আমার সংসার পর্ব ১৪

#আমার_সংসার
পর্ব-১৪
Sara Mehjabin

সাদা কাপড়টা সরাতেই আজমী চিৎকার দিয়ে সামনে দাঁড়ানো লোকটার বুকে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ল। লাশটা সিফাতের। ভয়ংকরভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। এতো ভয়ংকর যে মানুষজন মরা মুখ-ও দেখতে চাচ্ছে না।

ফারহান আজমীকে কোলে করে দ্রুত রুমে নিয়ে গেল। গ্লাসে পানি এনে ওর চোখেমুখে ছিটাতে থাকে। হাত-পায়ের তালু ঘষে দিতে থাকে। অল্পক্ষণ পরেই আজমীর জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরেই ফারহানকে জড়িয়ে ধরে। আজমীর সারা শরীর কাঁপছে। সিফাতের বীভৎস মৃতদেহ ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না।

“আজমী, এই আজমী শান্ত হোও। এত ভয় পাচ্ছ কেন?”

“সসসিফাত…সসসিফাত।”

ফারহান আজমীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, সিফাত আর নেই আজমী। যে নেই তাকে আবার ভয় কিসের?

“আমার খুব ভয় করছে। আমি একা থাকতে পারব না। খুব ভয় করছে আমার।”

“ঠিক আছে আমি এখানেই থাকব। তুমি কোন চিন্তা করো না। তোমার কাছেই আছি।”

আজমীকে পানি খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে ফারহান দূরে চেয়ারে গিয়ে বসল। ও কাছাকাছি থাকলে আজমী কখনো সস্তি পায় না। তারচেয়ে দূরে থাকাই ভালো। অল্পক্ষন পরেই ঘুমিয়ে পড়ল আজমী। ফারহান একদৃষ্টিতে আজমীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অজান্তেই চোখের কোন দিয়ে পানি ঝরে পড়ল। জানি না আর কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার ঘুমন্ত মুখ দেখার সৌভাগ্য হবে। হয়তো আর বেশিদিন নয়। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ফারহানের ভেতর থেকে।

আজমী খাটে ঘুমিয়ে আছে। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। ফারহান কাছে এসে পায়ের কাছে মাটিতে ধীরে ধীরে বসল। খাটের বাইরে ঝোলানো আজমীর পা দুটো তুলে দিল। কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিতে গিয়েও থমকে যায়। নাহ্ আজমীকে সে স্পর্শ করতে পারে না। তার সেই অধিকার নেই।

সিফাতের জানাযা হবে কাল সকালে। রাত বারোটার সময় বাসায় পুলিশ এলো। মৃতবাড়িতে পুলিশ দেখে সবাই অবাক। তারা জানালো পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে সিফাতের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। সিফাতকে খুন করা হয়েছে।

“আপনাদের ধারণা একদম ঠিক অফিসার। সিফাতকে খুন করা হয়েছে। ওকে আমি নিজে হাতে খুন করেছি। নাউ অ্যারেস্ট মি।”

ফারহান নিজের হাতদুটো মুষ্ঠিবদ্ধ করে পুলিশের সামনে তুলে ধরে।

বাড়িভর্তি মানুষ মুহূর্তেই যেন পাথর হয়ে যায়। এই খবর তো সিফাতের মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর; অবিশ্বাস্য লাগছে সবার কাছে। ফারহান সিফাতকে খুন করবে এটা কেউই বিশ্বাস করে না। প্রয়োজনে ফারহান নিজেকে মেরে ফেলবে কিন্তু সিফাতের গায়ে আচ-ও ফেলবে না। সেই ফারহান কিভাবে এই কাজ করতে পারে। তাছাড়া খুনী কখনো নিজের মুখে খুনের কথা স্বীকার করে না। ফারহানকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে মিথ্যা কথা বলছে।

পুলিশ: আপনি আপনার ভাইকে খুন করেছেন?

ফারহান: এক কথা কতবার বলতে হবে। আমি সিফাতকে মেরেছি। আর এতে আমার কোন আফসোস নেই। ওকে মেরে আমি আমার পাপের বোঝা হালকা করেছি। এবার আমাকে আমার উপযুক্ত শাস্তি দিন।

পুলিশ: কথাগুলো সজ্ঞানে বলছেন? নাকি কাউকে বাঁচাতে চান?

মুহুরৃতেই রেগে উঠল ফারহান, আমি কাউকে বাঁচাতে চাইছি না গট ইট? সিফাতকে আমি খুন করেছি আমি। ওর লাশকে নৃশংসভাবে ক্ষত-বিক্ষত আমি করেছি। মাথায় ঢুকছে না আপনার?

“দেখুন, আপনি বললেই হবে না। আমাদের প্রমাণ লাগবে। আপাতত যেহেতু নিজে আপনি খুনের দায় স্বীকার করেছেন আপনাকে পুলিশ কাস্টডিতে থাকতে হবে।”

—————————————————————–

“মনির আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি রিশানকে আমার কাছে নিয়ে আসব। ফারহান আরেকটা বিয়ে করেছে। আমি চাই না আমার ছেলে সৎ মায়ের কাছে মানুষ হোক।”

কম্বলের তলায় মনিরের পায়ের তালুতে দুই পা ঘষতে ঘষতে মনিরের ঘাড়ের কাছে হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে। মনিরকে আরো বেশি কাছে টেনে নেয়। চোখে আবেদনীয় দৃষ্টি। আনিকা ভেবেছিল মনিরকে এভাবেই ঘায়েল করে ফেলবে। ব‍্যাটার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজ্ঞান লোপ পেয়ে যাচ্ছে। একটু হেসে কাছে ডাকলেই যা চাইবে আনিকা তাই দিয়ে দিবে। বোকা লোক এখনো মনে করে আনিকা তার জন্য পাগল। তাকে ভালবেসে ফারহানের মতো জোয়ান বয়সী ছেলেকে ফেলে তার মতো অর্ধবুড়োর কাছে চলে এসেছে। অবশ্য মনিরের এই ভুল ধারণা আনিকার জন্য সুবিধাজনক। যখন যা চায় তাই পেয়ে যায়।

কিন্তু এবারে কাজ হলো না। মনির আনিকার ডাকে সাড়া দিল না। বরং আনিকাকে দূরে সরিয়ে হেসে বলল, “তুমি তো দেখা যায় ফারহানের সব খবর-ই জানো। স্পাই লাগিয়েছ নাকি ওর পেছনে?”

“আশ্চর্য মনির। স্পাই লাগতে যাবো কেন? ইউ নো ফারহানের বিষয়ে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই‌। বাট আমি ওর খোঁজ-খবর রাখি। সেটা আমার ছেলের জন্য। আমার ছেলে ওর কাছে থাকে। সেইজন্য। আমার ছেলে কেমন আছে মা হিসেবে এটা দেখা আমার দায়িত্ব?”

“হা হা। কি বললে? তোমার মা হিসেবে দায়িত্ব? ছয় মাসের বাচ্চা ফেলে একটা বাপের বয়সী লোকের সঙ্গে ভেগে এসেছে শুধু টাকার লোভে। সেই তুমি নিজেকে তোমার ছেলের মা দাবি করো?”

“জাস্ট সাট আপ মনির। একটা অর্ধবুড়া লোক হয়ে মেয়ের বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছ। নিজের বৌ-বাচ্চার খোঁজ নাও না। আবার আসো আমাকে জ্ঞান দিতে।”

উত্তেজিত অবস্থা থেকে ঠান্ডা হয়ে আসে আনিকা। এই মুহুর্তে লোকটাকে রাগানো যাবে না। পুরুষ মানুষের দুর্বলতা মেয়েদের চোখের জল। আনিকা তাই এই পদ্ধতিটাই কাজে লাগাল। আচমকা মনিরের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল,

“ও মনির আমি আর পারছি না গো। ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ে। তখন আবেগের বশে খুব বড় ভুল করে ফেলেছিলাম। যতোই হোক আমিই তো ওর আসল মা। নয় মাস আমিই ওকে পেটে রেখে জন্ম দিয়েছি। এই নাড়ির টান কি কখনো ভোলা যায়? কখনো ভোলা যায় না। না জানি কত কষ্টে আছে আমার কলিজার টুকরাটা। ওর বাবা তো নতুন বৌ পেয়ে ওকে ভুলেই গিয়েছে। সৎ মা নিশ্চয়ই খুব অবহেলা করে কষ্ট দেয় আমার ছেলেটাকে। মা হয়ে এটা আমি কি করে সহ‍্য করি!”

“আনিকা শান্ত হোও। ঠিক আছে। এত কাঁদতে হবেনা। আজ পর্যন্ত তোমার কোন চাওয়া অপূর্ণ রেখেছি বলো? এটাও রাখব না। রিশানকে খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে এনে দেব।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here