#আমার_শহরে_রংধনু_উঠেনা
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–4
ফারাজের কাণ্ডে বর্ষা হতভম্ব হলেও, ফারাজের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর দেখা দিলো না। সে নিজ রুমের দিকে পা বাড়ালো। তাকে চলে যেতে দেখে বর্ষা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে রান্নাঘরের কাজ গুছিয়ে ফারাজের রুমের পাশের রুমটায় এসে দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিল। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে তার। সবকিছু বিরক্তিকর লাগছে। বিছানায় শুতেই চোখ লেগে এলো। গলায় সম্ভবত এক-দুই জায়গায় ছিলে গেছে। ফারাজ কেন তার কাছ থেকে চেইন নিল তা তার বোধগম্য হলো না, তবে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে।চোখ বন্ধ করার পর আস্তে আস্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে লাগে সে।
এদিকে ফারাজ রুমে এসেই তার এক ফ্রেন্ডকে কল করে বেশ উল্লাসের সঙ্গে বলে উঠে, টাকা ম্যানেজ করতে পারছি। তুই কালকেই নিয়ে আসিস। আমি পারতেছি না আর থাকতে ।
ফ্রেন্ডটা ওপাশ থেকে বলে উঠে, তুই টাকা কীভাবে পাইলি?তোর আব্বা না তোকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিসে?
ফারাজ বাঁকা হেসে বলে, ম্যানেজ করছি সামহাউ। তুই সময় নষ্ট না করে কালকে নিয়ে আসবি।
— তোর কিন্তু এক লাখের মতো ধার আছে। সাঞ্জু ভাই বলছে ধার শোধ না করলে জিনিস না দিতে।
— আরে দিয়ে দিব সব টাকা। আমার শুধু ঠিক জিনিস চাই। প্লিজ ম্যানেজ করে দে কালকের মধ্যে।
— তাহলে তো টাকা ডাবল লাগবে।
— ডাবল কেন লাগবে? আজব!
— তোর ধার শোধ না করা অব্দি ডাবল দিয়ে কিনতে হবে৷
— তুই জানিস না আমার প্রবলেম চলতেছে। আব্বা সব জাইনা গেছি। উনি আর এক টাকাও আমাকে দিচ্ছে না। হাত সম্পূর্ণ খালি। বাসায় কোন ক্যাশ নাই। ম্যানেজার আমার ফোন ধরেনা। আব্বার অফিসেও চারবার গেছি। এক পয়সাও আমাকে দেয় না৷ আর এখন তো বাবা বাসাতেও নাই যে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিব। প্লিজ এবার একটু ম্যানেজ কর। আগামীবার থেকে ডাবল পে করব।
তার বন্ধু ফোনের ওপাশ থেকে বলে, টাকা ম্যানেজ হলে ফোন দিস। এর আগে না৷ রাখি৷
মুখের উপর ফোন রাখাতে বেজায় চেতে উঠে ফারাজ। আজ হাত ফাঁকা জন্য মানুষের আসল রুপ বেরিয়ে আসছে। এরা-ই তার পিছে পিছে ঘুরত আর এখন টাকার জন্য ফোনেও ঠিকমতো কথা বলছে। কোন ফ্রেন্ডদের কাছেও টাকা ধার চাওয়া যাবে না। ওদের সবার কাছে দশ-বারো হাজার করে টাকা নিয়ে ফেরত দেয়নি। ফারাজ সোনার চেইনটা বের করলো। এখন একমাত্র সম্বল এই চেইনটা। এটা বেচে যা টাকা পাবে সেটা দিয়ে মিনিমাম তিনদিনের টা ম্যানেজ হবেই।
ফারাজ নিজের বিছানায় ধুম করে শুয়ে পড়লো। সবকিছুই পানসে লাগে তার। এই জীবনটাও ভালো লাগে না। জিনিস পেটে পড়লে জীবনটা দারুণ লাগে কিন্তু এই জিনিস যতোক্ষণে পাচ্ছে তার আগ পর্যন্ত মৃত্যুসম যন্ত্রণা লাগে।এখন এমন অনুভূতি হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নিজেই নিজেকে মেরে ফেলুক। শেষমেশ আরাম পাবে। এই আসক্তিটা এতো ভয়াবহ কেন? সবকিছুই তুচ্ছ লাগে। মাঝে মাঝে এই সমস্ত কিছু থেকে বের হয়ে আসতে মন চায়৷ কিন্তু এডিকশন পিছন ছাড়ে না৷ একটা নির্দিষ্ট সময় পর সেবন না করলে মাথা ঠিক থাকে না৷ তখন যেন-তেন করে হলেও ব্যবস্থা করা লাগে।
সে টিয়াকে ফোন লাগালো। এই মেয়েটা ভার্সিটির প্রথম থেকে তাকে নাকি পছন্দ করে।একই ইয়ারে পড়ে দুইজন। মেয়ের বাবা বিশাল বড় অফিসার। চারবার রিং হতেই টিয়া ফোন তুলে আহ্লাদী কণ্ঠে বলে, এতোক্ষণে ফোন দেওয়ার সময় হলো?
ফারাজ কোনকিছুরই তোয়াক্ক না করে বলে, টিয়া তুমি আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবা? আই সোয়ার কিছুদিন পর-ই ব্যাক করব।
টিয়া তার কথায় ভড়কে যায়। সে বিমূঢ় হয়ে গেল। আমতাআমতা করে বলে, কত লাগবে?
— লাখের কাছাকাছি।
— এতো!
— হুম। পারবে?
— পারব কিন্তু…..
— তোমার যদি বাসা থেকে আসতে সমস্যা হয় তাহলে এড্রেস দাও। আমি যাব তোমার বাসার দিকে।
টিয়া ঘাবড়ে গিয়ে বলে, না। না। তোমাকে আসতে হবে না। আমি দেখি কাল ট্রাই করব। এখন রাখি৷
— কালকে কখন আসবে? দুপুরে?
— বলতে পারছি না। আমি তোমাকে কল করে জানাব। আজ রাখি কেমন? টেক কেয়ার।
টিয়ার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে সে রুম থেকে বের হলো। বর্ষাকে দেখার জন্য বের হয়েছে সে।মেয়েটা কি করছে দেখা উচিত। ফুফুর কথা অনুযায়ী বিয়েটা করে ফেসে গেছে সে। ফুফু আর শিলা আপুর কাছে টাকা চাইতে লজ্জা লাগে তার। সে রুমের বাইরে পা বাড়ালো।
বর্ষা হলো তার বাবার ছোটকালের বন্ধুর মেয়ে। ফারাজের বাবা রুহুল আমীন এবং বর্ষার বাবা মতিউর রহমান একই স্কুল এব ভার্সিটিতে পড়তেন। তবে তাদের কলেজ আলাদা ছিলো। ভার্সিটির গ্রাজুয়েশন শেষ করে বর্ষার বাবা চাকরি পেলেও রুহুল আমীন কোন চাকরি পাচ্ছিলেন না। বেকার হয়ে ঘুরতেন। তখন ফারাজের মা চারমাসের প্রেগন্যান্ট। চাকরির খুব প্রয়োজন। টাকার দরকার। এমন সময় রুহুল আমীন সাহেবকে মতিউর রহমান মোটা অংকের টাকা ধার দেয় ব্যবসা করার জন্য। মতিউর রহমানের ধারকৃত টাকা নিয়ে সে ঢাকা শহরে চলে আসেন। সেই টাকা পুঁজি করে সে ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসায় সবুজ বাতি জ্বলে যায়। বর্তমানে সে কোটি টাকার মালিক। পুরান ঢাকায় তার চামড়ার ব্যবসা। বনানীতে দুইটা পেট্রোল পাম্পের স্টেশন। পরিবহন সমিতির সঙ্গে জড়িত। শাহবাগের দিকে মায়ের দোয়া নামে পাঁচটা লোকাল বাস চলে যার মালিক রুহুল আমীন। ফারাজ ক্লাস সেভেনে থাকতে তার মা মারা যায়। রুহুল আমীন দ্বিতীয় বিয়ে করেননি আর। সবই ঠিক চলছিল। ভার্সিটিতে ঢোকার পর ফারাজের বেশ কিছু নতুন ফ্রেন্ড হয়। যাদের মাধ্যমে সে মা-দ-কা-স-ক্ত হয়ে পড়ে।
ফারাজ রুম থেকে বের হয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে বর্ষার রুমের সামনে দাঁড়ালো।রুমের দরজা লাগানো। ঘড়ির কাঁটায় সোয়া বারোটা বাজে। সে দরজা ধাক্কিয়ে বলে, এই মেয়ে দরজা খুলো। কথা আছে।
মিনিট পাঁচেক পরও বর্ষা দরজা খুললো না। ফারাজ আবার ডাক দিতেই ভেতরে থেকে মৃদ্যু গোংরানির শব্দ ভেসে ওঠে। সে কিছুটা চমকে উঠে দরজা ধাক্কাতে লাগে। কিন্তু বর্ষা দরজা খুলছে না দেখে দৌঁড়ে গিয়ে চাবি নিয়ে আসলো। নক খুলতেই বর্ষাকে সে বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখে।ঘর অন্ধকার তবুও মেয়েলি অবয়ব দেখেই সে বর্ষাকে চিনে ফেলে। আচ্ছা ছায়া দেখলেই কি মানুষ চেনা যায়?ছায়া দেখে চিনে ফেলার মতো তো তাদের সম্পর্ক টা নয়! এতো গভীর তো নয় এই সম্পর্কটা! বরং খুবই নাজুক একটা সম্পর্ক!
ফারাজ ভ্রু কুচকে বলে, বর্ষা এনি প্রবলেম?
এবারে বর্ষা চোখ খুললো। তার চোখ টকটকে লাল। সে থেমে থেমে বললো, আমার জ্বর এসেছে৷
ফারাজ বিছানার একপাশে বসলো। এরপর তার কপালে হাত ছোয়ালো। সম্ভবত এই প্রথম ফারাজ বর্ষাকে স্বাভাবিকভাবে স্পর্শ করলো। বর্ষা কেঁপে উঠে। ফারাজ তার মুখের কাছে মুখ এনে বলে, তোমার তো অনেক জ্বর।
চোখ তুলে বর্ষা একবার তাকে দেখল। ফারাজ উদ্বিগ্ন মুখে চেয়ে আছে।
আচমকা বর্ষা অনুভব করলো তার গরম গালে শীতল পাঁচটা আঙুলের ছোয়া। সে চোখ বুজে ফেলে।
ফারাজ বলে উঠে, তোমার গাল তো অনেক নরম। ধরার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে ডেবে যাবে। তুলা খাও নাকি?
বর্ষা জ্বরের মধ্যেও ফিক করে হাসলো। তাকে হাসতে দেখে সে বিব্রতবোধ করলো। বর্ষা ফের চোখ খুলে ফারাজকে দেখল। আজকে তাকে নরমাল লাগছে। বাকি দিনগুলোতে তাকে দেখেই বোঝা যেত মা-তা-ল হয়ে আছে। দুইজনের চোখাচোখি হতেই বর্ষা মৃদু আওয়াজ তুলে বলে, আপনার কি জীবনটা উপভোগ করতে ইচ্ছা করেনা?
— তোমার কথা বুঝলাম না৷
— আপনার কি মনে হয় আমি অবুঝ! কিছু বুঝিনা। আপনি এডিকটেড৷ আপনার জীবন কিন্তু অন্ধকার। এই অন্ধকারে আমাকে কেন টেনে আনলেন?
বর্ষার এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। সে উশখুশ করে বলে, জ্বর হলে কি করতে হয়? জলপট্টি কীভাবে দেয়?
— আপনার সাহায্য করার দরকার নাই।
আচমকা ফারাজ তার পাশে শুয়ে পড়লো। বর্ষা হচকচিয়ে উঠে যেতে ধরলে, ফারাজ তার হাত ধরে টেনে শুইয়ে দিল। দুজনের মধ্যে নিরবতা ছেয়ে গেল। দুইজনই চুপ।কেবল নিশ্বাস ফেলবার শব্দ।
হুট করে ফারাজ তার কানের কাছে মুখ এনে বলে, বর্ষা তোমার কাছে কিছু ক্যাশ টাকা হবে?
ফারাজের কথা শুনে বর্ষার কিছু বলার মতো অবস্থায় থাকলো না। চোখ বেয়ে এক ফোটা পানি পড়লো। সে খুব ভালো করেই জানে ফারাজ কেন টাকা চাচ্ছে৷ এই টাকা দিয়ে কি কু-কী-র্তি করবে বুঝে গেছে সে। তাই মিথ্যা বললো, আমার কাছে টাকা নেই।
— তাহলে তোমার বাবাকে কল দিয়ে বল তোমার টাকা দরকার বিকাশে যেন দশ হাজার টাকা পাঠায় দেয়৷
ফারাজ তার হাতটা তখনো বর্ষার হাতের উপর রেখে শুয়েছিল। তার এমন অন্যায় আবদার শুনে বর্ষা তৎক্ষনাত হাত সরিয়ে ফেলে বলে, প্লিজ এইসব মন্দ কাজ থেকে দূরে সরার পরই আমার কাছে আসবেন। এর আগে না। আপনাকে জাস্ট সহ্য হয় না আমার। এতো বেহায়া কেন আপনি? ছিঃ! নতুন বউয়ের কাছে টাকা চাইতে লজ্জা করে না?
তারপর একদন্ড থেমে বলে উঠে, আসলে এইসব আপনাকে বলে কোন লাভ নাই। আপনার জ্ঞান-বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।
ফারাজ কিছু বললো না। চুপ করে থাকলো। মিনিট খানেক পর সে বর্ষাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কি মনে পড়ে৷
চলবে।