#আমার_সংসার
পর্ব-০২
Sara Mehjabin
ফারহানের কথা শেষ না হতেই দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগলো। ফারহান জিগ্যেস করলেন, কে? কোন উত্তর পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে ফারহান দরজা খুলতে গেলেন।
দরজায় রিমা আপু দাঁড়ানো।
“আশ্চর্য! তুই এইঘরে কি করিস? রিশানকে কখন খাওয়াবি? এতরাত হয়ে গেছে তোর তো দেখা যায় কোন হুশ-ই নেই,, বাসরঘরে ঢুকে বসে আছিস! বাচ্চাটা আর কত রাত পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে?”
“কি বললি! রিশান খায় নি? তোরা ওকে খাওয়াবি না? ওহ্ খাওয়াবি কিভাবে আমি ছাড়া তো ও কারো হাতে খাবার খায় না। এত রাত হয়ে গেছে আমার খেয়ালই নেই।”
“থাকার কথাও না। তোর মাথায় এখন শুধু তোর নতুন বৌয়ের খেয়াল। হয় হয় এরকমই হয়। নতুন সংসার পেয়ে বাচ্চাদের কথা সবাই ভুলেই যায়। আমার নিজের জীবনটাই তার সাক্ষী। মনে রাখিস ফারহান, বিয়ে করেছিস মানে এই নয় দিন-দুনিয়া ভুলে সারাদিন বৌ নিয়ে পড়ে থাকবি,,বিশেষত রিশানের প্রতি অবহেলা করে নিজের নতুন জীবন নতুন সংসার সাজাবি এটা কখনোই হবে না। আশা করি তোর বিয়ে করার আসল উদ্দেশ্য তুই ভুলে যাবি না।”
“আপি কি বলা শুরু করলি,,,আজমী আছে। কি ভাববে ও? বাদ দে, রিশান কোথায়?”
“ইমার কাছে ছিল। তোর মা নিয়ে গেছে।”
“আচ্ছা আমি যাচ্ছি। আজমী আপনি অনেক টায়ার্ড। ঘুমিয়ে পড়ুন।”
বলেই উনি চলে গেলেন।
উনার এই আচরনে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। কার না কার জানি বাচ্চা তারজন্য উনি বাসররাতে বৌকে রেখে চলে গেলেন। কোনো স্বামী তার বৌকে বাসর রাতে বলে, “আপনি অনেক টায়ার্ড। ঘুমিয়ে পড়ুন”। উনার বাসার মানুষেরাই বা কেমন। এতগুলো মানুষ বাসায় একটা ছোট বাচ্চাকে খাওয়াতে পারছে না; না’ই যদি পারে তো না খাওয়াক,,, কোন বাচ্চা একরাত না খেলে মরে যাবে না। উনার কি একবারো মনে হলো না আজ আমাদের বাসররাত। নতুন বৌকে একলা রেখে উনি চলে গেলেন। উনার আচরনে খুব কষ্ট পেয়েছি। বিয়ের পর থেকে উনি আমাকে সমানে অপমান করছেন। সেই সময়-ও বাড়ির সবার সামনে আমার গায়ে হাত তুলেছেন কোন কারণ ছাড়া। ভেবেছিলাম বিয়ের পর অতীত ভুলে একটা নতুন জীবন শুরু করতে পারব। স্বামী সংসার নিয়ে একটা নতুন জীবন গুছিয়ে পুরোনো দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাব। এখন মনে হচ্ছে আমার এইসব স্বপ্ন স্বপ্ন-ই থাকবে। ফারহানের কাছে আমার কোন মূল্য নেই। আচ্ছা আমার বিষয়ে সবকিছু জানাই কি উনার এরকম করার কারন? সেই কারনে আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। ফারহানের প্রতি মনে মনে খুব রাগ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙার পর দেখি সকাল হয়ে গেছে। ফারহান সোফায় ঘুমাচ্ছেন। গায়ে চাদর জড়ানো দেখে কাজটি কার বুঝতে বাদ থাকল না। ভাবতেই আমার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে। একটানে গায়ের চাদর ফেলে ওয়াশরুমে দৌড়ে গেলাম। ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করে শাড়ি চেন্জ করে নেই যদিও গোসলের দরকার ছিল না।
“কি গো ভাবি তুমি একা,,,ভাইয়া কৈ?”
লিভিংরুমে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে একত্রে বসা ছিল। আমাকে নিচে নামতে দেখেই দলের মধ্যে একটা মেয়ে বলে উঠল। কাল বিয়েবাড়ি উপলক্ষ্যে বাড়িভর্তি মেহমান ছিল। অনেকেই রাতে থেকেছে। আজকে আবার বৌভাত।
“উনি এখনো ওঠেন নি। আসলে কালকে সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে,,,হয়তো ক্লান্ত।”
“আহারে ভাবি এটা একটা কাজ করলে? আমাদের ভাইটাকে একলা ফেলে চলে আসলে। ও হ্যা কি যেন বলছিলে ভাইয়া অনেক ক্লান্ত,, অনেক ধকল গেছে। মনে হয় ধকলটা রাতেই বেশি গেছে।”
“তোমারি বা এত আগেআগে ওঠার দরকার কি ছিল? ঘুমিয়ে থাকতে ভাইয়ার সঙ্গে। তুমিও তো ক্লান্ত, তাই না?”
আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে লাগল।
“আহ্ কি শুরু করেছিস তোরা! নিজেরা খা দা গল্পগুজব কর্,, মেয়েটাকে বিরক্ত করছিস কেন?” ফারহানের মা রান্নাঘরে ছিলেন। আমাকে দেখে বেরিয়ে আসেন।
হাসাহাসি করে তারা আবার নিজেদের কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
“আজমী তোমার চোখমুখ ফোলা লাগছে মা।এত তাড়াতাড়ি উঠতে গেলে কেন? আমরা মাইন্ড করব দেখে কি আগে আগে উঠে পড়লে নাকি?”
“না না আন্টি আমার ভোরবেলা ওঠা অভ্যাস। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আপনি আমাকে নিয়ে টেনশন করেন না আন্টি।”
আমার কথা শোনামাত্র একজন বয়স্ক মহিলা আমার দিকে তেড়ে এলেন,
“ওমা এইতা কি কতা! শাশুড়িরে আম্মা না কইয়া কিতা সুরতের ডাক কও! আর তুমিও বৌমা তোমার পোলার বৌ তোমার লগে মাইনসের সামনে এত বড় বেয়াদপিডা করল তুমি কিছু কইতাছ না। ও যে তোমারে সম্মান দিতাছে না তুমি ওরে শাসন করবা না?”
“আসলে চাচিআম্মা নতুন বিয়ে হয়েছে। অভ্যাস করতে সময় লাগবে। ওকে আমি বুঝিয়ে বলছি। আপনি রাগ করবেন না।”
বয়স্ক মহিলা গজগজ করে চলে গেলেন।
উনি সরতেই ফারহানের মা হেসে বললেন, চাচিআম্মার কথায় কিছু মনে করো না। বয়স্ক মানুষ শাসন করতেই পারেন। আমি তোমাকে জোর করছি না। হুট করে কাউকে মা ডাকা যায় না। কিন্তু ডাকতে যখন হবেই এখন থেকেই ডাকো। কারণ আমার ছেলের বৌকে তো আমি সারাজীবন আন্টি ডাকতে দিব না।”
মা আমাকে সকালের খাবারের দেওয়ার জন্য রান্নাঘরের টেবিলে বসালেন। তখনই রিমা আপু আসল,
“এই তুমি খেতে বসছ কেন? রিশান উঠে পড়েছে। যাও রিশানকে খাইয়ে আসো। রিশানকে খাওয়ানো শেষ করবে তারপর নিজে খেতে বসবে,,,বুঝছ?”
“আহারে মেয়েটা মাত্র বসল খেতে। তোরা কেউ খাইয়ে দে। নাহলে আমার কাছে দিয়ে যা। আমি খাওয়াই।”
“কেন? আমরা কোন দুঃখে খাওয়াতে যাব? এগুলো করা তো আমাদের কারো দায়িত্ব না। যাকে দায়িত্ব পালন করার জন্য নিয়ে আসছ তাকে বলো।”
“মাম্মা..মাম্মা কোতায় তুমি? মাম্মা”-
রিশানকে দেখা গেল রান্নাঘরে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। এসেই ঝাপিয়ে পড়ল আমার কোলে।
“মাম্মা” আদুরিঅন্ঠে ডাকল। এত মিষ্টি একটা সুন্দর বাচ্চার এতো আদরের ডাক শুনে যেকোনো মানুষের মন ভালো হয়ে যাবে। আর আমার ভালো মনটা উল্টো খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছা করছিল একটা ঠাস মারি গালে। শশুরবাড়ির সবার সামনে বিধায় হালকা হাসি দিয়ে আদর করলাম।
“আজমী যাও খাইয়ে দাও রিশানকে।”
রিমা আমার সামনে খাবারের সরঞ্জাম দিয়ে মাকেসহ বেরিয়ে গেলো।
নিজের প্লেটের খাওয়া রেখে হাত ধুয়ে সেরেল্যাক্স গুলছি। রাগে সারা শরীর কাঁপছে। বাসররাত প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বিশেষ রাত। এটা নিয়ে প্রত্যেক মেয়ের-ই কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে। সবাই চায় এই বিয়ের প্রথম রাতটায় জীবনসঙ্গীর সাথে একান্ত কিছু স্মৃতি থাকুক। এই বাচ্চার জন্য-ই কালরাতে ফারহান আমাকে রুমে একা রেখে চলে গিয়েছিল। আমার সব নষ্ট হয়ে গেল শুধু এই বাচ্চাটার জন্য। তখন থেকেই আমার মেজাজ টা খারাপ ছিল। সকালবেলা উঠে খেতে এসেছি, এই বাচ্চার জন্য তাও হলো না। বিয়ের নানান আনুষ্ঠানিকতা ব্যস্ততার মধ্যে কাল সারাদিন পানি ছাড়া কিছু খাই নি। এখন নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে এই বাচ্চাকে খাওয়াতে হচ্ছে। ফলে বাচ্চাটার ওপর আমার ভালোই রাগ ছিল। মুখে স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে রিশানের মুখে খাবার দিচ্ছিলাম। চামিচ দিয়ে ঠেসে ঠেসে মুখের ভিতর ঢুকাচ্ছি। বাচ্চাটার খাওয়ার প্রতি খুবই অনীহা। সহজে মুখ খোলে না। বলল বাগানে নিয়ে গেলে খাবে তাই নিয়ে গেলাম। তারপর যাও এক দুইবার মুখ খুলল আবার শুরু করল দৌড়াদৌড়ি। খাবার সহ দৌড়াতে দৌড়াতে আমার ঘাড় হাত-পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। আমি এর আগে কখনো বাচ্চা খাওয়াই নি। মাথাটাও ব্যথা করছে। এমনিতেই মেজাজ খারাপ এইসব ঢঙ আর সহ্য হচ্ছিল না।
“অসভ্য শয়তান বাচ্চা একটা জ্বালিয়ে মারতেছে। কথা ভালোভাবে বললে কথা শোনা যায় না, না? নে মাইর খা এইবার। বান্দর।”
গালের মধ্যে ঠাস ঠাস অনেকগুলো থাপ্পড় দিয়ে পিঠের ওপর ধুমধাম কিল বসানো শুরু করলাম।
“মাম্মা মেলো না ব্যতা পাত্তি,,,,ও মাম্মা,,,খুব ব্যতা পাত্তি। ছলি মাম্মা। আর দুত্তামি কবব না। মাম্মা মেলো না,,পিলিত।”
ওর কান্না আর আকুতি শুনে রাগ কমার বদলে কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেল। আরো মার পড়তে লাগল ওর উপরে। আর ও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল।
“তোকে খাওয়াবোই না, যাহ্।”
পিঠে আরো একটা থাপ্পড় লাগিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিই।
“মাম্মা ও মাম্মা লাগ কলেছ? ছলি মাম্মা..আল দুত্তামি কবব না আমি। ও মাম্মা তুমি লাগ কলো না। আমি তোমাল ছব কথা ছুনব। দুত্তামি কবব না। মাম্মা ছলি।”
রিশান কান ধরল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ওর এভাবে তাকানো দেখে কেমন যেন মায়া লাগল।
“আরো দুষ্টামি করবি?”
কান ধরে জোরসে দুইপাশে মাথা নাড়াল।
“খাওয়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হা করবি?”
আবারও মাথা নাড়াল।
“খাবার মুখে ঢুকিয়ে বসে থাকবি না…টপাটপ গিলবি?”
আবারো মাথা ঝাকানো।
“দৌড়াদৌড়ি করবি না…ঠ্যাং কিন্তু ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব।”
আমার কথার ধরনে রিশান খিলখিল হাসি শুরু করল। আমিও ওর সারাগায়ে সুড়সুড়ি কাতুকুতু দেওয়া শুরু করলাম। ও-ও তাই করল। আমি ওর গাল ধরে টান দিলাম। ও-ও দিল। এভাবে হাসাহাসির মাধ্যমে ওকে খাইয়ে ওর সাথে অনেকক্ষণ খেললাম।
“ওয়াও ভাবি খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। পুরোই গোল্লা একটা। ইচ্ছা তো করে গালদুটো কেটে রাখি। শুধু ভাইয়ার কথা ভেবে কাটি না।”
ইমা আজমীর গাল ধরে টানছে। বৌভাতের অনুষ্ঠান কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হবে। ইমাসহ কয়েকজন মেয়ে একত্রে আজমীকে সাজিয়ে দিল।
“ধ্যাত কি যে বলো। তোমার কাছে আমি কিছুই না।”
আজমী হাসল লজ্জা পেয়ে।
“থাক থাক ভাবিজান আমাকে পাম্প করতে হবে না। আমি শুকনা মানুষ তোমার পাম্পের চোটে উড়ে গেলে আমার বয়ফ্রেন্ডটার কি হবে! আমাকে যে ভালবাসে বেচারি তো আর কাউকে গার্লফ্রেন্ড-ও বানাবে না। আজীবনের জন্য সিংগেল হয়ে যাবে। যাক, তাড়াতাড়ি নিচে নামো। মেহমানরা বৌ দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে।”
ইমার ফোন আসতেই সে বেরিয়ে গেলো।
ঘরে আজমী একা। নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে কেউ ওর ব্লাউজের হুক খুলতে শুরু করে।
চলবে