যয়ের মা হঠাৎ শোনামাত্র একটু হলেও চমকে উঠতো,বা অস্বাভাবিক আচরণ করতো।কারণ নিজের সন্তানের থেকে বড়ো দূর্বলতা একজন মায়ের কাছে আর কিছুই হতে পারে না।যাই হোক আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি।তাই আর কথা বাড়ালাম না তার সাথে,কিন্তু মা চুপ করে রইলো না।

—কি ভাবছো এতো,তোমার মনের ভেতর চলছেটা কি বলবে আমায়।সেদিন কি দাগ না কি নিয়ে পড়ে ছিলে,আজ আবার জমজ।

—কিছু না‌।আর আপনাকে তো বললাম সময় হলে সবটা বলবো।

এই বলে আমি বেলকনি থেকে বেরিয়ে গেলাম।ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবে সাহিল নামের আমার এক বন্ধু জব করে।ওর কাছে একটা কল দিলাম।

—হ্যালো সাহিল,কেমন আছিস রে?

—হুমমম ভালো,কি খবর,এতো দিন পরে?

—আমায় একটা হেল্প করতে পারবি ভাই,খুব দরকারি!

—বল কি হেল্প করতে হবে?

—দুটো স্যাম্পল পাঠাবো তোর কাছে,তোকে তার ডিএনএ টেস্ট করে দিতে হবে।

—কিসের ডিএনএ টেস্ট করতে চাইছিস তুই?কেউ কিছু জানে এই বিষয়ে?

—না জানে না,জানলে কি তোকে এইভাবে বলতাম?

—কিন্তু এইভাবে নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে ডিএনএ টেস্ট করা যায় না,সরকারের অনুমতি লাগে।কেউ জানতে পারলে আমার চাকরি চলে যাবে!

—আচ্ছা তুই যদি বেশী রিস্ক মনে করিস তাহলে বল আর কোথাও করা যাবে কি,যেখানে কোনো অনুমতি লাগে না।

—আমাদের দেশে সরকারের অনুমতি ছাড়া ডিএনএ টেস্ট করতে পারে শুধু সিআইডি।এখন তুই বল,কে রিস্ক নিয়ে তোকে করে দেবে এই কাজ?

—আমি এতো কিছু জানি না,তুই যেভাবে হোক ম্যানেজ করে দিবি।

—আমি পারবো না এই কাজ,এটা সম্পূর্ণ ইলিগ্যাল।

—তুই এখন আমায় লিগ্যাল,ইলিগ্যাল শেখাবি,যদি তাই মনে হয় আজ থেকে ভুলে যাবো সাহিল নামে কেউ ছিলো আমার লাইফে,স্বার্থপর কোথাকার,

—এখানে স্বার্থপরতার কি দেখলি,আমি নিয়মের বিরুদ্ধে কেনো কাজ করতে যাবো?

—এতো নিয়ম অনিয়মের তোয়াক্কা কবে থেকে করছিস আবার,তুই তো এতো সাধু ছিলি না কোনোদিন।সব মনে আছে এখনো আমার,

—আচ্ছা কাদের ডিএনএ টেস্ট করাবি সেটা তো বল।

—আমার স্বামী আর শ্বাশুড়ী মায়ের,আমি তোকে দুজনের স্যাম্পল পাঠিয়ে দেবো তুই আমাকে কাজটা করে দিবি।আমাদের বন্ধুত্বের কসম,ফেরাস না আমায়।

—আর নাটক করতে হবে না,পাঠিয়ে দে তোর স্যাম্পল।তবে হ্যাঁ,কেউ যেনো এই বিষয়ে কিচ্ছু জানতে না পারে।জানলে জেল ফাঁস হয়ে যাবে আমার।

—কেউ কিচ্ছু জানবে না।কথা দিলাম তোকে।যতো দ্রুত সম্ভব আমায় রেজাল্টটা জানাবি,খুব জরুরী কিন্তু।

আমার কথা শেষ হতেই সাহিল ফোনটা কেটে গেলো।যাক যেরকেই হোক ম্যানেজ তো করেছি ওকে।একবার প্রত্যয় আর মায়ের ডিএনএ টেস্টের ফলাফল হাতে আসুক তারপর ওর চাকরি গেলে যাক।অবশ্য তাতে আমিও ফাঁসবো।তাই যা করার খুব সাবধানে করতে হবে।মা মুখে যতোই যা বলুক না কেনো,একবার প্রমাণ আমার হাতে চলে আসলে আর কোনো দ্বিধা দন্দ্ব থাকবে না।এই ডিএনএ টেস্ট প্রমাণ করবে মা সত্যি বলছে না মিথ্যে বলছে।আর প্রত্যয়ের সাথে আসলেই এই পরিবারের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা।




রাতেই খুব সতর্কতার সাথে মায়ের ঘরে গিয়ে তার চিরুনী থেকে চুল সংগ্রহ করে আনি, তারপর প্রত্যয়ের চুল সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখে দেই।পরেরদিন সকালে স্যাম্পলগুলো আমার এক বিশ্বস্ত লোক মারফত ঢাকাতে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।এখন শুধু আমার অপেক্ষার পালা‌।এই ব্যপারটা কিছুটা সলভ হলেও,রোদেলাকে এক্সপোস করা এখনো বাকি আমার।আমি ভালো করেই জানি ওকে ধরলেই প্রত্যয় আর ওর সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবো,যা ওরা দুজন ছাড়া কেউ জানে না।আমি সুযোগ খুঁজতে থাকি কখন প্রত্যয়ের ফোনটা কিছু সময়ের জন্য হাতে পাওয়া যায়।ও যতোই ধূর্ত প্রকৃতির হোক না কেনো,এই একটাই দূর্বলতা বারবার আমার কাছে ওকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করেছে।আর সেটা হলো প্রত্যয় মোবাইলের ব্যপারে খুব উদাসীন।যখন খুশি যেখানে খুশি ফেলে রেখে যায়।যাই হোক,অনেক কষ্ট করে প্রত্যয়ের ফোনটা ম্যানেজ করি।তারপর রোদেলার নম্বরে একটা মেসেজ দিলাম।

“তোমার সাথে দেখা করাটা খুব জরুরী,দোয়েল কেনো জানি না আমার ফোনটা জব্দ করে রেখেছে।অনেক মেহনত করে একটু হাতে পেয়েছি।ভুলেও কল দিও না কিন্তু আমার নম্বরে।শুধু আজ বিকেল পাঁচটায় কলেজ রোডের পাশের পরিত্যক্ত স্কুলে দেখা করো আমার সাথে।”

ব্যস,মেসেজটা সেন্ড করে সাথে সাথে মুছে ফেললাম।আজ বিকেলে পরিত্যক্ত স্কুলে রোদেলা আসবে,তবে সেখানে প্রত্যয় থাকবে না।থাকবো আমি।আজকেই রোদেলার খেলা শেষ।একবার হাতেনাতে ধরি ওকে,আমার সাথে ড্রামা করার শাস্তি কতোটা ভয়ানক হতে পারে সারাজীবন মনে রাখবে।






বিকেলে,আমি গিয়ে কলেজ রোডের পরিত্যক্ত স্কুলে অপেক্ষা করতে থাকি।জানি এখানে আজ রোদেলা আসবে।একটু পরেই আমার ধারনাকে সঠিক প্রমাণ করে রোদেলা উপস্থিত হলো।আমি জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি।স্কুলে ঢুকে রোদেলা প্রত্যয়ের নাম ধরে ডাকতে লাগলো।কিন্তু কোনো সাড়া এলো না প্রত্যয়ের তরফ থেকে।কিকরেই বা আসবে?প্রত্যয় যে নেই এখানে।রোদেলা প্রত্যয়কে খুঁজতে খুঁজতে আমার রুমের সামনে চলে আসে।দরজা খুলতেই দেখতে পায় আমি ভেতরে বসে আছি।আমাকে উপস্থিত দেখে যেনো আকাশ থেকে পড়লো রোদেলা।বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো ও‌।

—ওয়েলকাম,মাই সিস্টার।কি হলো ভয় পেয়ে গেলে নাকি আমায় দেখে?

—একি দোয়েল আপু,তুমি তুমি এখানে?

—কেনো,তুমি কি অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি?

—এসব কি হচ্ছে….

—ঠিক সেটাই।এতোদিন ধরে তুমি যেটা করে আসছো আমার সাথে।কি ভেবেছিলে প্রত্যয় তোমাকে ডেকেছে দেখা করার জন্য..?

রোদেলার আমার কথা শুনে আরো বেশী ঘাবড়ে গেলো,ওর আর বুঝতে বাকি রইলো না এসব আমারই প্ল্যান!

চলবে……

লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here