আরশি পর্ব ২০+২১

#আরশি
#Part_20
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

ঘড়িতে নয়টা ছুঁই ছুঁই। ড্রয়িংরুম জুড়ে ভাসছে কোরআন তিলাওয়াতের মধুর ধ্বনি৷ ড্রয়িংরুমের বা পাশের সোফায় বসে আমি আর অহনা সেই মধুর ধ্বনি মন দিয়ে শুনছি। আমি জানি যতক্ষণ না পুরো কোরআন শরিফ খতম হচ্ছে ততক্ষণ এই ধ্বনি প্রতিফলিত হতেই থাকবে। আমি স্থির হয়ে বসে আছি। মনের মধ্যে বিষন্নতা ঝেঁকে বসেছে। মনে পড়ছে মিহি আন্টির কথা। তার স্নিগ্ধ মুখখানি। চোখে ভাসতে শুরু করে পুরনো দিনের স্মৃতি।

_______________________

২০০৭ সাল। তখন আমি ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ি আর মামার পড়ালেখা প্রায় শেষের পথে। পড়ার সুবাদে মামা আমাদের সাথেই থাকতেন। আমার থেকে মামা ছিলেন বারো বছরের বড় আর ভাইয়ার থেকে সাত বছরের। মাঝে নাকি মামা এক কঠিন অসুখে পড়েছিলেন যা সারতে দুই-তিন বছর লেগে যায় আর মামা পড়ার দিক দিয়ে পিছে পড়ে। স্বভাবে মামা শুরু থেকেই বিচক্ষণ প্রকৃতির মানুষ ছিল। সাথে বেশ বুদ্ধিমানও ছিলেন। তাকে কখনো কোন কিছু ভেঙ্গে বলতে হতো না সে আপনা আপনি বুঝে যেত। ছোট থেকেই মামার সাথে আমি অনেক ফ্রি ছিলাম। আমার সবকিছুই তার জানা ছিল। মামার বিষয়েও আমি টুকুটাকি জানতাম। একদিন কথায় কথায় জানতে পারি মামা একজনকে ভালবাসে। এমনকি সেও নাকি মামাকে ভালবাসে। নাম জানতে চাইলে জানতে পারি তার নাম ছিল মিহি। মিহি আন্টি মামার ভার্সিটিতেই অনার্স প্রথম বর্ষে পড়তো। আর থাকতোও আমাদের এলাকায়। সেই সুবাদে তাদের দেখা সাক্ষাৎ প্রায় হতো। মামার কাছে মিহি আন্টির বর্ণনা শুনতে চাইলে সে বলেছিল, “সে হলো বৃষ্টিবিলাসী। তার রুপ খেলে বর্ষণের ধারায়। হরিণী নয়নের মায়ায় তখন লেপ্টে পড়ে গভীর ছাঁয়া। পা নাচিয়ে মৃদু মৃদু ঝঙ্কার তুলে স্বচ্ছ বর্ষণের ধারায়। সেই সাথেও মাতাল হাওয়ায় ভাসিয়ে বেড়ায় তার রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ। পায়ের পৃষ্ঠা রক্তিম আভায় রাঙ্গিয়ে ছাপ ছেড়ে যায় বর্ণহীন পানির ধারায়। আর সেই ছাপের পথচারী বানায় আমায়।” মামার কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম সে ছিল অত্যন্ত রূপবতী। সাথে এইটাও বুঝতে পারি যে তাদের প্রথম দেখা এই বৃষ্টির ধারায়ই হয়েছিল। সব শুনে আমারও ইচ্ছা হয় সেই রূপবতীকে এক ঝলক দেখার। এবং একসময় আমাদের দেখাও হয়েছিল। তাকে দেখার পর মনে হয়েছিল লজ্জাবতী গাছটা মনে তাকে দেখেই এতটা লজ্জা পায়। মিহি আন্টি যেদিন আমায় প্রথম দেখে সেইদিন আমায় আপন করে নেয়৷ বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেন আমার সাথে। এতটাই ভালো সম্পর্ক ছিল যে আমি পরবর্তীতে তার বাসায়ও যাওয়া আসা শুরু করেছিলাম।
এরপর থেকেই আমি তাদের দুইজনের ভালোবাসার জীবন্ত সাক্ষী ছিলাম। তাদের ভালোবাসার রচনাই ছিল সাধারণের মধ্যে অসাধারণ। অসাধারণ বলার কারণ তারা কখনো ভার্সিটির আঙ্গিনায় বসে আড্ডা দেয় নি, ফোনে কথা বলেনি, রাস্তার পাশে হাতে ধরে হাটে নি,টঙ্গের ঘরে বেঞ্চিতে বসে একসাথে চা খায়নি,সরাসরি দাঁড়িয়ে ভালো মত দুইটা কথা বলেনি, বাকি যুগলদের মত একান্ত বলতে কোন সময়ই তারা কাটায় নি। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে তারা ভালোবাসায় পড়লো কিভাবে? তাদের কথা হতো কিভাবে? উত্তরটা হলো তাদের যোগাযোগের মোক্ষম মাধ্যম ছিল চিঠি। তাদের ভালবাসার সূচনাও এই চিঠি আর ইতিও এই চিঠি। তাদের যতকথা, রাগ, অভিমান, আবদার, প্রতিশ্রুতি, ভালবাসা সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ ছিল এই চিঠি। এমনকি স্বপ্ন বোনার অঙ্গিকারও ছিল এই৷ ইচ্ছা গুলোকে কাগজের ভাঁজে তারা যত্ন সহকারে তুলে রাখতো,এক হালাল সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে পূরণ করবে বলে। কিন্তু কে জানতো এই ইচ্ছেগুলোই তাদের কাল হয়ে দাঁড়াবে। তাদের বিচ্ছেদের কারণ হবে।

আমি তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। মামা তখন পড়ালেখা শেষ করে বেকার। ঠিক এমনটাই সময় মিহি আন্টিকে লিখা মামার সকল সকল চিঠি ধরা পড়ে যায় তার বাবার নিকট। সবকিছু তার নিকট হয়ে যায় পরিষ্কার। মিহি আন্টিকে তিনি চিঠির মালিকের কথা জিজ্ঞেস করলে সে নির্ভয়ে সব বলে দেন। অতঃপর তার বাবা যখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন পাত্র বেকার তখনই তিনি নাকোচ করে দেন। তার বাবা ছিলেন অতি কঠোর আর এক বাক্যের মানুষ। তিনি যা একবার বলে দিয়েছেন সেটাই হতো শেষ কথা। আর তার শেষ কথা ছিল সে কোন মতেই একজন বেকার পাত্রের নিকট তার কন্যাকে তুলে দিবেন না। কিন্তু মিহি আন্টিও তখন জীদ করে বসে সে মামাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। কথা জানার পর তার বাবার তার উপর হাত উঠায়। এমনকি তার মাও। শিকার হতে হয় নির্মম অত্যাচারের। কিন্তু তাও মিহি আন্টি ছিলেন তার কথা অটল। যার ফলে হতে হয় গৃহবন্দী। প্রায় ৩ দিন থাকতে হয় ক্ষুদার্ত ও তৃষ্ণার্ত। এতে মিহি আন্টির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়েছিল তা কিন্তু নয়। সে তো নিজের কথায় দৃঢ়। তা দেখে তার বাবা তার জন্য উপযুক্ত পাত্র খোঁজা শুরু করে। এইদিকে মামা সব জানতে পেরে মিহি আন্টির বাবার চরণে গিয়ে পড়েছিল, কেঁদে ভিক্ষা চেয়েছিল মিহি আন্টিকে। কিন্তু তার বাবা দেয় নি। উল্টো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল মামাকে তার বাড়ি থেকে। আর আমারও সেই বাড়ি যাওয়া আসা বন্ধ হয়ে যায়।
সেইদিন থেকেই মামা আর মিহি আন্টির মধ্যে সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। দেখতেই দেখতে কেটে যায় একসপ্তাহ। মিহি আন্টির বাবা খুঁজে আনেন মিহি আন্টির জন্য যোগ্য পাত্র। বিয়ের দিন পাকা হয়। পারা মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে বিয়ের আমেজ। কিন্তু মিহি আন্টি তখনও তার সিদ্ধান্তে অটল। সে মামা ব্যতীত আর কাউকে বিয়ে করবে না। এই নিয়ে চলে আরেক দফা অত্যাচার। একই এলাকায় থাকার সুবাদে মামা বিয়ের কথা জানতে পারলো কিন্তু আন্টির কোন খোঁজই নিতে পারলো না। কেন না তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার সকল রাস্তাই যে বন্ধ ছিল। দিন গুনা ছাড়া আর কোন পথই ছিল না তাদের। এরপর একদিন খোঁজ আসলো। মিহি আন্টি আত্মহত্যা করেছেন। তার নিথর দেহ পড়ে আছে সেই পিছনের গল্লির দশ নাম্বার বাড়ির চারতলায়। বিয়ের আমেজে থাকা বাড়িটি এখন শোকের সাগরে আঁচড়ে পড়ছে। সব জেনে সেইদিন মামা একদম নিশ্চুপ ছিল। একটা টু শব্দও করেনি সে। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। বেশ কিছুক্ষণ পর ছুটে যায় মিহি আন্টির বাসার সামনে। কিন্তু তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সে উন্মাদ প্রায় হয়ে যায় মিহি আন্টির শেষ দেখা দেখার জন্য। কিন্তু তারা তাকে মিহি আন্টির শেষ দেখাটাও দেখতে দেন নি। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন। মামা অনেক চেঁচিয়েছিল,দরজায় কড়া নেড়েছিল কিন্তু কাজ হয়নি। একসময় সে ক্লান্ত সেখানে বসে পড়ে। চোখ দিয়ে গড়িতে পড়তে থাকে অজস্র জল। চিৎকার করে ডেকে উঠেন,”মিহি! মিহি!” বলে। কিন্তু না কোন সাড়া আসে নি। একসময় মামা হাল ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বেড়িয়ে আসেন সেখান থেকে। কিন্তু এরপর কোথায় যান তা আর জানা হয়নি। অতঃপর তিনি বাসায় ফিরেন রাত ১২ টায়। এসে চুপচাপ রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। সেইদিন অনেক ডাকাডাকি করেও তাকে রুম থেকে বের করা যায় নি। একসময় আমরাও হাল ছেড়ে দেই। সেইদিন নিশাচর রাতেই ভেসে আসে একজন পুরুষালী কন্ঠের আর্তনাদ। বুক ফাটা আর্তনাদ। ভেসে আসে ভাঙ্গচুরের শব্দ, সাথে কয়েকটা অস্পষ্ট বাক্য, “বিশ্বাসঘাতকতা করেছ তুমি। কথা দিতে কথা রাখো নি। ছেড়ে যাবে না বলে চলে গিয়েছ তুমি। প্রতারক তুমি!” আবার একসময় সব নিরব হয়ে যায়। বন্ধ দরজার ওপারে তখন কি চলে তা কাউরো জানা নেই। অতঃপর সেই বন্ধ দরজা খুলে ঠিক দুইদিন পর। তাও হয়তো খুলা হতো না যদি না মিহি আন্টির শেষ চিঠি আসতো মামার নিকট। মারা যাওয়ার আগে তিনি চিঠিটা কাকে দিয়ে যেন গোপনে পোস্ট করেছিলেন আর সেই চিঠিই সেইদিন এসেছিল। মিহি আন্টির চিঠি এসেছে শুনার পর সাথে সাথেই মামা বেরিয়ে আসে। এগিয়ে আসে আমার কাছে চিঠির আশায়। তখনই আমি দেখেছিলাম মামার বিভৎস মুখখানাটি। চোখ দুইটি লাল,চুল এলোমেলো,পড়নে সেই পুরোনো শার্ট। বাজে এক গন্ধ ভেসে আসছিল তার নিকট থেকে। কিন্তু মামা সেইসবে তোয়াক্কা না করে আমার কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করে।

“প্রিয় নীরব,

যখন চিঠিটা তুমি পাবে ততক্ষণে আমি হয়তো এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে বহু দূর চলে যাব। যেখানে আমার নাগাল কেউ পাবে না। এমনকি তুমিও না। তা যাওয়ার আগে আমি আমার মনের অবস্থা তোমায় জানাতে চাই। আমি একদম ভেঙ্গে পড়েছি। পারছি না এইসব সহ্য কর‍তে। একদিকে বাবা-মা আরেকদিকে তুমি। আমি উভয়কেই অনেক ভালোবাসি তাই তোমাদের মধ্যে কোন একজনকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একদম নয়। আমি না পারবো বাবা-মার মুখে কালি মেখে তোমার হাত ধরে চলে আসতে আর না পারবো তাদের কথা শুনে তোমার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে। পারবো না অন্যকে স্বামী মানতে। তার নিকট নিজেকে সঁপে দিতে। তাই স্বেচ্ছায় আমি এই পথ বেছে নিচ্ছি। জানি না এই পথ ঠিক কি না তাও আমার কাছে আপাতত এর ব্যতীত কোন রাস্তা নেই৷ জানি তুমি রাগ করবে কিন্তু আমি যে নিতে পারছি না এই মানসিক অশান্তি। আমি জানি না আমার মৃত্যুর পর তুমি কি করবে। আমার প্রতি তোমার অনুভূতি কি রকম হবে। শুধু এতটুকু জানি আমি আজকের পর থেকে তোমার কাছে প্রতারক হয়ে যাব। কিন্তু তাও একটা শেষ প্রতিশ্রুতি চাই আমি তোমার থেকে। জানি না এইটা অন্যায় কি না তাও চাইছি, তোমার বা পাজারের হাড়টাতে আমাকেই থাকতে দিও। আমার জায়গায়টা আর কাউকে দিও না। কাউকে না। দিবে কি আমায় প্রতিশ্রুতিটা?
আর লিখতে পারছি না। সবকিছু আজ এলোমেলো লাগছে। লিখতেও পারছি না খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই এইখানেই ইতি টানছি। আর শেষ বারের মত বলতে চাই,” ভালবাসি।” ভালো থেক।

ইতি
তোমার বৃষ্টিবিলাসী ”

চিঠিটা পড়ে মামা মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। আর্তনাদ করে কেঁদে উঠে। কন্ঠে ভেসে আসে চিৎকার। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে তপ্ত নোনা পানির ধারা। রক্তিম চোখ দুইটি হয়ে উঠে আরও রক্তিম। ঠোঁট দুইটি ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠে। তার এমন আর্তনাদে কেঁপে উঠে চারপাশ। কেঁপে উঠে দেয়ালের প্রত্যেকটা ইট কনা। বাঁধ ভাঙ্গে আমার, মায়ের,ভাইয়ার চোখের জল। বেশ কিছুক্ষণ পর মামা উঠে দাঁড়ায়। রুমে চলে যায়। রুমের মধ্যে থাকা মিহি আন্টির সকল চিঠি নিয়ে আসেন। মেঝেতে ফেলেন অতঃপর রান্নাঘরে গিয়ে ম্যাচের বক্স নিয়ে এসে আমাদের চোখের সামনে সেই সকল চিঠি পুড়িয়ে দেন। আমরা তাকে থামাতে গিয়েও থামাতে পারি নি। সে শেষে শুধু এতটুকুই বলে, “প্রতারক তুমি।” কথাটা বলেই সে রুমে চলে যান। দরজা দেন। আর এইদিকে মা দ্রুত পানি এনে আগুন নিভানোর জন্য তড়িঘড়ি করতে থাকেন। আমি শুধু সেই আগুনের দিকে তাকিয়ে রই। ধাউ ধাউ করে জ্বলছে আগুনের শিখা আর সেই শিখায় জ্বলছে বছর খানেক ধরে বোনা আবেগ, স্নেহ, ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি, স্বপ্ন। যেই প্রেমের রচনা মামা করেছিলেন তার ইতি মিহি আন্টি টেনেছিলেন।

__________________________

কোরআন শরীফের মধুর ধ্বনি বন্ধ হতেই আমি অতীত থেকে বেড়িয়ে আসি৷ চকিতে তাকাই মামার রুমের দিকে। সে মোনাজাতে বসেছেন। হয়তো কাঁদছেন। মামা যতই বলুক মিহি আন্টি প্রতারক। তার প্রতি তার কোন অনুভূতি নেই। কিন্তু আসলে তো সে এখনো তাকে খুব ভালবাসে। তাই তো তার কথা রাখতে গিয়ে আজও সে বিয়ে করে নি। প্রতি বছর তার মৃত্যু বার্ষিকীতে সে কোরআন শরীফ খতম দেয়। মামা জানে মিহি আন্টি পুড়ছে জাহান্নামের আগুনে। আর হয়তো সারাজীবন পুড়বে। কেন না ইসলাম ধর্মে যে আত্নহত্যা মহাপাপ। পরকালে এর শাস্তি যে কখনো ক্ষমাযোগ্য হবে না। তাও তিনি মনের শান্তির জন্য এই কাজটা করেন। সাথেই এই আশায়ও একটু হলেও যদি মিহি আন্টি আত্না শান্তি পায়। একটু আরাম পায়। জানি না এইটা ধর্মে জায়েজ কিনা তাও মামার ভালোবাসা দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ হই। কতই জনে বা পারে এমন ভাবে ভালবাসে। মামা আজো জানে না মিহি আন্টির দেহ কোথায় দাফন করা হয়েছে। কেন না, মিহি আন্টির না হয়েছে জানাযা, না হয়েছে ইসলামিক শরিয়ত অনুযাই দাফন। সে তো আত্নহত্যা করেছিল আর আত্নহত্যাকারীদের জানাযা ও দাফন কার্যক্রম করা ইসলামে নিষিদ্ধ। তকে কোথাও হয়তো মাটি খুঁড়ে তাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। আর এইভাবেও মৃত্যুর পরই তার পরিবার সেই এলাকা ছাড়ে। এরপর তারা কোথায় যায় কারো জানা নেই। সেইসাথে মিহি আন্টিকে কোথায় দাফন করে যায় তাও কারো জানা হয়নি। যার ফলে মামাও জানতে পারেন নি। জানলে হয়তো আন্টিকে দুই নজর ভরে একটু দেখতে পারতেন অনুভব করতে পারতেন। আচ্ছা মানুষ কেন বার বার ভুকে যায়, মৃত্যু কখনোই কোন কিছু সমাধান নয়। এতে যে মরে সে তো পরকালে আজীবন শাস্তির ভাগিদার হয়ই সাথেই বঞ্চিত হয় সুন্দর এক জীবন থেকে। অন্যদিকে তার সাথে জড়িত সকল মানুষেই ভুগে আরেক অমানসিক যন্ত্রণায়। কষ্টে, অনুশোচনায়। নিজের মনের কষ্ট বের করার পথ খুঁজে নিতে হয়। আল্লাহ/স্রষ্টার প্রতি ভরসা রাখতে হয়। তিনি কখনো কারো অমঙ্গল করে না তা বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু এই বিশ্বাসটি এই নেই আমাদের মনে। আমরা কিছু হলেই উত্তেজিত হয়ে উঠি। দিশেহারা হয়ে যাই। ধৈর্যহারা হয়ে যাই। যার ফলে এইসব অপ্রীতিকর ভাবনা বাসা বাঁধে। যা ধীরে ধীরে ভয়ংকর রুপ ধারণ করে। সাথেই বয়ে আনে নিজের ধ্বংস।

যখন আমি এইসব ভাবছি তখনই হঠাৎ গোঙ্গানি আওয়াজ কানে আসে। আমি দ্রুত মামার রুমের দিকে চলে যাই। রুমের সামনে গিয়ে দেখি মামা মাটিতে পড়ে আছেন। বুকের বা পাশট চেপে ধরে আছেন। তার চোখ উল্টিয়ে আসছে। ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। ছটফট করছেন। আমি দ্রুত মামার কাছে যাই। মামাকে ডাকতে থাকি। কিন্তু তিনি সাড়া দেন না। আমি রীতিমতো ভয়ে কান্না করে দেই৷ অহনাও আমার পিছু পিছু এসে এই অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়। হিচকি তুলে কান্না করতে থাকে। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠে,

— আম্মি! নানাভাইয়ের কি হয়েছে? সে এমন করছে কেন? ও আম্মি!

আমার বোধশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। কোন কথাই কানে ঢুকছে না আমার। দিশেহারা হয়ে পড়ছি। হঠাৎ টনক নাড়ে,” মামাকে হসপিটালে নিতে হবে। যেভাবেই হোক নিতে হবে।” কিন্তু আমার একার পক্ষে তা সম্ভব না। আর আশে পাশে আমি কাউকে চিনিও না। আমি দ্রুত অহনাকে বললাম আমার ফোন আনতে। ও দৌড়ে যায় রুমে আমার ফোন আনতে। অতঃপর অহনা আমায় ফোন এনে দিতেই আমি আগে ভাইয়াকে ফোন দেই। কিন্তু ভাইয়ার ফোন সুইচড অফ বলছে। বেশ অনেকবার দেওয়ার পরও কাজ হলো না। আমি ভাবীকে ফোন দিলাম। তার ফোনও অফ। অতঃপর মনে পড়ে ভাইয়া-ভাবী দুইদিন আগেই ভাবীর গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন। তার মা নাকি অসুস্থ। তাকেই দেখতে গিয়েছেন তারা। ভাবীর গ্রাম আটপাড়াগায় হওয়ায় সেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া দুষ্কর। আমি এখন বুঝে উঠতে পারছিলাম কাকে ফোন দিব। ভাইয়া বাদে ঢাকা শহরে আমার চেনা পরিচিত কেউ আছে বলেও আমার মনে পড়ে না। এত বছরে আমি সকলের সাথে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। কাউরো সাথে কোন রকম যোগাযোগ ছিল না। যার ফলস্বরুপ এখন আমি নিরুপায়। দারওয়ানকে যে ডাকবো তাও সম্ভব নয়। কেন না এই বাসায় দারওয়ান নেই আজ দুই সপ্তাহ হতে চললো। আগেরজন কাজ ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছেন। কথায় আছে, “বিপদ আসলে চারদিক দিয়ে আসে।” আজ কথাটি হারে হারে টের পাচ্ছি আমি। বুঝে উঠতে পারছি না কাকে ফোন দিয়ে সাহায্য চাইব। এইদিকে মামা ছটফট করেই চলেছে। আমি ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট ঘাটছি যদি কাউকে সাহায্যে জন্য পাওয়া যায়। ঠিক এমন সময় ফোনের স্ক্রিনে সাদ নামটা ভেসে উঠে। সাথে সাথে মনে হলো আঁধারে কিঞ্চিৎ আলোর আভা দেখা দিচ্ছে। আমি কিছু না ভেবে ওকে ফোন দেই। দুইবার রিং হতেই সাদ ফোন তুলে। ও কিছু বলার আগেই আমি তৎক্ষনাৎ কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠি,

— আমার তোমার হ্যাল্পের প্রয়োজন। প্লিজ হ্যাল্প মি। প্লিজ!
#আরশি
#Part_21
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

কেবিনের সামনে থাকা চেয়ারে বসে আছি। ভিতরেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে মামা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। কপালে নেই কোন চিন্তার ছাপ। আমি ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে আছি শূন্যে। মন আমার বিষন্নতায় ঘেরা। একটু আগেই ডাক্তাররা মামাকে চেকাপ করে গিয়েছেন। তাদের ধারণা মামা বোধ হয় মাইনর স্টোক করেছেন। কিন্তু তাও তারা সিউরলি কিছু বলতে পারছেন না। ‘সিটিস্ক্যান’ আর ‘এম আর আই’ করার পর বুঝা যাবে আসলেই তাদের ধারণা ঠিক কি না। একটু পর হয়তো নার্সরা এসে মামাকে পরীক্ষা করার জন্য নিয়ে যাবে। আমার অভিভাবক বলতে এখন মামাই আছেন। তার কিছু হলে আমি সইতে পারবো না। মাত্রই তো নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিলাম আর এখনই এমন এক ধাক্কা খেতে হবে বলে আশা করি নি। হঠাৎ নয়ন দুইটির বাঁধ ভেঙ্গে যায়। গাল বেয়ে চুয়ে পড়তে থাকে তপ্ত পানির দল। এমন সময় কাধে কারো স্পর্শ অনুভব করি। আমি মুখ তুলে উপরে তাকাই। দেখি সাদ। ওর কোলে অহনা। সাদ কাধ থেকে হাত সরিয়ে আমার পাশে এসে বসে। অহনাকে তার পাশের চেয়ারে বসায়। তারপর আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

— তুমি এইভাবে ভেঙে পড়লে কিভাবে হবে? বি স্ট্রোং। মামার কিছু হবে না।

আমি কিছু না বলে নিচে দিকে তাকাই৷ বা পা দিয়ে মেঝেতে ঘর্ষণ চালাতে থাকি। গলার স্বর ভারী হয়ে আসছে। কথাগুলো দলা পাকিয়ে আসছে। কোন কথাই যে বের হচ্ছে না। কিভাবে বুঝাই মামা আমার জন্য কি? মামার অবদান আমার জীবনে ঠিক কি রকম? মাথা ভার লাগছে। এমন সময় একজন নার্স এসে বলে,

— এক্সকিউজ মি ম্যাম!

আমি চকিতে তাকাই সেই নার্সটির দিকে। নার্সটি হালকা গলা ঝেড়ে বলে,

— ম্যাম আপনি দুইশ চার নাম্বার রুমের পেশেন্টের সাথে এসেছেন?

আমি মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। শুধু মাথা দোলালাম। যার অর্থ হ্যাঁ। নার্সটি তা বুঝতে পেরে বলে,

— তাহলে এই ফর্মটা ফিলাপ করে দিন আর কাউন্টারে এই পরিমাণ ক্যাশ জমা করে দিন। ক্যাশ জমা দেওয়ার পরই পেশেন্টকে এক্সামিন করা হবে।

কথাটা শুনে টনক নাড়ে, “আমি তো কোন টাকা আনি নি। আর পরীক্ষা করতে যত টাকা চাচ্ছে তা আমার কাছে হবেও না। মামা থেকে যে নিব তারও উপায় নেই। কেন না মামার ব্যাংক একাউন্টের নাম্বার বা তার বিকাশের পিন কোড আমি কিছুই জানি না। এখন পে করবো কিভাবে? এ কেমন বিপাকে পড়লাম আমি?”
হঠাৎ নার্সের ডাক কর্ণপাত হতেই আমি চকিতে তাকাই।

— ম্যাম ফর্মটা।

আমি কিছু না বলে ফর্মটা হাতে নেই। নার্স চলে যায়। আমি কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রই। বুঝে উঠতে পারি না আমার কি করা উচিৎ। টাকা কিভাবে মেনেজ করবো আমি? ভাইয়াকে একবার ফোন দিয়ে দেখবো? ভাবনাটা মস্তিষ্কের মাঝে আসতেই আমি দ্রুত হাতে থাকা মুঠোফোনটি তুলে ধরি। ভাইয়ার নাম্বারে ডায়াল করি। তখন মোবাইলের ওইপাশ থেকে জানান দেয় ভাইয়ার ফোনটি অফ। আমি এইবার বিচলিত হয়ে পড়ি। কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। এমন সময় সাদের কন্ঠে কানের কাছে ভেসে আসে।

— নিশ্চয়ই বাসা থেকে কোন ক্যাশ আনো নি। এক কাপড়েই তো বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছ। তা এইটাকা গুলা নাও। এই টাকায় হওয়ার কথা। আর যদি না হয় আমার ক্রেডিট কার্ডটা নাও।

এই বলে সাদ কিছু ক্যাশ আর ওর ক্রেডিট কার্ডটা এগিয়ে দেয়। আমি সাদের কথা শুনে চমকে যাই। বিস্ময়কর চোখে তাকাই ওর দিকে। মুহূর্তেই এক রাশ অস্বস্তি এসে ঝেঁকে ধরে আমায়। দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করি। বুঝে উঠতে পারি না আমার কি করা উচিৎ৷ টাকাটা নিব কি না? একে তো ওকে সকাল সকাল ওকে এমন এক ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দিলাম। তার উপর এখন আবার টাকা নেওয়ার বিষয়টা। এইটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? কি ভাববে ও আমার ব্যাপারে? সাদ হয়তো আমার অস্বস্তি ধরতে পেরে বলে,

— আমি বুঝতে পারছি তোমার পরিস্থিতি৷ বাট বি প্র‍েক্টিক্যাল। এখন তোমার টাকা জমা দেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টাকা জমা না দেওয়া আগ পর্যন্ত তারা কোন কার্যক্রমই শুরু করবে না। আপাতত মামাকে সুস্থ করে তোলাই মূল উদ্দেশ্য। তাই এত না ভেবে টাকাগুলো নাও। আই ইন্সিস্ট!

আমি এইবার সাদের দিকে কৃতজ্ঞ নয়নে তাকাই। অতঃপর অস্ফুটস্বরে বলি,

— পরে আমি টাকাগুলো দিয়ে দিব।

সাদ কিছু না বলে মিষ্টি হাসি দিয়ে মাথা দোলায়। এর মধ্যেই সাদ আবার বলে উঠে,

— অফিসে ফোন দিয়ে আমি তোমার আর আমার ছুটি নিয়ে নিয়েছি। যতটুকু বুঝেছি তুমি একাই। তার উপর তোমার মেয়েও আছে। একা তুমি সবদিক সামলাতে পারবে না বলে আমি এইখানে থাকছি। আশা করি তোমার কোন সমস্যা হবে না।

— না হবে না।

— গুড! তা আমি অহনাকে নিয়ে সামনের পার্কে যাচ্ছি। হসপিটালের পরিবেশ ওর জন্য ভালো নয়। মাথায় প্রেশার পরতে পারে। তো একটু না হয় ঘুরে আসুক। আর শুনো ফোনটা সাথে রেখ। দরকার হলে আমাকে ফোন দিও।

আমি মাথা দোলায় আর ওর দিকে কৃতজ্ঞচোখে তাকিয়ে রই। আর আনমনে ভাবি, ও যদি তখন আমার এক বাক্যে সাহায্যের জন্য এগিয়ে না আসতো না আর মামাকে হসপিটালে নিয়ে না আসতো তাহলে আমি যে কিভাবে কি করতাম তা আমার জানা নেই। ভেবেই বুক চিরে বেড়িয়ে আসলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

________________________

হসপিটালের সামনেই অবস্থিত এক পার্কে সাদ আর অহনা বসে আছে। অহনার হাতে হাওয়াই মিঠাই। কিন্তু তা সে খাচ্ছে না। বরং হাতে নিয়ে বসে আছে। সাদ বিষয়টা লক্ষ্য করে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

— কি হয়েছে অহুপরী? কোন সমস্যা?

অহনা সাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ না। সাদ তা দেখে জিজ্ঞেস করে,

— তাহলে খাচ্ছ না কেন?

— আম্মিকে ছাড়া আমি কিভাবে খাই?

সাদ অহনার কথা শুনে হেসে দেয়। তারপর অহনার গাল টেনে বলে,

— তুমি বুঝি আম্মিকে সব জিনিস দিয়ে খাও?

— হুম!

— আচ্ছা আপাতত তুমি এইটা খাও। যাওয়ার সময় আমরা তোমার আম্মির জন্যও এইটা নিয়ে যাব নে কেমন?

— আচ্ছা।

এই বলে অহনা হাওয়াই মিঠাই এর প্যাকেট খুলার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। অহনা এইবার সাদ এর দিকে কাদো কাদো হয়ে তাকিয়ে বলে,

— চকলেট আঙ্কেল! খুলে না।

কথাটা বলেই অহনা ঠোঁট উল্টিয়ে নেয়। সাদ অহনার এমন রিয়েকশন দেখে কিঞ্চিৎ হাসে। তারপর হাওয়াই মিঠাইটা নিয়ে প্যাকেটটা খুলে অহনার দিকে এগিয়ে দেয়৷ স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

— তা তোমার মনে আছে আমি তোমার চকলেট আঙ্কেল?

— মনে থাকবে না কেন? আমি কি ভুলাক্কার নাকি? আমি সহজে কোন কিছু ভুলি না।

— তাই বুঝি?

অহনা গর্বের সাথে বলে,

— হুম! তা তুমি কি আম্মিকে চিনো?

— হ্যাঁ চিনি! আগে তোমার আম্মি আমার সাথেই পড়ালেখা করতো। আর এখন আমি যেখানে চাকরি করি সেখানে তোমার আম্মিও চাকরি করে।

হাওয়াই মিঠাই মুখে পুড়তে পুড়তে অহনা বলে,

— অহ আচ্ছা।

সাদ আর কিছু না বলে অপলক দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকিয়ে রয়। অহনার বা পাশটায় হাওয়াই মিঠাই লেগে আছে। যা দেখে সাদ আনমনে হেসে ফেলে কিন্তু পরক্ষণেই চোখ দুইটি ছলছল করে উঠে। চোখের সামনে কিছু স্মৃতি ভেসে উঠে। যা মুহূর্তেই দীর্ঘ নিঃশ্বাসে পরিনত হয়। সে আলতো হাতে অহনার গাল স্পর্শ করে সেই হাওয়াই মিঠাইটা সরিয়ে দেয়। অহনা সাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

— চকলেট আঙ্কেল তুমি কি কাঁদছো? তোমার কি কোথাও কষ্ট হচ্ছে?

কথাটা শুনার সাথে সাথে সাদ চমকে উঠে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

— আরেহ না! আমি কাঁদছি না। চোখে কি জানি গিয়েছে। তাই পানি এসেছে শুধু।

কথা বলে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ কচলাতে থাকে। অহনা রুমাল দেখে বলে,

— অহহ! তোমার সেই রুমাল তো আমার কাছেই রয়ে গিয়েছ।

সাদ অহনার গাল টেনে বলে,

— থাকুক ওটা তোমার কাছে। আমার লাগবে না।

— আচ্ছা।

______________________

— এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

— মানে?

— একদম না জানার ভান করবে না। এই রাত ৮ টা বাজে কোথা থেকে আসছো তুমি? তুমি জানো না এই অবস্থায় বেশি চলা ফেরা করতে নেই। বেবির উপর ইফেক্ট পড়বে।

কথাটা শুনে জুঁই নিজের মুখ চোখ কালো করে বলে,

— বলেছিলামই তো তোমায় আমি শপিংয়ে যাচ্ছি।

— শপিং করতে বুঝি এত সময় লাগে? বেড়িয়েছিলে দুপুর ২ টায় আর আসছ এখন।

— তুমি কি আমায় সন্দেহ করছ?

জুঁইয়ের কথা শুনে ফাহাদ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায়। অস্ফুটস্বরে বলে,

— আর ইউ লোস্ট ইউর মাইন্ড? সন্দেহের কথা আসছে কোথ থেকে। আমি জাস্ট সিম্পল একটা প্রশ্ন করছি যে, “কোথায় ছিলে তুমি?” তুমি সেটার উত্তর না দিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছো। এখন তো সন্দেহ করতেই হচ্ছে।

জুঁই নাক মুখ কুঁচকে বলে,

— বললাম তো শপিংয়ে গিয়েছিলাম।

— তা এত সময় লাগার কারণ?

— তুমি কিন্তু আমায় জেরা করছো। আমি তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।

— তুমি আমার ওয়াইফ। তোমার সম্পর্কে জানার আমার পূর্ণ অধিকার আছে। তাই তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য।

— না নই। এইটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার। আর আমি এতে যা ইচ্ছা কর‍তে পারি। আর আমি আরশি নই যে তুমি যা ইচ্ছা তা জিজ্ঞেস করবে আর আমি তার ঢ্যাং ঢ্যাং করে তার সকল উত্তর দিয়ে দিব। আই হ্যাভ মাই ওউন পার্সোনাল স্পেস।

ফাহাদ এইবার রেগে গিয়ে বলে,

— আরশিকে মাঝে আনছো কেন?

জুঁই মুখ ব্যঙ্গ করে বলে,

— কেন গায়ে লাগলো বুঝি? এক্সের জন্য কি দরস উতলিয়ে পড়ছে?

ফাহাদ এইবার হুংকার দিয়ে বলে,

— জাস্ট শার্ট আপ! কোথাকার কথা কোথায় নিচ্ছ তুমি? এইটা তুমি ভালো করেই জানো, আরশির প্রতি যদি আমার মনে বিন্দু মাত্র মায়া বা অনুভূতি থাকতো তাহলে আমি কখনোই ওকে ছেড়ে তোমায় দ্বিতীয় বারের মত আপন করতাম না।

— খোটা দিচ্ছ?

— যদি তাই মনে হয় তাহলে ঠিক তাই।

বলেই ফাহাদ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এইদিকে জুঁই চেঁচাতে থাকে,

— ভুল হয়েছে আমার যে আমি তোমার কাছে এসেছিলাম। না এসে গলায় ফাঁস দিয়ে মরলেই ভালো হতো।

জুঁই এর কথা ফাহাদ শুনলো না। এর আগেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। এইদিকে ফাহাদের কোন সারা না পেয়ে জুঁই বুঝতে পারলো যে ফাহাদ চলে গিয়েছে। জুঁই অতঃপর বিরবির করতে থাকে,

— ধুরর! বারাবারি করে ফেললাম। বিষয়টা এখন হাত থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা করতে হবে।

________________________

ডাক্তারের কেবিনে একটি চেয়ারে আমি ও আরেকটি চেয়ারে সাদ বসে আছে। ডাক্তার সাহেব গভীর মনোযোগ দিয়ে রিপোর্টগুলো দেখছেন। রিপোর্ট দেখা শেষে তিনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকান। গলাটা ঝেড়ে বলেন,

— যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। তিনি মাইনর স্টোক করেছেন। রিপোর্ট দেখে যা বুঝতে পারছি, বিগত দুইদিনে তার প্রেশার আর কলোস্ট্রোলের মাত্রা খুব বেশি ছিল সাথেই তিনি কোন কিছু নিয়ে হয়তো বা স্ট্রেস আউট ছিলেন। যার ফলে তার ব্রেনে প্রেশার ক্রিয়েট হয় আর তিনি স্টোক করে।

কথাটা শুনে আমি জিজ্ঞেস করে উঠি,

— তিনি এখন কেমন আছে?

— মাচ ব্যাটার। আপাতত অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। আজ রাতটা তাকে সেখানেই রাখা হবে।

আমি ইতস্তত সুরে বলি,

— ডিসচার্জ কবে দেওয়া হবে?

— এখনো বলতে পারছি না। তার কালকে সকালে জ্ঞান ফিরলে বাকিটা বুঝা যাবে। কিন্তু আপনাদের তার স্পেশাল কেয়ার নিতে হবে। যেহেতু এইটাই তার ফাস্ট স্টোক তাই তিনি হয়তো কিছুদিনের জন্য একদম নেতিয়ে পড়বেন। হয়তো রিকোভার করার জন্য দুই-এক মাস বেড রেস্টে থাকতে হবে। আর তার যেহেতু আগে থেকেই হাই প্রেশার আর হাই কলোস্ট্রোল এর সমস্যা আছে সেহেতু এইটা আগে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। আর মোস্ট অফ অল তাকে কোন ভাবেই টেনশন করতে দেওয়া যাবে না। এতে কিন্তু সেকেন্ড টাইম স্টোক করার চান্স আছে।

আমি নিচু স্বরেই বলি,

— জ্বি আচ্ছা ডাক্তার।

আরও কিছুক্ষণ ডাক্তারের সাথে কথা বলে আমি আর সাদ কেবিন থেকে বেরিয়ে আসি। সাদ আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— আল্লাহ এর উপর ভরসা রাখো তিনি সব ঠিক করে দিবেন।

— হুম।

— তা এখন কি করবে? হসপিটালে থাকবে?

— হসপিটালে থাকার মত জায়গায় নেই। বাসায় যেতে হবে। তা অহনা তোমার বাসায় না?

— হ্যাঁ! মায়ের কাছে রেখে এসেছিলাম।

আমি একবার সাদের দিকে তাকালাম। অতঃপর দুপুরের কথা ভাবলাম। হসপিটালের পরিবেশ অহনার জন্য ভালো না বিধায় সাদ ওকে নিজের বাসায় নিয়ে যায়। তার উপর এই দৌড়াদৌড়ির মাঝে যদি ও কোথাও হারিয়ে যায়। ওকে তো হসপিটালে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা সম্ভব নয়। কখন কি হয় বলা যায় না। তো যখন সাদ অহনাকে নিজের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলো আমিও আর বাঁধা দিলাম না৷ কথাগুলো ভেবেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। অতঃপর ছোট করে বলি,

— হুম!

— তা এখন তো রাত ১১ টার বেশি বাজে। বাসায় তো মনে হয় না কিছু রান্না করা হয়েছে। কি খাবে? তার উপর অহনাও তো আমার বাসায়। এখন?

— বাসায় গিয়ে কিছু বানিয়ে নিব নে। ব্যাপার না। আর অহনাকে যাওয়ার সময় নিয়ে যাব নে।

— আচ্ছা তাহলে চলো।

— হুম!

#চলবে

গল্প এখন থেকে একদিন পর পর দেওয়া হবে। আমার পরীক্ষা চলাকালীন এই নিয়মেই চলবে। ইনশাআল্লাহ পরীক্ষা শেষ হলে রেগুলার গল্পটা দিব।
#চলবে

গল্প উপস্থাপন করার স্বার্থে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা উল্লেখ করতে হয়েছে। দয়া করে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here